একটি খবরের চ্যানেলে ইন্টারভিউতে ডেকেছিল সিরিয়ালের তিনজনকে। পরিচালক অজয় ভাট, নায়ক রাজর্ষি দেব এবং চিত্রনাট্যকার বিনোদ মিত্রকে। সিরিয়ালটা হইচই ফেলে দেবে তা কে জানত? যত এগোচ্ছে, ততই পাবলিকের চাহিদা বাড়ছে।
‘‘গল্প আরও টানতে হবে। পাবলিক যখন খাচ্ছে, ভাবনার কিছু নেই,’’ অজয়বাবু বলল।
‘‘কিন্তু মৃত নায়িকাকে কী ভাবে ফিরিয়ে আনব দাদা?’’ আপত্তি তুলেছিল বিনোদ।
‘‘মানুষ অলৌকিক ব্যাপারগুলো পছন্দ করে। ওই সব রসদ জোগাও।’’
‘‘কিন্তু নায়কের দুটো বৌ!’’
‘‘নিকুচি করেছে দুটো বৌয়ের। তুমি বৌগুলোরও দুটো করে স্বামী বা প্রেম দেখাও। দর্শক কেচ্ছা পছন্দ করে।’’
‘‘না দাদা, আমার দ্বারা হবে না।’’
‘‘বিনোদ, ইডিয়োলজি ধুয়ে জল খাবে? পাঁচটা পূজাবার্ষিকীতে লিখে পঞ্চাশ থেকে পঁচাত্তর হাজার। সারা বছরে গোটা কুড়ি গল্প। এতে সংসার চলবে? না পারলে আমাকে অন্য পথ দেখতে হবে। ওই যে নতুন মেয়েটা। কী যেন নাম? মনে পড়েছে,অরুন্ধতী। ওকেই তা হলে বলব চিত্রনাট্য লেখার জন্য।’’
‘‘দাদা, আমি আসলে ...’’
‘‘ইয়ংম্যান, এটা মেগা সিরিয়াল। শেষটা ভেবে লিখতে বোসো না। টেনে বাড়াও ইলাস্টিকের মতো। মানুষের সেনসিটিভ দিকগুলো নিয়ে খেলা করো। তোমার লেখার হাতটা ভাল। তাই গল্পটা নিয়েছিলাম। আর হ্যাঁ, তোমার চেকটা রেডি হয়ে আছে। কাল নিয়ে যেও। বাই।’’
বিনোদ মধ্যবিত্ত ঘরের ছেলে। বাংলা সাহিত্যে এমএ। কয়েকটা টিউশন পড়ায় আর পত্রপত্রিকায় লেখালেখি নিয়ে থাকে। দু-একটা গল্প-উপন্যাস বড় কাগজে বেরনোর পরে একটু নামডাক হয়েছে। বছর পাঁচেক হল সে ভালবেসে বিয়ে করেছে হিয়াকে। তাদের ছেলের বয়স দুই। কিন্তু ছেলের হার্টে জটিল অসুখ ধরা পড়েছে। ডাক্তার বলেছে অপারেশন করতে হবে। বিনোদ কী করবে বুঝতে পারছে না। শেষে পরিচালককে ধরে প্রযোজকের কাছ থেকে আগাম দেড় লাখ টাকা পেয়েছে। বাকিটা হিয়া ওর বাবার কাছ থেকে নিয়েছে। এই দ্বিতীয় ব্যাপারটা তার আত্মসম্মানে আঘাত করেছে। কিন্তু কিছু করার নেই। চেকটা আনতে গিয়েই অজয়দার কাছে জানল ইন্টারভিউয়ের ব্যাপারটা, ‘‘পরশু সকালটা ফাঁকা রেখো।’’
‘‘কেন দাদা?’’
‘‘আমাদের সিরিয়াল একশো এপিসোড পূর্ণ করল। সে খেয়াল আছে? ‘আধুনিক সময়’ চ্যানেল থেকে ইন্টারভিউ নেবে। আমি, তুমি আর রাজর্ষি বাইট দেব। সকাল এগারোটায় সময় দিয়েছে।’’
‘‘আমাকে এ বারের মতো ছেড়ে দিন। ছেলেটাকে ডাক্তার দেখাব, অপারেশনের ডেট...’’
‘‘স্যরি, কিছু মনে কোরো না। মধ্যবিত্ত সেন্টিমেন্ট থেকে বেরিয়ে আসতে না পারলে এই পেশায় আসা অনুচিত। তা ছাড়া দু’ঘণ্টার ব্যাপার তো।’’
বিনোদ বরাবর অন্তর্মুখী। চ্যানেলে গিয়ে বকবক করা তার পছন্দ নয়। সে যদি পাতার পর পাতা গল্প লিখে যেতে পারত, রোজগারের কোনও চিন্তা থাকত না, তা হলে বেশ হত। সে লেখাকিন্তু সেই নিশ্চিন্ত জীবন তাকে কে দেবে? বাধ্য হয়ে জীবনের প্রতিটি মোড়ে কোনও না কোনও বিষয়ের সঙ্গে তাকে সমঝোতা করতে হয়। ভালবেসে বিয়ে করেছিল বলে পরিবারের সঙ্গে সম্পর্ক নষ্ট হয়েছে। বিয়ের পর থেকে ভাড়াবাড়িতে। দিনকাল যা পড়েছে, একটা ভদ্র গোছের কাজ জোটানো অসম্ভব। হিয়া নিঃসন্দেহে ভাল মেয়ে। বিনোদের ইচ্ছা-অনিচ্ছাকে সম্মান করে। লেখায় প্রেরণা জোগায়। চ্যানেলের কথাটা বলতেই হিয়া আনন্দে লাফিয়ে বলল, ‘‘কিছুতেই ‘না’ বলতে পারবে না। কবে দেখাবে টিভিতে? আচ্ছা, আমাকে অ্যালাউ করবে?’’
‘‘বাবুর শরীর খারাপ, এই অবস্থায়?’’
‘‘তার ব্যবস্থা হয়ে যাবে।’’
‘‘কিন্তু...’’
‘‘কোনও কিন্তু নয়, তুমি যাবে। সুযোগ বার বার আসবে না।’’
‘‘হিয়া! এটা তুমি কী বলছ?’’
‘‘ঠিকই বলেছি। আগুপিছু না ভেবে এক দিন তোমার সঙ্গে এক কাপড়ে চলে এসেছিলাম। আজ আমার এই সামান্য ইচ্ছেটুকুর মূল্য তুমি দেবে না?’’ হিয়া কাপড়ের খুঁটে চোখ মোছে। বিনোদ আতান্তরে পড়ে যায়। মনস্থির করে ফেলে, ইন্টারভিউ দেবে।
চ্যানেলের সুন্দরী সঞ্চালক অজয়দা আর রাজর্ষির বাইট নিতে ব্যস্ত। বিনোদ মাঝখানে বসে নোটবুকে আঁকিবুকি কাটছে। অবশেষে সঞ্চালক তাকে জিজ্ঞেস করল, ‘‘ধারাবাহিকে একটা মৃত চরিত্রকে ফিরিয়ে আনলেন কেন?’’
প্রশ্ন শুনে থতমত খেয়ে গেল সে। কী উত্তর দেবে? পরিচালকের নির্দেশ, না কি পাবলিকের চাহিদা? সে বলল, ‘‘সিরিয়ালের চরিত্রগুলো আমাদের হাতের পুতুল। যেমন করে নাচাই, তেমন করে ওরা নাচে।’’
অজয়দার গাড়িতে ফেরার সময় একটাও কথা বলেনি বিনোদ। অজয়দা ওকে নামিয়ে দিল তার বাড়ির সামনের মোড়ে। ক্লান্ত ধ্বস্ত মনে বাড়ি ফিরে বিনোদ গেল ছেলের কাছে। ছেলে তখনও ঘুমোচ্ছে। রান্নাঘর থেকে ছুটে এল হিয়া, ‘‘কেমন হল তোমার ইন্টারভিউ? কবে দেখাবে?’’
‘‘জানি না, একটু জল দাও।’’
‘‘তোমার একটা চিঠি এসেছে রানাঘাট থেকে। এই নাও।’’
বিনোদ চিঠিটা খুলে দেখল, রানাঘাটের ‘দেশকালের ছায়া’ লিটল ম্যাগাজ়িনের সম্পাদক আমন্ত্রণপত্র পাঠিয়েছে কাগজের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে। একটা গল্প ওরা চেয়ে নিয়েছিল। হিয়াকে খুলে বলল সে কথা।
‘‘ওরা কি টাকাপয়সা দেবে?’’
‘‘লিটল ম্যাগাজ়িনের সম্পাদকের কাছে টাকাপয়সা চাওয়া যায় না। কষ্ট করে কাগজটা করে ওরা।’’
‘‘তুমি কি তা হলে সেখানে যাবে?’’
‘‘এই অনুষ্ঠান দেরি আছে। তার আগেই বাবুর অপারেশন হয়ে যাবে। তা ছাড়া, তুমি তো জানো আমার মাসির বাড়ি রানাঘাটে। ’’
‘‘তুমি যাও, আমি যাব না।’’
‘‘দেখ, মা বেঁচে থাকলে তোমাকে ঠিক মেনে নিতেন। বাবা এখন দাদাদের হাতের মুঠোয়। মাসির কাছে গেলে শান্তি পাই, ঠিক বলে বোঝাতে পারব না তোমায়,’’ বিনোদের গলা ধরে আসে।
ছেলের অপারেশন সাকসেসফুল। কিছুদিন প্রবল ধকল গেল বিনোদের। শ্বশুরবাড়ির লোকেরাও যথেষ্ট করেছে ছেলের জন্য। রোজ রাতে সিরিয়ালের জন্য খাতা-পেন নিয়ে বসতে হয়েছে তাকে। কিন্তু এই ফরমায়েসি লেখা তার ভাল লাগে না। কোনও ব্যক্তিস্বাধীনতা নেই, এরা শুধু পয়সা আর লাইমলাইট চেনে। বিনোদ চায় নিজের মতো লিখতে। গল্প উপন্যাস। যে সৃষ্টি প্রকাশ পাবে বাংলার সেরা প্রকাশনাগুলি থেকে। কিন্তু চেকটা দেওয়ার সময় অজয়দা তাকে দিয়ে স্ট্যাম্প পেপারে লিখিয়ে নিয়েছে। বিনোদের টিকিটা ওদের কাছে বাঁধা।
রানাঘাটে নেমেই সে ছুটল মাসির বাড়ি। মাসি আদর-যত্নের কোনও ত্রুটি নেই।
‘‘তুই না কি মস্ত লেখক?’’ মাসি বলল।
‘‘ওই আর কী, সামান্য লিখি।’’
‘‘বড় বৌমা বলল, ‘ঘরের লক্ষ্মী’ সিরিয়ালটা না কি তোর লেখা, সত্যি বিনু?’’
‘‘ওটা দেখ মাসি?’’
‘‘বৌমারা সন্ধেবেলায় টিভি খুলে বসে, আমিও দেখি।’’
‘‘তোমার ভাল লাগে মাসি?’’
‘‘একদম না।’’
হোচট খায় বিনোদ। জিজ্ঞেস করে, ‘‘কেন বলো তো?’’
‘‘সবার দু-দুটো বৌ, বৌদের আবার বাইরের সম্পর্ক! এ সব কী লিখছিস বিনু?’’
বড় বৌ বলে, ‘‘মার কথায় কান দেবেন না ঠাকুরপো, মা ব্যাকডেটেড। আমাদের কিন্তু বেশ লাগছে। আপনি লিখে যান।’’
পত্রিকার অনুষ্ঠানে ওদের আন্তরিকতায় মন ভরে যায় বিনোদের। সম্পাদকের সঙ্গে শুভেচ্ছা বিনিময়ের পরে বাইরে বেরিয়ে সিগারেট ধরাল সে। ঠিক সেই সময় নারীকণ্ঠের ডাক শুনে পিছন ফিরে তাকাল।
‘‘শুনছেন?’’
‘‘আমাকে ডাকছেন?’’ বিনোদ বলল। তার পর মেয়েটির দিকে তাকাল সে। লাবণ্যময় মুখশ্রী। বয়স আটাশ-তিরিশ।
‘‘আপনি আসবেন শুনে ছুটে এসেছি। তবে আমি কিন্তু অটোগ্রাফ-শিকারি নই। সাধারণ গৃহবধূ। শুধু একটা প্রশ্ন করতে চাই আপনাকে, কেন এমন সিরিয়াল লেখেন? আমার ঘরটা ভেঙে দিলেন আপনি!’’
‘‘তার মানে?’’
‘‘আমার স্বামী ‘ঘরের লক্ষ্মী’ সিরিয়ালটা দেখেন। সিরিয়ালে দাম্পত্য-সম্পর্কগুলো বড় এলোমেলো। শুধু পরকীয়া আর পরকীয়া। মাসখানের আগে জানলাম, ও একটা বিয়ে করেছেন গোপনে। এখন সেই বৌয়ের কাছেই থাকছেন।’’
হোঁচট খেল বিনোদ। বলল, ‘‘কিন্তু এর সঙ্গে সিরিয়ালের কি সম্পর্ক? আপনি আইনের সাহায্য নিচ্ছেন না কেন?’’ ‘‘আপনি জানেন না, সাধারণ মানুষ কতটা সিরিয়ালের গল্পের দ্বারা প্রভাবিত হয়। আর আমার বাবা খুব গরিব। আমাদের সামর্থ্য নেই কেস চালানোর।’’
মেয়েটিকে সান্ত্বনা দিয়ে কোনও রকমে সেখান থেকে স্টেশনে এসে ফেরার ট্রেন ধরল। কিন্তু সারা রাস্তা সে ভাবতে থাকল ওই অসহায় মেয়েটির কথা। বাড়ি ফিরে সে দেখল, গেটে তালা। পাশের বাড়ির কাকিমা জানাল, হিয়া তার কাছে চাবি রেখে গিয়েছে। বিনোদের মাথা গরম হয়ে গেল। সঙ্গে সঙ্গে ফোন করল হিয়াকে। হিয়া বলল, ‘‘ভীষণ ব্যস্ত ছিলাম গো। তোমাকে ফোন করতে পারিনি। রাগ কোরো না প্লিজ়। চাবিটা পাশের বাড়ি। তোমার রাতের খাবার ঢেকে রেখে এসেছি।’’
‘‘কিসের ব্যস্ততা? বাবু কোথায়?’’ ‘‘বাবুকে রেখে এসেছি মায়ের কাছে। আমার সঙ্গে বৌদি এসেছে।’’
‘‘তুমি কোথায়, সেটা বলবে তো!’’
হিয়া নীরব। বিনোদ আবার প্রশ্ন করে। ‘‘তুমি রাগ করো না। শুটিংয়ে এসেছি।’’
‘‘শুটিং!’’
‘‘তুমি যাওয়ার পরে তোমাদের ওই অজয়দা এসেছিলেন তোমার খোঁজ করতে। তার পরে বললেন, জমিদারবাড়িতে দুর্গাপুজোর একটা দৃশ্য আছে, আজই শুট। সন্ধের মধ্যে হয়ে যাবে। কয়েক জন মহিলা দরকার। প্রথমটায় রাজি হইনি। কিন্তু টিভিতে আমাকে দেখাবে...টাকাও দেবে ওরা! অজয়দা বলল, এটার পরে আরও...’’ বিনোদের মাথা ঝাঁ-ঝাঁ করতে থাকে। ফোনটা কেটে দেয়।
দু’দিন পরের ঘটনা। রবিবার সকাল। আইসিইউ থেকে বার করে বিনোদকে বেডে দেওয়া হয়েছে। সে এখন সুস্থ। বালিশে হেলান দিয়ে আধশোয়া। সামনে টুলে বসে আছে হিয়া। শূন্য দৃষ্টি মেলে সিলিংয়ের দিকে চেয়ে থেকে বিনোদ বলে ‘‘বাবু কোথায়?’’
‘‘বাড়িতে মায়ের কাছে,’’ ফুঁপিয়ে উঠে হিয়া, ‘‘তোমাকে না জানিয়ে আর কিছু করব না, কথা দিচ্ছি,’’ বিনোদের হাতে হাত
রাখে হিয়া।
সে দিন ফোনে হিয়ার সঙ্গে কথা হওয়ার পরে মনে মনে ভেঙে পড়েছিল বিনোদ। যে সিরিয়ালের জগত থেকে সে বেরিয়ে আসতে চাইছে, সেই জগতে পা রাখল হিয়া। সে জানে ভবিষ্যতেও এই গ্ল্যামার ও টাকার মোহকে হিয়া এড়াতে পারবে না। বাবুর জীবনটা শেষ হয়ে যাবে। সাতপাঁচ ভাবতে ভাবতে বিনোদ ছুট দেয় রাস্তার দিকে। হিয়াকে ফিরিয়ে আনতে হবে। আর তখনই উল্টোদিক থেকে একটা গাড়ি এসে ধাক্কা মারে তাকে। পাশের বাড়ির কাকিমার চেঁচামেচিতে ছুটে আসে
পাড়া-প্রতিবেশী।
পাশের বেডে এক বয়স্ক ভদ্রলোক কাগজ পড়ছিলেন। বিনোদ হিয়াকে জিজ্ঞেস করে, ‘‘আজ কী রবিবার?’’
‘‘হ্যাঁ, কেন?’’
‘‘রবিবারের গল্পের পাতাটা একটু চেয়ে আনো না।’’
হিয়া ভদ্রলোকের কাছে কাগজটা চাইতেই তিনি মৃদু হেসে বললেন, ‘‘আমি এখন পড়ছি, মা। পড়া হলে দেব।’’
‘‘আজ কার গল্প বেরিয়েছে?’’
‘‘বিনোদ মিত্র। ছেলেটার কলমের জোর আছে বেশ। পড়ো তোমরা।’’
চমকে উঠে বিনোদ আর হিয়া এ ওর দিকে তাকায়। বিনোদের মুখ থেকে কথা সরে না। গল্পটা কয়েক মাস আগে গল্পটা পত্রিকার দফতরে পাঠিয়েছিল সে। চোখদুটো জলে চকচক করে উঠল তার। হিয়ার হাতদুটো সজোরে আঁকড়ে ধরল বিনোদ।