আলাউদ্দিনকে দেখলে অপুর কথা মনে পড়ে। তেমনই মায়াময় চোখ, গড়ন। ভীষণ লাজুক। নাম শুনে বললাম, ‘‘আলাউদ্দিন খিলজি?’’ এমন রসিকতা আগে কেউ হয়তো করে থাকবে। ডান গোড়ালিতে ভর রেখে চরকি পাক খেল। বিস্তর সাধাসাধির পর জানাল, খিলজি নয়, ও দপ্তরি। আলাউদ্দিন দপ্তরি।
আলাউদ্দিন যখন ক্লাস ওয়ানে, ওদের বাড়ি নদীতে তলিয়ে যায়। হাত তুলে দেখায়, ‘‘ওইখানে আমাদের বাড়ি ছিল।’’ তার আঙুলের নির্দেশ যে দিকে, সেখানে মুড়িগঙ্গার স্রোত বইছে। ঘোলা জলে, তাদের বাড়িঘর কেমন ছিল তা ঠাহর করা যায় না। সে এখন ক্লাস থ্রিতে পড়ে। রাস্তার পাশে টুকরো জমিতে তাদের বাড়ি।
কৃষ্ণার বাবা খুব গরিব। মেয়েদের পাত্রস্থ করার মতো আর্থিক সঙ্গতি ছিল না। একই পরিবারে দুই ভাইয়ের সঙ্গে দুই বোনের বিয়ে হয়। সামান্য জমি ছিল, তিনটি পান বরজও। সব নদীতে তলিয়ে গিয়েছে। নতুন করে ঘর তোলার মতো টাকা নেই। স্থানীয় এক প্রাইমারি স্কুলে ঠাঁই হয়েছে। স্কুলঘরটি অব্যবহৃত, তাই রক্ষে। সেও তো এক দিন ছাড়তে হবে। তখন কোথায় যাবেন, জানেন না।
কৃষ্ণা ও আলাউদ্দিনের বাড়ি ঘোড়ামারায়। নদী পেরিয়ে সাগরদ্বীপে যাওয়ার সময় ডান দিকে পড়ে ঘোড়ামারা দ্বীপ। এক সময় সাগরদ্বীপেরই অংশ ছিল। স্থানীয় প্রবীণেরা জানান, সাগরদ্বীপ আর ঘোড়ামারার মধ্যে ছিল একটা ‘নাসা’। লোকে সাঁতরে সেই নাসা পেরিয়ে যেত। নাসা বেড়ে এখন প্রায় চার কিলোমিটার চওড়া নদী।
ক্ষয়ে যাচ্ছে দু’টি দ্বীপই। তবে ঘোড়ামারা ভাঙছে দ্রুত। প্রত্যেক বার কোটালে বাঁধ ভেঙে জল ঢোকে। প্রতি বারই কেউ ভিটেমাটি হারায়। নদী খেয়ে নেয় ফলবতী গাছ, বরজ।
ভাঙন এমনই যে, এ বছর চাষ হল তো পরের বছর হয়তো সেই জমিতেই ঢেউ খেলছে। হাসিনা বেগমের বাড়ির উঠোনে এক সময় তিনটে ধানগাদা বসত। এখন সম্বল কয়েক ছটাক জমি। সেও হারিয়ে যাওয়ার মুখে। তার পরে কোথায় যাবেন, সেই প্রশ্নের উত্তর দীর্ঘশ্বাস। ভাঙনের ভয় দ্বীপবাসীর মনে এমনই সেঁধিয়ে গিয়েছে যে, দু’টো মানুষ একত্র হলে সেখানেও ভাঙনের কথা। জমিহারা, উদ্বাস্তু, পুনর্বাসন— দ্বীপে খুব পরিচিত শব্দ।
কেন ঘোড়ামারা দ্রুত ভাঙছে? নদীর স্রোত এখন দ্বীপের গা ঘেঁষে বইছে। প্রচণ্ড স্রোতে ভূপৃষ্ঠের যে অংশটি বালির, সেটি দ্রুত ক্ষয়ে যাচ্ছে। ফলে উপরে নদীর পাড় ঝুলছে শূন্যে। মাত্রাতিরিক্ত ভারী হয়ে পড়লে পাড় ঝুপ করে ধসে পড়ে। তারই সঙ্গে হারিয়ে যাচ্ছে সর্বস্ব। দ্বীপের প্রৌঢ় বাসিন্দা বাদল মণ্ডল জানালেন, আগে দ্বীপ ছিল প্রায় আঠারো হাজার বিঘা জুড়ে। এখন মেরেকেটে পাঁচ হাজারে দাঁড়িয়েছে।
ভূ-বিজ্ঞানীদের মত, ভাঙনের জন্য সমুদ্রের জলস্তর বৃদ্ধিকে দায়ী। বাকি পৃথিবীর তুলনায় এখানে জলস্তর বৃদ্ধির পরিমাণ বেশি। শুধু ঘোড়ামারা নয়, সুন্দরবনের বাকি দ্বীপগুলির দশাও সঙ্গিন।
দ্বীপে একটিই উচ্চ বিদ্যালয়। সেটি মাধ্যমিক পর্যন্ত। মাধ্যমিকের পর কী হবে সেই আতঙ্কে যেমন পড়ুয়ারা। উচ্চশিক্ষার পাঠ নিতে গেলে মূল ভূখণ্ডে এসে ঘর ভাড়া নিয়ে থাকতে হয়। হস্টেল আছে এমন স্কুলে ভর্তি হতে হয়। কিন্তু ছেলেমেয়েকে বাইরে রেখে পড়ানোর ক্ষমতা অনেকেরই নেই। বেশির ভাগ বাবা-মা কিশোরী মেয়েকে চোখের আড়াল করতে ভয় পান। ফলে খুব কম মেয়েই উচ্চশিক্ষার সুযোগ পায়।
‘‘ঢেউয়ের মাথায় বসে আছি। আমাদের ছেলেমেয়েদের কথা আর কে ভাবে,’’ আক্ষেপ কাজল গিরি, শশধর শিটের। বলছেন, ‘‘স্কুলটা উচ্চ মাধ্যমিক হলে আরও কিছু ছেলেমেয়ে পড়ার সুযোগ পেত।’’
পাঁচ হাজার মানুষের জন্য বরাদ্দ একটি স্বাস্থ্যকেন্দ্র। হঠাৎ কেউ অসুস্থ হয়ে পড়লে ছুটতে হয় কাকদ্বীপ। সময়মতো খেয়া পাওয়া গেলে রক্ষে। নইলে নৌকা ভাড়া করতে হয়। সবার সে সঙ্গতি নেই। ‘‘তখন প্রিয়জনকে তিলে তিলে মৃত্যুর দিকে ঠেলে দেওয়া ছাড়া কিছু করার থাকে না,’’ বলছেন জয়ন্তী মণ্ডল।
সকলেই কমবেশি জানেন, দ্বীপ আর বেশি দিন নেই। ‘‘কিন্তু কেউ কি চায় ভিটেমাটি ছেড়ে যেতে?’’ প্রশ্ন নকুল প্রধান, রঞ্জিত জানা, শক্তিপদ গিরি, লালু জানা, বিশ্বজিৎ জানাদের। সকলেই চান, দ্বীপকে রক্ষা করা হোক। দ্বীপের রাজনীতিতে তুরুপের তাস তাই নদীর ভাঙন।
পান খেয়ে দাঁতগুলো মোরাম রাস্তার মতো লাল বিষ্ণুপদ রাউতের। তাঁর কথায়, ‘‘পদ্মফুলের মতো ভেসে থাকা দ্বীপ টুপ করে এক দিন ডুবে যাবে।’’ তবে তিনি চান দ্বীপ ডুবে যাক। তাতে নিজেও তো ডুববেন! তা হলে এমন আকাঙ্ক্ষা কেন! জবাব আসে, নিজে ডুবলে ডুববেন, সঙ্গে রাজনৈতিক নেতাদেরকেও নিয়ে ডুববেন! তাঁর খেদ, দুয়ারে ভোট, তাই নেতারা ‘বাবু বাবু’ করছেন। ভোট পেরোলে যার বাড়ি, সে-ই বাঁচাবে। তাঁর ক্ষোভ, ‘‘ওই তো কাকদ্বীপ। সেখানে মন্ত্রীর বাস। এক বারও এসেছেন?’’নৌকার যাত্রীরা চুপ। হয়তো এটি তাঁদেরও মনের কথা।
দ্বীপমুখী নৌকা থেকে নদীর বুকে ঘোড়ামারাকে একটা মোটা কালো রেখার মতো লাগে। হয়তো কুড়ি বছর পরে সেই রেখাটি আর থাকবে না। পড়ুয়ারা বইয়ে পড়বে, সমুদ্রের জলস্তর বেড়ে যাওয়ায় ঘোড়ামারা ডুবে গিয়েছে। একই সময়ে মূল ভূখণ্ডে বসে কোনও এক বৃদ্ধ স্মৃতি রোমন্থন করে চলেছেন, এক সময় তাঁর ভিটেমাটি ছিল, একটা পানের বরজ। ছিল দু’বেলা দু’মুঠো অন্নের বন্দোবস্ত। মনের ঘরে তখন পাক খেয়ে উঠছে হাহাকার।