ত্রয়ী: ইন্দিরা দেবী (বাঁ দিকে) ও সুরেন্দ্রনাথ ঠাকুরের সঙ্গে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর (মাঝখানে)। —ফাইল চিত্র।
১৮৯৩ সাল। মার্চ মাসের সাত তারিখ। কটক থেকে প্রিয় ভাইঝি ইন্দিরাকে রবীন্দ্রনাথ একটি চিঠিতে লিখলেন, “সুরি বেচারা একজামিন পাস করার জন্যে সৃষ্টি হয় নি। ওর উচিত ছিল আমার মতো পাশ-কাটানো ‘লিটারেরি’ হওয়া। কিন্তু তার পক্ষে একটি ব্যাঘাত হয়েছে এই যে, ও যেমন আপনার ইজিচেয়ারটির মধ্যে নিমগ্ন হয়ে দিব্যি আরামে বসে আছে, ওর মনটিও তেমনি ওর অন্তঃকুহরটির মধ্যে দিব্যি গট হয়ে বসে আছে— তার অগাধ সন্তোষ কিছুতেই বিচলিত হয় না।” এই চিঠিতেই কবি জানিয়েছিলেন, “সুরির কোনো খ্যাপামি নেই, ও ভারি স্নিগ্ধ।” কিন্তু কে এই কবির আদরের ‘সুরি’, যার প্রশংসায় তিনি নিজের সঙ্গে তুলনা করেছেন!
দেড়শো বছর আগেকার কথা। বাংলায় তখন নবজাগরণের জোয়ার। বাংলার নবজাগরণের সাক্ষী ঠাকুরবাড়ির কর্তা মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ। মহর্ষির মধ্যম পুত্র এ দেশের প্রথম আইসিএস সত্যেন্দ্রনাথ ও তাঁর পত্নী জ্ঞানদানন্দিনীর কোলে ১৮৭২ সালের ২৬ জুলাই তারিখে, পুণে প্রবাসকালে জন্ম সুরেন্দ্রনাথের। সমসাময়িক অনেকের স্মৃতিকথায় জানা যায় সুরেন্দ্রনাথ বলতেন, তিনি নাকি ইংরেজদের চোখে খুবই অপ্রিয়। কারণ তাঁর মতে, ইংরেজরা যে দু’টি জীবকে দু’চক্ষে দেখতে পারে না তা হল ‘বেঙ্গলিবাবু’ এবং ‘পুনা ব্রাহ্মিন’— তিনি একাধারে দু’টিই। কিন্তু বাস্তবে দেখা গেছে, তিনিই ইংরেজদের দেখতে পারতেন না, এবং বিলিতি শিক্ষায় পারদর্শী হয়েও দেশ থেকে ইংরেজদের তাড়ানোয় সক্রিয় ভূমিকা নিয়েছিলেন।
সুরেন্দ্রনাথ ১৮৮৯ সালে সেন্ট জেভিয়ার্স কলেজ থেকে প্রথম বিভাগে এনট্রান্স পাশ করে ১৮৯৩ সালে বিএ পরীক্ষাতেও কৃতিত্বের সঙ্গে উত্তীর্ণ হন। এর বছর দুই পর ১৮৯৫ সালে ‘টেগোর অ্যান্ড কোম্পানি’ খুলে জীবিকার সন্ধানে নামেন। যদিও সে ব্যবসায় লাভের বদলে চূড়ান্ত আর্থিক ক্ষতি হয় বলে জানা যায়। ব্যবসার ভূত তাঁর মাথা থেকে সাময়িক ভাবে চলে যায়। এই সময়ে রবীন্দ্রনাথ সম্পাদিত ‘বঙ্গদর্শন’ পত্রিকার প্রথম সংখ্যায় হিন্দু বর্ণাশ্রমের পক্ষে ব্রহ্মবান্ধব উপাধ্যায়ের একটি লেখা প্রকাশিত হয়েছিল। দ্বিতীয় সংখ্যায় সেই লেখাটির প্রবল সমালোচনা করে সুরেন্দ্রনাথ বর্ণাশ্রমের বিরোধিতা করে একটি প্রবন্ধ লেখেন। এর পর থেকেই তিনি ধীরে ধীরে জড়িয়ে পড়েন দেশের কাজে।
