জিপটা বাঁক নেওয়ার মুখেই পাথরের টুকরোটা ধাঁই করে জানলার কাচটায় লাগল। ফাট-ধরা শার্সির আড়ালে গাড়ির মালিক আয়দিনের ভ্যাবাচ্যাকা খাওয়া মুখ। আয়দিন শুধু ওই গাড়িটার মালিক নন, এই ছোট্ট পাহাড়ি গ্রামটারও দণ্ডমুণ্ডের কর্তা। তাঁর গাড়িতে কিনা ঢিল! কার এত সাহস? ড্রাইভার হিদায়েত একটু পরেই মুজরিমটিকে কলার পাকড়ে হাজির করল। ভিজে চুপচুপে জামাকাপড় আর ইস্কুলের ব্যাগ কাঁধে পুচকে ছোঁড়াটার নাম ইলিয়াস। ওর বাপ ইসমাইল আয়দিনেরই ভাড়াটে। ক’মাসের ভাড়া বাকি পড়েছে বলে ওর বাড়িতে পুলিশ পাঠিয়ে পুরনো ফ্রিজটা, সাদাকালো সেকেন্ডহ্যান্ড টিভিটা তুলে আনা হয়েছিল। ইসমাইল আটকাতে গিয়েছিল বলে পুলিশের লোক ছেলেটার সামনেই তাকে ঠেঙিয়েছিল। সেই রাগেই নাকি বাচ্চাটা... কী কাণ্ড!
কার কত ভাড়া বাকি, কাকে ঠেঙাতে হবে, কাকে মামলায় ফাঁসাতে হবে, এগুলো হিদায়েতই দেখেটেখে। আয়দিন ব্যস্ত থাকেন শিল্প নিয়ে। তিনি প্রাক্তন অভিনেতা। তা ছাড়া স্থানীয় খবরের কাগজে কলাম লেখেন। তুরস্কের থিয়েটারের একশো বছরের ইতিহাস নিয়ে একটা বই লেখার কথাও ভাবছেন। পাহাড়ের চুড়োয় পৈতৃক বাড়িতে তিনি যে হোটেল খুলেছেন, তার নামও ‘ওথেলো’। ঘরে তাঁর দেসদিমোনাটিও আছেন— তাঁর চেয়ে বয়সে অনেক ছোট, সুন্দরী বউ নিহাল। আয়দিন নিহালকে ঠিক সন্দেহ করেন না, আবার পুরো বিশ্বাসও করতে পারেন না। পাথরের দেওয়ালের আড়াল থেকে, আবছা-ভেজা জানলার কাচের ভেতর দিয়ে তিনি নিহালের গোপনীয়তায় উঁকি মারেন।
আয়দিনের পাহাড়-প্রাসাদে আর এক নারী-চরিত্র তাঁর সদ্য-ডিভোর্সি বোন নেকলা। তিতকুটে মন আর খরখরে জিভ নিয়ে সে দাদার অফিসঘরের কৌচেই সারা দিনটা ঘুমিয়ে আর বই পড়ে কাটায়। এবং এক বার মুখ খোলালেই কথার ছোবলে উলটো দিকের লোকটাকে অস্থির করে দেয়। ঘনিয়ে আসা শীত, আচরাচর বরফ, তিনটে টুকরো দ্বীপের মতোই তিন জন বিচ্ছিন্ন অভিজাত মানুষ। আর তাদের ঘিরে আরও কিছু খুচরো, প্রান্তিক মানুষের জীবন। কাহিনির ছায়ায় কোথাও আন্তন চেখভ তাঁর ‘দ্য ওয়াইফ’ গল্পের টেক্সট-টা নিয়ে আছেন। তবে, এখানে তিন ঘণ্টা সতেরো মিনিটের বিশাল ক্যানভাসে পরিচালক অনেক যত্নে, ধৈর্যে, একটু একটু করে চরিত্রগুলোর একটা-একটা পরত খুলেছেন। কান ফেস্টিভ্যালে সেরার পুরস্কার পাওয়া সিনেমাটিতে সংলাপ প্রায় দৃশ্যের মতো হয়ে উঠেছে।
আয়দিনরা ভাইবোন অফিসঘরের মধ্যে টানা দশ-বারো মিনিট ধরে কথা বলছেন— কথাগুলো ক্রমশ কথা কাটাকাটি হয়ে উঠছে— সমাজ-সাহিত্য নিয়ে আঁতেল-আলাপ হুল-ফোটানো ব্যক্তিগত আক্রমণ হয়ে যাচ্ছে— তার পর একটা সময় দুজনেই চুপ করে যাচ্ছেন! কিংবা আয়দিন-নিহালের তীব্র-বিষাক্ত ঝগড়ার পর গোটা ছবিতে প্রথম বার নিহালের মনের হিম-বরফ ভেঙে আবেগের অবুঝ-অঝোর কান্না আসে। আয়দিনের সম্ভ্রান্ত, উদার, নিরাসক্তির বর্ম ফাঁক করে উঁকি দেয় যৌন-ঈর্ষায় ছটফটানো এক চিরকেলে গেঁয়ো পুরুষ।
অভিজাতদের এই সম্পর্ক-বিলাসের পালটা-মুখ হিসেবেই যেন মাতাল-রগচটা ইসমাইল আর তার পরিবার। নিহালের দেওয়া দয়ার দান ইসমাইল যখন ফায়ারপ্লেসে ছুড়ে দেয়, আর বড়লোকের বিবেক-দংশনের মুখে আগুন দিয়ে টাকার বান্ডিলটা দাউদাউ পুড়তে থাকে, তখন নিহালের চোখেমুখে বিস্ময়ের চেয়েও বেশি থাকে শ্রেণি-ঘেন্নার আতংক! এর পরেও গল্পটা আয়দিন-নিহালের দাম্পত্যেই ফেরে।
নিহালকে লেখা তাঁর ক্ষমা-প্রার্থনার চিঠিতে ‘তোমায় ছাড়া বাঁচব না’-গোছের আবেগ মাখামাখি। চিঠি-টিঠি লিখে বিবেক-টিবেক সাফসুতরো করে তিনি তাঁর বইয়ের কাজটা নিয়ে বসেন। নিহাল কিন্তু তাঁর ঘরে তখনও একাই! চরাচর তখনও বরফে ভরে আছে। শীতঘুমে গোটা গ্রাম। বসন্ত কি কখনও আসবে সে দেশে?
sanajkol@gmail.com