দে খলেই মনে হবে এক জন গ্রিক মাস্টার সামনে দাঁড়িয়ে। খুব লম্বা, উসকোখুসকো চুল, পাঞ্জাবির ওপর বোতাম-খোলা খাদির জ্যাকেট, কাঁধে একটা ঝোলা, আর জ্বলজ্বলে দুটো চোখ— যেন এই বার অলৌকিক কোনও আখ্যান শুরু হবে।
ঋত্বিকদার সঙ্গে আমার প্রথম দেখা বিমলদা মারফত। ঋত্বিকদার বড়দাদা আবার ছিলেন বিমলদার প্রোডাকশন হেড। এক দিন আমায় ডেকে বললেন, ‘শোনো, তুমি ওঁর কাছ থেকে গল্পটা শুনে লিখে নাও আর নোট্স নিয়ে নাও। পরে এটার ওপর একটা স্ক্রিপ্ট তৈরি করতে হবে।’ আমি আর ঋত্বিকদা বসে গেলাম। এর পর এই রকম বসা বহু বার হয়েছে, কিন্তু তা থেকে কোনও দিন কোনও সিনেমা তৈরি হয়নি। পরে জেনেছিলাম, কোনও বাঙালির প্রয়োজনে বিমলদা তাঁকে খালি হাতে ফেরান না। কিন্তু ঋত্বিকদাকে কোনও কাজ ছাড়া সাহায্য করাটা যে ঋত্বিকদার সম্মানে এবং মনে বড় লাগবে, সে কথা বিমলদার মাথায় থাকত। তাই দু’পক্ষের মন ও সম্মানের আশ্চর্য দেওয়া-নেওয়ার সাক্ষী হয়েছিলাম আমি।
এর পর অবশ্য মাইডিয়ার হিসেবে ঋত্বিকদাকে চিনতে আরম্ভ করি অভীদা, মানে অভিনেতা অভী ভট্টাচার্যের বাড়িতে। সেখানে রোজ সন্ধেবেলায় একটা জমাটি আড্ডা বসত। তখনকার বম্বে-বাঙালিদের দু’জায়গায় একদম নিশ্চিত করে পাওয়া যেত। এক, কাজের জায়গা— বিমল রায় প্রোডাকশন্স। কারণ, বিমলদা বড়লোক প্রোডিউসার ছিলেন। সবাইকে নাইয়ে-খাইয়ে রাখতেন। আমাকেও। আমি তো কনভার্টেড বাঙালি। আর দুই, অভীদার বাড়িতে, সেখানে সবাই আড্ডা দিতে যেত। অভীদার বাড়িতেই আমি প্রথম ‘জতুগৃহ’ পড়েছিলাম, বাংলায়।
সেই আড্ডায় রোজ আমরা একটা করে নতুন সিনেমা বানাতাম, কাস্ট ঠিক হত, বাজেট হত, স্ক্রিপ্ট কে করবে— সব ঠিক হত। পরের দিন যথারীতি ভেস্তে যেত। আবার একটা নতুন সিনেমা তৈরি হত। অন্য রকমের নতুন সিনেমা। যখনই মিউজিক ডিরেকশনের কথা উঠত, আমরা বলে উঠতাম, ‘ওই তো, সলিলদাই তো করবে, আবার কে?’ ঋত্বিকদা তাঁর প্রাণের বন্ধু সম্পর্কে বলে উঠতেন, ‘কী! সলিল মিউজিক দেবে? কোথায় মাল খেয়ে উলটে পড়ে থাকবে!’ আমরা সবাই মুখ চাওয়াচাওয়ি করতাম, মনে মনে বলতাম, ‘ঋত্বিকদা এই কমেন্ট করছে!’ আর তার পর একটা বিরাট হাসির রোল উঠত। আর সবাই মিলে তখন ঋত্বিকদার পেছনে লাগা হত।
ঋত্বিকদার ছবির সঙ্গে আমার আগেই পরিচয় হয়েছিল। আমি এখনও ‘মেঘে ঢাকা তারা’য় সুপ্রিয়ার চটি ছিঁড়ে যাওয়ার সিনটা ভুলতে পারি না, কিংবা যে বিশাল গাছটার নীচে দাঁড়িয়ে অনিলদা বন্দিশ গাইছিলেন, সেই দৃশ্যটা। ওই গাছটা চুজ করাই একটা মাস্টারের কাজ। ওই বিশালত্ব, ওই রাজকীয় ব্যাপারটা ওই সিনটাকে একেবারে অন্য মাত্রায় পৌঁছে দিয়েছে। ঋত্বিকদাকে যখন প্রথম দেখেছিলাম, ওই গাছটার মতো মনে হয়েছিল আমার। খুব আলুথালু রাজকীয়।
কিন্তু আমার মোহ ভাঙল ‘সুবর্ণরেখা’ দেখে। একটা-দুটো দৃশ্য এত মেলোড্রামাটিক যে আমার পছন্দ হয়নি। হয়তো ঋত্বিকদার অনেক কিছুই আমার পছন্দ ছিল না। পুনে ফিল্ম ইনস্টিটিউটের ডিন থাকাকালীন উনি যে ভাবে নিজেকে কনডাক্ট করেছিলেন, তা-ও আমার পছন্দ ছিল না। সেখানে ছাত্রদের সঙ্গে একটা ফারাক রাখার দরকার ছিল বলে আমার মনে হয়। এতটা বোহেমিয়ানিজ্ম ধারণ করার ক্ষমতা সবার থাকে না। শিষ্যরা যদি অন্ধের মতো ফলো করে, সেটা শিষ্যদের পক্ষে সব সময় শুভ হয় না, সেখানে একটা দায়িত্ব থাকা দরকার ছিল। কোথাও যেন ডিসিপ্লিনের ভারী অভাব ছিল। আর ওঁর যা দেওয়ার ক্ষমতা ছিল, নিজেকে একটু ঠিক ভাবে চালনা করলে শিল্প হয়তো আরও সমৃদ্ধ হতে পারত।
আবার ভেবেছি, ঋত্বিকদা যদি ডিসিপ্লিন্ড আর প্রথাগত ‘প্রপার’ হতেন, তা হলে ঋত্বিকদা হতেন না। অন্য মানুষ হতেন। তিনি ওই একটা রকম ভাবেই বাঁচতে পারতেন, শিল্প করতে পারতেন। ওটা তাঁর ঘরানা, তার যাপন। সেটা তাঁর সিনেমায় প্রতিফলিত। ঋত্বিকদার নিয়মছাড়া ভাব হয়তো কিছুটা জেনেটিকও। ওঁর আরও দুই ভাইকেও আমি খুব ভাল ভাবেই চিনতাম। তাঁদের মধ্যেও এই খামখেয়ালিপনা বা একসেনট্রিক ব্যাপারস্যাপার লক্ষ করেছি।
কিন্তু শিল্পের মানচিত্র তো হরেক রকম প্রতিভা দিয়ে তৈরি। কিছু মানুষ থাকবেনই, যাঁরা ছন্নছাড়া, উদ্দাম প্রতিভাধর, উল্কার মতো— স্বল্পকালীন। সেই সব মানুষকে তাঁদের মতো করেই গ্রহণ করতে শিখতে হবে।
অনেক বছর পর মুম্বইয়ের খার স্টেশনের কাছে ঋত্বিকদার সঙ্গে দেখা। সব সময়ই ওই স্টেশনের কাছে একটা লজে উঠতেন। সেই না-আঁচড়ানো উসকোখুসকো চুল, না-কামানো দাড়ি, খাদির জ্যাকেট, একই রকম রাজকীয়, কেবল চেহারা একটু ভেঙেছে, জৌলুস একটু কমেছে, এই যা। দেখা হতেই পায়ে হাত দিয়ে প্রণাম করলাম। গালে আলতো একটা থাপ্পড় মেরে বললেন, ‘তুই কী এমন করেছিস রে, যে এত নাম হয়েছে তোর!’ এ কথা বলাটা ওঁরই সাজে। সেই কবে থেকে আর কত কাছ থেকে দেখেছেন তো এই ছোকরাকে! কিন্তু অত বড় হাতের চেটো, তার থাপ্পড় যত আলতোই হোক, তা হজম করার কলজে থাকতে হবে। আমার তো মনে হয়, আমার সেই কলজে ছিল বইকী! আ স্মল টোকেন অব লাভ ফ্রম আ গ্রিক মাস্টার!