Dwarkanath Tagore

বরফ-ব্যবসার অনুমতি পাননি প্রিন্স দ্বারকানাথ

একচেটিয়া কারবার তখন ফ্রেডরিক টিউডরের হাতে। ১৮৩৩ সালে তিনি প্রথম কলকাতায় আনেন মার্কিন বরফ। তাতে সাহেব-মেমদের দেশের ছোঁয়া। সঙ্গে পাওনা খাদ্য-পানীয়ের সুস্বাদ এবং জ্বরের চিকিৎসা। তবে বিদেশি বরফের দাম ছিল আগুন। দু’আনা সের! একচেটিয়া কারবার তখন ফ্রেডরিক টিউডরের হাতে। ১৮৩৩ সালে তিনি প্রথম কলকাতায় আনেন মার্কিন বরফ। তাতে সাহেব-মেমদের দেশের ছোঁয়া। সঙ্গে পাওনা খাদ্য-পানীয়ের সুস্বাদ এবং জ্বরের চিকিৎসা। তবে বিদেশি বরফের দাম ছিল আগুন। দু’আনা সের!

Advertisement

অমিতাভ পুরকায়স্থ

শেষ আপডেট: ০৬ সেপ্টেম্বর ২০২০ ০০:০১
Share:

বরফঘর: কলকাতার একটি আইস হাউস।

উনিশ শতকের প্রথমার্ধে মার্কিন দেশে ভারতীয় মশলা, রেশমের বিরাট চাহিদা ছিল। কিন্তু সে দেশ থেকে আমদানি করার মতো জিনিস তেমন ছিল না। ফলে জলে ভারসাম্য রাখার জন্য খালি জাহাজে বালি ভর্তি করে নিয়ে আসা হত। স্পষ্টতই লোকসান। ১৮৩৩ সালে প্রথম ফ্রেডরিক টিউডর আমেরিকা থেকে ‘টুস্কানি’ নামের জাহাজে বরফ ভর্তি করে পাড়ি দিলেন কলকাতার উদ্দেশে। উনিশ শতকের প্রথম দিকে আন্তর্জাতিক বরফ-বাণিজ্যের পথিকৃৎ ছিলেন ‘আইস কিং’ ফ্রেডরিক টিউডর। বস্টনে তাঁর প্রতিষ্ঠানের নাম ছিল ‘টিউডর আইস কোম্পানি’। জাহাজ কলকাতা বন্দরে এলে দেখা গেল যে, এক-তৃতীয়াংশ বরফ গলে গিয়েও যা রয়েছে, তা বিক্রি করে প্রচুর মুনাফা করা যায়। ব্যস! মার্কিন দেশে ঠান্ডায় নদী বা জলাশয়ে প্রাকৃতিক ভাবে জমা বরফের বাণিজ্যিক মূল্য সম্পর্কে দুনিয়ার চোখ খুলে গেল।

Advertisement

তখন ভারতের রাজধানী কোম্পানির শাসনাধীন। দেশে প্রচুর ব্রিটিশ সাহেব-মেম। এখানকার গরম আর নানা রোগের প্রকোপে তাঁদের অবস্থা কাহিল। তখন এক টুকরো বরফ তাদের শুধু যে দেশের কথা মনে করিয়ে দিত, তা-ই নয়, দিনের শেষে খাদ্য ও পানীয়ও করে তুলত উপাদেয়। অনেক সময় জ্বর কমাতেও কাজে লাগে বরফ। ১৮৩০-৪০ নাগাদ আর্থিক মূল্য ও ওজনের নিরিখে, আমেরিকা থেকে ভারতে আমদানিকৃত পণ্যের মধ্যে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ স্থান পেয়েছিল মার্কিন বরফ।

সাহেবদের আগেও বরফ ব্যবহার হত এ দেশে। হিমালয় থেকে বরফ আনাতেন মুঘল বাদশারা। মুর্শিদকুলি খাঁ বরফ খেতে খুব ভালবাসতেন। সাহেব-মেমদের জন্যও তৈরি হত দিশি বরফ। বিত্তশালী ইউরোপীয়রা নিয়োগ করতেন ‘আবদার’ নামে এক শ্রেণির কর্মচারী, যারা শ্রমিকের সাহায্যে শীতের রাতে অগভীর পাত্রে জল জমিয়ে তৈরি করতেন দিশি বরফ, স্থানীয় নাম ছিল ‘হুগলি আইস’। তবে সেই দিশি বরফ স্বাদ ও গুণমানে মার্কিন বরফের ধারে কাছে যেতে পারেনি। তাই স্বচ্ছ সুস্বাদু মার্কিন বরফ কলকাতায় এসে পৌঁছলে, তার চাহিদা হল আকাশছোঁয়া।

Advertisement

লর্ড বেন্টিঙ্কের দেওয়া রুপোর স্মারক

সরাসরি এই বরফ উঁচু দামে বিক্রি করে চড়া মুনাফা করার রাস্তায় হাঁটেননি ফ্রেডরিক টিউডর। প্রথমে কম দামে বরফ বেচে কলকাতার বাবু-বিবিদের বরফ ব্যবহারে অভ্যস্ত করে দীর্ঘমেয়াদি বাজার নিশ্চিত করলেন তিনি। সঙ্গে স্থানীয় ক্রেতাদের উদ্বুদ্ধ করলেন আইস হাউস তৈরি করে আমদানিকৃত বরফ মজুত করতে। তৈরি হল কলকাতার আইস হাউস। প্রথমে গঙ্গার ধারে, স্ট্র্যান্ডে আর তার পর বর্তমান ব্যাঙ্কশাল কোর্টের ঠিক পশ্চিমে, চার্চ লেনের দিকে মুখ করে। প্রথমে সাহেবরা বরফ নেওয়ার জন্য বাড়ির কাজের লোককে খুব ভোরে পাঠাতেন আইস হাউসে। ওজন করে মেপে, প্যাক করে মহার্ঘ বস্তুটি বাস্কেটে তুলে দিতেন এক জন ‘আবদার’। বেলা বাড়ার আগেই সেই বরফ ঢুকে যেত শৌখিন সাহেবদের অন্দরমহলে। পরে ধীরে ধীরে শহরের বিভিন্ন জায়গায় তৈরি হয় খুচরো বরফ বণ্টনের বিতরণকেন্দ্র।

এর মধ্যেও খানিকটা জল মেশানোর খবরও আছে। আইস হাউস থেকে বরফ নেওয়ার পর তার কিছুটা স্থানীয় বাজারে বেচে দিত কাজের লোক আর বাড়ি এসে বলত, বরফ গলে গেছে! অনেক সময় আবার বলত, বরফের দাম বেড়ে যাওয়ায় কম বরফ পাওয়া গেছে। কালোবাজারেও বরফের চাহিদা ছিল। সে বরফের উপভোক্তাও ছিলেন শ্বেতাঙ্গ বা স্থানীয় বিত্তশালীরা, কারণ বরফের দাম ছিল সাধারণের আয়ত্তের বাইরে— সের প্রতি দু’আনা!

ভারতের ক্রান্তীয় জলবায়ুতে সাহেবরা এই বরফের জন্য কতটা উন্মুখ ছিলেন, তা বোঝা যায় দর কষাকষির বিবরণ থেকে। টিউডরের তরফে এজেন্ট হিসেবে জাহাজের সঙ্গে কলকাতায় আসেন উইলিয়াম রজার্স। তিনি ছিলেন ব্যবসার এক-তৃতীয়াংশের অংশীদারও। রজার্স সরকারের কাছ থেকে শুল্ক পরীক্ষা ও যাচাই প্রক্রিয়া থেকে অব্যাহতি চাইলেন, যাতে গলে যাওয়ার আগেই দ্রুত বরফ গুদামজাত করা যায়। অনুরোধ গ্রাহ্য হল, উপরন্তু সরকার নিজে থেকে আমদানি শুল্কেও ছাড় দিলেন। কলকাতায় বরফ আমদানির জন্য কৃতজ্ঞ শ্বেতাঙ্গ সম্প্রদায়ের পক্ষ থেকে রজার্সকে সংবর্ধনাও দেওয়া হয়। তাতে রজার্স-কে যে রুপোর স্মারক দেওয়া হয়েছিল, সেটি সংরক্ষিত আছে আমেরিকায় পিবডি মিউজ়িয়ামে। স্মারকে খোদাই করা আছে ইতিহাস— ‘প্রেজ়েন্টেড বাই লর্ড উইলিয়াম বেন্টিঙ্ক, গভর্নর জেনারেল অ্যান্ড কম্যান্ডার ইন চিফ, ইন্ডিয়া, টু মিস্টার রজার্স অব বস্টন ইন অ্যাকনলেজমেন্ট অব দ্য স্পিরিট অ্যান্ড এন্টারপ্রাইজ় হুইচ প্রোজেক্টেড অ্যান্ড সাকসেসফুলি এগজ়িকিউটেড দ্য ফার্স্ট অ্যাটেম্পট টু ইমপোর্ট আ কার্গো অব আমেরিকান আইস ইনটু ক্যালকাটা— নভেম্বর ২২, ১৮৩৩।’

এর পর টিউডর বরফের জাহাজে মার্কিন আপেল, মাখনও পাঠাতে শুরু করলেন আর কলকাতার বাজার লুফে নিল সে-সব। ভাল জিনিসের জন্য কলকাতার ক্রেতা তখন যে কোনও দাম দিতে প্রস্তুত। ক্যালেব ল্যাড নামে এক এজেন্ট চিঠি দিয়ে টিউডরকে জানান শুধু সর্বোৎকৃষ্ট পণ্যই পাঠাতে, কারণ কলকাতার সেটাই বিক্রি হয়। গুণগত মানের সামান্যতম হেরফের হলেও এ বাজারে মাল বিক্রি হবে না!

এত নিয়ন্ত্রণ সত্ত্বেও বরফের দামে তারতম্য হত, যখন বিভিন্ন কারণে জাহাজ পৌঁছতে দেরি হত আর মজুতে পড়ত টান। তখন বরফের রেশনিং চালু হত। প্রত্যেক ক্রেতাকে দৈনিক এক সেরের থেকে বেশি বরফ দেওয়া হত না। তার চেয়ে বেশি বরফ পেতে দেখাতে হত ডাক্তারের সার্টিফিকেট, কারণ বিভিন্ন চিকিৎসায় বরফ দরকার হত। তৎকালীন বিশিষ্ট শিল্পী ও লেখক কোলসওয়ার্দি গ্রান্ট আরও জানাচ্ছেন, বরফের আকালে শহরের মানুষ যত উত্তেজিত, ততটা বোধহয় বেঙ্গল ব্যাঙ্ক ফেল করার পর নিজেদের গচ্ছিত সঞ্চয় খুইয়েও হয়নি!

ক্রমে ক্রেতাদের কাছে মার্কিন বরফ আর বিলাসিতা নয়, দৈনন্দিন প্রয়োজন হয়ে উঠল। সেই চাহিদার সঙ্গে তাল মিলিয়ে বাড়িতে দীর্ঘ সময় বরফ রাখার জন্য এসে গেল আইস চেস্ট। সেই চেস্টের মধ্যে মাখন থেকে দামি মদ ঠান্ডা রাখা সম্ভব হল। সুখী গৃহকোণের আবশ্যক সজ্জা হয়ে উঠল বরফ-বাক্স।

১৮৩৫-এর পর সরকারের তরফে বরফ বণ্টনের জন্য একটি নয় সদস্যের কমিটি গঠিত হয়, যার মধ্যে দুজন দেশীয় সদস্য ছিলেন প্রিন্স দ্বারকানাথ ঠাকুর এবং কুরবুলাই মহম্মদ। এই কমিটির মাধ্যমেই বরফের দাম ও রেশনিং ব্যবস্থা রূপায়িত হত। কৃষ্ণ কৃপালনীর লেখা জীবনী থেকে জানা যায়, প্রিন্স দ্বারকানাথ মোটেই গরম সহ্য করতে পারতেন না। আর সেই জন্যই বরফ পছন্দ করতেন। ব্যক্তিগত পছন্দই হোক আর লাভের ব্যবসা বলেই হোক, দ্বারকানাথ সরাসরি বরফের আমদানি ও ব্যবসায় নামার ইচ্ছে প্রকাশ করলেও, সে-প্রস্তাব অগ্রাহ্য করে সরকার টিউডরের একচেটিয়া কারবারের অধিকার বজায় রাখে আরও বেশ কয়েক বছর।

অন্য দিকে দেখা যায়, বোম্বাইয়ে প্রথম বরফ বোঝাই জাহাজ আসে ১৮৩৪ সালে। কলকাতার ঠিক এক বছর পর। কিন্তু সেই সময়েই আমরা দেখি, জামশেদজি নুসুরওয়ানজি ওয়াদিয়া সরকারি ভাবে বরফ বণ্টনের ব্যবসার সঙ্গে যুক্ত। সমকালীন তথ্য বলছে, এদেশীয়দের মধ্যে পার্সিরা কিন্তু বরফের ব্যবহারকে আপন করে নিয়েছিলেন আগেভাগেই। ভারতীয়দের মধ্যে প্রথম ‘নাইট’ খেতাব পাওয়া স্যর জামশেদজি জিজিবয়, ডিনার পার্টিতে প্রথম আইসক্রিম পরিবেশনের ব্যবস্থা করেন। অবশ্য সেই আইসক্রিম খেয়ে গৃহকর্তা-সহ অধিকাংশ অতিথির ঠান্ডা লাগায় খবরের কাগজে তা নিয়ে বেশ খানিক হাসিঠাট্টা হয়।

তা হলে কি বাঙালিরা কালাপানি পেরিয়ে আসা বরফ এড়িয়ে চলতেন? তা তো নয়! কোলসওয়ার্দি গ্রান্ট জানাচ্ছেন যে, গোঁড়া হিন্দুরাও পবিত্র গঙ্গাজলের সঙ্গে মার্কিন বরফ মিশিয়ে পান করতেন। আর অন্য ধর্মাবলম্বীদের তেমন কোনও সংস্কার না থাকায়, তারা বরফ ব্যবহার করতেন আরও স্বাধীন ভাবে। তবে এ কথাও ঠিক যে, কিছু কিছু ক্ষেত্রে সাধারণ মানুষ বরফ ব্যবহার করলেও, জিনিসটি কিন্তু প্রধানত উচ্চকোটির মানুষের ব্যবহার্য সামগ্রী হিসেবেই চিহ্নিত ছিল।

খাঁটি ইউরোপীয়, ইউরেশিয়ান ও ভারতীয় নাগরিকদের মধ্যে যে সমস্ত বিষয় দিয়ে বিভাজনরেখা টানা হত, তার মধ্যে অন্যতম ছিল নিয়মিত বরফের ব্যবহার।

১৮৫০-এর কাছাকাছি, আমেরিকান বণিকদের সঙ্গে কলকাতার বেনিয়া পরিবারগুলির সুসম্পর্কের নিরিখে। অক্রূর দত্তের উত্তরপুরুষ রাজেন্দ্র দত্ত, কালীদাস দত্ত, তার পর দুর্গাপ্রসাদ ঘোষ, রাজকৃষ্ণ মিত্র— এঁরা সকলেই আমেরিকান ব্যবসায়ীদের সঙ্গে দীর্ঘ দিন ধরে সুনামের সঙ্গে ব্যবসা করেছেন। ব্যবসায়িক সম্পর্ক উন্নীত হয় বন্ধুত্বে। স্বদেশ, স্বাধীনতা ও অধ্যাত্মবাদ নিয়ে মতামত আদানপ্রদানও হয়। তবু আমেরিকান বরফের ব্যবসায় এঁদের অংশগ্রহণ সম্পর্কে তথ্য খুব সীমিত।

১৮৪০ সালের পরের বছরগুলোয় টিউডরের বরফ-রফতানি ফুলে-ফেঁপে ওঠে। কিন্তু টিউডরের সাফল্য আরও ব্যবসায়ীদের এই ব্যবসায় লগ্নি করতে উৎসাহী করে তোলে। শুরু হয়ে যায় প্রতিযোগিতা। অন্য দিকে শিল্প বিপ্লবের ঝড়ে কৃত্রিম বরফ তৈরির কৌশল চলে আসে ভারতে। এ দেশে সেই প্রযুক্তি প্রথম ব্যবহৃত হয় মাদ্রাজে, ১৮৭৪ সালে। কলকাতায় বরফ উৎপাদন শুরু হয় ১৮৭৮ সালে। প্রথম ‘বেঙ্গল আইস কোম্পানি’ আর তার কিছু দিন পর বামা-লরি কোম্পানির নিয়ন্ত্রণাধীন ‘ক্রিস্টাল আইস কোম্পানি’ নামে দুটি প্রতিদ্বন্দ্বী সংস্থা খুলে গেল কলকাতার বরফের বাজার ধরতে। কিন্তু প্রতিযোগিতায় লোকসান হওয়ার ফলে, পরে দুই সংস্থা জুড়ে গিয়ে তৈরি হল নতুন সংস্থা ‘ক্যালকাটা আইস অ্যাসোসিয়েশন লিমিটেড’। মার্কিন বরফ আমদানির বিদায়ঘণ্টা বেজে গেল। শেষ হল অর্থনৈতিক ইতিহাসের এক ব্যতিক্রমী অধ্যায়।

আজ আর বরফ-বাণিজ্যের তেমন কোনও স্মৃতিই অবশিষ্ট নেই। চেন্নাই সমুদ্রতটের একটি বাড়ির কিছু অংশ দেখে বোঝা যায় যে, সেটি ছিল শহরের পুরনো আইস হাউস। বহু বছর পর মার্কিন মুলুকে ভারতীয় আধ্যাত্মিকতার জয়ধ্বজা উড়িয়ে এক সন্ন্যাসী দেশে ফেরেন, তখনকার মাদ্রাজ হয়ে। ৬ থেকে ১৪ ফেব্রুয়ারি ১৮৯৭ সালে সমুদ্রতীরের তিনি এই বাড়িতে থেকেই যুবসমাজের উদ্দেশে তাঁর উদ্দীপনাময় ভাষণ দেন। সেই ঘটনার স্মৃতিতে বাড়িটি আজ ‘বিবেকানন্দ হাউস’। যে-বাড়িতে এক সময় আমেরিকার বরফ রাখা হত, সেখানেই উঠেছিলেন আগুনের মতো গনগনে বাঙালি সন্ন্যাসী।

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement