চিত্ররূপ: ক্রিস্টোফার নোলান পরিচালিত ‘ওপেনহাইমার’ ছবিতে বিজ্ঞানী রবার্ট ওপেনহাইমারের ভূমিকায় অভিনেতা সিলিয়ান মারফি
এর থেকে ভাল সময় বুঝি আর কিছু হয় না। ‘ফাদার অব অ্যাটম বম্ব’ জে রবার্ট ওপেনহাইমারের বায়োপিক তৈরি করছে ইউনিভার্সাল পিকচার্স। ছবিটি মুক্তি পাবে আগামী জুলাই মাসে। ওয়ার্নার ব্রাদারস-এর ছবিটা তৈরি করার কথা ছিল। কোভিড আসায় সব ভন্ডুল। এখন ওই বায়োপিকের ডিরেক্টর ক্রিস্টোফার এডওয়ার্ড নোলান। ২০১৪ সালে যিনি পরিচালনা করেছিলেন সায়েন্স ফিকশন ফিল্ম ‘ইন্টারস্টেলার’। ২০১৭ সালে যিনি দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের উপর নির্মিত ফিল্ম ‘ডানকার্ক’-এর ডিরেক্টর। বিশ্বযুদ্ধ এ বারেও তাঁর ছবির প্রেক্ষাপট। এ বারে তাঁর ফিল্মের প্রধান চরিত্র এক জন বিজ্ঞানী। রক্তমাংসের এক চরিত্র। গোটা বিশ্ব অধীর আগ্রহে। নোলানের ওপেনহাইমার কেমন হবেন? হ্যাঁ, ছবির নামও ‘ওপেনহাইমার’। চলচ্চিত্রে যে চরিত্রে অভিনয় করেছেন সিলিয়ান মারফি। আর, এ ছবির কাহিনি জুগিয়েছে কাই বার্ড এবং মার্টিন জে শেরউইন-এর বই ‘আমেরিকান প্রমিথিউস: দ্য ট্রায়াম্ফ অ্যান্ড ট্র্যাজেডি অব জে রবার্ট ওপেনহাইমার’। ২০০৬ সালে যে বই পেয়েছিল পুলিৎজ়ার প্রাইজ়। নোলান-পরিচালিত ‘ওপেনহাইমার’ এখন ফিনিশিং টাচের অপেক্ষায়। এই সময় এসে গেল খবর।
কী? ১৯৫৪ সালের ২৭ মে তারিখে আমেরিকার অ্যাটমিক এনার্জি কমিশনের তরফে ওপেনহাইমারের উপর থাকা নিরাপত্তা বলয় তুলে নেওয়াটা ভুল হয়েছিল। ফলে আমেরিকার পারমাণবিক দফতরের গোপন কাগজপত্র— যার মধ্যে অনেকগুলো তিনি নিজেই লিখেছিলেন— তাঁর ধরাছোঁয়ার বাইরে চলে যায়। আর, এর দরুন মানসিক ভাবে ভেঙে পড়েন তিনি। ১৯৬৭ সালে ক্যানসারে মারা যাওয়ার আগেই তাঁর ‘মৃত্যু’ হয়। যদিও তাঁকে ১৯৬৩ সালে ‘অ্যাটম বোমা এবং পরমাণু শক্তির শান্তিপূর্ণ ব্যবহার’-এর জন্য দেওয়া হয় এনরিকো ফের্মি অ্যাওয়ার্ড (ঘোষণা জন ফিটজ়েরাল্ড কেনেডির, তিনি আততায়ীর গুলিতে মারা যাওয়ায় মেডেল হাতে তুলে দেন পরবর্তী প্রেসিডেন্ট লিনডন জনসন), যদিও তাঁর সম্মানার্থে ২০১৭ সাল থেকে আমেরিকা সরকার ঘোষণা করেছে ‘ওপেনহাইমার সায়েন্স অ্যান্ড এনার্জি লিডারশিপ প্রোগ্রাম’, তবু সেক্রেটারি জেনিফার মুলহার্ন ব্রানহলস-এর তরফে এই ঘোষণায় অপবাদমুক্তি ঘটল ওপেনহাইমারের।
কেমন বিজ্ঞানী ছিলেন ওপেনহাইমার? এ প্রশ্নের উত্তর দিতে গেলে এক ভাগ্যবিপর্যয়ের কথা বলতে হয়। ১৯৩৯ সালের পয়লা সেপ্টেম্বর— যে দিন অ্যাডলফ হিটলার পোল্যান্ড আক্রমণ করে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শুরু করলেন— সে দিন পদার্থবিজ্ঞানের সবচেয়ে বিখ্যাত জার্নাল ‘ফিজ়িক্যাল রিভিউ’-তে দু’টি পেপার ছাপা হয়। একটি পেপারের লেখক ওপেনহাইমার এবং ক্যালিফোর্নিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে তাঁর ছাত্র হার্টল্যান্ড স্নাইডার। প্রবন্ধের শিরোনাম: ‘অন কনটিনিউড গ্র্যাভিটেশনাল কনট্রাকশন’।
কী বিষয়? আকাশের নক্ষত্র। প্রত্যেক তারায় চলে দুই বিপরীতমুখী ক্রিয়া। জ্বালানি পুড়িয়ে আগুন, যা লুচির মতো ফোলাতে চায় তারাকে। আর প্রচণ্ড পদার্থজনিত গ্র্যাভিটির চাপ, যা সঙ্কুচিত করতে চায় নক্ষত্রকে। তাপ এবং চাপের এই বিপরীতমুখী ক্রিয়া চলে সারা ক্ষণ। তবে, জালানি ফুরোলে কী হবে? এই নিয়ে মাথা ঘামান আমাদের সুব্রহ্মণ্যম চন্দ্রশেখর। মাথা ঘামান কেমব্রিজে যাওয়ার পথে জাহাজে। কেমব্রিজে পৌঁছে এক সভায় পেশ করেন তাঁর গণনা। ওই ধরনের নক্ষত্রকে বলে হোয়াইট ডোয়ার্ফ বা শ্বেত বামন। ফিজ়িক্সের নতুন শাখা কোয়ান্টাম মেকানিক্স এবং আলবার্ট আইনস্টাইন-আবিষ্কৃত স্পেশাল রিলেটিভিটি মিশিয়ে চন্দ্রশেখর দেখালেন, শ্বেত বামন নক্ষত্রের ক্ষেত্রে একটা নির্দিষ্ট ভরের বেশি হলে কী হবে, তা কেউ বলতে পারে না। ওই সভায় উপস্থিত ছিলেন বিখ্যাত ব্রিটিশ জ্যোতির্বিজ্ঞানী আর্থার স্ট্যানলি এডিংটন। ১৯১৯ সালে আইনস্টাইন-আবিষ্কৃত জেনারেল রিলেটিভিটির পরীক্ষামূলক প্রমাণ দিয়ে তাঁর তখন খুব নামডাক। তিনি তাচ্ছিল্য করে ঠাট্টা পর্যন্ত করেন চন্দ্রশেখরের গণনাকে।
নক্ষত্রের ভর খুব বেশি হলে কী হবে? সে প্রশ্নের উত্তর দিলেন ওপেনহাইমার এবং স্নাইডার তাঁদের পেপারে। ওঁরা আইনস্টাইন-আবিষ্কৃত জেনারেল রিলেটিভিটি কাজে লাগিয়ে দেখালেন, খুব ভারী নক্ষত্র ব্ল্যাক হোলে পরিণত হওয়ার দিকে এগিয়ে যাবে। সেই জন্যই কনটিনিউড গ্র্যাভিটেশনাল কনট্রাকশন। যদিও ওপেনহাইমার অনেক কাজ করেন কোয়ান্টাম মেকানিক্স এবং স্পেশাল রিলেটিভিটি মিশিয়ে যে কোয়ান্টাম ফিল্ড থিয়োরি, সে বিষয়ে, অনেক বিজ্ঞানীই মনে করেন, ‘ফিজ়িক্যাল রিভিউ’ জার্নালে প্রকাশিত ওই পেপারটিই তাঁর শ্রেষ্ঠ গবেষণা।
১৯৩৯ সালের পয়লা সেপ্টেম্বর ‘ফিজ়িক্যাল রিভিউ’ জার্নালে দ্বিতীয় প্রবন্ধের লেখক নোবেলজয়ী বিজ্ঞানী নিলস বোর এবং জন আর্চিবাল্ড হুইলার-এর পেপারের শিরোনাম : ‘দ্য মেকানিজ়ম অব নিউক্লিয়ার ফিশন’। ইউরেনিয়াম বা প্লুটোনিয়ামের ভারী পরমাণু নিউট্রন কণার আঘাতে কেমন করে দু’টুকরো হয়— এবং বাড়তি পাওয়া যায় কিছুটা এনার্জি (যা অ্যাটম বোমার মূল নীতি)— তা-ই ব্যাখ্যা করা হয় ওই পেপারে। ভাগ্য পরিবর্তন এমনই যে, হুইলার ভবিষ্যতে কাজ করেন ব্ল্যাক হোল নিয়ে, আর ওপেনহাইমার বনে যান ফাদার অব অ্যাটম বম্ব। জীবন যে কোন পথে নিয়ে যায় মানুষকে, তা কে জানে!
পাছে অ্যাডলফ হিটলারের দেশের বিজ্ঞানীরা অ্যাটম বোমা তৈরি করে ফেলে, তাই আমেরিকা তৈরি করতে নামে সে বোমা। সে বোমার মূল নীতি ইউরেনিয়াম বা প্লুটোনিয়ামের মতো ভারী পরমাণুকে নিউট্রনের আঘাতে দু’টুকরো করা— সেটি আবিষ্কৃত হয়েছিল জার্মানিতে। ফলে আমেরিকার ভয় পাওয়ার যথেষ্ট কারণ ছিল। জার্মানি থেকে আমেরিকায় পালিয়ে যাওয়া আইনস্টাইনও সেই ভয়ই পান। তাই তিনি আমেরিকার প্রেসিডেন্ট ফ্রাঙ্কলিন ডিলানো রুজ়ভেল্টকে চিঠি লিখেছিলেন, আমেরিকা যেন অ্যাটম বোমা বানাতে নামে। চিঠির তারিখ ২ অগস্ট, ১৯৩৯। বোর এবং হুইলার-এর পেপার টনক নড়িয়ে দেয় অনেকের। কাজ হয় অনেক ধাপে। এর মধ্যে একটা কাজ হল ব্রিটিশ বিজ্ঞানী স্যর রুডলফ আর্নস্ট পিয়েরেলস এবং বার্মিংহাম বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক অটো রবার্ট ফ্রিশকে নিয়ে একটা কমিটি গঠন। কমিটির বিবেচ্য: ঠিক কতটুকু ইউরেনিয়াম লাগে অ্যাটম বোমা তৈরির জন্য। কমিটি রিপোর্ট দেয় এক পাউন্ড (০.৪৫ কিলোগ্রাম) ইউরেনিয়াম প্রয়োজন।
প্রয়াত নোবেলজয়ী বিজ্ঞানী স্টিভেন ওয়েনবার্গ বলেছিলেন, জার্মানি যে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধকালে অ্যাটম বোমা বানাতে পারেনি, আর আমেরিকা যে পেরেছিল, তার কারণ জার্মানিতে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল ওয়ার্নার হাইজ়েনবার্গকে, আর আমেরিকায় সে দায়িত্বে ছিলেন ওপেনহাইমার। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের শেষে দশ জন জার্মান বিজ্ঞানীকে একে-একে বন্দি করা হয়। ওঁদের রাখা হয় ইংল্যান্ডে একটা বাড়িতে। বাড়ির দেওয়ালে লুকোনো মাইক্রোফোন ছিল। উদ্দেশ্য জার্মান বিজ্ঞানীদের কথাবার্তা ওঁদের না জানিয়ে রেকর্ড করা। যাতে জার্মানিতে অ্যাটম বোমার কাজ কত দূর এগিয়েছিল, সেটা জানা যায়। ১৯৪৫ সালের ৬ ও ৯ অগস্ট জাপানের হিরোশিমা ও নাগাসাকি শহরে আমেরিকার অ্যাটম বোমা ফেলার ঘটনা বিবিসি রিপোর্টে জানতে পারেন ওই দশ বিজ্ঞানী। শুনে প্রথম বিশ্বাসই করতে পারেননি তাঁরা। ভাবেন, আমেরিকা বুঝি ভাঁওতা দিচ্ছে ওঁদের। পরদিন খবরের কাগজে রিপোর্ট পড়ে সত্যি ঘটনা জানতে পারেন ওঁরা। ওই দশ বিজ্ঞানীর মধ্যে ছিলেন অটো হান, যাঁর হাতে ইউরেনিয়াম পরমাণুর বিভাজন। এর জন্য ১৯৪৫ সালে নোবেল প্রাইজ় পান তিনি। হান-এর নোবেল প্রাইজ়ের খবর ওই দশ বিজ্ঞানী পান বন্দিদশায়। যাই হোক, আমেরিকা যে অ্যাটম বোমা বানিয়ে ফেলেছে, সে খবর পাওয়ার পরে হান হাইজ়েনবার্গকে বলেন, “তোমরা তো হেরো।” ব্যঙ্গের অর্থ বোঝা যায়। অ্যাটম বোমা তৈরি হলে বিজ্ঞানীরাই যে সে কাজ করবেন, সে তো সকলের জানা। আমেরিকার বিজ্ঞানীরা অ্যাটম বোমা তৈরি করতে পেরেছেন, অথচ জার্মানিরা তা পারেনি— এই ছিল ওই খোঁচার উদ্দেশ্য।
খোঁচা খেয়ে হাইজ়েনবার্গ গণনা করতে বসেন অ্যাটম বোমায় কতটা ইউরেনিয়াম বা প্লুটোনিয়াম লাগবে। যে উত্তর পান, তা ভুল। হাইজ়েনবার্গ গণনা করে পান, টন টন ইউরেনিয়াম বা প্লুটোনিয়াম লাগবে। ওই গণনা খুব জরুরি, অ্যাটম বোমা তৈরি করার আগে ওটা জানতে হয়। তার মানে, আইনস্টাইন যা-ই ভাবুন, জার্মানি অ্যাটম বোমা বানাতে নামেনি।
আমেরিকা অ্যাটম বোমা বানাতে নামে পিয়েরেলসদের রিপোর্ট পাওয়ার পর। ১৯৪২ সালের ১৯ জানুয়ারি তারিখে প্রেসিডেন্ট রুজ়ভেল্ট অ্যাটম বোমা তৈরির সবুজ সঙ্কেত দেন। ব্যাপারটা দেখাশোনা করার সামরিক প্রধান নির্ধারিত হন লেসলি রিচার্ড গ্রোভস। তাঁকে দেওয়া হয় বিজ্ঞানী-প্রধান নির্বাচন করার দায়িত্ব। বিজ্ঞানীদের প্রথম পছন্দ আর্নেস্ট ওর্নাল্ডো লরেন্স। পরমাণু বিভাজনের যন্ত্র সাইক্লোট্রন-এর আবিষ্কর্তা। ওই আবিষ্কারের জন্য লরেন্স নোবেল প্রাইজ় পান ১৯৩৯ সালে। তাঁকে বাদ দিয়ে গ্রোভস নির্বাচন করেন ওপেনহাইমারকে। বিজ্ঞান এবং কবিতা দুই-ই বোঝেন ওপেনহাইমার। সংস্কৃত ভাষা জানেন। গীতা সংস্কৃতে পড়েছিলেন ওপেনহাইমার। মুখস্থ হয়ে গিয়েছিল। সে কারণে এই ওপেনহাইমার ১৯৪৫ সালের ১৬ জুলাই, যখন নিউ মেক্সিকোর আলামোগার্ডোর মরুভূমিতে অ্যাটম বোমা প্রথম ফাটে, তখন আগুন আর ধোঁয়া দেখে আবৃত্তি করেছিলেন গীতার শ্লোক— ‘দিবি সূর্যসহস্রস্য ভবেদ্ যুগপদুত্থিতা।/ যদি ভাঃ সদৃশী সা স্যাদ্ ভাসস্তস্য মহাত্মনঃ॥’ (‘যদি আকাশে সহস্র সূর্যের প্রভা যুগপৎ সমুদিত হয়, তা হলে সেই দীপ্তি বিশ্বরূপের প্রভার সদৃশ।’) গীতার একাদশ অধ্যায়, যেখানে বর্ণনা করা হয়েছে শ্রীকৃষ্ণের বিশ্বরূপদর্শনযোগ। কুরুক্ষেত্রে শত্রুশিবিরে আত্মীয়স্বজন দেখে অর্জুন কিংকর্তব্যবিমূঢ়। দ্বিধাগ্রস্ত অর্জুনকে চাঙ্গা করতে শ্রীকৃষ্ণ তাঁর বিশ্বরূপ দেখাচ্ছেন। কেমন সে বিশ্বরূপ? অন্ধ রাজা ধৃতরাষ্ট্রকে সঞ্জয় ব্যাখ্যা করছেন তা। কী বলছেন? আকাশে যদি এক দিন হাজারটা সূর্য ওঠে, তবে যে পরিমাণ আলো ছড়াবে, সেই তেজ তার সমান। নিজের তৈরি যুদ্ধাস্ত্রের সংহারলীলা দেখে গীতার শ্লোক মনে পড়া— চাট্টিখানি কথা নয়। এই বিজ্ঞানীর বিরুদ্ধে তদন্ত!
আসলে পরিস্থিতি তখন অন্য রকম। জোসেফ স্টালিনের নেতৃত্বে কমিউনিজ়ম অগ্রসর হচ্ছে। চিনে মাও জেদঙ-এর নেতৃত্বে কমিউনিস্ট সরকারের প্রতিষ্ঠা। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর থেকেই জার্মানির রাজধানী বার্লিন শহর পুবে ও পশ্চিমে দ্বিধাবিভক্ত। পুব বার্লিন কমিউনিস্টদের অধীন, আর পশ্চিম বার্লিন আমেরিকার। যেন একটা দ্বীপ। সেই পশ্চিম বার্লিনে খাবারদাবার নিয়ে ঢোকা বন্ধ করে দিয়েছে কমিউনিস্টরা। বার্লিন শহরের মতো কোরিয়া দেশটাও জাপানের দখলে থাকার পর দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের শেষে দু’ভাগ হয়ে যায়। কমিউনিস্ট উত্তর কোরিয়া আক্রমণ করে দক্ষিণ কোরিয়াকে। এ দিকে আবার গোদের উপর বিষফোড়া! ১৯৪৫ সালের ১৬ জুলাই যখন আমেরিকা অ্যাটম বোমা ফাটায়, তা ছিল গোপনে। একুশ দিন পরে জাপানের হিরোশিমা শহরে যখন সেই বোমা ফেলা হয়, তা সবাইকে জানিয়ে। আমেরিকার ধারণা ছিল, অ্যাটম বোমা তৈরি করতে প্রস্তুতি দরকার, সে প্রস্তুতির পর সোভিয়েট ইউনিয়ন অ্যাটম বোমা তৈরি করে উঠতে পারবে ১৯৫৩ সালে। কিন্তু আমেরিকান বিমান সোভিয়েট ইউনিয়নের আকাশপথে উড়ে যাওয়ার সময় বাতাসে তেজষ্ক্রিয় পদার্থ শনাক্ত করে ১৯৪৯ সালেই। মানে, স্টালিনের দেশ গোপনে অ্যাটম বোমা ফাটিয়েছে। এত তাড়াতাড়ি স্টালিন ওই বোমা তৈরি করলেন কী করে? রহস্য ফাঁস হল ১৯৫০ সালের ২৭ জানুয়ারি।
ও দিন লন্ডনের ওয়ার অফিসে গিয়ে পূর্ব জার্মান বিজ্ঞানী ক্লউস ফুক্স নিজে জানালেন, “হ্যাঁ, আমি কমিউনিজ়মকে ভালবেসে সোভিয়েট ইউনিয়নকে জানিয়ে দিয়েছি আমেরিকার বোমা বানানোর কৌশল।” ফুক্স কাজ করছিলেন ওই প্রকল্পে। আমেরিকা যতই চেষ্টা করুক অ্যাটম বোমা তৈরির খবর গোপন রাখার, গুপ্তচর মারফত সব জানেন স্টালিন। মায় অ্যাটম বোমার নকশা পর্যন্ত!
আন্তর্জাতিক পরিস্থিতি কমিউনিস্টদের অনুকূল। জোসেফ স্টালিনের অ্যাটম বোমা বিস্ফোরণ। আমেরিকা ভীতসন্ত্রস্ত। দেশ এখন কী করবে? আর এক যুদ্ধ শুরু। যার নাম কোল্ড ওয়ার। ফুক্স জবানবন্দি দেওয়ার পর প্রেসিডেন্ট হ্যারল্ড এস ট্রুম্যান ঘোষণা করলেন, আমেরিকা তৈরি করবে অ্যাটম বোমার চেয়ে হাজার গুণ বেশি বিধ্বংসী হাইড্রোজেন বোমা। আর, উইসকনসিন রাজ্য থেকে নির্বাচিত রিপাবলিকান সেনেটর জোসেফ রেমন্ড ম্যাককার্থি ডাক দিয়েছেন, সরকারি পদে কমিউনিস্টদের প্রতি সহানুভূতিশীল যত জন আছেন, সবাইকে এক ধার থেকে বরখাস্ত করা হোক। ফেডারেল ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন (এফবিআই)-এর প্রথম ডিরেক্টর জন এডগার হুভারও মনে করেন, প্রশাসনে অনেক কমিউনিস্ট ঢুকে আছে। প্রশাসনকে ওঁদের থেকে মুক্ত করা দরকার। অনেকের বিরুদ্ধে তদন্ত করান তিনি। আইনস্টাইনের বিরুদ্ধে তদন্ত করেও রীতিমতো ফাইল তৈরি করেন। ম্যাককার্থির কমিউনিস্ট-ঘৃণার নাম হয়ে যায় ম্যাককার্থিজ়ম। এই ঘৃণা অনেকটা হিটলারের আমলে জার্মানিতে ইহুদি-বিদ্বেষের মতো। কত ইহুদি বিজ্ঞানীর যে এফবিআই ফাইল তৈরি করেছিলেন হুভার, তার ইয়ত্তা নেই। আইনস্টাইনের বিরুদ্ধে ফাইল, মূল কারণ তিনি জাতে ইহুদি। ওপেনহাইমারও আইনস্টাইনের মতোই ধর্ম মানতেন না, কিন্তু তাঁর জন্মইহুদি পরিবারে।
অবস্থা এমন জায়গায় গিয়ে দাঁড়ায় যে, ১৯৫২ সালের নির্বাচনে একটা প্রধান ইস্যু হয়ে দাঁড়ায় প্রশাসনে কমিউনিস্টদের কারা বেশি সহ্য করে— ডেমোক্র্যাট না রিপাবলিকান? এত দিন ক্ষমতায় থাকা ডেমোক্র্যাটদের সরিয়ে ক্ষমতা দখল করেন রিপাবলিকান পার্টির ডেভিড ডিউইট আইসেনহাওয়ার। রিপাবলিকান পার্টি ক্ষমতায় আসার ফলে সুবিধে হয় ম্যাককার্থি এবং হুভার-এর। ১৯৫৩ সালের ৭ নভেম্বর হুভারকে চিঠি লেখেন মার্কিন কংগ্রেসের ‘জয়েন্ট কমিটি অন অ্যাটমিক এনার্জি’র এগজ়িকিউটিভ ডিরেক্টর উইলিয়াম লিসকাম বোর্ডেন। ‘মোর প্রোবাবলি দ্যান নট’ ওপেনহাইমার এক জন ‘সোভিয়েট চর’। ওপেনহাইমার-এর কমিউনিস্ট সংস্থার সঙ্গে খুব দহরম-মহরম। ওঁর অনেক কমিউনিস্ট বন্ধুও আছেন। আর, ওপেনহাইমার হাইড্রোজেন বোমার বিরোধিতা করেছেন।
হ্যাঁ, হিরোশিমা-নাগাসাকি শহরে অ্যাটম বোমার ধ্বংসলীলা দেখে ব্যথিত হয়েছিলেন ওপেনহাইমার। অথচ, বোমা ফেলার আগে যখন ভাবা হচ্ছে, ফাঁকা জায়গায় বোমাটা ফাটিয়ে জাপানকে আত্মসমর্পণে বাধ্য করা যায় কি না, তখন ওপেনহাইমার কিন্তু বলেছিলেন যে, বোমাটা জাপানের কোনও লোকালয়ে ফাটানো হোক। বোমা ফেলার হুকুম তিনি দেননি, দিয়েছিলেন প্রেসিডেন্ট ট্রুম্যান। প্রেসিডেন্টের টেবিলে লেখা থাকত ‘দ্য বাক স্টপস হিয়ার’। অর্থাৎ, সব কিছুর মূলে আমি। হিরোশিমা-নাগাসাকিতে অ্যাটম বোমা ফেলা কতখানি আমেরিকার শক্তি-প্রদর্শন, আর কতখানি জাপানকে আত্মসমর্পণে বাধ্য করতে, সে বিতর্ক এখনও চালু। দ্বিতীয় মতের সমর্থকরা মনে করেন, ১৯৪৫ সালের ৬ অগস্টের আগে জাপানি সেনারা যুদ্ধ বন্ধ না করায় মারা যাচ্ছিল শয়ে-শয়ে আমেরিকান সেনা। সেই জন্য ট্রুম্যান অ্যাটম বোমা ফেলার হুকুম দেন। সেই ট্রুম্যানের সঙ্গে অ্যাটমিক এনার্জি কমিশনের বড় কর্তা ডেভিড এলি লিলিয়েনথালকে ধরে ১৯৪৫ সালের অক্টোবরে দেখা করেছিলেন ওপেনহাইমার। তিনি তখন বিবেকদংশনে ভুগছেন। তাই ওপেনহাইমার ট্রুম্যানকে বলেন, “বিজ্ঞানীদের হাত রক্তমাখা।” ওঁর কথা শুনে ট্রুম্যান নাকি পকেট থেকে রুমাল বার করে বলেন, “মুছে নিন।” ট্রুম্যান যে ওপেনহাইমারের উপর চটে গিয়েছিলেন, তা বোঝা যায়। লিলিয়েনথালকে বলেছিলেন, “ওই শুয়োরের বাচ্চাটাকে আর আমার সামনে এনো না। ও ছিঁচকাদুনে বিজ্ঞানী!”
হুভার বোর্ডেন-এর চিঠি পত্রপাঠ পাঠিয়ে দিলেন প্রেসিডেন্ট আইসেনহাওয়ার-এর কাছে। তিনি নির্দেশ দিলেন, ওপেনহাইমার এবং পরমাণুর গোপন নথিপত্রের মধ্যে নিশ্ছিদ্র দেওয়াল তুলে দিতে। তখনও অ্যাটমিক এনার্জি কমিশনের জেনারেল অ্যাডভাইজ়রি কমিটি (জিএসি)-র চেয়ারম্যান ওপেনহাইমার। মানে, আমেরিকা কেন হাইড্রোজেন বোমা বানাচ্ছে, সে বিষয়ে বিরুদ্ধ মতের প্রবক্তা তিনি। তাঁর বক্তৃতাসভায় ভিড় উপচে পড়ছে। লোকে জানতে চায় কেন সোভিয়েট ইউনিয়নের অ্যাটম বোমার পরিপ্রেক্ষিতে আমেরিকার হাইড্রোজেন বোমা বানানো উচিত নয়। জিএসি-র অন্যান্য সদস্যের মধ্যে আছেন এডওয়ার্ড টেলার। ওপেনহাইমার-এর কট্টর সমালোচক। হাঙ্গেরির বিজ্ঞানী। ও দেশের বিজ্ঞানী লিয়ো ঝালার্ডকে চিনতেন আইনস্টাইন। তাঁর প্ররোচনাতেই আইনস্টাইন চিঠি লেখেন প্রেসিডেন্ট রুজ়ভেল্টকে। ঝালার্ডকে আইনস্টাইনের কাছে গাড়ি ড্রাইভ করে নিয়ে গিয়েছিলেন টেলার। গর্ব করে বলতেন, “আমি ‘ড্রাইভ’ (চালনা) করেছি অ্যাটম বোমা।” এই টেলার ওপেনহাইমার-এর ওপর খেপে গিয়েছিলেন কেন? তিনি তাঁকে অ্যাটম বোমা তৈরির প্রকল্প ম্যানহাটান প্রজেক্টের তাত্ত্বিক প্রধান করেননি বলে। ওপেনহাইমার টেলার-এর বদলে বেছে নেন হান্স আলব্রেখ্ট বেদে-কে।
ওপেনহাইমার একেবারে নির্দোষ ছিলেন না। একের পর এক জীবনীকার তাঁকে দেখিয়েছেন ‘অ্যারোগ্যান্ট’ হিসেবে। সেমিনারে তিনি বসতেন প্রথম সারিতে। প্রশ্নোত্তর-পর্বে চোখা-চোখা প্রশ্ন ছুড়ে দিতেন বক্তার দিকে। উদ্দেশ্য অবশ্যই বক্তার জ্ঞানবিচার, তার চেয়েও বেশি থাকত তিনি নিজে কতটা জানেন, তা জাহির করা। নতুন গবেষকদের প্রথম সাক্ষাতে জিজ্ঞাসা করতেন, “হোয়াট’স নিউ ইন ফিজ়িক্স?” রে মংক যে জীবনী লিখেছেন ওপেনহাইমার-এর, তার নাম ‘রবার্ট ওপেনহাইমার: আ লাইফ ইনসাইড দ্য সেন্টার’। মংক দেখিয়েছেন, ওপেনহাইমার কী ভাবে পাদপ্রদীপের আলোয় থাকতে ভালবাসতেন। আর এক জীবনীকার জেরেমি বার্নস্টাইন। তিনি যে জীবনী লিখেছেন, তার নাম ‘ওপেনহাইমার: পোর্ট্রেট অব অ্যান এনিগমা’। ওই বইতে বার্নস্টাইন বর্ণনা করেছেন ওঁর সঙ্গে ওপেনহাইমার-এর প্রথম সাক্ষাৎ। ম্যানহাটান প্রজেক্টে অ্যাটম বোমা তৈরির পর ওপেনহাইমার ফিরে গিয়েছিলেন তাঁর নিজের জায়গা বার্কলে বিশ্ববিদ্যালয়ে। সেখান থেকে ১৯৪৭ সালে তিনি যোগ দেন প্রিন্সটনের ইনস্টিটিউট অব অ্যাডভান্সড স্টাডি (আইএএস)-তে। যেখানে আছেন আইনস্টাইন। বার্নস্টাইন নতুন রিসার্চ ফেলো হিসেবে যোগ দিয়েছেন আইএএস-এ। প্রথম দিন। নিয়ম অনুযায়ী, তাঁর দেখা করার কথা ইনস্টিটিউটের ডিরেক্টর ওপেনহাইমার-এর সঙ্গে। ডিরেক্টরের তলব এল। বার্নস্টাইন যখন ঘরে ঢুকছেন, তখন ওপেনহাইমার টেলিফোনে কথা বলছেন কারও সঙ্গে। টেলিফোনে কথা শেষ করে ওপেনহাইমার বললেন, “কিটির ড্রিঙ্কিং প্রবলেমটা আবার বেড়ে গেছে।” বার্নস্টাইন হতবাক। কিটি কে, তা তাঁর জানার কথা নয়। সম্পূর্ণ অপরিচিতের সামনে বাড়ির সমস্যা উজাড় করে দিতে ওপেনহাইমার-এর বাধল না। তবে, বার্নস্টাইন জানতেন কিটি কে। তিনি ওপেনহাইমারের স্ত্রী ক্যাথরিন ওপেনহাইমার। ১৯৪০ সালে বিয়ে হয়েছিল ওঁদের।
যখন ওপেনহাইমার-এর সিকিয়োরিটি ক্লিয়ারেন্স কেড়ে নেওয়া হল, তখন তিনি ইনস্টিটিউট অব অ্যাডভান্সড স্টাডিতে। অ্যাটমিক এনার্জি কমিশনের চেয়ারম্যান লিউইস লিচেনস্টাইন স্ট্রাউস প্রস্তাব দিলেন, দু’টি রাস্তা খোলা আছে ওপেনহাইমারের সামনে। এক, তিনি চুপচাপ মেনে নেবেন সিকিয়োরিটি ক্লিয়ারেন্স প্রত্যাহার, আর দুই, তিনি ওই সিদ্ধান্তের প্রতিবাদে আপিল করতে পারেন। ওপেনহাইমার বেছে নিলেন দ্বিতীয় পথ, কারণ চুপচাপ মেনে নিলে মনে হবে তিনি দোষী।
অ্যাটমিক এনার্জি কমিশনের পারসোনেল সিকিয়োরিটি বোর্ডে ১৯৫৪ সালের ১২ এপ্রিল থেকে ৫ মে চলল বিচার। স্ট্রাউস নির্বাচন করলেন তিন জন বিচারক। গর্ডন গ্রে, সেনাবাহিনীর প্রাক্তন সচিব; টমাস মরগান, শিল্পপতি; ওয়ার্ড ইভান্স, প্রাক্তন অধ্যাপক। নির্বাচন, বলাই বাহুল্য, পক্ষপাতদুষ্ট। যাতে ওই বিচারকরা ওপেনহাইমারকে সোভিয়েট চর হিসেবে ঠাওরান। স্ট্রাউস অ্যাটমিক এনার্জি কমিশনের উকিল ঠিক করলেন রজার রবকে। দুঁদে উকিল তিনি। অন্য দিকে ওপেনহাইমার পেলেন লয়েড গ্যারিসনকে। ওপেনহাইমার যাঁর যাঁর কাছে যেতে পারেন, তাঁদের প্রত্যেকের টেলিফোনে আড়ি পাতা শুরু হল।
মোট ৩৮ জনের সাক্ষ্য নেওয়া হল, ১০ জন ওপেনহাইমার-এর পক্ষে, বাকি ২৮ জন বিপক্ষে। প্রায় ৭০ বছর আগে সেই বিচারের সাক্ষীদের ট্রানস্ক্রিপ্ট (‘ইন দ্য ম্যাটার অব জে রবার্ট ওপেনহাইমার’, এমআইটি প্রেস, ১৯৭১) সাড়ে সাত লক্ষ শব্দ। যে ২৮ জন সাক্ষী ওপেনহাইমারের বিপক্ষে বলতে আসবেন, তাঁদের তালিকা চাইলেন গ্যারিসন। রব তাঁকে দিলেন না।
১৩ এপ্রিল ‘দ্য নিউ ইয়র্ক টাইমস’ প্রথম পাতায় ছাপল ওপেনহাইমার-এর বিচারের খবর। গোটা পৃথিবী জানল, যে মানুষটা বানিয়েছেন অ্যাটম বোমা, তাঁর আনুগত্য আজ প্রশ্নের সম্মুখীন। গ্রে চটে গেলেন। তিনি সন্দেহ করলেন ওপেনহাইমারকে। তিনি ফাঁস করেছেন খবর। নাটের গুরু হোয়াইট হাউসের প্রেস সেক্রেটারি জেমস হ্যাগার্টি। ওঁর স্বার্থ হোয়াইট হাউসের ইমেজ রক্ষা— দেখো, হোয়াইট হাউস কাউকে রেয়াত করে না।
বিচারে ওপেনহাইমারের বিরুদ্ধে উঠল তাঁর কমিউনিস্ট-সংসর্গের প্রশ্ন। রব তাঁকে জেরা করে যে উত্তর পেলেন, তা এ রকম—
আপনি কি আমেরিকান কমিউনিস্ট পার্টির সদস্য?
না।
আপনি হাকোন শেভালিয়ের-এর ঘনিষ্ঠ ছিলেন?
হ্যাঁ।
তিনি কি পার্টি সদস্য?
জানি না।
আপনি তা হলে কর্নেল বরিস প্যাশ-কে মিথ্যে বলেছিলেন?
হ্যাঁ।
আপনি কর্নেল প্যাশকে আর কী বলেছিলেন?
বলেছিলাম যে, জর্জ এলটেনটন বোমা তৈরির প্রকল্পে যুক্ত তিন জন বিজ্ঞানীর কাছে গুরুত্বপূর্ণ তথ্য চেয়েছিলেন সোভিয়েটকে পাচার করার জন্য।
কেন আপনি এই গাঁজাখুরি গল্পটা ছড়িয়েছিলেন?
কারণ আমি ইডিয়ট ছিলাম।...
কিটিকে বিয়ে করার আগে ওপেনহাইমারের প্রেমিকা ছিলেন জিন তাতলক নামে এক মহিলা। মহিলা কমিউনিস্ট পার্টির সদস্যা ছিলেন। এমনকি বিয়ের পরেও তাঁর সঙ্গে রাত কাটিয়েছিলেন ওপেনহাইমার। তিনি তা অস্বীকারও করলেন না বিচারকালে। তবে যা অস্বীকার করলেন তা হল, ওপেনহাইমার-এর ভাই ফ্র্যাঙ্ক, কিটি এবং তাঁর বোন কমিউনিস্ট পার্টির সদস্য বা সদস্যা ছিলেন।
সবচেয়ে খারাপ সাক্ষ্য দিলেন টেলার। রব তাঁকে প্রশ্ন করেন, “আপনি মনে করেন কি করেন না যে, ওপেনহাইমার আমেরিকার নিরাপত্তার ক্ষেত্রে বিপজ্জনক?” উত্তরে তিনি বলেন, “অনেক বিষয়ে আমাদের মতান্তর হয়েছে, কারণ আমার মনে হয়েছে, উনি বড় জটিল। সে ক্ষেত্রে আমার মনে হয়েছে, দেশের স্বার্থ ওঁর হাতে না গিয়ে, অন্য কারও হাতে গেলে— যে হাত আমি বেশি বুঝতে পারি, সুতরাং বেশি বিশ্বাসও করি— আমি খুশি হতাম।”
এর পর অ্যাটমিক এনার্জি কমিশনের পারসোনেল সিকিয়োরিটি বোর্ডের তরফে গ্রে সুপারিশ করেন, ওপেনহাইমার-এর সুরক্ষা কবচ কেড়ে নিতে।
দেখেশুনে মনে হচ্ছে, আইনস্টাইন যা বলেছিলেন, তা-ই ঠিক। ১৯৫৪ সালের ১২ এপ্রিল। ওপেনহাইমার তখন প্রিন্সটনে। আইনস্টাইন তখন যে প্রতিষ্ঠানে গবেষণা করছেন, তার প্রধান ওপেনহাইমার। ‘দ্য নিউ ইয়র্ক টাইমস’ থেকে ঘন ঘন ফোন আসছে। আইনস্টাইনকে চাই। হাজার হোক, তাঁর ইনস্টিটিউটের ডিরেক্টরের বিচার বসছে। তাঁর ‘কমেন্ট’ চাই। আইনস্টাইনের পরিচিত ইনস্টিটিউটের তরুণ বিজ্ঞানী আব্রাহাম পায়াস। তিনি আইনস্টাইনের সঙ্গে দেখা করে ‘দ্য নিউ ইয়র্ক টাইমস’-এর হন্যে হয়ে তাঁকে খোঁজাখুঁজির কারণটা বললেন। পায়াস লিখেছেন, আইনস্টাইন তাঁকে বললেন, “ওপেনহাইমার যেন অ্যাটমিক এনার্জি কমিশনের পারসোনেল সিকিয়োরিটি বোর্ডের বিচারকদের গিয়ে বলেন, তোমরা বুদ্ধু। ব্যস!”