সুরশিল্পী: হেমন্ত মুখোপাধ্যায় ও লতা মঙ্গেশকর
কলকাতা থেকে বম্বে এসেছেন এক সুরকার। নিজের সুরে প্রথম হিন্দি ছবিতে গান গাওয়াতে চাইলেন লতা মঙ্গেশকরকে দিয়ে। শুনে প্রযোজনা সংস্থার মালিক বললেন, “লতা এখানে আসবেন না, কর্তৃপক্ষের সঙ্গে তাঁর সম্পর্ক ভাল নয়।” সুরকার যদি ব্যক্তিগত উদ্যোগে তাঁকে নিয়ে আসতে পারেন, তাতে সংস্থার আপত্তির কিছু নেই। অগত্যা সুরকার নিজেই চলে গেলেন লতাজির বাড়ি। নিজের পরিচয় দিতে গিয়ে অবাকই হতে হল তাঁকে। লতা মঙ্গেশকর বললেন— “আপনাকে আমি চিনি, নাম শুনেছি। আপনি যখন নিজে এসেছেন, আমি আপনার জন্যই গাইব।” পারিশ্রমিক পর্যন্ত নিতে চাইলেন না। কিন্তু ফিল্মিস্তান-এ গিয়ে কাজ করতে তাঁর অনিচ্ছা। সুরকার প্রস্তাব দিলেন, তাঁর বাড়িতে এসে গান তোলার। সৌজন্য ও আন্তরিকতায় লতা মঙ্গেশকর তাতেই রাজি। দাদা-বোনের মতো ঘরোয়া সম্পর্কের সূত্রপাত এ ভাবেই। গান তোলা হল। এ বার রেকর্ডিং-এর পালা।
ছায়াছবির একটি দৃশ্যে বিপ্লবীরা যুদ্ধের প্রস্তুতি নিয়ে বেরোচ্ছেন ঘোড়ায় চড়ে। ঘোড়সওয়ারির সঙ্গে তাল রেখে বাজবে দেশাত্মবোধক গান। মূল গান অতি পরিচিত, একাধিক শিল্পী বেসিক রেকর্ডে বা রেডিয়োয় গেয়েছেন। হিন্দি চলচ্চিত্রেও আগে গানটি ব্যবহৃত হয়েছে, ‘অমর আশা’ (১৯৪৭), ‘আন্দোলন’ (১৯৫১)-এর মতো ছায়াছবিতে। কিন্তু এ বার যে সুর দিয়েছেন সুরকার, তা অন্য ধরনের। সেই সুরে গানটি গাইছেন লতা মঙ্গেশকর। একের পর এক টেক দিয়ে যাচ্ছেন, কিন্তু চলচ্চিত্র পরিচালকের আর কিছুতেই পছন্দ হচ্ছে না। তাঁর বক্তব্য, ‘গানে প্রাণ পাচ্ছি না।’ সুরকারও পড়েছেন রীতিমতো অস্বস্তিতে, এত বার ‘টেক’ করতে হলে বিরক্ত হয়ে লতাজি চলে যাবেন না তো? কিন্তু লতা মঙ্গেশকর পূর্ণ সহযোগিতা করলেন। বললেন, যত ক্ষণ পরিচালকের না পছন্দ হচ্ছে, তিনি গেয়ে যাবেন। শেষ পর্যন্ত একুশ বার ‘টেক’-এর পর মিলল সবুজ সঙ্কেত। এত কাণ্ডের পর গানটি মুক্তি পেল ১৯৫২ সালে, বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের কাহিনি অবলম্বনে নির্মিত, হেমেন গুপ্তর পরিচালনায় হিন্দি ‘আনন্দমঠ’ ছবিতে। সুরকার হেমন্ত কু্মার, অর্থাৎ হেমন্ত মুখোপাধ্যায়। বাকিটা ইতিহাস।
‘আনন্দমঠ’ ছবিটি তখন ‘হিট’ করেনি, কিন্তু ‘বন্দে মাতরম্’ গানের ওই অভিনব সুর ভারতবাসীর দেশপ্রেমের আবেগের সঙ্গে জড়িয়ে গেল অচিরেই।
১৮৭৫ সালের নভেম্বরে গানটি লেখেন বঙ্কিমচন্দ্র। প্রথম প্রকাশ ‘বঙ্গদর্শন’ পত্রিকায়। পরে তিনি এটি ব্যবহার করলেন ‘আনন্দমঠ’ (১৮৮২) উপন্যাসে। পাদটীকায় লেখা ছিল, গানটি মল্লার রাগ, কাওয়ালি তালে বাঁধা। বিষ্ণুপুর ঘরানার সঙ্গীতজ্ঞ যদুভট্ট (যদুনাথ ভট্টাচার্য) এই রাগেই গানটিতে সুরারোপ করে শুনিয়েছিলেন বঙ্কিমচন্দ্রকে, যদিও সে স্বরলিপি প্রকাশ পায়নি। এর পর ১৮৯৬ সালে কলকাতায় আয়োজিত জাতীয় কংগ্রেসের অধিবেশনে গানটির প্রথম দুই স্তবক শোনা গিয়েছিল রবীন্দ্রনাথের সুরে, তাঁরই কণ্ঠে। এতে সুর দিয়েছেন স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ থেকে শুরু করে একাধিক বরেণ্য সুরকার, বিভিন্ন সময়ে। অল ইন্ডিয়া রেডিয়ো-র সংরক্ষণে যে প্রচলিত সংস্করণটি রয়েছে, তা দেশ রাগে আধারিত। পণ্ডিত বিষ্ণু দিগম্বর পালুস্কর সুর দিয়েছিলেন কাফি রাগের আশ্রয়ে। তিমিরবরণ ভট্টাচার্যের দেওয়া সুর ছিল দুর্গা রাগে। দেশকর এবং তিলক কামোদ-আশ্রিত সুরেও গানটি গেয়েছিলেন একাধিক শিল্পী। এই জাতীয় নির্দিষ্ট রাগভিত্তিক সুররচনা সাধারণত স্তোত্র বা বন্দনাগীতির আঙ্গিকে গড়ে ওঠে। কিন্তু হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের সুরে ‘বন্দে মাতরম্’ হয়ে উঠল ‘মার্চিং টিউন’। দেশসেবক ‘সন্তান’দলের যুদ্ধযাত্রার দৃশ্যের নাটকীয় আবেদন এ গানকে আলাদা এক মাত্রা দিয়েছে। সমগ্র কম্পোজ়িশনের মধ্যে ধরা দিয়েছে ভারতীয় রাগ-রাগিণীর নানা ভাবরূপ থেকে শুরু করে গণসঙ্গীতের কোরাস-আবেদন, তার সঙ্গে মিলেছে দেশি-বিদেশি যন্ত্রানুষঙ্গ— সিম্বাল-এর আওয়াজ, কুচকাওয়াজের চলন, পাখোয়াজের বোল, ক্ল্যারিয়োনেট, ফ্লুট আর পাশ্চাত্য ধাঁচের হারমোনির এফেক্ট। শুরুতেই ‘বন্দে মাতরম্’ উচ্চারণে, খানিক বিস্তারিত তানের ব্যবহারে ভৈরবীর চলন। অবরোহী গতিতে নেমে এসে, ওই পদটিকেই বার বার ধ্রুবপদের মতো ব্যবহার করে চৌগুণ দ্রুতলয়ে পুনরাবৃত্তি— যেন দেশমাতার প্রভাতী মঙ্গলারতি আরম্ভ হল। ‘সুজলাং সুফলাং মলয়জ শীতলাং’ অংশেও সেই শক্তি-আরাধনার আনুষঙ্গিক আরতির ভাববাহী ছন্দ। এর মাঝে মাঝে সমবেত কণ্ঠে ‘বন্দে মাতরম্’, ‘বন্দে মাতরম্’ ধ্বনি, যা অনেকটা গণনাট্য-সুলভ বৃন্দগানের উদ্দীপ্ত আবহ তৈরি করে। নিবিষ্ট শ্রোতা ভাবতেই পারেন, সুরকার যে এক সময় গণনাট্যের সাংস্কৃতিক মঞ্চের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন, এ যেন খানিকটা তারই প্রতিফলন। আবার গানের মাঝে মাঝে উঁচু পর্দায় ভেসে আসা ‘মা...’ ডাকের জাদুকরী সুরব্যঞ্জনা— যার সামগ্রিক ‘হারমোনাইজ়েশন’ সেই সময়ের নিরিখে ভারতীয় চিত্রগীতির ধারায় একেবারেই ভিন্ন স্বাদের। পরে ‘মহাবিপ্লবী অরবিন্দ’ ছবিতে শীর্ষসঙ্গীত হিসাবে একেবারে নতুন করে এই গানের সুর দিয়েছিলেন হেমন্ত, তবে তা তেমন প্রচারিত নয়।
‘আনন্দমঠ’ ছবিতে ‘বন্দে মাতরম্’ গানটি ব্যবহৃত হয়েছে একাধিক বার, পুরুষকণ্ঠে এবং নারীকণ্ঠে। যখন নারীকণ্ঠে (লতা মঙ্গেশকর) গাওয়া হচ্ছে, তখন মাঝে মাঝে, বিশেষ করে শেষ স্তবকে ‘মা...’ ডাকের নেপথ্যে পুরুষকণ্ঠে হামিং দিয়েছেন হেমন্ত, আবার পুরুষকণ্ঠে (হেমন্ত) গাইবার সময় পশ্চাৎপটের আবহ তৈরি হয়েছে সমবেত কণ্ঠের হামিং-এ। ‘বন্দে মাতরম্’-এর মতো ঐতিহ্যবাহী গানে এ রকম পরীক্ষামূলক প্রয়োগ খানিকটা পশ্চিমি ছোঁয়া আনলেও, তা স্বদেশি ভাবাবেগের সঙ্গে আশ্চর্য রকম মিলে গিয়েছে।
‘বন্দে মাতরম্’-এর তৃতীয় স্তবকে ‘সপ্তকোটি-কণ্ঠ-কলকল-নিনাদ করালে...’ অংশে পাই আহির ভৈরোঁর ছোঁয়া, আবার গানের মধ্যবর্তী ইন্টারল্যুডে মালকোষের আমেজ। সকাল থেকে রাত্রি— ভারতীয় সঙ্গীতের ধারায় সম্পূর্ণ একটি দিনের যাত্রাপথের ভাব ধরা পড়ছে একটি দেশভক্তিমূলক গানের নব রূপায়ণে। মার্গসঙ্গীতের নির্দিষ্ট পথ থেকে বেরিয়ে এসে গানটি হয়ে উঠছে স্বতন্ত্র এক সাঙ্গীতিক প্রকাশ— যার মধ্যে মিলে যাচ্ছে ধ্রুপদী, প্রগতিবাদী, আধুনিক, দেশি-বিদেশি উপাদান।
১৯৯৭ সালে ভারতের স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী উদ্যাপনের সময় এ আর রহমান একটি ‘ফিউশন’ গানে সুর করলেন, এবং সে গানটিও লতা মঙ্গেশকর গাইলেন। এর কথা, সুর, সঙ্গীত আয়োজন নতুন ভাবেই করা। কিন্তু তার মুখড়ার প্রথমেই তান, মাঝে মাঝে ব্যবহৃত ‘রিফ্রেন’ হিসেবে সুরকার ‘বন্দে মাতরম্, বন্দে মাতরম্’ ধুন আর সেই অবিস্মরণীয় ‘মা...’ বলে ‘পুকার’ আঙ্গিকটি রেখে দিলেন এমন ভাবে, যা সরাসরি ১৯৫২-র ‘বন্দে মাতরম্’-এর সুরের আমেজ বয়ে আনে অমোঘ নস্ট্যালজিয়ার মতো। এ যেন আধুনিক প্রজন্মের পক্ষ থেকে শ্রদ্ধাজ্ঞাপন— পূর্ববর্তী সময়ের এক অবিস্মরণীয়, কালজয়ী সৃষ্টিকে।
২০০২ সালে বিবিসি ওয়ার্ল্ড সার্ভিস-এর সমীক্ষা অনুসারে, সারা বিশ্বে ১৫৫টি দেশ থেকে সংগৃহীত, সবচেয়ে জনপ্রিয় ৭০০০ গানের মধ্যে প্রথম দশে দ্বিতীয় স্থান অধিকার করেছিল ‘আনন্দমঠ’ ছায়াছবির এই ‘বন্দে মাতরম্।’ এই কম্পোজ়িশন এ বার সত্তর বছরে, আর পঁচাত্তর পূর্ণ করতে চলেছে আমাদের দেশের স্বাধীনতা। আবর্তন আর সমন্বয় যেমন সঙ্গীতের ধর্ম, তেমন ইতিহাসেরও।
কৃতজ্ঞতা: অনির্বাণ চক্রবর্তী