পুজোর গল্প
Bengali Story

কলকলিদের বাড়িতে দুটো দিন

ক’দিন আগে মহালয়া ছিল। ভোরের আলো ফোটার আগে বাড়িতে বাড়িতে রেডিয়ো বেজেছে। কলকলিদের বাড়িতে বাজেনি।

Advertisement

প্রচেত গুপ্ত

কলকাতা শেষ আপডেট: ১৫ অক্টোবর ২০২৩ ০৬:১০
Share:

ছবি: সুব্রত চৌধুরী।

‌প্রথম দিন

Advertisement

“‌শরৎকালের নীল আকাশে পেঁজা তুলার মতো সাদা মেঘ ভাসিয়া বেড়ায়.‌.‌.‌ ভাসিয়া বেড়ায়..‌. ‌ভাসিয়া বেড়ায়.‌.‌.‌”

কলকলি দুলে দুলে পড়ে চলেছে। সঙ্গে চলছে ফোঁপানি। এই মেয়ে মতিপুর বালিকা বিদ্যালয়ের পঞ্চম শ্রেণির ছাত্রী। বসে আছে লম্বা দাওয়ায়
এক পাশে। সামনে বই খোলা। স্কুলের দিদিমণি রচনা শিখিয়েছেন। শেখানোর সময় নানা মজার কথাও বলেছেন।

Advertisement

“‌বুঝলে মেয়েরা, সব ঋতুর যেমন ভাল দিক আছে, তেমন খারাপ দিকও আছে। যেমন গরমে ঘামাচি, বর্ষায় জ্বরজারি, শীতে কাঁপুনি। কিন্তু শরৎকালের সবটাই ভাল। এই সময়টা হল খুশি‌র সময়। নীল আকাশ, কাশফুল, ভোরের ঠান্ডা বাতাস মন ভাল করে দেয়। দেখবে, এই সময় পা মচকালেও তেমন জোরে লাগবে না। চার পাশে পুজো-পুজো গন্ধ। মেয়েরা, পুজোর গন্ধ কি তোমরা চেনো?‌” ক্লাসের সবাই এক সঙ্গে মাথা নাড়ে। দিদিমণি বললেন, “খুব ভাল, তোমরা বাড়িতে রচনা লিখবে। নাম দেবে, ‘‌আমার বাড়িতে শরৎকাল’‌।”

ক’দিন আগে মহালয়া ছিল। ভোরের আলো ফোটার আগে বাড়িতে বাড়িতে রেডিয়ো বেজেছে। কলকলিদের বাড়িতে বাজেনি। তাদের রেডিয়ো, টিভি নেই। অবশ্য শরতের বাতাস ‘‌পুজোর গন্ধ’‌ নিয়ে যখন ঘুরে বেড়ায়, তখন সে কার বাড়িতে কী আছে, কী নেই, এ সব দেখে না, সব বাড়িতেই যায়। কলকলিদের বাড়িতেও এসেছে। বর্ষা-ধোওয়া নীল আকাশ এখন এই বাড়ির মাথার ওপর। এ দিকে গ্রামের পুজোমণ্ডপে প্রতিমা তৈরির কাজে শেষটান চলছে। কলকলির কাছে খবর, কাল সন্ধেবেলা বর্ধমান থেকে ঢাকীরা চলে আসছে। মণ্ডপেই রিহার্সাল হবে।

কলকলি বুদ্ধিমতী মেয়ে। তবে পড়াশোনা করার মতো সময় তার হাতে থাকে না। তার কাছে আছে খেলাধুলোর নানা ব্যবস্থা। পুতুলের সংসার, এক্কাদোক্কার ছক, দড়িলাফের দড়ি, দোলনা। সকালে ঘুম ভাঙার পর থেকেই কলকলিকে এ সব নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়তে হয়। আজও পড়েছিল। তবে বেশি ক্ষণ পারেনি। মাঝপথে সব ছেড়েছুড়ে পড়ার বই খুলতে হয়েছে। এখন পড়ছে, পড়া শেষ হলে লিখতে হবে। এই মাত্র চাঁপা তার মেয়েকে একটা চড় মেরেছে। সঙ্গে নিচু গলায় বকুনি।

“‌সকাল থেকে শুধু খেলা আর খেলা.‌.‌. লেখাপড়া না শিখে এই বাড়ির লোকদের মতো অকম্মার ধাড়ি হবি?‌ বাবার মতো পালানি হবি? পালানি কি জানিস?‌ পালানি হল ঘর-সংসার ছেড়ে পালানো। নাকি‌ কাকার মত হাতটানি হবি? হাতটানি কী জানিস?‌ জানতে হবে না। বল এর মধ্যে কোনটা হতে চাস?‌”

একতলা এই বাড়িতে লম্বা মাটির দাওয়ায় পর পর ঘর। দু’‌সিঁড়ি নামলে চওড়া উঠোন। উঠোনের এক পাশে রান্নার জায়গা, কলঘর, গুদাম। গুদামঘরের আধখানা চাল তিন বছর আগে সেই যে ঝড়ে উড়ে গেছে, আর ফিরে আসেনি। সেই ঘরে এখন বাতিল বাক্সপ্যাঁটরা, জং-ধরা সিন্দুক, তেবড়া হ্যারিকেন থাকে। সাপখোপের বাসাও থাকতে পারে। কলকলির ঠাকুমা শান্তিদেবী যখন বেঁচে ছিলেন, নিজের হাতে এই ঘর সাফসুতরো করতেন। তিনি মারা যেতে সে পাট চুকেছে। অবশ্য এই বাড়িতে গুদামঘরের প্র‌য়োজনও আর নেই। গুদামে চাল-গম মজুত রাখা তো দূরের কথা, এখন হল ‘‌দিন আনি, দিন খাই’‌ অবস্থা। মাঝে মধ্যে তাও কঠিন হয়ে পড়ে। বাড়ির সাড়ে পাঁচ জন সদস্যের মধ্যে
চাঁপা এবং কলকলিকে বাদ দিলে তিন জন পুরুষ মানুষ। হলে কী হবে?‌ বাড়িতে নিয়মিত রোজগারের ব্যবস্থা নেই।‌‌

বাড়ির কর্তা আদিনাথ। কলকলির ঠাকুরদা। বয়স সত্তর ছুঁই-ছুঁই। এক সময়ে শক্তসমর্থ ছিলেন, কাজও করেছেন বিস্তর। স্ত্রীর মৃত্যুর পর সব ছেড়ে, জমিজমা, দুটো দুধেল গরু, তিনটে ছাগল, ক’টা হাঁস-মুরগি সব বেচেবুচে বাড়িতে থম মেরে বসে পড়েছেন। তাঁর নাকি কাজ করতে ভাল লাগছে না। কথাও বলেন কম। টাকাপয়সা কোথায় রেখেছেন, কেউ জানে না। সম্ভবত ঘরের আলমারিতে। মাঝেমধ্যে সংসারে টানাটানি বাড়লে ছেলের বৌকে ডেকে পাঠান। হাতে কিছু টাকা দিয়ে বলেন, “চাঁপা, ‌এই দিয়ে ক’টা দিন চালিয়ে নাও।”

শ্বশুরের হাত থেকে টাকা নিতে চাঁপার লজ্জা হয়। সে নিচু গলায় বলে, “ঘরে ‌আরও দু’-এক দিনের মতো বাজার আছে বাবা। আর ক’টা দিন পরে দিলেও...”

আদিনাথ কথা না বলে হাত নেড়ে পুত্রবধূকে চলে যেতে বলেন। এই মেয়েকে তিনি বিশেষ পছন্দ করেন। সংসারের জন্য খুব কষ্ট করে। আদিনাথ আজ সকালে ঘুম থেকে উঠে পুকুরঘাটে এসে বসেছেন। গায়ে নরম রোদ পড়েছে। আরাম লাগছে। আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে আনমনা হয়ে গেলেন। আজ কি আকাশ বেশি নীল? কেন যেন আজ স্ত্রীর কথা খুব মনে পড়ছে। প্রেম কি বেশি বয়সেও গোলমাল পাকায়? নিশ্চয়ই পাকায়। নইলে কেন মৃত্যুর তিন বছর পরও মাঝেমধ্যে মনে হয়, শান্তি আছে, বাড়িতেই আছে কোথাও?‌ এ রকম মনে হলে আদিনাথ নিঃশব্দে ঘুরে বেড়ান। রান্নাঘরে উঁকি দেন, কুয়োর পাড়ে যান, গুদামঘরের সামনে দাঁড়ান। স্ত্রীকে খোঁজেন নাকি?‌

আদিনাথ পুকুরঘাট থেকে উঠে পড়লেন।

আদিনাথের বড় ছেলে হরিনাথ। বিয়ে করলে এবং সন্তানের জন্ম দিলেও এই লোক হল ‌সংসার-‌পালানো লোক। মাঝে মধ্যেই তিন মাস, ছ’‌মাসের জন্য ঘরবাড়ি, বৌ, মেয়ে ফেলে উধাও হয়। তবে ফিরেও আসে। উসকোখুসকো চুল, ধুলোমলিন বেশে যখন ফেরে, হাতে কখনও থাকে একটা বড় কুমড়ো, কখনও কানকোয় দড়ি বেঁধে ঝোলানো ক’টা বিঘত সাইজ়ের চারাপোনা, কখনও কলকলির জন্য সস্তার তুলোর পুতুল। হাসিমুখে বাড়িতে ঢোকে সে। যেন কিছুই ঘটেনি। কিছু ক্ষণ আগে বাজার করতে বেরিয়েছিল, এ বার দাওয়ায় গেঞ্জি পরে বসে চা-মুড়ি খাবে। চাঁপা তাকে সংসারে বেঁধে রাখার জন্য অনেক কিছু করেছে। কান্নাকাটি, মেয়ের নামে দিব্যি, ডাক্তার, মানত, উপোস, মাদুলি। কোনওটাই কাজ করেনি। যখন বাড়ি ফেরে হরিনাথ, রাতে মেয়ে ঘুমিয়ে পড়লে হ্যারিকেনের আলো কমিয়ে বৌকে কাছে ডাকে।

“এসো চাঁপা।”

চাঁপা গভীর অভিমানে স্বামীর হাত সরিয়ে দেয়। বলে, “না, যাব না।”‌

হরিনাথ হেসে হাত ধরে টান দেয়। বলে, “আহা, রাগ করো কেন?‌ ‌বলছি তো আর পালাব না।”‌

চাঁপা ঘন হয়ে এসে বলে, “‌‌তুমি মিথ্যুক। তুমি জানো না সংসারে কত অভাব?‌ তুমি বাড়ি থাকো না, তোমার ভাইয়ের পাকা রোজগার নেই.‌.‌.‌ কী করে চলবে?‌ শ্বশুরমশাইয়ের কাছ থেকে হাত পেতে টাকা নিতে লজ্জা করে।‌”

হরিনাথ ফিসফিসিয়ে বলে, “দেখো, ক’দিন পরে আর কষ্ট থাকবে না।”‌

চাঁপা যে তার স্বামীর এই কথা বিশ্বাস করে, এমন নয়, তার পরেও আত্মসমর্পণ করে। কেন করে সে জানে না। ক‌’দিন পরে ‘‌একটু আসছি’ বলে আবার উধাও হয় হরিনাথ। যাওয়ার আগে খাটের তোশক তুলে সুতোয় গোল করে পেঁচিয়ে কিছু টাকা রেখে যায়। চাঁপার আগে রাগ হত, কান্নাকাটি করত। ইচ্ছে হত, টাকাগুলো ছুড়ে পুকুরে ফেলে দেয়। এখন আর হয় না, অভ্যেস হয়ে গেছে। শুধু রোজ তার মনে হয়, আজ হরিনাথ বাড়ি আসবে। বেড়ার গেটে আওয়াজ হলে চমকে ওঠে। আজও মনে হচ্ছে।

ছবি: সুব্রত চৌধুরী।

কলকলির কাকা বিধুনাথ। বাড়ির ছোট ছেলে। আদিনাথের বেশি বয়সের সন্তান। বয়স পঁচিশ পেরিয়ে ছাব্বিশ হতে চলল। চুপচাপ ধরনের, সাতে পাঁচে না থাকা, অলস প্রকৃতির যুবক। লেখাপড়া তেমন হয়নি। তবে মাঝেমধ্যে কিছু ছোটখাটো কাজ জুটে যায়। কোথাও বেশি দিন মন টেকে না। বছরের কিছু দিন সংসারে অল্প টাকা দিলেও, বেশির ভাগ সময়ই বেকার। ঘরে চাদর মুড়ি দিয়ে শুয়ে থাকে। মাসকয়েক আগে বলাই নস্কর সদরে তার দোকানে ঢুকিয়ে নিয়েছিল। বলাই ধুরন্ধর লোক।

‌“‌কাজ করতে ভাল লাগে না তো করবি না, কিন্তু আমার দোকানে এসে সাহায্য তো করতে পারিস। দোকান বেড়েছে, খদ্দের বেড়েছে। এখন চাল, ডাল, তেলের সঙ্গে, শাকসব্জি, ফল-টলও রাখি। একা সামলাতে পারি না। তার ওপর সামনে পুজো। ভাবছি, কাপড়জামা কিছু রাখব। ভিড় আরও বাড়বে। আমার সঙ্গে ক’দিন না হয় তুইও হাতে হাতে খাটলি। কি রে, পারবি না?”

বিধুনাথ কিছু একটা ভেবে বলল, “চেষ্টা করে দেখতে পারি।”‌

বলাই খুশি হয়ে বলল, “‌খুব ভাল। তবে এখনই টাকাপয়সা কিছু দিতে পারব না বাপু। কিছু দিন দেখব, কাজ ভাল হলে পুজোর পর একটা পাকা ব্যবস্থা হবে। তবে ভাবিস না যে, মাগনায় খাটিয়ে নেব। সকালে চা-মুড়ি, দুপুরে পাশের হোটেলে ভরপেট ভাত-ডাল পাবি। হাতে টাকা না পাস, বাড়ির চাল ডালটা তো ক’দিন বাঁচবে। কম হল?‌”

বিনি পয়সাতেই বলাইয়ের কাছে বেশ ক’দিন কাজ করে ফেলল বিধুনাথ। আরও হয়তো করত, কিন্তু গত শনিবার তার কাজ চলে গেছে। কারণ বিশ্রী। বিধুনাথের ‘‌হাতটান’‌ ধরা পড়েছে। বড় কিছু নয়, ছোটখাটো হাতটান। দোকান থেকে সে মাঝেমধ্যে অল্প চাল, এক মুঠো ডাল ঠোঙায় ভরে নিয়ে যায়। শুধু চাল-ডাল নয়, কখনও দুটো ডিম, কটা ঢেঁড়স, খানকয়েক আলু, দুটো কলা, একটা নধর বেগুনও সরিয়েছে। এক দিন শিশিতে তেল ভরে ঝোলায় পুরতে সেই তেল টপটপ করে মেঝেতে পড়তে লাগল। বলাই ধরে ফেলল।

বলাই বলল, “কানাঘুষোয় খবর পেয়েছিলাম বটে, বিশ্বাস করিনি। আজ হাতেনাতে প্রমাণ পেলাম। ছি ছি বিধু, অভাবে তোর এই স্বভাব হয়েছে!‌ ভাবতেও পারছি না। একই সঙ্গে অবাক হচ্ছি, চুরির আইটেম জেনে। সামান্য চাল-ডাল, কটা ঢেঁড়স, একটা বেগুন চুরি!‌‌ অথচ ক্যাশবাক্স তোর হাতের কাছেই থাকে। ইচ্ছে করলে, সেখান থেকে টাকাপয়সা সরাতে পারতিস। একটা আধুলিতেও হাত দিসনি কখনও। এ কেমন চুরি তোর?‌ চোরেরা শুনলে মুখ লুকোবে।‌”‌

বিধুনাথ কাঁচুমাচু মুখে বলল, “‌বলাইদা, তোমাকে বলতে পারিনি.‌.‌.‌ ব্যাপারটা হল.‌.‌. ‌পুজোর পর এখানে পাকা কাজ হলে সব দাম মিটিয়ে দেব.‌.‌.‌ যা নিয়েছি, হিসেব লেখা আছে আমার।‌”

বলাই হাত তুলে বলল, “‌থাক, আর বলতে হবে না। কচু কাটতে কাটতেই মানুষ ডাকাত হয়। তোর এই হাতটান স্বভাব যে কবে আমার গলায় ছুরির টান দেবে তার ঠিক নেই।‌ টাকা‌পয়সা চুরি হলে তাও একটা কথা ছিল, ঢেঁড়স-বেগুন নিয়ে পুলিশের কাছে যাচ্ছি না। তবে আজই বিদায় হও বিধুনাথ।”‌

‌বিধুনাথ নিজের ঘরে, তক্তপোশে শুয়ে আছে। ঘুম ভেঙেছে, কিন্তু বিছানা ছাড়েনি। সে রয়েছে চিন্তার মধ্যে। গভীর চিন্তা। সে একটা কাণ্ড করতে চায়। কিন্তু মনে জোর পাচ্ছে না। একটা ঝাঁকুনি লাগবে। খানিক আগে সে বৌদির বকুনি শুনতে পেয়েছে। বৌদি তাকে ‘‌হাতটানি’‌ বলেছে। সে বলুক, বৌদি মানুষটা অতিরিক্ত ভাল। ইচ্ছে করলেই মেয়ের হাত ধরে বহরমপুরে বাপের বাড়ি চলে যেতে পারত। যায়নি, সংসারটাকে আগলে রেখেছে। এত চাপে সব সময় মাথার ঠিক থাকে?‌ দুটো কড়া কথা তো বলতেই পারে। তবে যদি জানত, কেন সে বলাইয়ের দোকান থেকে জিনিস সরিয়েছে, নিশ্চয়ই এ কথা বলত না। তবে কোনও দিনই জানবে না। বৌদি কেন, কেউই জানবে না। ঘুঙুরকে কথা দিয়েছে বিধুনাথ। সবাইকে দেওয়া কথা বিধুনাথ ফেলতে পারে, ঘুঙুরকে দেওয়া কথা ফেলতে পারবে না।

ঘুঙুর বলেছিল, “আমার হাত পেতে কিছু নিতে লজ্জা করে বিধুদা। আপনি এ সব আনবেন না।”‌

বিধুনাথ সঙ্কুচিত ভাবে বলল, “‌‌এইটুকু চাল ডাল, দুটো আলু আবার দেওয়া হল নাকি?‌”‌

ঘুঙুর বলে, “‌তা হোক। বাবা জানলে রাগ করবে...” একটু থমকে বলে, “‌শুধু বাবার রাগ নয়, লোকে শুনলেও পাঁচকথা বলবে। জানেনই তো, স্বামীর কাছ থেকে তাড়া-খাওয়া মেয়েমানু্ষকে নিয়ে লোকে নানা কথা বলতে চায়।”

বিধুনাথ একটু চুপ করে থাকে। নিচু গলায় বলল, “‌‌তোমার বাবা জানবে কেন?‌ কে বলবে তাকে?‌ লোকেও বা শুনবে কী করে?‌‌ আমি তো কাউকেই বলি না, বলবও না। এই কথা দিলাম। ও তুমি কিছু ভেবো না ঘুঙুর। মুকুন্দদাকে ওষুধ খাওয়ানোর আগে দুটো ভাতে-ভাত ফুটিয়ে নিয়ো। একটু আনাজ দিয়ো। সঙ্গে আধখানা ডিমসেদ্ধ। পেটে কিছু না পড়লে ওষুধ কাজ করবে না। তুমি বাকি আধখানা ডিম খেয়ো। শরীর গেলে বাবার সেবা করতে পারব না।‌‌”‌

ঘুঙুর একটু চুপ করে থেকে বলে, “‌আপনি ঘরে আসুন বিধুদা। কিছু ক্ষণ বসে, জিরিয়ে নিন। একটু জল খাবেন?‌”

রোগা চেহারা, গায়ের রংও ময়লা, তাও বড্ড মায়াকাড়া মেয়ে ঘুঙুর। চোখে চোখ পড়লেই বুকের ভিতর কাঁপুনি দেয় বিধুনাথের। দ্রুত চোখ নামিয়ে ফেলে। সে শুনেছে, মেয়েদের অনেক ক্ষমতা। চোখে চোখ রেখে নাকি পুরুষমানুষের বুকের কাঁপুনি ধরিয়ে ফেলে। তার বেলা যদি সে রকম কিছু ঘটে?‌ সে বড় লজ্জার হবে। এই কারণেই বিধুনাথ বেশি ক্ষণ থাকতে চায় না, দোরগোড়ায় দাঁড়িয়ে দুটো কথা বলে চলে আসে। মা-মরা ঘুঙুরের বিয়ের আগেও তাই করেছে। কষ্ট হলেও এই বিয়ে মেনে নিয়েছিল বিধুনাথ। না নিয়ে উপায় কী?‌ সে কে? করে কী? ভালবাসার কথা বলবে কোন জোরে?‌‌ দু’‌বছর গড়াতে না গড়াতে‌ শ্বশুরবাড়ি থেকে ফেরত এসেছে ঘুঙুর। এখন মুকুন্দদার কঠিন অসুখ। কাজকম্ম শিকেয় উঠেছে। সংসার চলাই কঠিন। বিধুনাথ যে বলাইয়ের দোকানে কাজ নিয়েছিল, সে তো খানিকটা এদেরই জন্য। যদি কিছু করা যায়। কিন্তু ঠিক পথে সে আর হল কই?‌ বলাই তো টাকাপয়সা কিছুই দিল না। বাধ্য হয়ে চাল-ডালে হাত বাড়াতে হল। না হলে বাপ-বেটিতে না খেয়ে মরবে। নিজের বাড়িতে তাও দু’‌বেলা ভাত জুটে যায়। ঘুঙুররা তো হাবুডুবু খাচ্ছে। এই সময় পাশে না দাঁড়ালে হয়?‌ তবে হিসাব রেখেছে বিধুনাথ। হাতে পয়সা এলে বলাইকে মিটিয়ে দেবে সব। এ সব কথা কাউকে বলার নয়। বিধুনাথ বলতে চায়ও না।

ঘুঙুরকে ভালবাসার মতোই নিজের কাছে গোপন রাখতে চায়।

পড়া শেষ করেছে কলকলি। রচনা লিখেও ফেলছে। ‘‌আমার বাড়িতে শরৎকাল’। লেখাপড়ায় মন না থাকলেও এই মেয়ের হাতের লেখা ঠাকুমার মতো সুন্দর, গোটা গোটা। সে ঠিক করেছে, বাড়ির সবাইকে এই লেখা দেখাবে। কারণ এই রচনা সে খুব রেগে রেগে লিখেছে। রাগের কথা চেপে রাখলে পেট ফোলে।

কলকলি পা টিপে টিপে ঘরে ঢুকল। খাতা এগিয়ে দিয়ে বলল, “‌কাকা, দেখে দাও।”

ভাইঝির জন্য বিধুনাথের মায়া হল, বেচারি মায়ের কাছে বকুনি খেয়েছে। শুয়েই শুয়েই পড়তে শুরু করল বিধুনাথ। আর পড়তে পড়তেই লাফিয়ে উঠল! কলকলি এ সব কী লিখেছে! সে বুদ্ধিমতী ঠিকই, তা বলে এত পাকা‌ কথা শিখল কোথায়?‌ কলকলি লিখেছে—

“‌‌নীল আকাশে পেঁজা তুলার মতো সাদা মেঘ ভাসিয়া বেড়ায়। কাশফুল ফোটে। রেডিয়োতে মহালয়া বাজে। বাতাসে পুজোর গন্ধ ওড়ে। পুজো মণ্ডপে দুর্গাঠাকুর তৈরি হয়। এই সময় সবার মন থাকে খুশি। শুধু আমাদের বাড়িতে কেউ খুশি থাকে না। কেউ কাউকে খুশি করার কথা ভাবে না, খুশি দেখতেও চায় না। এক জন বাড়ি ফেরে না, এক জন গম্ভীর মুখে পুকুরঘাটে বসে থাকে, এক জন বেলা পর্যন্ত ঘরে চাদর মুড়ি দিয়ে শুয়ে কী যেন ভাবে। এ বাড়ির ছোট মেয়েটাই শুধু একা একা খুশি থাকতে জানে। তখন তার মা রাগ করে বকুনি দেয়। চড়ও মারে। এই বাড়ির শরৎকাল‌ মোটে ভাল নয়।”

বিধুনাথ‌ তক্তপোশ থেকে লাফিয়ে নামল। একটু আগে নিজের জন্য যে ঝাঁকুনি সে খুঁজছিল, তা সে পেয়ে গেছে। কলকলির চুল ঘেঁটে দিয়ে হেসে বলল, “‌মাকে এই রচনা দেখালে আবার চড় খাবি কিন্তু।”

এই সময় বাড়ির গুদামঘরে আর এক ঘটনা ঘটেছে। আদিনাথ তাঁর মৃতা স্ত্রীকে খুঁজে পেয়েছেন। ঘরে ঢুকে এটা-সেটা নাড়াচাড়া করতে গিয়ে জং-ধরা ট্রাঙ্কটা খুলে ফেলেছিলেন। আর তখনই দেখলেন এক কোণে কাচ ভাঙা, তেবড়ে যাওয়া টিনের ফোটো ফ্রেমে সাজগোজ করে ছবি হয়ে বসে রয়েছেন অতি সুন্দরী, তরুণী শান্তিদেবী। যেন অপেক্ষা করছেন। বহু বছর আগে স্টুডিয়োতে তোলা ছবি।‌ কত দিন আগে?‌ বিয়ের বছর?‌ না কি তার পরের বছর?‌ ছবিহলুদ হয়ে গেছে। আদিনাথের মনে হল, ছবির শান্তি যেন ভুরু কুঁচকে ধমক দিচ্ছেন।

‘সব কিছু আঁকড়ে আছ কেন? ছেড়ে দাও এ বার।‌‌’‌‌

আদিনাথ স্ত্রীর ছবি বুকে চেপে ধরে ঘরে ফিরলেন।

দ্বিতীয় দিন

আজ ভোরে আলো ফোটার আগে, আবছা অন্ধকারে হরিনাথ ফিরে এসেছে। সে বৌয়ের জন্য একটা সস্তার শাড়ি কিনে এনেছে। পুজোর শাড়ি। সেই শাড়ি হাতে নিয়ে অনেক ক্ষণ বসেছিল চাঁপা। এক বার আনন্দে কাঁদছিলও কি?‌

সকালে ঘুম ভেঙে কলকলি দেখে, পাশে বাবা শুয়ে। ‘‌ফুড়ুত ফুড়ুত’ করে‌ নাক ডাকাচ্ছে। সে আনন্দে চিৎকার করে উঠতে যায়। চাঁপা তার মুখ চেপে ধরে। বলে, “‌‌চেঁচাবি না। মানুষটার ঘুম ভেঙে যাবে। বেচারি কত পথ পেরিয়ে এসেছে কে জানে।”

বেলা বাড়তে চাঁপাকে ডেকে পাঠালেন শ্বশুরমশাই। চাঁপা ঘরে গিয়ে বলল, “‌বাবা, আপনার বড় ছেলে এসেছে।”

আদিনাথ গম্ভীর গলায় বললেন, “‌গাধাটাকে বাড়িতে ঢুকতে দেওয়া উচিত হয়নি। দেখো যদি পুজোর ক’টা দিন আটকে রাখতে পারো। একটা কথা চাঁপা, এ বার থেকে আমার আলমারির চাবি থাকবে তোমার কাছে। টাকা পয়সা বুঝেশুনে খরচ করলে অসুবিধে হবে না। আর শোনো, ফটো বাঁধানোর ভাল দোকান কোথায় হয়েছে খবর নিয়ো তো।”

হতভম্ব চাঁপা কিছু বলতে যায়। আদিনাথ মুখ ফিরিয়ে নেন।

শ্বশুরের কাছ থেকে ফিরে চাঁপা বিধুনাথকে চা করে দিল। গলা নামিয়ে বলল, “কাল আমার কথা তোমার কানে গেছে?‌ ‌কিছু মনে কোরো না। মাথার ঠিক থাকে না। আমি জানি, তুমি নিজের জন্য অমন কাজ করবে না। নিশ্চয়ই কিছু ঘটেছে। যাক, আমার কাছে কিছু টাকা সরানো আছে। যাও, আজই বলাই লোকটার মুখের ওপর ছুড়ে দিয়ে এসো।”‌

দুপুরে সদরে গিয়ে বলাই নস্করের পাইপয়সা মিটিয়ে, বিকেল নাগাদ ঘুঙুরের বাড়ি পৌঁছল বিধুনাথ। সে আজ ও বাড়ির চৌকাঠ ডিঙোল। শুধু তা-ই নয়, মোড়ায় বসে ঘুঙুরের এনে দেওয়া জল খেল, ঘুঙুরের চোখে চোখ রেখে গল্পও করল খানিক ক্ষণ। বেরিয়ে আসার সময় নিচু, কিন্তু দৃঢ় গলায় বলল, “চিন্তা কোরো না ঘুঙুর, আমি আছি।”‌

ঘুঙুর মাথা নামিয়ে বলল, “‌আর একটু বসে যান বিধুদা।”

বিধুনাথ হেসে বলল, “‌আজ হবে না। কলকলিকে পুজো মণ্ডপে নিয়ে যেতে হবে। সন্ধেবেলা ঢাকীদের রিহার্সাল আছে। তুমি যাবে ঘুঙুর?‌ চলো না, ভাল লাগবে।”

ওহ্‌, আজ আর এক কাণ্ড হয়েছে, সে কথা তো বলাই হয়নি। আজ সকালে কলকলিদের বাড়ির শিউলি গাছটা ঝাঁপিয়ে ফুল ফেলেছিল। উঠোন ছেয়ে গিয়েছিল। মনে হচ্ছিল, এ বাড়ির যাবতীয় মনখারাপ কেউ ফুল দিয়ে মুছে দিয়েছে।

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement