বই-ই শিল্প ফিনল্যান্ডে

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের শুরুতে সাহিত্যে নোবেল এনেছিল এই দেশ। আজও বইকে ঘিরে চাঙ্গা ফিনল্যান্ড। বিশ্ব জুড়ে রমরমা বাণিজ্যও। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের শুরুতে সাহিত্যে নোবেল এনেছিল এই দেশ। আজও বইকে ঘিরে চাঙ্গা ফিনল্যান্ড। বিশ্ব জুড়ে রমরমা বাণিজ্যও।

Advertisement
শেষ আপডেট: ০৯ সেপ্টেম্বর ২০১৮ ০০:০০
Share:

লেখক: ফ্রান্‌জ এমিল সিলানপা। ডান দিকে, সোফি ওকসানেন

ছোট্ট এক দেশ। পাহাড়, জঙ্গল, হ্রদে মোড়া। জনবসতি বড্ড কম, আরও কম তার শহুরে দিনযাপন। তিন দিকে ঘিরে থাকা সুইডেন, নরওয়ে, রাশিয়া আর বাল্টিক সাগরের জলপথ, এই সব মিলেমিশে গড়ে তুলেছে ফিনল্যান্ডের নিজস্ব সংস্কৃতি। নর্ডিক জীবনযাপনে দাগ কেটেছে স্ক্যান্ডিনেভিয়ার লালরঙা কাঠের বাড়ি কিংবা কফি-কার্ডামম বানের আড্ডা। রাশিয়া কিংবা বাল্টিক অঞ্চলের সংস্কৃতি বা রাজনীতির প্রভাবও কম নয়। ভাষা, সাহিত্য, শিল্প— ফিনল্যান্ড জুড়ে প্রভাব ফেলেছে বৈচিত্র। শতকের পর শতক পেরিয়ে এমন মিলমিশের সাক্ষী ফিনল্যান্ডের মানুষ।

Advertisement

নব্বইয়ের দশকের শেষে বিশ্বে সাড়া ফেলল নোকিয়া মোবাইল ফোন। সৌজন্য ফিনল্যান্ড। দাপটে রাজত্ব করা সেই ফোনের দৌলতে চড়চড়িয়ে বাড়তে লাগল দেশের আয়। বাণিজ্যের একটা বড় অংশ জুড়ে রইল তার রফতানি। কিন্তু ব্যবসায় যেমন হয়, ২০০৭-এ প্রতিদ্বন্দ্বী এক ব্র্যান্ডের ফোন দখল নিল বিশ্বের বাজারের। ছোট্ট দেশটার অর্থনীতি ধাক্কা খেল। রাজকোষে তো বটেই, চোট আত্মবিশ্বাসেও। নতুন কিছু চাই, যার হাত ধরে ফের ঘুরে দাঁড়াবে ফিনল্যান্ড।

মন্দার বাজার তখন গোটা বিশ্বেই। তারই মধ্যে খুঁজে নিতে হবে তাকে, যাকে ঘিরে ফের চাঙ্গা হয়ে উঠবে দেশের বাণিজ্য। গোটা দেশ মাথা ঘামাল, আর বুঝেও ফেলল, দরকার শুধু উপযুক্ত ব্র্যান্ডিং। তাতেই হবে কেল্লাফতে। কিন্তু কী হতে পারে সেই জিনিস? প্রযুক্তি? সংস্কৃতি?

Advertisement

এর মধ্যেই চমক। ২০০৮, ফিনিশ-এস্টোনিয়ান লেখিকা সোফি ওকসানেন-এর উপন্যাস ‘পার্জ’ সাড়া ফেলে দিল সাহিত্যের দুনিয়ায়। সোভিয়েতের দখলে থাকা এস্টোনিয়ার দুই নারীর সংগ্রামের সেই কাহিনি যে শুধু ফিনল্যান্ডেরই পুরস্কার জিতে নিল তা-ই নয়, বিদেশেও জয় করল অজস্র খেতাব। বেগুনিরঙা বিনুনি আর পরিপাটি সাজগোজে, একের পর এক সাহিত্য সম্মেলনে নিজের বইয়ের প্রচার নিজেই করা ওকসানেন স্বয়ং হয়ে উঠলেন একটা ‘ব্র্যান্ড’। ৩৮টি ভাষায় তাঁর বইয়ের অনুবাদ, এবং বিপুল বাণিজ্য চোখ খুলে দিল দেশের। শুধু ফ্রান্সেই বিক্রি হল এক লক্ষ সত্তর হাজার কপিরও বেশি!

সবাই বুঝল, পৃথিবীর পাঠকের মনের মতো হয়ে ওঠার যোগ্য হয়েছে ফিনল্যান্ডের সাহিত্য। পরবর্তী ওকসানেন-এরও খোঁজ শুরু করে দিয়েছে বিশ্বসাহিত্যজগৎ। বুঝেশুনে, সাজিয়েগুছিয়ে তুলে ধরা গেলে সাহিত্যই হয়ে উঠতে পারে বিশ্বের বাজারে ফিনল্যান্ডের তুরুপের তাস। নড়েচড়ে বসল বইপাড়া।

ছোট্ট দেশটার সাহিত্যের ইতিহাস অবশ্য পুরনো। দ্বাদশ শতকের মাঝামাঝি থেকে উনিশ শতকের শুরু অবধি ফিনল্যান্ড সুইডেনের শাসনে। সুইডিশই ছিল উচ্চবিত্ত ফিনিশদের ভাষা। তবে গ্রামগঞ্জে ছড়িয়ে থাকা লোককথা— যার বেশির ভাগটাই পৌরাণিক বীরগাথা— ছিল ফিনল্যান্ডের নিজস্ব। মালার মতো সেই ছড়া আর গান গেঁথেই অষ্টাদশ শতকের শেষ দিকে তৈরি হল ফিনল্যান্ডের মহাকাব্য ‘কালেভালা’।

উনিশ শতকে সুইডেন থেকে বেরিয়ে রাশিয়ার স্বশাসিত অংশ হল ছোট্ট দেশটা। সাহিত্যেও নিজস্বতা গড়ে তোলার ভাবনা জেগে উঠল তখনই। লেখার মাধ্যম যদিও সুইডিশ। জোহান লুডভিগ রুনবার্গ-এর লেখায় প্রথম জীবন্ত হয়ে উঠল ফিনল্যান্ডের প্রকৃতি আর জীবনযাপন। তার পর এলেন আরও ক’জন। উনিশ শতকের দ্বিতীয়ার্ধে আলেক্সিস কিভি-র লেখায় প্রাণ পেল ফিনল্যান্ডের সাহিত্য। কবিতা, গান, উপন্যাস, নাটক, বাড়তে লাগল সাহিত্যের পরিধি। পায়ে পায়ে ঢুকে পড়ল নরওয়ে-ফ্রান্সের প্রভাব— বাস্তবতা আর সমাজের আয়না হয়ে উঠল ফিনল্যান্ডের সাহিত্য। তাতে আধুনিক ধারা নিয়ে এলেন লেখিকা মিনা কান্থ ও অন্যেরা। স্ক্যান্ডিনেভিয়ান সাহিত্যের ধাঁচে এল বাস্তবের কথা, সমাজে মেয়েদের অবদমন আর শ্রমিক শ্রেণির দুর্দশার ছবি উঠে এল তাঁদের লেখায়। সমালোচিত হল চার্চের ভূমিকা।

উনিশ শতকের শেষ থেকেই সুইডিশ আর ফিনিশ ধারার ক্রমশ আলাদা হওয়া শুরু। বিশ শতকের শুরুতেই তাই দু’রকম ধাঁচে ভাগাভাগি হয়ে গেল ফিনল্যান্ডের সাহিত্যজগৎ। বছর গড়াল একের পর এক। দুই ধারার লেখকদের কলমে কবিতায়, গদ্যে, নাটকে, উপকথায়, গীতিকাব্যে এল আধুনিকতার নতুন স্বাদ। তাতে ঠাঁই পেল বাস্তব সমাজের কথা, ম্যাজিক রিয়েলিজ়ম, নর্ডিক ক্রাইম থ্রিলার, ব্লগ লেখনীর আঙ্গিক, নানা ধরনের নিরীক্ষামূলক বিষয়বস্তু। ইতিমধ্যে ফ্রান্‌স এমিল সিলানপা-র হাত ধরে ফিনল্যান্ডের মুকুটে এসে গিয়েছে নতুন পালক। প্রথম বার সাহিত্যে নোবেল— ১৯৩৯ সালে।

ফেরা যাক ২০০৮-এর গল্পে, ওকসানেনের তুমুল জনপ্রিয়তায় নড়েচড়ে বসা ফিনল্যান্ডে। নর্ডিক ক্রাইম থ্রিলারের চাহিদায় ভাটার টান চলছে বেশ ক’বছর হল। নতুন কোনও ধারাকে তুলে ধরার এই তো সময়! প্রাক্তন প্রকাশক এলিনা আলবাক-এর মাথায় এল আন্তর্জাতিক সাহিত্য এজেন্সি গড়ে তোলার প্ল্যান। সাহিত্যের প্রচারকে এত কাল বাঁকা চোখে দেখে আসা দেশটাকে তিনি বুঝিয়ে ছাড়লেন তার প্রয়োজনীয়তা। বললেন, সাহিত্যই হয়ে উঠতে পারে সবচেয়ে লাভজনক ব্যবসা। বইয়ের রফতানি আগামী দশ বছরে বাড়তে পারে দশ গুণ।

কাজটা সহজ ছিল না। এলিনা ও তাঁর দলের অক্লান্ত পরিশ্রমে গড়ে উঠল এজেন্সি। তাবড় আন্তর্জাতিক প্রকাশনা সংস্থাগুলোর দোরে দোরে ঘুরে প্রচার চলল। গোলাপি স্যুট আর গোলাপি বিজ়নেস কার্ডে এলিনা হয়ে উঠলেন বিশ্বের তাবড় বইমেলার চেনা মুখ।

২০০৯-এ শুরু কর্মযজ্ঞ, আর ফ্রাঙ্কফুর্টের বিশ্বখ্যাত বইমেলায় ডাক এল ২০১৪ সালের অতিথি দেশ হিসেবে। মাঝের পাঁচটা বছরে নিজেকে আমূল বদলে ফেলল ফিনল্যান্ডের বইপাড়া। বাণিজ্যিক চুক্তি, ফরেন রাইটস, অন্য রকম ভাবনার সাহিত্য এবং স্লোগান ‘ফিনল্যান্ড। কুল’। তাতেই বাজিমাত!

অতিথি দেশ হিসেবে ফিনল্যান্ডের নাম শুনে যাঁরা ভুরু কুঁচকেছিলেন, বইমেলার শেষে তাঁরাই মানতে বাধ্য হলেন— দেশটার দম আছে! পাঠকের মুখে মুখে ফিরতে লাগল ফিনিশ সাহিত্যের স্বাদ। জার্মানি, অ্যাংলো-আমেরিকান দেশগুলো, যারা ক’বছর আগেও ছিল ফিনল্যান্ডের বইপাড়ার ধরাছোঁয়ার বাইরে, সেখানেই হইহই ফেলল ফিনল্যান্ডের একের পর এক নতুন লেখকের গল্প-উপন্যাস। হালে ২০১৫ সালে পেঙ্গুইন ক্লাসিকস-এও ঢুকে পড়েছে ফিনিশ উপন্যাস ‘আননোন সোলজার্স’। ফিনল্যান্ডের তিন গুণ বেড়ে যাওয়া বই-রফতানির খাতায় জার্মানিকেও টেক্কা দিয়েছে অ্যাংলো-আমেরিকান দেশের চাহিদা। নর্ডিক এজেন্সি হিসেবে একমাত্র আলবাক-এর এজেন্সিরই এখন নিউ ইয়র্ক এবং লস অ্যাঞ্জেলেস, দু’জায়গাতেই অফিস।

কেন এত জনপ্রিয় হয়ে উঠল ফিনল্যান্ডের সাহিত্য? পাঠক এবং প্রকাশক, দু’দলই একবাক্যে বলছেন— এ দেশটার সাহিত্য এক্কেবারে আলাদা স্বাদের, অদ্ভুত। আর সেটাই তার ইউএসপি। সঙ্গে ঝরঝরে লেখনী আর ঝকঝকে, টানটান প্লট। জোহানা সিনিসালো-র ‘দ্য কোর অফ দ্য সান’-এ স্বাবলম্বী নারীদের বন্ধ্যাত্বকরণ আর পায়ের নীচে শক্ত জমি না-থাকা মেয়েদের যৌনতায় ঘিরে রাখার এক নয়া ধাঁচের অবদমনের গল্প, পাজ়তিম স্তাতোভসি-র ‘মাই ক্যাট যুগোস্লাভিয়া’য় একেবারে অন্য চোখে যুগোস্লাভিয়ার পতনের কাহিনি কিংবা লরা লিন্ডস্টেট-এর ‘ওনেইরন’-এ এক অন্য জগতে সাত নারীর আলাপচারিতার মতো বিষয় মন টেনেছে সারা বিশ্বের পাঠকদের।

ফিনল্যান্ডে সাক্ষরতার হার বরাবরই বেশি, বই পড়ার অভ্যাসও। তাই কলমও যে শক্তিশালী হবে, তাতে আর সন্দেহ কী! প্রকাশক, এজেন্সির ব্যাপক উদ্যোগের পাশাপাশি এখন মিলছে সরকারি সাহায্যও। আর তার জোরে ফিনল্যান্ডের সাহিত্যিকদের সেরা দশে থাকা জ্যানসন, ওকসানেন, লরা লিন্ডস্টেটরা তো বটেই, বছর আঠাশের স্তাতোভসি-র ঝুলিতেও ইতিমধ্যে দু’দুটো উপন্যাস! লিখছেন তৃতীয়টিও। কলম ধরছেন, খ্যাতি পাচ্ছেন আরও আরও নতুন মুখেরা।

লেখিকাদের আধিক্য এবং অদ্ভুত বিষয়বস্তু এখন ফিনল্যান্ডের সাহিত্য-বিপ্লবে দুই মূল অস্ত্র। বই-ই এখন নতুন ইন্ডাস্ট্রি, নিঃসন্দেহে!

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement