হরপ্রসাদ শাস্ত্রী।
টোল-চতুষ্পাঠী প্রতিষ্ঠা ও অধ্যাপনায় বিপুল খ্যাতি ছিল নৈহাটির ভট্টাচার্য পরিবারের। মহারাজা কৃষ্ণচন্দ্রের আনুকূল্যে তাঁদের ব্রহ্মোত্তর জমি লাভ, টোল প্রতিষ্ঠা ও পাঠদান প্রায় পৌনে তিনশো বছর আগে বঙ্গদেশে বিদ্যাচর্চার এক উজ্জ্বল ইতিহাস। এই পরিবারের সন্তান রামকমল ন্যায়রত্ন উনিশ শতকের প্রথমার্ধে বাংলার অন্যতম নৈয়ায়িক হিসাবে পণ্ডিতসমাজে পরিচিত ছিলেন। তাঁর ষষ্ঠ সন্তান শরৎনাথ ছোট থেকেই রুগ্ণ। বাঁচার আশাই ছিল না। শিবের কাছে মানত করে, শিবের প্রসাদে ছেলে সুস্থ হয়ে উঠলে শরৎনাথের নাম বদলে রাখা হল হরপ্রসাদ।
মানুষ তাঁকে চেনে চর্যাপদের আবিষ্কর্তা হিসেবে। হরপ্রসাদ শাস্ত্রীর ৭৮ বছরের (৬ ডিসেম্বর ১৮৫৩-১৭ নভেম্বর ১৯৩১) জীবন এক বাঙালি বিদ্যাজীবীর অক্লান্ত লড়াইয়ের ইতিহাস। মাত্র আট বছর বয়সে হারালেন বাবাকে। বছর আঠারোর বড় দাদা নন্দকুমারের কাঁধে এসে পড়ল সংসারের ভার। তিনি তখন সংস্কৃত কলেজে সহকারী অধ্যাপক। ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের আনুকূল্যে পাইকপাড়ার রাজাদের কান্দি স্কুলে অপেক্ষাকৃত বেশি বেতনে হেড পণ্ডিতের পদে যোগ দিলেন নন্দকুমার। মা-ভাইদেরও কান্দিতে নিয়ে গেলেন তিনি। এক বছরের মাথায় ১৮৬২-তে আকস্মিক মৃত্যু নন্দকুমারের। গোটা পরিবারই তখন বিপর্যস্ত। ফিরে আসতে হল নৈহাটিতে। লেখাপড়া দূর অস্ত্, জীবনধারণই অনিশ্চিত হয়ে পড়ল।
বিদ্যাসাগর পরিবারটির পাশে দাঁড়ালেন। ১৮৬৬-তে বিদ্যাসাগরই বছর তেরোর হরপ্রসাদকে সংস্কৃত কলেজে সপ্তম শ্রেণিতে ভর্তি করে দিলেন। শুরু হল আর এক লড়াই। মাস কয়েক বিদ্যাসাগরের বাড়ির ছাত্রাবাসে থাকলেন। তার পর ছাত্র পড়িয়ে, নিজে রান্না করে খেয়ে কলেজ করতেন। মাত্র তেরো বছরের ছেলের পক্ষে এ কাজ সহজ ছিল না। তবু দু’বার ডবল প্রমোশন পেয়ে ১৮৭১-এ কৃতিত্বের সঙ্গে এন্ট্রান্স পাস করলেন। ১৮৭৭-এ সংস্কৃত কলেজ থেকে অনার্সে প্রথম হয়ে এমএ এবং শাস্ত্রী উপাধি লাভ করেন। উল্লেখ্য, সে কালে বিএ ক্লাসে সংস্কৃত কলেজের ছাত্ররা সংস্কৃত ছাড়া অন্য সব বিষয়ে পাঠ নিতেন প্রেসিডেন্সি কলেজে। হরপ্রসাদকেও বেশির ভাগ বিষয় পড়তে হয়েছে প্রেসিডেন্সি কলেজে। ফলে বিএ পরীক্ষার ফলাফলে তাঁকে প্রেসিডেন্সির গ্র্যাজুয়েট দেখানো হয়।
সংস্কৃত কলেজ ও প্রেসিডেন্সিতে দ্বারকানাথ বিদ্যাভূষণ, প্রসন্নকুমার সর্বাধিকারী, মহেশচন্দ্র ন্যায়রত্ন, রামনারায়ণ তর্করত্ন প্রমুখ গুণী অধ্যাপকের সান্নিধ্যে হরপ্রসাদের ভাবনাবৃত্ত নতুন আলোর পথ দেখল। আর ছিলেন অধ্যাপক শ্যামাচরণ গঙ্গোপাধ্যায় ও রাজকৃষ্ণ মুখোপাধ্যায়। হরপ্রসাদ নিজেকে শ্যামাচরণের চেলা বলে গর্ববোধ করতেন। শ্যামাচরণই তাঁকে সংস্কৃত-আচ্ছন্ন বাংলার বদলে চলতি খাঁটি বাংলায় লেখার প্রেরণা দিয়েছিলেন। তাঁর সুযোগ্য ছাত্র হরপ্রসাদ বলতেন, “যাহা চল্তি, যাহা সকলে বুঝে— তাহাই চালাও।…যাহা চল্তি নয় তাহাকে আনিও না।… তাহাকে বদলাইয়া শুদ্ধ সংস্কৃত করিবার দরকার নাই।”
‘বঙ্গদর্শন’ পত্রিকায় যখন হরপ্রসাদের প্রথম প্রবন্ধ ‘ভারত মহিলা’ প্রকাশিত হয়, তখন তাঁর বয়স মাত্র বাইশ বছর। বঙ্কিমচন্দ্র লেখাটির প্রশংসা করেছিলেন। বঙ্কিমচন্দ্রের প্রশংসায় পুলকিত হরপ্রসাদ এর পর লিখলেন ‘বাল্মীকির জয়’। সঞ্জীবচন্দ্র সম্পাদক থাকাকালীন তাঁর ‘কাঞ্চনমালা’ উপন্যাসটি প্রকাশিত হয় ‘বঙ্গদর্শন’-এ। ‘কাঞ্চনমালা’ বৌদ্ধ ধর্ম ও দর্শনের প্রেক্ষাপটে রচিত। অশোক-পুত্র কুণাল, তাঁর স্ত্রী কাঞ্চনমালা ও কুণালের প্রণয়-প্রার্থী বিমাতা তিষ্যরক্ষা এই উপন্যাসের প্রধান তিন চরিত্র। কাঞ্চনমালা আর তিষ্যরক্ষা, এই দুই নারীর আশ্চর্য অনুভব উপন্যাসটিকে দ্যুতিময় করে তুলেছে। তাঁর ব্যবহৃত ভাষা যুগের তুলনায় যথেষ্ট আধুনিক, মনেই হয় না এটি ১৪০ বছর আগের রচনা।
পরের উপন্যাস ‘বেণের মেয়ে’ও বৌদ্ধ-অনুষঙ্গ আচ্ছন্ন। লিখেছিলেন ‘মোহিনী’ নামে খণ্ডকাব্য আর দু’-একটি গল্প। তবে ‘বেণের মেয়ে’-র (১৯১৯) পর আর উপন্যাস রচনায় হাত দেননি। ইতিহাস, পুরাতত্ত্ব, প্রত্নতত্ত্ব, ভাষাবিজ্ঞান নিয়ে প্রাচ্যবিদ্যার ডুব দিয়েছেন।
সাহিত্যজগতে বঙ্কিমচন্দ্রের সস্নেহ সাহচর্য পেয়েছিলেন, আর এই পর্বে তাঁর সহায় হলেন রাজেন্দ্রলাল মিত্র। এশিয়াটিক সোসাইটির প্রথম ভারতীয় সভাপতি রাজেন্দ্রলালের মাধ্যমে সোসাইটির সঙ্গে তাঁর সংযোগ। তাঁর অভিভাবকত্বে পুরাতত্ত্ব ও বৌদ্ধচর্চায় হরপ্রসাদের গবেষক সত্তার বিকাশ। নেপালের বৌদ্ধ পুঁথির ক্যাটালগ তৈরির কাজে রাজেন্দ্রলালের সহকারী ছিলেন তিনি। আবার পুরাতত্ত্বের সীমানা ছাড়িয়ে বৃহত্তর ইতিহাস চর্চাতেও আগ্রহ বাড়ছিল হরপ্রসাদের। রাজেন্দ্রলাল মিত্রের অন্যতম প্রধান কাজ ‘দ্য স্যান্সক্রিট বুদ্ধিস্ট লিটারেচার অব নেপাল’-এ হরপ্রসাদের সহায়তার স্বীকৃতি আছে। রমেশচন্দ্র দত্তের ‘ঋগ্বেদ সংহিতা’-র টীকা ও বঙ্গানুবাদেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা ছিল হরপ্রসাদের। আবার রাখালদাস বন্দ্যোপাধ্যায়ের মতো একাধিক মেধাবী ছাত্রও তৈরি করেছিলেন। তিনি ছিলেন একাধারে সংস্কৃতজ্ঞ, পুরাতাত্ত্বিক, ইতিহাসবিদ, ভারতবিদ্যাবেত্তা। বাংলায় বৌদ্ধবিদ্যা চর্চায় তাঁর অবদান অবিস্মরণীয়। এ সবের প্রমাণ আছে তাঁর বিপুল রচনা সংগ্রহ আর সম্পাদিত অজস্র গ্রন্থে।
এমএ পাসের পর ১৮৭৮-এ হরপ্রসাদ হেয়ার স্কুলে হেড পণ্ডিত ও ট্রানস্লেশন মাস্টার পদে যোগদান করেন। ওই বছরই তাঁর বিয়ে হয় কাটোয়ার দেয়াসিন গ্রামের রায়বাহাদুরের মেয়ে হেমন্তকুমারীর সঙ্গে। ১৮৮৩-তে হলেন সংস্কৃত কলেজের অধ্যাপক। তখন থেকেই একের পর এক গুরুত্বপূর্ণ পদ ও কাজে ব্যস্ত থেকেছেন। হয়েছেন সংস্কৃত কলেজের অধ্যক্ষ। এশিয়াটিক সোসাইটি ও বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদের সঙ্গে বেড়েছে সংযোগ। পেয়েছেন মহামহোপাধ্যায়, বিলেতের সিআইই উপাধি। হয়েছেন ‘বুদ্ধিস্ট টেক্সট অ্যান্ড রিসার্চ সোসাইটি’-র সম্পাদক, পেয়েছেন ইংল্যান্ডের রয়্যাল এশিয়াটিক সোসাইটির অনারারি মেম্বার-সহ বহু গুরুত্বপূর্ণ পদ।
শত দায়িত্ব সত্ত্বেও গবেষকের মনটি কখনও হারাননি হরপ্রসাদ। পুরাতত্ত্ব ও প্রাচীন পুঁথির সন্ধানে পৌঁছে গেছেন দেশের বিভিন্ন প্রান্তে, বিদেশেও। তাঁর বিপুল কাজের তালিকা দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর হয়েছে। ১৮৯৭-এ সাহিত্য পরিষৎ-এর সঙ্গে তাঁর সংযোগ। ১৯১৩-তে পরিষৎ-এর সভাপতি হন। ১৮৯৭-এর মে মাসে পুঁথির সন্ধানে প্রথম বার নেপাল গেলেন। পেলেন সন্ধ্যাকর নন্দীর ‘রামচরিত’। তৃতীয় বার নেপালে গেলেন ১৯০৭ খ্রিস্টাব্দে। আবিষ্কার করলেন চর্যাপদের পুঁথি। কিন্তু ওটাই তাঁর জীবনের চূড়ান্ত কাজ নয়। ১৯২২-এ আবার নেপাল যাত্রা করে মৈথিলী ভাষার প্রাচীন পুঁথি ‘বর্ণরত্নাকর’, রামাই পণ্ডিতের ‘শূন্যপুরাণ’, মানিক গঙ্গোপাধ্যায়ের ‘ধর্মমঙ্গল’ খুঁজে এনে প্রকাশের কৃতিত্বও তাঁর। কাশীরাম দাসের মহাভারতের ‘আদিপর্ব্ব’ সম্পাদনা করেছেন। আবার রাজেন্দ্রলালের ‘নোটিসেস অব স্যানস্ক্রিট ম্যানুস্ক্রিপ্ট’-এর কাজও এগিয়ে নিয়ে গিয়েছেন।
সাহিত্য পরিষদে সভাপতি হিসেবে শেষ অভিভাষণে (১৩৩৭ বঙ্গাব্দ) বলেছিলেন, “১৩ বৎসর আমি এখানে সভাপতির কাজ করিয়াছি,… এই ১৩ বৎসরের মধ্যে আমি অনেকবার লাঞ্ছিত, অবমানিত এবং বিতাড়িতও হইয়াছি, এবং অনেকবার পূজিত, অভিনন্দিত এবং সংবর্ধিতও হইয়াছি…।”
‘তৈল’ প্রবন্ধে লিখেছিলেন— “বাস্তবিকই তৈল সর্ব্বশক্তিমান;… যে তৈল দিতে পারিবে, তাহার বিদ্যা না থাকিলেও সে প্রফেসার হইতে পারে। আহাম্মুক হইলেও ম্যাজিস্ট্রেট হইতে পারে, সাহস না থাকিলেও সেনাপতি হইতে পারে…।”
তাঁর প্রতি রবীন্দ্রনাথের শ্রদ্ধা নিবেদন যেন সকলের মনোভাবকেই তুললে ধরে—“ধ্বনি প্রবল করবার এক রকম যন্ত্র আজকাল বেরিয়েচে তাতে স্বাভাবিক গলার জোর না থাকলেও আওয়াজে সভা ভরিয়ে দেওয়া যায়। সেই রকম উপায়েই অল্প জানাকে তুমুল করে ঘোষণা করা এখন সহজ হয়েছে।…আজ এই দৈন্যের দিনে মহামহোপাধ্যায় শাস্ত্রী মশায় যে সঙ্গিবিরল সার্থকতার শিখরে আজও বিরাজ করচেন তারই অভিমুখে সসম্মানে আমি আমার প্রণাম নিবেদন করি।”