তাঁর যৌবনকালে ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনের প্রতি তাঁর আকর্ষণ জন্মায়। বঙ্গভঙ্গ রদ আন্দোলনের আগে তৎকালীন অবিভক্ত বাংলায় ছোট ছোট বিপ্লবী সংগঠন আর গুপ্ত সমিতি গড়ে উঠছিল। সেই সমস্ত গুপ্ত সমিতির মধ্যে ১৯০১ সালে গড়া ‘নিখিল ভারত বৈপ্লবিক সঙ্ঘ’ অন্যতম। এই সমিতি তৈরির নেতৃত্ব দিয়েছিলেন সভাপতি প্রমথনাথ মিত্র, সহ-সভাপতি চিত্তরঞ্জন দাশ ও অরবিন্দ ঘোষ, কোষাধ্যক্ষ সুরেন্দ্রনাথ ঠাকুর, ছাত্রপরিচালক ও ব্যায়ামাগারের অধ্যক্ষ যতীন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় প্রমুখ। সেই বছর নিবেদিতার সৌজন্যে জাপানের শিল্পী ও বিপ্লববাদী নেতা কাকুজ়ো ওকাকুরা কলকাতায় এলে সুরেন্দ্রের সঙ্গে আলাপ হয়। এই বিষয়ে বিপ্লবী নেতা ভূপেন্দ্রনাথ গুপ্তর সাক্ষ্য বলে, “ওকাকুরার উদ্যোগে, ভারতকে স্বাধীন করিবার উদ্দেশ্যে, ভারতে মুক্তির বাণী প্রচার করিবার জন্য, জনকতক নামজাদা লোক লইয়া একটি ভাসা ভাসা মণ্ডলী গঠিত হয়। ইহার মধ্যে যতদূর অবগত আছি হেমচন্দ্র মল্লিক, সুরেন্দ্রনাথ ঠাকুর, ভগিনী নিবেদিতা প্রভৃতি ছিলেন।” নিবেদিতা নিজের বাড়িতে আমন্ত্রণ করে ওকাকুরার সঙ্গে সুরেন্দ্রনাথকে আলাপ করিয়েছিলেন। সুরেন্দ্রনাথ ওকাকুরাকে নিজের বাড়িতে অতিথি হিসেবে রেখেছিলেন। ওকাকুরা এবং নিবেদিতাই সুরেন্দ্রর ভিতরের দেশপ্রেম জাগিয়ে তোলেন।
বিহারীলাল চক্রবর্তীর পড়শি, রবীন্দ্র-অনুচর প্রিয়নাথ সেনের কন্যা সংজ্ঞা দেবীর সঙ্গে ১৯০৩ সালের ৬ জুলাই সুরেন্দ্রনাথের বিবাহ হয়। সেই উপলক্ষে রবীন্দ্রনাথ উপহার দিয়েছিলেন দু’টি গান, ‘যে তরণীখানি ভাসালে দুজনে’ এবং ‘দুজনে যেথায় মিলিছে সেথায়’। সংজ্ঞা দেবীর স্মৃতিচারণে জানা গেছে, সুরেন্দ্র তাঁর স্ত্রীকে পর্যন্ত বলেননি দেশের সশস্ত্র বিপ্লবীদের সঙ্গে তাঁর ঘনিষ্ঠ যোগাযোগের কথা। বিপ্লবীদের অর্থদান করতেন নীরবে।
দেশসেবার সঙ্গে দেশবাসীর সেবাকেও বরাবর প্রাধান্য দিয়েছেন। তিনি দেশব্রতের আদর্শ সমান ভাবে মেনে চলতেন ব্যক্তিজীবন ও পরিবারের ক্ষেত্রেও। সুরেন্দ্র ও সংজ্ঞা দেবীর ছোট মেয়ে জয়শ্রী যখন বিয়ের জন্য নিজের পছন্দ করা পাত্রের পরিচয় পরিবারের কাছে জানান, দেখা যায় তা পারিবারিক প্রথাবিরুদ্ধ। পরিবারের অনেকেই সম্মত হননি। সুরেন্দ্রনাথ তখন বলেছিলেন, “আমরা সকলেই উচ্চকণ্ঠে প্রচার করি যে দেশমাতা এক, আমরা সকলেই তাঁর সন্তান, তখন মেয়ে অন্য জাতে বিয়ে করবার ইচ্ছে প্রকাশ করলে কোন্ মুখে আপত্তি করব?” প্রসঙ্গত জানা যায়, জয়শ্রীর বিয়ে হয়েছিল রবীন্দ্রসুহৃদ বিহারীলাল গুপ্তের কন্যা স্নেহলতা ও গুরুপ্রসাদ সেনের পুত্র কুলপ্রসাদের সঙ্গে। রবীন্দ্রনাথ নিজে উপস্থিত থেকে এই বিয়ের পৌরোহিত্য করেছিলেন।
পূর্বপুরুষদের এই প্রথা ভাঙার কৃতিত্বের তিনি ছিলেন সার্থক উত্তরাধিকারী। সুরেন্দ্রের বাবা সত্যেন্দ্রনাথ চিরকাল মেয়েদের শিক্ষা ও স্বাধীনতায় নজর দিয়েছিলেন। বিলেতে থাকাকালীন স্বপ্ন দেখতেন জোড়াসাঁকোর বাড়ির অন্দরমহলের সমস্ত খড়খড়ি ভেঙে দিচ্ছেন, পর্দাপ্রথা তুলে দিচ্ছেন। দৃঢ়চেতা স্বামীর পরামর্শ মতো ফরাসি ওরিয়েন্টাল পোশাকে সজ্জিত হয়ে জ্ঞানদানন্দিনী ঘেরাটোপ পালকিতে করে জাহাজে উঠে পাড়ি দিয়েছিলেন বিলেত অভিমুখে। পরিবার-জীবনে অনুশাসন-প্রথা ভাঙার এমন দুঃসাহসিক পদক্ষেপ বাংলাদেশে এর আগে কেউ করেছিলেন বলে জানা নেই। সত্যেন্দ্রনাথ ছেলেবেলা থেকেই যে স্ত্রী-স্বাধীনতার পক্ষপাতী ছিলেন তা কবুল করেছেন ‘আমার বাল্যকথা ও বোম্বাই প্রবাস’ বইতে। শুধু তো নারী স্বাধীনতা নয়, স্বাদেশিকতাবোধ ও বাঙালিয়ানায় তিনি ছিলেন ষোলো আনা খাঁটি। সেই যুগে যখন বাংলা বলতে বাঙালি লজ্জা পেত, তার সাজপোশাক আদবকায়দায় থাকত পুরোদস্তুর সাহেবিয়ানা, সত্যেন্দ্র বিলেত-ফেরত সিভিলিয়ান হয়েও সেই মোহে কখনও আচ্ছন্ন হননি।
এ ছাড়াও সুরেন্দ্রের মধ্যে শিল্প-সাহিত্যের দক্ষতাও স্পষ্ট। রবীন্দ্রনাথ তাঁকে বার বার লেখায় উৎসাহিত করেছেন। চিঠিতে ‘সেটা ইংরেজিতে তর্জমা করিস তো ভালো হয়’, এমন কথাও লিখেছিলেন। রবীন্দ্রনাথের বহু লেখা তিনি ইংরেজিতে অনুবাদ করেছেন। উল্লেখযোগ্য ‘ঘরে-বাইরে’, ‘চোখের বালি’, ‘জীবনস্মৃতি’। তাঁর করা অনুবাদে কবি নিজেও নিশ্চিন্ত থাকতেন। জানতেন, তাঁর মনের ভাব প্রিয় ভাইপো ‘সুরি’ ঠিকই অনুধাবন করতে পারবে। রথীন্দ্রনাথের ‘পিতৃস্মৃতি’ থেকে জানা যায়, কালীপ্রসন্ন সিংহের মহাভারত ইংরেজিতে অনুবাদ করার কথা রবীন্দ্রনাথই সুরেন্দ্রকে বলে করিয়েছিলেন। শিলাইদহে গেলে সুরেন্দ্র সেই অনুবাদের পাণ্ডুলিপি সঙ্গে নিয়ে সকলকে গিয়ে পড়ে শোনাতেন। বিজ্ঞান বিষয়ক প্রবন্ধও লিখেছেন ‘সাধনা’ পত্রিকার প্রথম সংখ্যা থেকে।
অসম্ভব ভাল পিয়ানো বাজাতে পারতেন। ব্রাহ্মসমাজে রবীন্দ্রনাথ গান গাইতে গেলে ইন্দিরা বা সুরেনকে সঙ্গে নিতেন। এসরাজে তাঁর হাত ছিল ঝরঝরে ও সুরেলা। ব্রাহ্মসমাজ ও ঠাকুরবাড়ির শিক্ষক কানাইলাল ঢেঁড়ির কাছে তিনি এসরাজে তালিম নিয়েছিলেন। পদ্মাবোটে প্রায় প্রতি সন্ধ্যায় রবীন্দ্রনাথ গানের আসর বসাতেন। সুরেন্দ্র সেখানে থাকলে এসরাজে সঙ্গত করতেন, রথীন্দ্রনাথের স্মৃতিকথায় সেই তথ্য মেলে। ১৩২৩ বঙ্গাব্দের আশ্বিন-কার্তিক সংখ্যা ‘সবুজপত্র’-এ ‘রাগ ও মেলডি’ নামে একটি অসাধারণ প্রবন্ধ লিখে সকলের প্রশংসা কুড়োন।
যখন সতেরো বছর বয়সে প্রথম বার ইংল্যান্ডে গিয়েছিলেন রবীন্দ্রনাথ, তখন সুরেন্দ্র এবং ইন্দিরার শৈশবকাল। এই দুই শিশু ছিল সে সময়ে কিশোর রবির খেলার সঙ্গী। কবি তাঁদের নিয়ে মজার মজার গান করতেন, ছড়া লিখতেন হিন্দি-বাংলা মিশিয়ে। ‘নাসিক হইতে খুড়ার পত্র’ এমন একটি ছড়া— “কলকাত্তামে চলা গয়ো রে সুরেনবাবু মেরা,/ সুরেনবাবু, আসল বাবু, সকল বাবুকো সেরা।/... গাড়ি চড়কে লাঠিম পড়কে তুম্ তো যাতা ইস্কুল,/ ঠোঁটে নাকে চিমটি খাকে হমারা বহুৎ মুস্কিল!”
সুরেন্দ্রনাথও খুড়োকে দেবনাগরী হরফে চিঠি দিতেন। “তব চিঠি প্রাপ্য সন্তোষং প্রাপ্নোমি। তব পেটম্ম পীড়ণাং ন ভক্ষয়সি শ্রুত্বা বড়ং কষ্টং প্রাপ্নোমি।...” এই ধরনের মজার খেলার মধ্যে তাঁদের উভয়ের জীবন কেটেছিল বলেই রবীন্দ্রনাথ ‘জীবনস্মৃতি’তে লিখেছেন, “শিশুদের কাছে হৃদয়কে দান করিবার অবকাশ সেই আমার জীবনে প্রথম ঘটিয়াছিল— দানের আয়োজন তাই এমন বিচিত্র ভাবে পূর্ণ হইয়া প্রথম প্রকাশ পাইয়াছিল।” রবীন্দ্রনাথ ‘বিসর্জন’ লেখার পর উৎসর্গপত্রে সুরেন্দ্রনাথের উদ্দেশ্যে একটি দীর্ঘ কবিতা লিখেছিলেন, “শ্রীমান সুরেন্দ্রনাথ ঠাকুর প্রাণাধিকেষু,
তোরি হাতে বাঁধা খাতা, তারি শ-খানেক পাতা/ অক্ষরেতে ফেলিয়াছি ঢেকে,/ মস্তিষ্ককোটরবাসী চিন্তাকীট রাশি রাশি/ পদচিহ্ন গেছে যেন রেখে...”
ইন্দিরা দেবীর নানা স্মৃতিচারণে রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে তাঁদের এই সমস্ত নানা মজার কাহিনি বিধৃত আছে। এই ভাইবোনের প্রতি রবীন্দ্রনাথের সেই স্নেহ শেষ দিন পর্যন্ত অটুট ছিল। বেশ কিছু দিন শান্তিনিকেতনে ‘সুরপুরী’তে বাস করেছেন সুরেন্দ্রনাথ। ‘বিশ্বভারতী কোয়াটার্লি’ পত্রিকার সম্পাদনাও করেছেন। বিশ্বভারতী অছি-পরিষদের আজীবন সদস্য ছিলেন তিনি। বিশ্বভারতী কার্যসমিতির নানা ভূমিকাতেই তাঁকে দেখা গেছে।
যদিও মাঝে পূর্ববঙ্গের জমিদারি ভাগের সময়কালে জমি কেনাবেচা নিয়ে রথীন্দ্রনাথ ও সুরেন্দ্রনাথের উপর রবীন্দ্রনাথ যথেষ্ট বিরক্ত হয়েছিলেন। এঁদের ব্যাপারে উদ্বেগ প্রকাশ করেছিলেন প্রমথ চৌধুরীর কাছে। একটি চিঠিতে লিখেছিলেন, “ব্যাঙ্ক সম্পর্কে আমার মনে উদ্বেগ আছে। ওতে বিদ্যালয়ের টাকা ঢেলেছি। সুরেন কিম্বা রথী যদি যখন খুশি ওর থেকে টাকা draw করে তাহলে আমি ওখানে টাকা রাখা কোনোমতেই নিরাপদ মনে করি নে।” এক সময়ে সুরেন্দ্রনাথ খুবই আর্থিক অনটনে পড়েছিলেন। যে কারণে কলকাতা-সহ নানা স্থানের জমি ও বাড়ি তাঁকে বিক্রি করতে হয়েছিল।
১৯০৬ সালে এ দেশের বুকে স্বাদেশিকতার এক ঐতিহাসিক কীর্তি স্থাপনে সুরেন্দ্রনাথের বিশেষ অবদান ছিল। জোড়াসাঁকো ঠাকুরবাড়ির একটি ছোট্ট ঘরে পটনার অধ্যাপক অম্বিকাচরণ উকিলের পরামর্শে সুরেন্দ্রনাথ গৌরীপুরের ব্রজেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরীকে সঙ্গে নিয়ে ‘হিন্দুস্থান জীবনবীমা সমবায়’ প্রতিষ্ঠান (হিন্দুস্থান ইনশিয়োরেন্স সোসাইটি) শুরু করেছিলেন। তখন স্বদেশি যুগ। বিলিতি জিনিস বর্জনের পাশাপাশি স্বদেশি দ্রব্যের বণ্টন ব্যবস্থায় স্বদেশি সমবায় বিমার প্রয়োজনেই তৈরি হয়েছিল এই প্রতিষ্ঠান। পরে তা কলকাতা পুরসভার প্রধান দফতরের কাছে একটি বাড়িতে স্থানান্তরিত হয়েছিল। আজ সেই বাড়ি এক বিশাল মহীরুহ হয়ে এসপ্ল্যানেডের মোড়ে মাথা তুলে ইতিহাসের সাক্ষী হয়ে আছে। এই প্রতিষ্ঠানটিকে দাঁড় করাতে তাঁকে অক্লান্ত ও অতিরিক্ত পরিশ্রম করতে হয়। এই কারণে শুরুতে জ্ঞানদানন্দিনী দেবী আপত্তি করেছিলেন। কিন্তু সে নিষেধ তিনি অমান্য করে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন সাধারণ মানুষের সুরাহা হবে ভেবে। স্ত্রীকে বলেওছিলেন, “আমার প্রাণের ইচ্ছে সকল গৃহস্থের বাড়ি-ঘর হবে।” প্রায়ই বলতেন, “রাস্তার মোড়ে মোড়ে কফিখানায় গাড়োয়ানরা বসে চা খায়। দেখে আমার বড়ো ইচ্ছে করে ওদের সঙ্গে চা খাই, আর ওদের ঘরের সুখদুঃখের কথা শুনি।” যখন সত্যি সত্যি সে সব দোকানে চা খেতে ঢুকেছেন, দুঃখ পেয়েছেন। কারণ তিনি ঢুকলেই তারা চুপ করে যেত, তাঁর সঙ্গে বন্ধুর মতো মিশে চা খেতে পারত না। বলেছিলেন, “তাই আমি দূর থেকে দাঁড়িয়ে ওদের একটু আনন্দ করতে দেখি।” স্ত্রী সংজ্ঞা দেবীর মতে, এমন চিন্তার ফলেই হয়তো তাঁর শেষ বয়সে লেখা ‘বিশ্বমানবের লক্ষ্মীলাভ’ বইটি প্রকাশিত হয়েছে। শ্রমজীবী মানুষের উন্নতিতে রুশ বিপ্লবের জয় তাঁকেও প্রভাবিত করেছিল।
অথচ আজ ভারতে স্বাধীনতার পঁচাত্তর বছরের ‘অমৃত মহোৎসব’কালে সার্ধশতবর্ষ-অতিক্রান্ত এই নিভৃতচারী প্রচারবিমুখ আদ্যন্ত স্বদেশি মানুষটিকে ক’জনই বা মনে রেখেছেন! হয়তো এই কারণেই বহু দিন আগে সুরেন্দ্র সম্পর্কে ‘ছিন্নপত্র’-এ কবি লিখেছিলেন, “পুরুষ মানুষ যতক্ষণ না সর্বসাধারণের মধ্যে আপনাকে প্রতিষ্ঠিত করে ততক্ষণ তার সম্পূর্ণ সার্থকতা নেই।” সুরেন্দ্রনাথ ঠাকুর তাঁর নানা কীর্তি প্রতিষ্ঠিত করলেও, প্রচারের আলোয় নিজেকে তুলে ধরতে পারেননি।
তথ্যঋণ: সুরেন্দ্রনাথ ঠাকুর শতবার্ষিকী সংকলন, গৌতম চট্টোপাধ্যায় ও সুভাষ চৌধুরী সম্পাদিত; শ্রীনন্দা মুখোপাধ্যায়