পুরুলিয়ার নাচনি আর তাঁদের রসিকদের নাগরিক সমাজ বেশির ভাগ সময় বাঁকা চোখেই দেখেছে
Folk Culture

নাচনিদের পুনর্বাসন কেন্দ্রে এখন শুধুই হতাশা

নাচনিদের বাসস্থান, বৃদ্ধাবাস নিয়ে পুরুলিয়ায় পুনর্বাসন কেন্দ্র গড়ে ওঠার কথা ছিল। আজও তা ফাঁকা, অর্ধসমাপ্ত এক বাড়ি মাত্র।

Advertisement

প্রবীর সরকার

শেষ আপডেট: ২৩ মে ২০২১ ০৭:১৪
Share:

নর্তকী: তারা দেবী ও সরস্বতী সিং পাতর (ডান দিকে)। এই লোকশিল্পের মতো এঁদের ভবিষ্যৎও অনিশ্চিত।

যে নাচে সে-ই ‘নাচনি’— এমন সারল্যে নাচনির প্রকৃত পরিচয় নেই। সমাজ-নিন্দিত, আপাত-ব্রাত্য এই নৃত্যকলায় নাচ এবং নাচের শিল্পী, উভয়েই নাচনি। মানভূম-ধলভূমে যা নাচনি, বীরভূমে তা-ই ‘ঝুমুর’। পুরুলিয়ায় অবশ্য ঝুমুর বলতে বোঝায় গানকেই। সে গানের নানা শ্রেণি, নানা উপলক্ষ, নানা রস। একটা ধারার নাম ‘নাচনিশালিয়া ঝুমুর’। অতএব নাচনি আর ঝুমুরের সম্পর্ক পারস্পরিক সহযোগিতার, যেন একে অপরের হাত ধরে চলে।

Advertisement

কোথা থেকে এল নাচনির এই সংস্কৃতি? কত দিন আগে? কোন পথে এর বিবর্তন? এ নাচের ব্যাকরণ কী? এ সব প্রশ্নের উত্তর খুঁজেছেন অনেকেই। কেউ এর উৎস পেয়েছেন মনসামঙ্গলে, কেউ বা বৈষ্ণবীয় কীর্তনের মধ্যে। তারাশঙ্করের ‘কবি’ উপন্যাসের কেন্দ্রে রয়েছে বীরভূমের মল্লারপুরের ঝুমুরদল। পণ্ডিত হরেকৃষ্ণ সাহিত্যরত্নের মতে, মহাপ্রভু চৈতন্যদেবের আবির্ভাবের ঢেউ স্তিমিত হয়ে গেলে পশ্চিমবঙ্গ
থেকে বহু কীর্তনিয়ার দল পূর্ববঙ্গে যেত অর্থোপার্জনের জন্য। এদের মধ্যে কিছু কিছু শিল্পী কালে কালে বৈষ্ণবের ভক্তিবাদ ছেড়ে আদিরসকেই প্রাধান্য দিয়েছে। উদ্দেশ্য ছিল, শ্রোতাদের মনোরঞ্জন। এরাই ক্রমশ পদাবলি ছেড়ে খেউর ধরেছে, টপ্পা ছেড়ে ঝুমুর ধরেছে, অবলম্বন করেছে খেমটা নাচ।

সেই খেমটারই বিবর্তন আজকের নাচনি, এমন ইঙ্গিতও দিয়েছেন কেউ কেউ। ‘নাচনিরা পুরোপুরি গ্রাম্য ও অসংস্কৃত বাইজি’— এই হল পণ্ডিতদের সিদ্ধান্ত। তবু এই লোকায়ত শিল্পের শিকড় খোঁজার চেষ্টা করেন অনেকেই। গল্প-উপন্যাস, নাটক-সিনেমা হয় তাদের নিয়ে। সরকার শিল্পীর স্বীকৃতি দিয়েছে, শিল্পী-ভাতাও পাচ্ছেন অনেকে। তাঁদেরই জন্যে নানা পরিকল্পনা নিয়ে পুরুলিয়ার উপকণ্ঠে গড়ে উঠেছিল নাচনি পুনর্বাসন কেন্দ্র। নাচনিদের বাসস্থান, কর্মশালা, বয়স্ক নাচনিদের বৃদ্ধাবাস, যৌথ দিনযাপন... স্বপ্ন ছিল অনেক। পাশে ছিল দুর্বার মহিলা সমিতি। দেখতে দেখতে দেড় দশক পেরিয়ে গেল, কিন্তু ফাঁকা মাঠের মধ্যে অর্ধসমাপ্ত সেই বাড়ির পলস্তারাবিহীন দেওয়াল জুড়ে এখন শুধুই হতাশার আলপনা।

Advertisement

‘নহ মাতা নহ কন্যা, নহ বধূ সুন্দরী রূপসী’— কথাগুলো নির্মম সত্য নাচনিদের জন্য। গ্রাম্য অসংস্কৃত অশ্লীল নৃত্যকলা নিয়ে জীবন, তাই ব্রাত্য হয়ে ওঠার দুর্ভাগ্য গোড়া থেকেই ছিল নাচনিদের সঙ্গে। তবু সম্প্রতি দৃষ্টি পড়েছে নাগরিক রসিকজনের। সুব্রত মুখোপাধ্যায়ের উপন্যাস বা রুদ্রপ্রসাদ সেনগুপ্তের নির্দেশনায় নাটক ‘নাচনি’, রসিকদের সমস্যা নাগরিক সংস্কৃতির মঞ্চে নিয়ে এসেছে, তবু তাতে বাস্তব অবস্থার হেরফের ঘটেনি।

নাচনির সঙ্গে যাঁরা কিঞ্চিৎ পরিচিত, তাঁরাই জানেন, ‘রসিক’ শব্দের অর্থ এখানে একেবারে আলাদা। নাচনির নৃত্য ও সঙ্গীতের গুরু তিনি, তার পালক-পোষক, অভিভাবক, প্রভু, দেহসঙ্গী— এক কথায় সবই। অচ্ছেদ্য উভয়ের পারস্পরিক নির্ভরতা। রসিকই নৃত্য-পরিচালক। আসরের সূত্রধর, সঙ্গীতশিল্পী, প্রয়োজনে বাদ্যযন্ত্রীও তিনিই। লোকসংস্কৃতির গবেষকদের কেউ কেউ সাঁওতাল মাদলিয়াদের মধ্যে রসিকের আদিরূপ কল্পনা করেছেন, কিন্তু সাংস্কৃতিক মিশ্রণ কিছু থাকলেও ঝুমুর-নাচনির কোনওটাই আদিবাসী সংস্কৃতি নয়। পশ্চিম সীমান্ত-রাঢ়ে যাঁরা রসিক হয়ে উঠেছিলেন, তাঁদের অধিকাংশই ছোট ছোট সামন্তপ্রভু।

অর্থ-সামর্থ্যের জোর আর কিশোরী-তরুণীর প্রতি জৈবিক আকর্ষণের পালাগান বাংলার দুই প্রান্তেই। বাংলাদেশের প্রয়াত কথাশিল্পী হুমায়ূন আহমেদ তাঁর উপন্যাস ‘ঘেঁটুপুত্র কমলা’কে সিনেমায় রূপান্তরিত করেছিলেন। পূর্ব বাংলার জমিদারেরা কোনও বালককে কী ভাবে নিজের শয্যাসঙ্গী করে নিজেদের মহলে রুদ্ধ করে রাখতেন, তা নিয়ে উপন্যাস।

কিন্তু সে তো ভূস্বামী-কাহিনি। আজকের পুরুলিয়াতেই এমন উদাহরণ আছে, যেখানে বেশ খানিকটা ভূমির অধিকারী সামন্ত-পুরুষ নাচনি-ঝুমুরের মোহে একটু একটু করে সব হারিয়ে কেবল রসিক হয়েই দিনযাপন করেছেন। রূপ-যৌবন শারীরিক সামর্থ্য ফুরোলে নাচনিদের জীবন দুর্বিষহ হয়ে ওঠে, এ কথা বহুচর্চিত। কিন্তু তাঁদের রসিকও শেষ জীবন সুখে কাটিয়েছেন, এমন শোনা যায় না। নাচনির সঙ্কট আর রসিকের সঙ্কট এক সুতোয় বাঁধা।

লোকপুরাণে উল্লেখ আছে নাচনিদের। কেতকাদাস ক্ষেমানন্দের ‘মনসাবিজয়’ কাব্যে অসংখ্য বার ‘নাচনী’ বলা হয়েছে বেহুলাকে। পুরুলিয়ার কবি চৈতন্যদাস মণ্ডলের মনসামঙ্গলেও বেহুলা বস্তুত নাচনিই। মঙ্গলকাব্যের ভেতরের খবর যাঁরা রাখেন, তাঁরা জানেন, এখানে আছে স্বর্গভ্রষ্ট দেবতাদের মর্ত্যে আসা এবং দেব-দেবীকে মর্ত্যে প্রতিষ্ঠা করিয়ে দেওয়ার পুণ্যে স্বর্গ-পুনরুদ্ধারের কাহিনি। ঊষা-অনিরুদ্ধ মর্ত্যে এসেছিলেন বেহুলা-লখিন্দর হয়ে। চৈতন্যদাস মণ্ডল লিখছেন,

‘বাণকন্যা ঊষা অনিরুদ্ধের রমণী।/ হরশাপে হইয়াছে বেহুলা নাচনী।’

শম্ভু মিত্রের ‘চাঁদবণিকের পালা’-তেও স্পষ্ট সে কথা। সেখানে নববিবাহিত লখিন্দর স্বপ্ন দেখেছে স্ত্রীকে নিয়ে, ‘নাচুনী বেহুলা তুমি নিছনি কামিনী, দ্বীপ হয়ো, অপরূপ দ্বীপ হয়ো আমার জীবনে।’ কিন্তু দেবসভায় নৃত্যপ্রদর্শনের পরে সব কিছু ফিরে পেয়েও অপরাধবোধে বেহুলার আক্ষেপোক্তি, ‘তেত্রিশ কোটি সেই কামোৎসুক চোখের সমুখে যে নাচ নেচেছি... সে বড় অশ্লীল। কোথাও তা শিখি নাই। দেখি নাই কোথাও।... আর সেই নাচের ভিতরে সায় বণিকের কন্যা, সেই যে বেহুলা... সেই বেহুলা মরে গেল।’

নাচনিদের সামাজিক, অর্থনৈতিক বা মনস্তাত্ত্বিক সঙ্কট নিয়ে আজকাল অনেকেই সরব। কিন্তু রসিকদের নিয়ে? অনেকের চোখে এরাই খলনায়ক। নাচনিকে মর্যাদাহীন শোষণ এবং নাচনির উপার্জিত অর্থে সুখভোগ— এমনই নানা অভিযোগে তারা অভিযুক্ত। উপার্জিত অর্থ নাচনি সত্যিই তুলে দেয় রসিকের হাতে। অনেকে স্বেচ্ছায় দেয়, অনেকে অভ্যেসে। রসিকেরও প্রচ্ছন্ন যুক্তি আছে। সেই বালিকা বয়স থেকে অভিভাবক হিসেবে নাচ-গান শিখিয়ে, প্রতিপালন করে এক জন নাচনিতে যে লগ্নি সে করেছে, এ বার তার লভ্যাংশ ঘরে তোলার সময়। নিছক পুরুষতান্ত্রিকতা নয়, এ তত্ত্ব এক রকম অর্থনীতিরও!

রসিককে ‘ভিলেন’ করা খুব সহজ, কিন্তু অনেকেই মনে রাখেন না, রসিকের জন্যই নাচনির অস্তিত্ব-সহ সমগ্র শিল্পটিই বেঁচে আছে। “অল্পবয়সি মেয়েরা আজকাল আর কেউ আর নাচনি হতে চায় না...” কথাটা নাচনি পুনর্বাসন কেন্দ্রের প্রৌঢ়া নাচনি পস্তুবালার। পাশে রসিক বিজয়, তাঁর অস্ফুট কণ্ঠে শোনা যায় পরের কথাটি, “রসিক হতেও কেউ চায় না গো।”

রসিককেও ঘর ছাড়তে হয় নাচনির মতো। সামাজিক অগৌরবের যন্ত্রণা ভোগ না করলেও ঘর এবং বাইরের দ্বন্দ্ব তার অবিরত। নাচনির যৌবনের আকর্ষণ তাঁর কাছে সত্য, কিন্তু শিল্পের টান আরও বড় সত্য। রসিকদের স্পষ্টত দু’টি শ্রেণি— এক দল শিল্পের অনুরাগী, অপর দল দেহের। পুরুলিয়ার এই প্রান্তভূমিতে নাচনির উপার্জিত অর্থ রসিক ভোগ করেন, এ যেমন সত্য, তেমনই নাচনির রসিক হয়ে অনেকে সর্বস্ব খুইয়েছেন, এ-ও সত্য।

নাচনি নাচের উদ্ভবই হয়েছে সামন্ত ভূস্বামীদের পৃষ্ঠপোষকতায়, এমন ধারণা যথেষ্ট জোরালো। তবে অনেকে নাচনি পোষণ করলেও রসিক হননি। আবার অনেক ঝুমুর কবি রসিক হয়েছিলেন শিল্পের আকর্ষণে। কিন্তু এমন রসিকও আছেন, যাঁরা গান বাঁধেন না, প্রচলিত গান দিয়েই আসর মাতান। তাঁরা পেশাদার রসিক। এঁদের সংখ্যাই বেশি এবং এঁরাই নাচনির উপার্জিত অর্থের সিংহভাগ ভোগ করেন। বৃদ্ধা নাচনি ভিক্ষাজীবী হয় এঁদেরই জন্য।

নাচনির জীবন সুখের নয়। তবু যত দিন শরীরের চমক থাকে, দর্শক টানার ক্ষমতা থাকে, তত দিন আদর মেলে রসিকের কাছে। কিন্তু অর্থনৈতিক স্বাধীনতা বলে কিছু থাকে না। তাঁদের দুর্বলতার আর একটি কারণ, প্রায় সকলেই নিরক্ষর। অর্জিত জ্ঞান সবটাই শুনে বা দেখে। আরও একটি দুর্ভাগ্য, এক জন রসিকের একাধিক নাচনি থাকতে পারে, কিন্তু নাচনির ক্ষেত্রে এ নিয়ম প্রযোজ্য নয়। রসিক বদলের প্রথা নাচনিদের মধ্যে আছে, কিন্তু একই সঙ্গে একাধিক রসিকের কাছে থাকা যায় না।

তবু সব রসিকের জীবনেই শেষের দিনগুলো বেদনার। এঁরাও শিল্পী। গৃহী মানুষের মতো ভবিষ্যতের নিরাপত্তার কথা এঁরা কেউ ভেবেছেন বলে মনে হয় না। নাচনিদের ঘরে ফেরার পথ রুদ্ধ হলেও রসিকের ক্ষেত্রে তা নয়। বৃদ্ধ রসিক কেউ কেউ ঘরে ফিরে গেছেন, স্ত্রী-পুত্র-পরিজনদের সঙ্গে জীবনের শেষ দিনগুলো অতিবাহিত করেছেন, এমন শোনা যায়, কিন্তু ভাঙনের দাগ মেলায় না। জানা যায় না, পারিবারিক সুখ সত্যিই তারা কতটা উপভোগ করেন।

নাচনির মতো এতটা না হলেও রসিকের উত্তর-জীবনও বেদনার। নাচনিদের কথা অনেকেই বলেছেন, কিন্তু রসিকদের কথা? তাঁদের দিনযাপন? তাঁদের স্বপ্ন ও স্বপ্নভঙ্গের কথা? সে কথা লেখা হয় না। মনে রাখা হয় না যে, রসিক না থাকলে নাচনিও নেই। তাই দিনশেষে নাচনি-রসিক সকলেই অন্ধকারে নিমজ্জিত। তাঁদের ভবিষ্যৎও।

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement