কাপড়ের পটে দুর্গা

বোলপুরের কাছেই হাটসেরান্দি গ্রামে পূজিত হন কাপড়ের পটে আঁকা দুর্গা। লোকসংস্কৃতি ও ঐতিহ্যের ধারক এই পটশিল্প এখন বিপন্ন। ঊর্মি নাথবোলপুরের কাছেই হাটসেরান্দি গ্রামে পূজিত হন কাপড়ের পটে আঁকা দুর্গা। লোকসংস্কৃতি ও ঐতিহ্যের ধারক এই পটশিল্প এখন বিপন্ন। ঊর্মি নাথ

Advertisement
শেষ আপডেট: ২১ অক্টোবর ২০১৮ ০০:০০
Share:

দেবী: হাটসেরান্দি গ্রামের চট্টোপাধ্যায়-বাড়ির দুর্গা

হাটসেরান্দি গ্রামের চট্টোপাধ্যায়দের দুর্গামণ্ডপে পুজোর ছবিটা একটু আলাদা। মণ্ডপে মাটির প্রতিমা নেই, এখানে দেবী পূজিত হন পটে। মাটির নয়, কাপড়ের পটে। বোলপুর থেকে ১৩ কিমি দূরে ছোট্ট হাটসেরান্দি গ্রামে প্রায় ১৬-১৭টি বাড়িতে দুর্গাপুজো হয়! পুজোর এই আড়ম্বরই বুঝিয়ে দেয়, গ্রামটি বর্ধিষ্ণু এবং বনেদি।

Advertisement

গৃহকর্তা শ্যামাপ্রসাদ চট্টোপাধ্যায় মাটির দাওয়ায় বসিয়ে খাওয়াচ্ছেন গ্রামের সকলকে। ভাত, ডাল, তরকারি, পুকুর থেকে তোলা মাছ, চাটনি, পায়েস। পটে পুজো কেন? ‘‘এই পুজো শুরু আট পুরুষ, মানে মোটামুটি দুশো বছর আগে। সেই অষ্টম পুরুষ, গঙ্গাপদ চট্টোপাধ্যায়ের আর্থিক অবস্থা ভাল ছিল না। কিন্তু তাঁর ভারী ইচ্ছে হয়েছিল দুর্গাপুজো করার। এক দিন বাড়ির জবাগাছের নীচে এক ষোড়শী কন্যাকে বসে থাকতে দেখেছিলেন। সেই কন্যেই তাঁকে বলেছিলেন, ঘটে পটে পুজো কর। কম খরচে হয়ে যাবে। সেই সময় যিনি বাঁশের কাঠামোর উপর কাপড় সেঁটে পট এঁকেছিলেন, সেই সূত্রধর পরিবারেরই শিল্পী রামকৃষ্ণ সূত্রধর আজ আমাদের পট আঁকেন। এই পটুয়াদের মধ্যে বিখ্যাত হয়েছিলেন রামকৃষ্ণের দাদু কালীপদ সূত্রধর, তাঁর ছেলে আদুরগোপাল। এঁরা প্রত্যেকেই আমাদের পরিবারে পট করেছেন,’’ বললেন শ্যামাপ্রসাদবাবু। শান্তিনিকেতনের পাঠভবনে বাংলার শিক্ষক শ্যামাপ্রসাদবাবুর দাদা শিল্পপতি পূর্ণেন্দু চট্টোপাধ্যায়। পালা করে পুজো হয় দুই ভাইয়ের বাড়ি।

পরে হাটসেরান্দিতে অনেকেই পটে দুর্গাপুজো শুরু করেন। এখন অবশ্য চট্টোপাধ্যায় ও মণ্ডল পরিবার ছাড়া বাকি বাড়িগুলোয় প্রতিমায় পুজো হয়। এক দিকে শিল্পীর অভাব, অন্য দিকে জাঁকজমক ও প্রতিমার সাজ হারিয়ে দিয়েছে কাপড়ের পটের ঐতিহ্যকে। ‘‘এ বছর একটি পট কলকাতা ললিতকলা অ্যাকাডেমি থেকে নিয়ে গিয়েছে। আর দুটো পট আঁকছি দুই বাড়ির জন্য,’’ বললেন রামকৃষ্ণ সূত্রধর। এই মুহূর্তে এই গ্রামে একমাত্র পটশিল্পী তিনি। সূত্রধর পটুয়াদের মধ্যে সবচেয়ে জনপ্রিয় ছিলেন কালীপদ পটুয়া। তাঁর ছেলে আদুরগোপালও নামী শিল্পী ছিলেন। বছরে এক বারই পট আঁকেন সূত্রধররা। বাকি সময় চাষই পেশা।

Advertisement

প্রতিমা পুজোর সঙ্গে পটের পুজোর পার্থক্য বির্সজনে। নতুন পটটি দশমীর দিন রাখা হল গ্রামের মন্দিরে। আর গ্রামের পুকুরে বিসর্জন দেওয়া হয় গত বছরের পট। আগামী বছর রথযাত্রায় ফের মন্দিরে রাখা পটে একটু মাটি ছুঁইয়ে নতুন কাপড়, দড়ি দেওয়া হবে পটুয়াকে।

রামকৃষ্ণ বাঁশ দিয়ে ফ্রেম করেন। জানালেন, এঁটেল মাটি ছেঁকে, কাদাগোলা তৈরি করে নতুন কাপড় ভিজিয়ে নিতে হয়। কাপড়ে মাটি শুকিয়ে গেলে খড়ি দিয়ে প্রথমে এঁকে, পরে তুলিতে লাল রঙ দিয়ে বর্ডার এঁকে রং হয়। জমির রং হয় নীল। আগে আঁকার জন্য ভেষজ রং ব্যবহার হত। কুলগাছের আঠা থেকে লাল, ভুসো কালি থেকে কালো, গিরিমাটি থেকে কমলারং তৈরি হত। ঠাকুরের গয়না বা অস্ত্র কখনও চুমকি দিয়ে, কখনও রাংতা দিয়ে সাজানো হয়। লোক-ঐতিহ্য সঙ্গী হাটসেরান্দির পটের দুর্গার। তবে ভবিষ্যৎ খুব উজ্জ্বল, এমনটা বলা যায় না।

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement