ব্যোমকেশ ম্যানিয়া

হঠাৎ যে যেখানে আছে, ব্যোমকেশ নিয়ে ছবি বানাতে লাফিয়ে পড়ল কেন? আর, এই উচ্চণ্ড লাফালাফিতে ব্যোমকেেশর ট্রেডমার্ক বাঙালিয়ানা চোট খেল কি?অজিত ভেবে ভেবে কিছুতেই থই পাচ্ছে না। এমনিতে ‘ভাবুক’ বলে তার বিশেষ সুনাম নেই! ব্যোমকেশ যে দুটো-একটা কেসের প্রাথমিক তদন্তের ভার তাকে দিয়েছিল, প্রত্যেক বারেই সে অনেক মাথা খাটিয়ে ঘোড়ার ডিম ছাড়া কিছুই খুঁজে বের করতে পারেনি! তবুও এই কেসটায় অজিতকে মাথা ঘামাতে হচ্ছে! কারণ ব্যোমকেশ হাত তুলে দিয়েছে। তার পর পুঁটিরামের কাছ থেকে এক ফ্লাস্ক চা আর তিনটে বাংলা, দুটো ইংরেজি খবরের কাগজ বগলে নিয়ে লাইব্রেরি ঘরে গিয়ে ঢুকেছে।

Advertisement

শান্তনু চক্রবর্তী

শেষ আপডেট: ১২ এপ্রিল ২০১৫ ০০:০৫
Share:

ছিল উত্তমকুমার, হয়ে গেল সুশান্ত সিংহ রাজপুত, এ তো হামেশাই হচ্ছে!

অজিত ভেবে ভেবে কিছুতেই থই পাচ্ছে না। এমনিতে ‘ভাবুক’ বলে তার বিশেষ সুনাম নেই! ব্যোমকেশ যে দুটো-একটা কেসের প্রাথমিক তদন্তের ভার তাকে দিয়েছিল, প্রত্যেক বারেই সে অনেক মাথা খাটিয়ে ঘোড়ার ডিম ছাড়া কিছুই খুঁজে বের করতে পারেনি! তবুও এই কেসটায় অজিতকে মাথা ঘামাতে হচ্ছে! কারণ ব্যোমকেশ হাত তুলে দিয়েছে। তার পর পুঁটিরামের কাছ থেকে এক ফ্লাস্ক চা আর তিনটে বাংলা, দুটো ইংরেজি খবরের কাগজ বগলে নিয়ে লাইব্রেরি ঘরে গিয়ে ঢুকেছে।

Advertisement

ব্যাপারটা কী? গত কয়েক মাস ধরেই দেখা যাচ্ছে, দেশ জুড়ে ডেঙ্গু-ম্যালেরিয়া-আন্ত্রিকের মতোই ব্যোমকেশ-ম্যানিয়া লেগেছে। দেশসুদ্ধ লোক যেন খেপে উঠেছে। টালি-নালার পার থেকে আরব সাগরের ধার অবধি, যে যেখানে পারছে ব্যোমকেশের গপ্প নিয়ে এক পিস সিনেমা নামিয়ে দিচ্ছে! এমনকী টিভি খুললেও (সত্যবতী আর পুঁটিরামের বায়নাক্কায় ওই রঙিন ‘বোকা বাস্‌কো’টাও মেসবাড়ির তেতলায় উঠেছে বেশ কিছু দিন) রেহাই নেই। সেখানেও হপ্তায় তিন রাত্তির ব্যোমকেশ-সিরিজ! সর্বত্র লম্বা, মাঝারি, বেঁটে, রোগা, ভুঁড়িদার, আধ-টেকো, ঢেউ খেলানো বাবরি চুল— নানান বয়সের নানান কিসিমের ব্যোমকেশ! এমন অবস্থা যে সত্যবতীরই মাঝে মাঝে গুলিয়ে যাচ্ছে, কোনটা আসল ব্যোমকেশ— ঘরে যে আছে ‘সে’, না কি পরদার ‘হ্যান্ডসাম’বৃন্দ? এই তো সে দিন বৈঠকখানা বাজারে পুঁটিরামকে নিয়ে ভাল তোপসে মাছ কিনতে গিয়ে কী কেলেঙ্কারি! লম্বা মতন এক জনকে পাশ থেকে এক ঝলক দেখেই ব্যোমকেশ ভেবে ‘আরে তুমি আবার এখানে কী করতে এসেছ’ বলতে বলতে এগোচ্ছিলও। কী ভাগ্যি শেষ অবধি পুঁটিরাম দেখতে পেয়ে তাকে সরিয়ে নিয়ে যায়।

অজিতেরও একই রকম ‘আইডেন্টিটি ক্রাইসিস’ চলছে! এতগুলো ছবির এতগুলো অজিত— কোনটা যে তার নিজের মতন কে বলবে! কেউ হাসিখুশি, মজাদার! কেউ গম্ভীর, সিরিয়াস! কেউ কবি-কবি রোম্যান্টিক! কেউ ব্যাজারমুখো, ডিসপেপ‌টিক! সে-ও নয় হল— কিন্তু মোদ্দা যে কথাটা সত্যবতী থেকে মেসের দোতলার বাসিন্দা ঘনশ্যামবাবু সব্বার মাথা ঘুরিয়ে দিচ্ছে, সেটা হল: আচমকা কেন এই ব্যোমকেশ-বুম্, মানে ব্যোমকেশ বানানোর ধুম? অমনিবাস-এর পাতায় ব্যোমকেশ তো বেশ ছিল। কিন্তু মোটামুটি ২০১০ থেকে কী যে হল! স্টেডি-পুরনো দাম্পত্যের মতো বাঙালির সেই তিরতিরে ব্যোমকেশ-প্রেম কি রাতারাতি সুনামির মতো দু-তিনতলা ঢেউ হয়ে কলকাতার ‘কালচারাল সোনাবেলা’য় আছড়ে পড়ল? যার ধাক্কায় এমনকী ঋতুপর্ণ যে ঋতুপর্ণ, একটা ‘শুভ মহরৎ’ বাদ দিলে যিনি চিরটাকাল ঘরের মধ্যে গুনগুন সম্পর্কের সিনেমা বানিয়ে গেলেন, তিনিও কিনা জীবনের শেষ ছবিতে সেই ব্যোমকেশের চোরাবালিতেই ডুবলেন? অজিত এই কথাটাই জিজ্ঞেস করেছিল ব্যোমকেশকে! ছপ্পড় ফাড়কে এই ব্যোমকেশ-সিনড্রোম কোত্থেকে উদয় হল? ব্যোমকেশ বাঙালির কে হয়? সন্দীপ রায়ের দৌলতে দু’বছর অন্তর একটা করে ফেলুদা-কাণ্ড বাঁধা, সেখানে প্রায় চার দশক ধরে ব্যোমকেশ শুধু খটখটে, শুখা অক্ষরের ধাঁধায় ঘুরপাক খাচ্ছে— এই ভয়ানক অন্যায়-অবিচারের দিন খতম করতেই কি এমন তেড়েমেড়ে স্টেজে নামা? কিন্তু ব্যোমকেশ সেই মামলাটাই উলটে অজিতের ঘাড়ে চাপিয়ে দিয়েছে! আর অজিত কলমের পেছন কামড়ে-টামড়ে নোটবইয়ে দু-চারখানা ‘ক্লু’ যা লিখল, তার ফোটোকপিটা আপনাদের দেখাতে পারি।

Advertisement

ব্যোমকেশ ও ফেলুদা

১৯৬৭-তে সত্যজিৎ রায় যখন ‘চিড়িয়াখানা’ নিয়ে ছবি করছেন, তখন তাঁর নিজের ডিটেকটিভ, থুড়ি ‘প্রাইভেট ইনভেস্টিগেটর’ ফেলু মিত্তিরের কেরিয়ারের বয়স সবে দুই। ফেলুদার গায়ে তখনও ছাত্র-ছাত্র গন্ধ, আর ব্যোমকেশ ঘোর সংসারী। সত্যান্বেষী ব্যোমকেশ সম্পর্কে সত্যজিতের নিজের কতটা শ্রদ্ধাভক্তি ছিল, জানা নেই। তবে ‘চিড়িয়াখানা’ ছবিটা যে তিনি খুব একটা ভালবেসে করেননি, বরং দায়ে পড়েই তাঁকে কাজটা করতে হয়েছিল, সেটা তিনি সুযোগ পেলেই বুঝিয়ে দিয়েছেন। এমনকী ’৬৮-তে এই ছবির জন্য সেরা পরিচালকের রাষ্ট্রীয় পুরস্কার পেয়ে তিনি এতটাই চমকে গিয়েছিলেন যে মারি সিটন-কে লেখা চিঠিতে বলেই ফেললেন— ‘এ দেশে কি ভাল পরিচালকের আকাল পড়ল নাকি? ভাবো, চিড়িয়াখানা-র মতো ছবির জন্য আমি পুরস্কার পাচ্ছি!’ আসলে কে-খুনি-রে গোছের ‘হুডানিট’ (whodunnit, who done it) থ্রিলার ওঁর বরাবরই না-পসন্দ! কারণ সেখানে শেষ দৃশ্যে নিয়ম করে সব্বাইকে বসিয়ে কী করিয়া কী হইল তার খুঁটিনাটি বোঝাতে হয়! আর সেই লম্বা সময়টায় পাবলিক ঠায় হাঁ করে গোয়েন্দার মুখের দিকে তাকিয়ে থাকে! কিন্তু তার পরেও ‘চিড়িয়াখানা’ বানাতে গিয়ে সত্যজিৎ খোদার ওপর খোদকারি করেননি! ব্যোমকেশের গপ্প যে ভাবে শেষ হয় সে ভাবেই ক্লাইম্যাক্সে গেছেন। তবে ফেলুদা নিয়ে সিনেমা করতে গেলে তিনি কী করবেন সেটাও বোধহয় তখনই ঠিক হয়ে গিয়েছিল।

এমনিতে ব্যোমকেশ আর ফেলুদা দুজনেই শার্লক হোম্স-এর ভক্ত, দুজনেই মোটের ওপর মধ্যবিত্ত, দুজনের কেউই তেমন একটা পয়সার পেছনে ছোটেনি, এবং দুজনের কারওরই নিজের গাড়ি নেই। কিন্তু ‘জেনারেশন গ্যাপ’ বাদ দিলেও দুজনের মধ্যে ফারাকও অনেক। হ্যাঁ, ফেলুদা চিরকুমার আর গল্পের ধারেকাছে মেয়েদের ঘেঁষতে দেয় না— আর ব্যোমকেশ সেই কবে বিয়ে-থা করে ছেলের বাপ হয়েছে আর তার কাহিনি ঘিরে নারী এবং সেই নারীদের ঘিরে নানান আদিম রিপুর আনাগোনা— এটা তো অবশ্যই একটা মস্ত তফাত। অবশ্য তাতে যে ফেলুদা নেহাত ছেলে-ভোলানো আর ব্যোমকেশ সাংঘাতিক কিছু অ্যাডাল্ট-পাঠ্য হয়ে গেল, এমন নয়। তবু হয়তো ক্লােয়ন্টেল-এর একটা তফাত হয়। ফেলুদার বই আট-ন’বছরের বাচ্চারাও গোগ্রাসে গেলে। ব্যোমকেশ অমনিবাসে ১৩-১৪ বছরের আগে হাত দেওয়া মানা। কিন্তু, ব্যোমকেশ আর ফেলুদার আসল ফারাক ওদের বাঙালিয়ানার ডি.এন.এ-তে। ফেলুদা হল আধুনিক গ্লোবাল বাঙালি। বাংলার চেয়ে ইংরেজি বই বেশি পড়ে। দেশ-বিদেশের খবর রাখে— যাকে বলে একদম চলতা-ফিরতা উইকিপিডিয়া! স্মার্ট, ফ্যাশন-দুরস্ত, ডায়েটিং-ও করে (নলেন গুড়ের সন্দেশ আর ভাল মিহিদানা বাদ দিয়ে)!

উলটো দিকে ব্যোমকেশ হল সেই চিরকেলে বাঙালি, গত শতাব্দীর বিশ-তিরিশের দশক থেকে এই সে দিনও সত্তর-আশি অবধি কলকাতার রকে-বাজারে-অফিসে মেসে যাদের লেপটালেপটি করতে দেখা যেত। ‘বোম্বাইয়ের বোম্বেটে’-তে লালমোহনবাবুর পাড়াতুতো ভাই বলিউডের হিট পরিচালক পুলকবাবু তো ফেলুদাকে দেখেই বলেছিলেন, ‘আরে মশাই আপনার মতো হিরো চোখের সামনে থাকতে, আমরা হিরো খুঁজে মরছি!’ মানে, সত্যজিৎ নিজেই মনে করছেন, ঠিক প্রখর রুদ্র-র মতো না হলেও, ফেলুদার ইমেজে বলিউডের নায়ক হওয়ার যথেষ্ট ‘এলিমেন্ট’ ছিল।

এ দিকে ব্যোমকেশকে দেখে কেউ কিন্তু নায়ক-টায়ক বলতে যাবে না! ‘পথের কাঁটা’-র শুরুতেই তো শরদিন্দু লিখে দিচ্ছেন— ‘বাহির হইতে তাহাকে দেখিয়া বা তাহার কথা শুনিয়া এক বারও মনে হয় না যে, তাহার মধ্যে অসামান্য কিছু আছে—।’ হ্যাঁ, ‘তার গায়ের রং ফরসা, বেশ সুশ্রী সুগঠিত চেহারা— মুখে চোখে বুদ্ধির একটা ছাপ আছে।’ কিন্তু দশটা বাঙালির ভিড়ে ফেলুদার মতো সে আলাদা করে চোখে পড়বে না। আর এটাই ব্যোমকেশের বাঙালিয়ানার ইউ.এস.পি।

বাঙালি ও ব্যোমকেশ

এই যে ব্যোমকেশ বাঙালির ঝাঁকে দিব্যি ভেসে-মিশে থাকতে পারে— ডায়েটিং-ফায়েটিং-এর ধার না ধেরে পুঁটিরামের তৈরি তেলেভাজা স্যাটাস্যাট সাঁটিয়ে দেয়— এর মধ্যে কোথাও একটা খুব আটপৌরে মধ্যবিত্তপনা আছে, মেসবাড়ির তেতলার ফ্ল্যাটে যাকে মানিয়ে যায়। ফেলুদার রজনী সেন রোডের বাড়িটা নিশ্চয়ই তেমন চকমেলানো নয়। কিন্তু তবুও ব্যোমকেশের মতো এতটা আটপৌরে গেরস্তপনায় তাকে আঁটানো যায় না। ব্যোমকেশ বক্সী তাই বাঙালির চিরকালের গৃহী-সংসারী ‘শার্লক হোম্স’! এমনিতে চুপচাপ হলেও তাকে খুঁচিয়ে, রাগিয়ে দিলে ভালই তর্ক করতে পারে। আর ঝকঝকে, শান দেওয়া মগজাস্ত্রে রহস্যের জাল ফর্দাফাঁই করাটা তো তার পেশাদারি দায়িত্বের মধ্যেই পড়ে। তা ছাড়া মারকুটে-মাচো না হলেও দরকার পড়লে ‘সত্যান্বেষী’র অনুকূলবাবুর মতো ভয়ানক খুনেকে এক ঘুসিতে মেঝেতে শুইয়ে দেওয়ার হিম্মত তার আছে। ফেলুদার মতো জীবন্ত ‘বুক অব নলেজ’ না হলেও কিছুটা কাণ্ডজ্ঞানও আছে। আর আছে ট্র্যাডিশনাল মধ্যবিত্ত, কিন্তু একবগ্গা বেয়াড়া গোছের কিছু মানবিক মূল্যবোধ। কাণ্ডজ্ঞানের সঙ্গে মিলেজুলে যেটা ব্যোমকেশের নিজস্ব ন্যায়-অন্যায়ের মাপকাঠিটা ঠিক করে দেয়। আর সেটা মাঝে মাঝেই সমাজ-চলতি নীতি-নিয়মকেও পাশ কাটায়।

তাই বলে ব্যোমকেশ কখনওই খুব বিপ্লবী, প্রতিষ্ঠানবিরোধী নয়। বরং গড়পড়তা বাঙালির মতোই সরকার-ভক্ত। ব্রিটিশ আমলে কলকাতা পুলিশের সাহেব কমিশনার এটা-ওটা কাজে তাকে ডেকে পাঠাতেন। আবার দেশ স্বাধীন হওয়ার পর ভারত সরকারের কর্তারাও বিপদে-আপদে ব্যোমকেশকে এত্তেলা পাঠান, সে দিক থেকে ফেলু মিত্তিরের চেয়েও গোয়েন্দা হিসেবে ব্যোমকেশ বক্সী বড় স্টার। বেশি সেলেব্রিটি। তবে ঘরোয়া, গেরস্ত সেলেব্রিটি। যার সঙ্গে বউয়ের ঝগড়াঝাঁটি হয়, যার ওপর রাগ করে বউ দাদার বাড়ি চলে যেতে পারে। বউয়ের মান ভাঙাতে যাকে আবার পশ্চিমে ছুটতে হয়। এই যে ব্যোমকেশকে নিজেদের এক জন বলেই ভাবা যায়— এই আপন-আপন ভাবটাই তার
ব্র্যান্ড-ভ্যালু। আর ব্র্যান্ড-ফেলুদা’য় ‘টেকনিকাল’ কারণে হাত দেওয়া যাবে না জেনেই টলি-বলি ব্যোমকেশের ওপর এমন বিয়েবাড়ির লাস্ট ব্যাচের মতো হামলাচ্ছে়!

[অজিতের নোটবইয়ে আর কোনও এন্ট্রি নেই। কিন্তু তার পরেও ‘বাঙালি সিনেমাওয়ালাদের প্রতি একটি আবেদন’ গোছের ড্রাফ্‌ট আছে। ব্যোমকেশের বয়ানে লেখা। অজিতই লিখেছে কি না, বা ব্যোমকেশ মূল পয়েন্টগুলো বলে দিয়ে ছাদে চলে গেছে কি না, জানা নেই! নীচে তার ফোটোকপি দেওয়া হল।]

আমাকে আমার মতো থাকতে দাও

মশাইরা, সেই ২০১০ থেকে একদম মুখটি বুজে আছি। সহ্য তো কম করিনি। গল্পের নাম ছিল ‘আদিম রিপু’, ছবিতে হয়ে গেল ‘ব্যোমকেশ বক্সী’। বুঝলাম, আমার ব্র্যান্ড ভ্যালুটাই ভাঙানোর চেষ্টা হচ্ছে। পরের ছবিটার নাম ‘আবার ব্যোমকেশ’। আমি ভেবেছিলাম, তারও পরের ছবিটার নাম ‘আবার আবার ব্যোমকেশ’। কিংবা ‘আরও ব্যোমকেশ’। কিন্তু মধ্যিখানে প্রযোজকের সঙ্গে পরিচালকের ভয়ানক ঝগড়া ও তার পরে ভীষণ ভাব সেলিব্রেট করতেই তিন নম্বরের নাম হল ‘ব্যোমকেশ ফিরে এল’। কেন ভাই, আমি তো কোথাও নিরুদ্দেশে যাইনি— বাঙালি পাঠকের সঙ্গেই থেকেছি! তোমরাই বরং গল্পের ক্লাইম্যাক্স ১৯৪৭-এর ১৫ অগস্ট হলেও সেটাকে খামখা ষাটের দশকে টেনে এনেছ। কারণ ১৯৪৬-৪৭’এর ওই দাঙ্গা–পার্টিশন-স্বাধীনতা দিবস-টিবস সুদ্ধ সময়টাকে তুলে ধরা তোমাদের ক্ষমতায় কুলোত না। ভাবলে, ষাটের দশক বানানোটা বোধহয় সোজা হবে, সেখানেও ঝুলিয়ে-টুলিয়ে একশেষ! শহর জুড়ে ভয়ানক দাঙ্গা চলছে, দেখে মনে হবে লোকজন যেন আইসপাইস আর কুমিরডাঙা খেলছে! সদর রাস্তায় দাঁড়িয়ে অজিত নিশ্চিন্তে বুক ফুলিয়ে কার সঙ্গে যেন আড্ডা দিচ্ছে, তাদের এদিক-ওদিক দিয়ে দাঙ্গাবাজরা ছোরা-তলোয়ার উঁচিয়ে পাশ কাটিয়ে চলে যাচ্ছে! মারবে কী করে, হিরোর বন্ধু যে!

এর পর ‘বেণীসংহার’ নিয়ে আমার যে পরদায় ফিরে আসা, সেখানে আমি সত্যান্বেষীগিরির পাশাপাশি নিজের বাড়িতেই যেন পাবলিক লাইব্রেরি খুলেছি, আর কমবয়সি ছেলেদের মার্কসীয় সাহিত্য পড়াচ্ছি! আর কাহিনির এঁচড়েপাকা কমিউনিস্ট ছোঁড়াটা, যার নাম মকরন্দ, ছবিটার একদম শেষে তার হাতে আমি অরওয়েলের কমিউনিজ্ম-বিরোধী ‘অ্যানিম্যাল ফার্ম’ তুলে দিচ্ছি— যেন উলটো মগজধোলাই। এটা ‘নিস্তালিনীকরণ’ না কি ব্যোমকেশের বেমালুম ‘সোশাল অ্যাকটিভিস্ট-ভবন’ ঠিক বুঝলাম না! আসলে আমাকে ধরেবেঁধে আঁতেল বানাতে গেলে বড্ড মুশকিলে পড়ি। এই তো হালের ‘শজারুর কাঁটা’য় আমি পাইপ না টেনেও দাঁতে পাইপ-চাপা অ্যাকসেন্টে ইংরেজি বলি। আমি ভাই দু’বেলা মাছ-ভাত খাওয়া বাঙালি। আমায় ধরে ঝাঁকালেও অমন ইংরিজি বেরবে না হে! এই ব্যোমকেশের চুল পেকে গেছে, গাল ঝুলে গেছে, তাতে আমার কোনও সমস্যা নেই। শজারুর কাঁটার সময় আমার অমনই বয়স হওয়ার কথা। কিন্তু এই ভদ্রলোকের হাঁটা-চলা-তাকানো-বলা, এমনকী চশমার ফ্রেম থেকেও যে খাঁটি বিলিতি কর্পোরেট দিব্যজ্যোতি ঠিকরোয়, সাতজন্ম ঘুরেও আমার ওটা আসবে না। তা ছাড়া এ ছবিটার খুনিটার ‘সমনামবুলিজ্ম’ না কী একটা ঘোড়ারোগ আছে— তাতে সে প্রতি শুক্কুরবার রাত্তিরে ঘুমের ঘোরে রাস্তায় বেরিয়ে পড়ে। সঙ্গে সুন্দর একটা খাপে করে শজারুর কাঁটাও নিয়ে ষায়। আর ঘুমোতে ঘুমোতেই পথের ধারে যাকে পায় তার পিঠ দিয়ে শজারুর কাঁটা ঢুকিয়ে হার্ট দিয়ে বের করে দেয়! আর ও যে ঘুমিয়ে ঘুমিয়েও এমন একটা কাজ নিখুঁত ভাবে পারে, তার কারণ ও নাকি কবে দু’বছর ডাক্তারি পড়েছিল! তা হলে তো ডাক্তারি পড়া এবং তার পর ঘুমিয়ে পড়া খুব ডেঞ্জারাস ব্যাপার! শুনলাম, পরিচালক নাকি বলছেন, গল্পটায় প্রচুর যুক্তির ফাঁক ছিল! সে সব মেরামত করতেই তাঁকে এত খাটাখাটনি করতে হয়েছে। কিন্তু ছবিতে গায়িকা দীপার দাদার বয়স দীপার দ্বিগুণেরও বেশি কেন, তার কোনও ব্যাখ্যা খুঁজে পেলাম না! এ রহস্যভেদ করতে কেন ব্যোমকেশ বক্সীকেই ঢাকা হল না? তবে এখানে নির্দোষ ভিলেন সরল মনে রাতবিরেতে আনি-মানি-জানি না বলে খুন করে বেড়ালেও পরিচালক সময়টা ২০১৪-১৫’তেই রেখেছেন। পিরিয়ড পিস বানাতে যাননি।

কিন্তু একদম হালের হিন্দি ‘ডিটেকটিভ ব্যোমকেশ বক্সী’ দেখে আমরা গোটা পরিবার খুব ঘাবড়ে আছি। পুঁটিরাম তো ভয়ে বেরতেই চাইছে না, পাছে ওকে কেউ চিনেপট্টিতে তুলে নিয়ে যায়। আসলে পুঁটিরাম তো জানে না, এটা আসলে পিরিয়ড পিস। গাদা গাদা টাকা খরচ করে, প্রচুর স্পেশাল এফেক্ট দিয়ে, এই সিনেমার প্রতিটা ফ্রেমের পেছনে ১৯৪৩-এর কলকাতা শহর টাঙানো আছে। তাতে পাওয়ার পয়েন্ট প্রেজেন্টেশনের মতো এক ঝলক করে সব আছে। ঘোড়ার গাড়ি, পুরনো ট্রাম, মাথাখোলা দোতলা বাস, শুধু পঞ্চাশের মন্বন্তরের ‘ফ্যান দাও! ফ্যান দাও!’ ডাকটাই বাদ পড়েছে! ১৯৪৩ নিয়ে ছবি করে ১৯৪৩-এর বাংলার সবচেয়ে ভয়াবহ ও প্রধান ঘটনাটা, বিরাট বীভৎস বিকট দুর্ভিক্ষটাই বেমালুম বাদ দিয়ে কেমন চমৎকার পিরিয়ড পিস হয়, সে ব্যাখ্যাটা বোধহয় সিনেমার শেষের লম্বা লিস্টির পণ্ডিতেরা ৪৩ মিনিটেই দিয়ে দেবেন! তবে সন্দেহ হয়, মন্বন্তরটা দেখালে, হাজার হাজার বুভুক্ষু ও মরতে-বসা আর মরে-পড়ে-থাকা মানুষের সামনে হয়তো গোয়েন্দার এই লম্ফঝম্প মানাত না। কিংবা এক্সট্রাদের অনেক পয়সা দিতে হত। আচ্ছা, সেও থাক। কিন্তু ভাই, ফ্রেমের সামনে যেটা হয় সেটা ব্যোমকেশের কোন গল্প? কোনওটাই তো নয়! এই গল্পের খোসা, ওই গল্পের আগা, সেই গল্পের ন্যাজ, এই সব ঘেঁটে এমন একটা ঘণ্ট পাকানো হয়েছে, শীর্ষেন্দুর ভাষায় যাকে ‘সামসাডিহি টকদই হামলা খামলা’ বলতেও অসুবিধে নেই। আর এত সব ‘হামলা খামলা’র একটাই লক্ষ্য— পোড়া বঙ্গদেশের এই অধম সত্যান্বেষীকে রাতারাতি ‘ইন্টারন্যাশনাল খিলাড়ি’ বানিয়ে দেওয়া। জেমস বন্ডের মতো, বা গাই রিচি-র পরিচালনায় শার্লক হোম্‌সের মতো। এই যে ভদ্রলোক হোম্স-কে হঠাৎ পেল্লায় মারকুটে অবতারে জন্ম দিলেন ও সাংঘাতিক কেতা-কায়দা ভর্তি অ্যাকশন-কাঁপাকাঁপি সুপারহিট হলিউডি ছবি করে ফেললেন, ব্যস, ভারতেও অমনি ‘গাই’ হতে হুড়োহুড়ি। ওরে, সবার দুধ কি এক জাতের হয়? কারও কারও কেটে ছানা হয়ে যায়!

ভাই, খুব সোজা কথা, আমার ইন্টারন্যাশনাল হওয়ার উচ্চাকাঙ্ক্ষা নেই। আমি মেসবাড়ির লোকাল ডিটেকটিভ। ছোট-মাঝারি রহস্য ঘেঁটেই আনন্দে থাকি। ‘গ্লোবাল ইন্ডিয়ান ডিটেকটিভ’ হয়ে আন্তর্জাতিক ড্রাগ-চোরাচালান বা জাপানের ভারত আক্রমণের মতো অত বড় বড় কেস সামলানো আমার কম্ম নয়। আমি বাঙালি মাতাহারির মতো কোনও সুন্দরীর চুমু চাই না। আর সটান তার গোসলখানায় ঢুকে ভরা বাথটবের ধারে ইন্টুমিন্টু? মাইরি বলছি, আমার হার্ট ফেল করে যাবে। ক্লাইম্যাক্সের খুনোখুনিটা শুরু হওয়ার ঠিক আগে পাঁচ ফুটের এক চিনেম্যান আড়াই-ফুটিয়া তরোয়াল নিয়ে বিকট হাঁক ছেড়ে দোতলার বারান্দা থেকে উঠোনে যে লাফখানা মারল, অজিত বলল, শাওলিন টেম্পল বলে কী একটা সিনেমার সিরিজ আছে, তাতে নাকি অমনটা আকছার হয়। ছবির একদম শেষের সিনে ভিলেনটা চার পাশে ডজনখানেক লাশ ছড়িয়ে, ছোরা না কী উঁচিয়ে যে রক্তারক্তির চ্যালেঞ্জ ছোড়ে, আমি মোটেই সেটা নিচ্ছি না। ফেলু মিত্তির পারলেও পারতে পারে, এই বাঙালি হাড়ে ও-সব মার্শাল আর্ট-ফার্ট শেখা আমার পোষাবে না। বলিউডের ডিজিটাল ব্যোমকেশ বরং সত্যবতীর কুলুঙ্গিতে তোলা থাকুক। রোজ সন্ধেয় জল-বাতাসা দেবে’খন!

sanajkol@gmail.com

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement