গোলাপজল, আবির নিয়ে রং খেলেছেন মোগল বাদশারা। বাংলার দোলে অন্য মাত্রা যোগ করেছেন নবদ্বীপে শ্রীচৈতন্য আর শান্তিনিকেতনে রবীন্দ্রনাথ।
Holi

HOLI: দোলের রঙে রঙিন ইতিহাস, পুরাণ, সংস্কৃতি

সিনেমা সাহিত্য সঙ্গীতেও জায়গা করে নিয়েছে হোরিখেলা। গত পরশু পালিত হল এ বারের দোলযাত্রা।

Advertisement

পৃথা কুণ্ডু

শেষ আপডেট: ২০ মার্চ ২০২২ ০৭:২৮
Share:

পাঠান সেনাপতি কেসর খাঁর আনন্দ আর ধরে না! রাজপুত রাজার সুন্দরী রানি তাঁকে শত্রুতা ভুলে হোলি খেলতে আসার আমন্ত্রণ জানিয়েছেন। যুদ্ধ, কেল্লা দখল, এ সবের পরিশ্রম ছাড়াই রূপসী রাজপুত মেয়েদের এত কাছে পাওয়ার সুযোগ কে ছাড়ে? সুর্মায়, আতরে, রঙিন পাগড়িতে সেজে তিনি এসে পৌঁছলেন কেতুনগড়ে। কিন্তু রানি এলেন সখীদের সাজের আড়ালে রাজপুত সৈন্যদল নিয়ে, আগের যুদ্ধে হেরে যাওয়ার বদলা নিলেন পাঠানদের সঙ্গে রক্তের হোলি খেলে। রবীন্দ্রনাথের ‘কথা ও কাহিনী’র কল্যাণে এ গল্প অনেকেরই জানা। এর পরিণতি যদিও প্রতিশোধের রঙে মর্মান্তিক, তবে পাঠান-রাজপুত আমলে রাজস্থানে হোরিখেলার উন্মাদনা কেমন ছিল, তার বর্ণনা জীবন্ত হয়ে উঠেছে এই কবিতায়। অবশ্য পাঠান-মোগল আমলে হোলির উৎসবে দুই সংস্কৃতির মিলনের কথাও নানা ভাবে লিখেছেন ইতিহাসের পণ্ডিতরা। বিশেষ করে মোগল আমলে বাদশা আর আমির-ওমরাহের দল রীতিমতো উৎসাহের সঙ্গেই এই উৎসব পালন করতেন। মানুচির ‘স্টোরিয়ো দ্য মোগর’ এবং আলেকজ়ান্ডার হ্যামিল্টন-এর ‘আ নিউ অ্যাকাউন্ট অব দ্য ইস্ট ইন্ডিজ়’-এর পাতায় ধরা আছে সেই বিবরণ। বাদশা হুমায়ুন দেশি হোলি উৎসবকে মিশিয়ে দিয়েছিলেন পারস্য দেশের ‘নওরোজ়’-এর সঙ্গে। পারস্যের পঞ্জিকা অনুসারে নতুন বছরের আরম্ভ বসন্তকালে। হিন্দুস্তানে হোলি উৎসবের একটু পরেই এর সূচনা। হুমায়ুন এই দুই উৎসব মিলিয়ে দিলেন উনিশ দিনের এক মহোৎসবে। আকবর আর জাহাঙ্গিরের আমলেও এই উৎসবের জৌলুস ছিল দেখার মতো। হোলিকে ঘিরে বসত নাচ-গানের আসর, আমন্ত্রিত হতেন দেশের নানা অঞ্চলের ওস্তাদরা। গোলাপজল, কমলালেবু, আবির আর শরাবের ছড়াছড়িতে মেতে উঠত দিল্লির দরবার, পথঘাট, মিনাবাজার— যেখানে ক্রেতা আর পসারিনী শুধু মেয়েরাই, আর একমাত্র পুরুষ হিসেবে বাদশার প্রবেশের অধিকার। কিন্তু তাঁকেও সওদা করতে হত বিস্তর দরদাম করে।

Advertisement

বৃন্দাবনের সংস্কৃতিতে হোলি মানেই রাধাকৃষ্ণের লীলা-অনুষঙ্গ, আর গৌড়ীয় বৈষ্ণব ধর্মের প্রভাবে সেই লীলারস ছড়িয়েছে বাংলাতেও। বিশেষ করে বাংলার দোলযাত্রায় এক অন্য মাত্রা যোগ করেছেন শ্রীচৈতন্য। আর আধুনিক যুগে বসন্ত উৎসবের সংস্কৃতি যে বিশেষ রূপ নিয়েছে, তার অনেকটাই রবীন্দ্রনাথ আর শান্তিনিকেতনের অবদান। কিন্তু এর বাইরে, আরও প্রাচীন কাল থেকেই ভারতে বসন্তের উৎসবকে কেন্দ্র করে লেখা হয়েছে নানা গাথা— সে সব কথা এখন অনেকটাই ঢাকা পড়ে আছে পুরাণ-পুঁথি আর প্রাচীন সাহিত্যের পাতায়। সংস্কৃত সাহিত্যে বসন্ত আর প্রেম প্রায় সমার্থক, বোধ হয় এই কারণেই সে কালে বসন্ত উৎসবের আর এক নাম ছিল মদন-মহোৎসব। কন্দর্প দেবতার মন্দিরে পুজো দিতে আসতেন উৎসব-সাজে সেজে যুবক-যুবতীর দল। মহাকবি কালিদাসেরও আগে, শূদ্রকের ‘মৃচ্ছকটিক’ নাটকে এই মদন-উৎসবেই চারুদত্তকে প্রথম বার দেখেছিলেন বসন্তসেনা। ‘মালবিকাগ্নিমিত্র’ নাটকে রানি ইরাবতী সুরাপানে মদির হয়ে উঠেছেন, রাজার সঙ্গে দোলায় আরোহণ করতে চাইলেন তিনি। অবশ্য বিদূষকের চক্রান্তে তা আর হয়ে উঠল না, রাজার জীবনে নতুন প্রেমের বার্তা নিয়ে এলেন মালবিকা। আবার শকুন্তলার বিরহে রাজা দুষ্যন্ত বসন্ত উৎসব বন্ধই করে দিয়েছেন রাজপুরীতে। হর্ষের ‘রত্নাবলী’ নাটকেও রাজা উদয়ন আর সাগরিকার দেখা হয় কামদেবের মন্দিরে, এই উৎসব-দিনেই। আরও বর্ণনা পাই, রমণীরা পিচকারি নিয়ে রঙিন জল ছুড়ছেন নাগরিক পুরুষদের উদ্দেশে, বাজছে মাদল। আবার লৌকিক সংস্কৃতির ‘বাড়াবাড়ি’ হিসেবে যে কাদা-মাখামাখি চলে, তার উল্লেখও রয়েছে কবি হাল-এর লেখায়। আর শ্রীকৃষ্ণের বসন্তরাস-এর বর্ণনা তো প্রবাদপ্রতিম হয়েছে কবি জয়দেবের ‘গীতগোবিন্দ’র সূত্রেই, যার উৎস ব্রহ্মবৈবর্তপুরাণ। শ্রীজীব গোস্বামীর ‘শ্রীগোপালচম্পূ’, কবি কর্ণপূরের ‘আনন্দবৃন্দাবনচম্পূ’ থেকে জ্ঞানদাস-উদ্ধবদাসের পদ, একাধিক বৈষ্ণব কবির রচনায় রাধাকৃষ্ণের বসন্তলীলার কথা উজ্জ্বল হয়ে রয়েছে রাগাত্মিকা ভক্তির রঙে।

দোল-উৎসবের আর এক জনপ্রিয় লৌকিক আচার চাঁচর পোড়া। বুড়ির ঘর পোড়া বা মেড়াপোড়ার (লৌকিক উচ্চারণে অনেক সময় ন্যাড়াপোড়া) সঙ্গে অনেকেই অশুভ শক্তির প্রতীক হিসেবে হোলিকা-দহনের অনুষঙ্গকে যুক্ত করেন। হরিভক্ত প্রহ্লাদকে কোলে বসিয়ে পুড়িয়ে মারতে গিয়ে হোলিকা নিজেই মারা যায়, প্রহ্লাদের কিছুই হয় না— বলা আছে ভাগবতে। অনেক পুরাণ-বিশেষজ্ঞ আবার তুলে এনেছেন শ্রীকৃষ্ণের মেষাসুর-বধের স্মৃতি। কিন্তু শ্রীকৃষ্ণ নিজে স্কন্দপুরাণে বলছেন অন্য কথা। যুধিষ্ঠির এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে তাঁর উত্তর, সত্যযুগে রঘু নামে এক ধার্মিক রাজা ছিলেন। তাঁর রাজ্যে ঢুণ্ঢা নামে এক রাক্ষসীর উপদ্রব শুরু হয়। পুরোহিত বলেন, ঢুণ্ঢা তপস্যা করে শিবের বর পেয়েছে। শুধু ঋতু পরিবর্তনের সময় উন্মাদ ব্যক্তি এবং অল্পবয়সি ছেলেদের হাতে এই রাক্ষসীর বিপদ হতে পারে। তাই উন্মাদনা, ঢাক-ঢোলের আওয়াজ-সহ একে পুড়িয়ে মারতে হবে। এখান থেকেই নাকি এসেছে চাঁচর-পোড়ার আচার। ঋতু উৎসবের নিরিখে ভাবলে, পুরনো খড়-লতাপাতা দিয়ে তৈরি ‘মেড়া’ বা মানুষের মূর্তি পোড়ানোর মাধ্যমে পুরাতন বছরকে বিদায় দেওয়া এবং নতুন বছরকে আবাহনের গুরুত্ব উঠে আসে। আবার অনেক নৃতাত্ত্বিকের মতে, এর মধ্যে আদিম যুগের কিছু কিছু উপজাতির কৃষি-সম্পর্কিত আচারের স্মৃতি জড়িয়ে আছে। অনার্য সংস্কৃতিতে দোল এক সময় ‘শূদ্র-উৎসব’ হিসেবে পরিচিত ছিল। কিন্তু এ এমনই এক মিলনের উৎসব, যার মধ্যে ইতিহাসের স্রোতেই এক সময় মুছে গেছে সাংস্কৃতিক বা সামাজিক ভেদাভেদ।

Advertisement

আধুনিক সাহিত্যেও দোলের রং লেগেছে নানাভাবে। তারাশঙ্করের ‘হাঁসুলী বাঁকের উপকথা’য় শুনি, ‘যে রঙ আমার ভেস্যে গেছে কোপাই নদীর জলে হে’— কাহারদের দোলের গান। ‘পদ্মানদীর মাঝি’তে কুবের দোল উৎসবের অজুহাতে ছেলেদের নিয়ে আসে শ্বশুরবাড়ি। একান্তে তাকে পেয়ে কপিলা বলে, “আমারে রং নি দিলা মাঝি?” কুবেরের উত্তর, “রং তো নাই। পাঁক দিমু কপিলা?” আবার ‘তিতাস একটি নদীর নাম’ উপন্যাসে দোলের অনুষঙ্গে ঘনিয়ে ওঠা পুনর্মিলন মোড় নেয় গভীর ট্র্যাজেডিতে। চলচ্চিত্রায়নে ঋত্বিক ঘটক অসামান্য শৈল্পিক রূপ দেন দোলের দৃশ্যটিকে। পাগল কিশোরের মুখে রং মাখিয়ে দেয় ‘রাজার ঝি’। মুহূর্তের জন্য পূর্বস্মৃতি ফিরে আসে তার, বৌকে কোলে তুলে নেয় সে। আবহে ভেসে আসে প্রায় অস্ফুট সুরে— ‘রাধাকৃষ্ণের মিলন হইল…’

গান ছাড়া তো দোলের উৎসব অসম্পূর্ণ। রবীন্দ্রনাথের ‘ওরে গৃহবাসী’, ‘নীল দিগন্তে’র পাশাপাশি নজরুলের ‘ব্রজগোপী খেলে হোরি’, ‘আজি মনে মনে লাগে হোরি’র মতো গান অবিস্মরণীয়। তরুণ মজুমদারের ‘বালিকা বধূ’ ছবিতে হোলির গানে লাগল কীর্তন অঙ্গের সঙ্গে আধুনিক কোরাস এফেক্ট-এর জাদু ‘লাগ লাগ লাগ রঙের ভেল্কি…’ সুর ও মূল কণ্ঠ হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের। ‘দাদার কীর্তি’-তে (১৯৮০) ‘সাত সুরোঁকি বাঁধ পায়েলিয়া’র তালে হোলির দৃশ্যটি তো ‘আইকনিক’। এখানে হেমন্তর সঙ্গে গেয়েছেন শক্তি ঠাকুর এবং অন্যান্য শিল্পী।

প্রবাসী বাঙালি আর অবাঙালিদের বাংলা-হিন্দি মেশানো গানের উচ্ছলতায় সব ভেদাভেদ মুছে দেওয়ার আহ্বান— ‘আজ না কোই ছোটা বা কি ঔর না কোই মহান/ এসো হে বন্ধু থেকো না দূরে গাও ফাগুয়ার গান।’ গানটি এক রকম হোলির গণসঙ্গীত হয়ে উঠেছে। আবার এই সমষ্টিগত উৎসবের পটভূমিতে, ছুটি পেয়ে ঘরে ফেরা বড় ছেলের সঙ্গে বড় বৌয়ের মিলনদৃশ্যের ব্যক্তিগত পরিসরটুকুও আঁকা হয়ে থাকে উজ্জ্বল রঙে।

‘মঞ্জরী অপেরা’ (১৯৭০) ছবিতে বসন্তরাগে সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায় গাইলেন ‘আজ হোলি খেলব শ্যাম তোমার সনে, একলা পেয়েছি তোমায় মধুবনে’। বৃন্দাবনের ফাগলীলাকে হাস্যকৌতুকে রসিয়ে সুরের ছোঁয়া লাগাল ‘বসন্ত বিলাপ’ (১৯৭৫), ‘ও শ্যাম যখন তখন খেলো না খেলা এমন, ধরলে আজ তোমায় ছাড়ব না’। সন্ধ্যা-আরতি মুখোপাধ্যায় মিলে নেপথ্যে গাইলেন, আর পর্দায় অপর্ণা সেন, সুমিত্রা মুখোপাধ্যায়ের দল রীতিমতো নাকাল করে ছাড়লেন সৌমিত্র-অনুপ-চিন্ময়দের। নায়ক নায়িকার নামেও রাধাকৃষ্ণের আভাস, শ্যামসুন্দর আর অনুরাধা।

১৯৮৭-তে ‘একান্ত আপন’ ছবিতে রাহুল দেব বর্মণের সুরে আশা ভোঁসলে-কবিতা কৃষ্ণমূর্তির গাওয়া ‘খেলব হোলি রং দেব না’ বাঙালির আর এক প্রিয় হোলির গান। বাঙালি অবশ্য ‘হোলি কে দিন দিল খিল যাতে হ্যায়’ আর ‘রং বরসে ভিগে’ও শুনেছে পরম উল্লাসে। হাল আমলের বাংলা গান ‘বসন্ত এসে গেছে’, ‘ফাগুনের মোহনায়’ বা ‘বাকিটা ব্যক্তিগত’ ছবির হোলির দৃশ্যও মনে রাখার মতো, তবে প্রবীণদের আক্ষেপ, তাঁদের ছোটবেলার দোলের আনন্দ যেন কোথায় মিলিয়ে গিয়েছে।

আসলে বসন্ত কখন যে আসে আর চলে যায়, ক্রমাগত যান্ত্রিকতা আর উত্তরোত্তর আধুনিকতায় জড়াতে থাকা আমরা বুঝতেই তো পারি না। ক্যালেন্ডারে ছুটির দুটো দিন আছে, তাই অনেকে ‘হোলি পার্টি’র আয়োজন করেন আর ফ্ল্যাটের ছোট্ট ছাদটুকুতেই রং মেখে ছবি তুলে আপলোড করে দেন। আরও অনেক বছর পরে হয়তো ‘বসন্ত’ কথাটার মানে খুঁজতে ই-ডিকশনারি হাতড়াবে উত্তরপ্রজন্ম। আর তখন, বসন্ত কেমন, তার আমেজ পাওয়ার আশায় হয়তো ইউটিউবের উন্নততর সংস্করণে ক্লান্ত আঙুল চালাতে চালাতে এক সময় শোনা যাবে— ‘প্রাঙ্গণে মোর শিরীষশাখায় ফাগুন মাসে/ কী উচ্ছ্বাসে...’

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement