তুষারশুভ্র হিমালয় আমাদের উত্তরাপথের অতন্দ্র প্রহরী, তবু গ্রীষ্মপ্রাধান্যের ‘স্টিগমা’ আমাদের সংস্কৃতি থেকে ঘুচল না কোনও দিন। সেই কবেই এক ইতিহাসবিদ লিখেছিলেন, আড়াই হাজার বছর আগে বিশ্ববিজয়ী আলেকজ়ান্ডারকে বিপাশার তীর থেকে দেশে ফেরত পাঠিয়েছিলেন পরাক্রান্ত ভারতীয় সেনাপতি ‘জেনারেল হট ওয়েদার’। সেই যে দাবদাহের ব্র্যান্ডিং দেগে গেল আমাদের গায়ে, আর ওঠার নামগন্ধ নেই। স্বয়ং রবীন্দ্রনাথও দৃশ্যতই এই চাপেই কাটিয়ে দিলেন সারা জীবন, নয় তো গ্রীষ্ম আর বর্ষা নিয়ে অমন অতুলনীয় উচ্ছ্বাসের পরেই চাইনিজ চেকার্সের দানের মতো কেউ হেমন্তের পূর্ণশশীর মধ্যে বসন্তের বাণী শুনতে পায়? প্রশ্ন করতে ইচ্ছে করে, শীতটা গেল কোথায় গুরুদেব, শুধু ‘পৌষ তোদের ডাক দিয়েছে’, বা ‘শীতের হাওয়ায় লাগল নাচন’, গুটিকয়েক লাইনে সেরে দিলেই হবে? জীবনানন্দেরও দেখি একই দশা, কার্তিকের কুয়াশা, নবান্ন ইত্যাদি নিয়ে যত শব্দ খরচ করেছেন, তার তুলনায় শীত নিতান্ত দুয়োরানি, এক বিনম্র নিমপেঁচার মতোই তার জড়সড়, কুণ্ঠিত উঁকি, এক-আধবার মাত্র। তা হলে, বিশেষ করে বসন্ত যখন সত্যিই আমাদের দোরগোড়ায় জাগ্রত, শীতের জন্য কেন এখনও আমাদের এই চাতকসুলভ প্রার্থনা?
শীত বাঙালির প্রতি বেশ সদয়ই বলতে হবে। পশ্চিম গোলার্ধের বেশির ভাগ জায়গাতেই যেমন সাত-আট মাস তার দৌরাত্ম্যে ছেড়ে দে মা কেঁদে বাঁচি বলতে বলতে নাভিশ্বাস ওঠার জোগাড়, আমাদের সে রকম নয়। মেরেকেটে এক মাস একটু ‘চিলচিলে’ ভাব, তার পরেই পাখা চালু। তাও আমাদের ছোটবেলায় যেটুকু শীত পড়ত, এখন তার ধারেকাছেও নয়, ‘কুয়াশা যখন’ টাইপ নামের টিভি সিরিয়াল শীত নামক এই ফেক নিউজ়ের সিজ়নে চলে কী করে, ঠিক বুঝি না, সম্ভবত ‘যখন’ শব্দটা আমার মতো সাতবুড়োদের দূরায়ত শীতস্মৃতি খুঁচিয়ে তোলার জন্য।
তবু এখন দেখি আমাদের এই এলেবেলে শীতকেও আবাহন করার জন্য অনেক বাদ্যিবাজনা। প্রত্যেক বছরই কয়েক সপ্তাহ ধরে প্রায় রোজই কাগজে পড়ি বিস্তর জল্পনা— শীতের আগমনে কেন এত বিলম্ব, হিমালয় থেকে কনকনে উত্তরের হাওয়ার যাত্রাপথে কত বাধা, তাই তার আসতে আরও দেরি, আরও ঝাড়া দু’সপ্তাহের অপেক্ষা ‘অফিশিয়াল উইন্টার’-এর জন্য, মন কিছুতেই মানতে চায় না। অপেক্ষাতে, অপেক্ষাতে সারা শরীর জুড়ে রক্তপাত, হাজার প্রশ্নের বর্শামুখ খুঁচিয়ে চলে অবিরত: গুড়ে গন্ধ হবে কি? পনেরোর নিচে পারদ নামবে কি? ‘ওরা’ কাশ্মীর রাখতে দেবে কি? নিউ ইয়ার্স ইভের পার্টিতে পরব কী? সব প্রশ্নের উত্তর মেলে না। শীত তার উত্তেজনা, ওম, ভয়, কাঁপুনি, সব নিয়ে আমাদের আদুড় গা জাপটে জড়িয়ে থাকে, নিরুত্তর।
আমাদের আগের অন্তত দুটি প্রজন্মের জীবনে যেমন রবীন্দ্রনাথ, তেমনই আমাদের জীবনে, আমাদের মনের মধ্যে ষড়ঋতুর আনাগোনা নিয়ন্ত্রণ করতেন শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়। পূর্ণেন্দু পত্রীর ভাষায়, ঘুমের মধ্যে কাঁদতে কাঁদতে আমরা যখন যুবক হলাম, বাইরে তখন আমাদের সেই কান্না— আর কিঞ্চিৎ বিষাদ মাখা হাসি— নিয়ে তাঁর কলম ধরেছেন শীর্ষেন্দু। সেই কলমের ডগায় তার আশ্চর্য কুহক নিয়ে শীত আমাদের শরীর-মনে চারিয়ে দিত তার প্রসন্ন প্রসার। যেমন তাঁর ‘দেখা হবে’ নামের আশ্চর্য গল্পটির শুরুতেই: ‘নকশিকাঁথার মত বিচিত্র এক পৃথিবী ছিল আমাদের শৈশবে। এখনও পায়ের তলায় পৃথিবীর মাটি, চারিদিকে গাছপালা, মাথার উপর আকাশ। বুক ভরে শ্বাস টেনে দেখি। না, শীতের সকালে কুয়াশায় ভেজা বাগান থেকে যে রহস্যময় বন্য গন্ধটি পাওয়া যেতো তা আর পাওয়া যায় না।’
হয়তো আমাদের সেই ঘ্রাণশক্তিও চলে গেছে এখন, তবু মনে জেগে থাকে এক অনিশ্চিত সংশয়— বিশেষ করে গাঁয়েগঞ্জে মফস্সলে বনতুলসী ইত্যাদি গাছগাছড়ার উপর ভোরের শিশির পড়ার যে সোঁদা-সোঁদা গন্ধটি পাওয়া যেত, তা এখন আর পাওয়া যায় কি? এ কথা ঠিক যে আমাদের ছোটবেলায় অন্তত মফস্সলেও বড় বড় ফাঁকা মাঠ থাকত বলে তার উপর সকাল সন্ধ্যায় সাদা তুলোর চাদরের মতো বিছিয়ে থাকত কুয়াশার আস্তরণ, কোনাকুনি সেই ছায়াপথ চিরে সকালে যেতাম মাস্টারমশাইয়ের বাড়ি, আর শীতসন্ধ্যায় ক্রিকেট খেলেও সেই পথেই ঘরে ফেরা।
আমার ছেলেবেলায় শীতের শান্ত, নিরুপদ্রব অগ্রসঞ্চার নিয়ে খুব একটা হাঁকডাক ছিল না, কালীপুজোর শ্যামাপোকারা বাজির আগুনে পুড়ে মরার কয়েকদিন পরেই, আর ভাইফোঁটার পর স্কুল খুললেই আস্তে আস্তে বাতাসে দেখা দিত একটা শিরশিরানি ভাব।
পাতা খসানোর সময় শুরুর বার্তা তো এর অনেক আগেই পৌঁছে গেছে আমলকী গাছেদের কাছে, আর এই সময়ে দেখতাম এক নতুন ঋতুর জন্য তৈরি হচ্ছে আমাদের নিম্ন মধ্যবিত্ত সংসার। পুরনো ট্রাঙ্ক থেকে, স্টিলের আলমারির মাথায় প্যাঁটরা থেকে বেরোত লেপ, সোয়েটার, মাফলার, চাদর, শাল, শেয়ালরঙা আলোয়ান। আজকের পায়রার খোপের মতো ফ্ল্যাটবাড়ির কালচারে শীত সে ভাবে বোঝাই যায় না আদৌ, বরং গ্রামগঞ্জ মফস্সল শহরের পুরনো পাড়ার পুরনো বাড়ির শীতের ছাদে লেপ-কম্বল রোদে শুকোতে দেওয়া, অথবা সেই রোদে বসে কমলালেবু খেতে খেতে গল্পের বই পড়ার মধ্যে এক রকম কমিউনিটির যৌথযাপনের, কৌমজীবনের অনুষঙ্গ ছিল। শীতের শৈত্যকে বুক বেঁধে, দাঁতে দাঁত চেপে সহ্য করতাম আমরা, আর শীতের আমেজ, তার হাজার মজাকে বুক চিতিয়ে আবাহন।
প্রতি শীতে আমাদের মফস্সল শহরটির অতিথি কোনও না কোনও সার্কাস পার্টি, তার বাঘ ও হাতির দল, পুরুষপ্রবর রিংমাস্টার আর মোটর সাইক্লিস্ট, পরমাসুন্দরী জিমন্যাস্ট আর ট্র্যাপিজ আর্টিস্ট, আর খর্বকায় ক্লাউনদের পারস্পরিক সম্পর্কে নজর দিতে গিয়ে আমাদের অনেক বন্ধুদের নষ্ট হয়েছে অনেকগুলি হেমন্তকাল। আর ছিল, বিশেষত বড়দিন আর নিউ ইয়ারের সময় পাড়ার কাকু, মাসিমা, দাদা-দিদি আর সমবয়সি বন্ধুদের সঙ্গে দল বেঁধে বাসে করে পিকনিকে যাওয়া।
উষ্ণতা: কলকাতার শীত-সকালে আগুন পোহানো।
ক্লাসরুমের বাইরে জীবনের অনেক বৃহত্তর শিক্ষা পেয়েছি এই সব পিকনিক থেকেই, কিন্তু মনে গেঁথে আছে মাধ্যমিকের টেস্ট শেষ হওয়ার কয়েক দিন পরের যাত্রা। নিউ ইয়ার্স ডে’তে নবদ্বীপের গঙ্গার ঘাটে বাস থেকে নেমে মায়াপুরের উদ্দেশে যখন রওনা দিলাম নৌকোয় (ব্রিজ তখনও দূরায়ত), প্রবল শীতের ঠকঠকানির মধ্যে গমগম করে উঠল ট্রানজিস্টরের স্ট্যাটিক আর ইডেনের তরঙ্গায়িত গর্জনকে ছাপিয়ে পুষ্পেন সরকারের গলা, আর তার দু’মিনিটের মধ্যেই, ম্যাচের চতুর্থ বলে গাওস্কর শূন্য রানে আউট। ভাগীরথীর বিপুল বিস্তারের মধ্যে যেখানে আবছা কুয়াশা আর কবোষ্ণ রোদ পরস্পরের সঙ্গে মাখামাখি হয়ে যাচ্ছে, সেই মাঝনদীতে মনে হল তৎক্ষণাৎ ঝাঁপ দিই। কয়েক দশকের বহু পিকনিকের হাজার মজাকে ছাপিয়ে কেন জানি না ওই যন্ত্রণাকাতর মুহূর্তটিই মনে রয়ে গেছে এখনও।
গবেষণার জন্য প্রথম শীতের দেশে গেলাম যখন, ভারী বিড়ম্বনা হল। নির্ধারিত সময়ের এক টার্ম পরে, জানুয়ারি মাসে যাচ্ছি, সেই ভুল সময়ে শীতের অত্যাচার সইব কী করে? শীতের দেশ ঘোরা আত্মীয়স্বজন যে দু’চার জন, তাঁদের জীবনস্মৃতি তখন ধূসর হয়ে আসছে। অবশেষে এক বিলেতফেরত ইঞ্জিনিয়ারকে পাওয়া গেল, যিনি পঁচিশ বছর আগে সে দেশে কাটিয়েছেন কয়েক বছর। তিনি প্রগাঢ় গাম্ভীর্যের সঙ্গে সতর্কবাণী জানালেন, প্লেন থেকে নামার সঙ্গে সঙ্গেই নাকের সর্দি থুতনি অব্দি নামার আগেই বরফ হয়ে যাবে। তখনও মাস দুয়েক সময় ছিল, আমার এক মামাশ্বশুরের কাছ থেকে একটা পুরনো পুলিশের দারোগার ওভারকোট জোগাড় করা হল, সহধর্মিণীর জন্য বানানো হল উলের ওভারকোট, এক বছরের একটি দামাল শিশুকে আপাদমস্তক মুড়ে ফেলা হল রকমারি আস্তরণে। দমদম থেকে দিল্লি যেতেই আক্ষরিক অর্থেই গলদঘর্ম হয়ে গেলাম আমরা, আর তার পরের দীর্ঘ বিমানযাত্রায় অন্তত বিদেশি যাত্রীদের কাছে, সহাস্য ও প্রশ্রয়প্রবণ বিমানসেবিকাদের সামনে আমরা হয়ে দাঁড়ালাম এক ইন-হাউস এন্টারটেনমেন্ট সিস্টেম। শীতের আতঙ্কের কাছে সেই প্রথম আমাদের, যাকে বলে, বাপ্টিজ়ম বাই ফায়ার। উত্তর মেরুর মতো প্রস্তুতি ছিল বলেই সে যাত্রা পাশ করে গেছিলাম।
এক বার দার্জিলিং-এর ম্যালে বসে লক্ষ করেছিলাম, ক্লক টাওয়ারে ঢং করে বিকেল সাড়ে চারটে বাজার সঙ্গে সঙ্গেই ঠিক অলিম্পিকের সিনক্রোনাইজ়ড সুইমিং-এর মতো অন্তত দশ জন বাঙালি গৃহিণী এক সঙ্গে ব্যাগ থেকে মাঙ্কি ক্যাপ বের করে স্নেহাকুল উদ্বেগে পরিয়ে দিচ্ছেন সলজ্জ স্বামীদের মাথায়। আজকের সুপারকুল ডুডদের মতো ব্র্যান্ডেড বিনি হুডি এ সব তখন দোকানে কিনতে পাওয়া যেত না। কোথায় তখন আজকের সোয়েটশার্ট, ফ্লিস জ্যাকেট, পার্কা? জ্যাকেট তখন দার্জিলিং গেলে এক দিন টেকনিক্যালি নেপালের পশুপতিনাথে মন্দির-কাম-শপিং ট্রিপে গিয়ে বিস্তর গাঁটের কড়ি খরচ করে কিনতে হত। মাঙ্কি ক্যাপ, সোয়েটার কিনতে গেলে যেতে হত একটু মোটা সুতির জিনিস কেনার জন্য দোকানে, অথবা ওয়েলিংটন স্কোয়ারের কাছে সার বেঁধে বসে থাকা ভুটিয়াদের কাছে।
মফস্সলে এক চায়ের দোকানে ব্যস্ততা
তবে, ক’টাই বা কেনা সোয়েটার ছিল তখন? শীতের অনেক আগে থেকেই সোয়েটার বানানোর ধুম পড়ে যেত। উলের দোকান, ডিজ়াইনের বই, বিভিন্ন নম্বরের কাঁটা, টু-প্লাই থ্রি-প্লাই ফোর-প্লাই উল, ডাবল নিটিং, সোজা-উল্টো বুনট, হাই নেক, আরও কত কী! তিনটের সময় খেয়ে উঠে পড়ন্ত রোদে ছাদে বসে সোয়েটার বুনে চলেছেন বাড়ির মহিলারা, আবার রাতের টিমটিমে আলোয় দুর্বল দৃষ্টিশক্তি নিয়েও চলছে একই কাজ। ‘আ টেল অব টু সিটিজ়’-এ আমরা পড়েছি ফরাসি বিপ্লবের সময় প্যারিসের রাস্তায় বিপ্লবী জনতার হাতে নিহত অভিজাতদের কাটামুন্ডু নিয়ে শোভাযাত্রার সময় মাদাম দেফার্জ-এর মতো মহিলাদের উল বুনতে বুনতে কর্তিত মস্তকের নিঃস্পৃহ গণনা। আর শঙ্করীপ্রসাদ বসু অতুলনীয় ভাষায় আমাদের শুনিয়েছেন ইডেনে শীতের দুপুরে রমণীয় টেস্ট ক্রিকেটের আসরে অখণ্ড মনোযোগে গ্যালারিতে মহিলাদের সোয়েটার বুনে চলার কথা। এখন হয়তো একটু মিসোজিনিস্টিক বা নিদেনপক্ষে পেট্রনাইজিং মনে হবে, কিন্তু বিগত দিনের কলকাতায় এক বিগত দিনের ক্রিকেটের বর্ণনে অনবদ্য।
শীতকালের কথা বলতে গেলে তার খাওয়াদাওয়াকে বাদ দেওয়া যায় না। যদিও আগে যে সব জিনিসের জন্য বছরভর হাপিত্যেশ করে থাকতে হত, সেই টোম্যাটো, বাঁধাকপি, গাজর, ধনেপাতা এখন সারা বছরই হাতের নাগালে। তবু শীতের সম্ভার তার আকর্ষণে অপ্রতিরোধ্য, আনাজপাতি আর নতুন আলুর কথা বাদই দিলাম, নতুন গুড়ের কথা লিখতে গেলেই একখানা মহাকাব্য রচনা হয়ে যাবে। দুঃসহ তাপপ্রবাহে নিরন্তর দগ্ধ হতে থাকা সাহারা মরুর খর্জুর-বীথিকার নির্যাসটুকু নিংড়ে আমরা যে এক শীতল ও মহানন্দময় রসভাণ্ডার তৈরি করেছি, তা অবশ্য মহাকাব্যেরই দাবি রাখে। সেই মহাকাব্যের প্রশ্নগুলি মহাভারতে যুধিষ্ঠিরকে করা বকরূপী ধর্মরাজের প্রশ্নের থেকে কোনও অংশে কম নয়। নরম পাক না কড়াপাক? পয়রা না পাটালি? বলরাম না নকুড় (অন্যদের প্রতি সম্পূর্ণ শ্রদ্ধা রেখেই)? এই বিতর্ক, বলার অপেক্ষা রাখে না, কখনও শেষ হবে না।
বয়স হয়েছে যথেষ্ট, জীবনের বেশির ভাগ অপরাধবোধই কাটিয়ে ফেলেছি নির্লজ্জের মতো, তবু এই সব অমীমাংসিত প্রশ্ন নিয়ে লিখতে বেশ একটু লজ্জাই লাগে। কারণ এ সবই ‘ফার্স্ট ওয়ার্ল্ড প্রবলেম’, সকালে হাঁটতে বেরিয়ে দেখেছি গরিব মানুষদের কাছে শীতের নির্দয় রূপ। অনেক বার দেখেছি, বিশেষ করে শীতকালেই, নিথর শায়িত শরীরের পাশে দাঁড়িয়ে প্রাজ্ঞ ব্যবস্থাপক টাইপের কিছু মানুষের প্র্যাকটিকাল পরামর্শ কাশী মিত্রের ঘাট বা সিরিটি শ্মশানে যাওয়ার জন্য, কারণ অপেক্ষাকৃত ‘জনপ্রিয়’ গন্তব্যগুলিতে চুল্লির সামনে দরিদ্র ও বৃদ্ধ শরীরের অন্তিম মিছিল থাকবে দীর্ঘতর। কলেজে পড়ার সময় এক মাস্টারমশাইকে দেখেছিলাম পণ করেছিলেন, গোটা শীত কাটাবেন শীতবস্ত্র এক বারও গায়ে না চাপিয়ে। বহু দিন নকল করার চেষ্টা করেছি, ফল: প্রতি শীতে অন্তত এক বার করে হাঁচি-কাশিতে নাকাল হয়ে অ্যান্টিবায়োটিকের শরণাপন্ন হওয়া।
তাই ঝুঁকি না নিয়ে সকাল সাড়ে ছ’টায় জ্যাকেট মাফলার স্নিকার পরে, কানে ইয়ারফোন লাগিয়ে মর্নিং ওয়াকে বেরিয়ে দেখি জীবনসংগ্রামে জর্জরিত মানুষরা ছেঁড়া সস্তার সোয়েটার আর রোঁয়া-ওঠা মাঙ্কি ক্যাপ পরে তাঁদের চ্যালাকাঠ আর জং-ধরা টিনের ডালাগুলি খুলে চায়ের জন্য আদা পিষছেন, বা খোসাসুদ্ধ দাগি আলু কাটতে শুরু করছেন তরকারির জন্য, কোথাও লিট্টি সেঁকার আগুনেই জমে যাওয়া হাত একটু গরম করে নেওয়ার প্রচেষ্টা চলছে। ফুটপাতে এ সবের মধ্যেই পড়ে থাকে জরাজীর্ণ ভুষো কম্বলে আপাদমস্তক মোড়া ইতস্তত বডিব্যাগ, আর তার কাঠকুটো কার্ডবোর্ডের প্রাত্যহিক বেডরুম ভেঙে উঠে বসে সকালের প্রথম বিড়িটি ধরায় আধপাগলা উলোঝুলো হোমলেস সান্টা ক্লস। এই সবের মধ্যেই সন্তর্পণে ছোঁয়াচ বাঁচিয়ে ফুটপাতের বাজারে দাঁড়াই, যেখানে ভোর তিনটে বাহান্নর লোকাল ধরে শহরে এসে বিবিধ প্রাকৃতিক বেগের টুঁটি টিপে আনাজ বিক্রি করে দৈনিক একশো কুড়ি টাকা আর বিকোলাই-ইকোলাই ইনফেকশন অর্জন করেন মধ্য ও বৃদ্ধবয়সি মাসিরা। বরফশীতল হৃদয়ে নির্মম হাসিমুখে তাঁদের সঙ্গে দরাদরি করে শীতের ব্রকোলি,
রেড ক্যাবেজ, সেলেরি আর পার্সলি কিনে বাড়ি ফিরি, সন্ধেবেলা ভিনিগ্রায়েট ড্রেসিং মাখিয়ে স্যালাড খাব বলে। এ কলকাতার মধ্যে যে আছে আরও একটা দুটো তিনটে কলকাতা, শীতের সময়ে হাঁটলে তা বোঝা যায় আরওই বেশি।
তবু একটা খচখচানি যায় না। এ বার ঠান্ডাটা পড়েছিল ভালই, তার দাপটও চলেছে অনেক দিন ধরেই, এখনও তার রেশ যায়নি। উত্তর ভারতে তো ভয়াবহ শীত পড়েছিল, দিল্লিতে তাপমাত্রা নেমেছিল শূন্যের কাছাকাছি। এই শীতকে উপেক্ষা করে আমার দেশের অগণিত সংগ্রামী মানুষ অপেক্ষা করছেন, অবস্থান করছেন, যুঝে চলেছেন পার্ক সার্কাসে, শাহিন বাগে, আরও অনেক জায়গায়। কত মানুষ এগিয়ে এসে খাবার তুলে দিয়েছেন তাঁদের হাতে, কিন্তু সহযোদ্ধা ও সাধারণ মানুষের উষ্ণতা কি শীতের প্রকোপ কমিয়েছে একটুও? হয়তো, একটু হলেও, অন্তত পার্ক সার্কাসে, তাঁবুর ছাদ নিশ্চয়ই খানিক আটকেছে শিশিরের বরফশীতল আক্রমণ। সবটুকু যে বুঝতে পারি, তা নয়। তবু, সঙ্গোপনে হলেও, এটুকুই আশা, শীতের এই সমবেত প্রার্থনা বিফলে যাবে না। এই বসন্তে, ফুল ফুটুক না ফুটুক, ফিরিয়ে দাও আমার দেশ।