ছবি: প্রসেনজিৎ নাথ।
টোটো একটু পরে ধরবে, ফোনে ছেলেটা চকলেট নিয়ে যাওয়ার জন্য আবদার করেছিল। বেশি কিছু নয়, সামান্য কুড়ি টাকার একটা চকলেট পেলেই ছেলেটার মুখে স্বর্গীয় হাসি ফুটে ওঠে। আগে ঋক কমদামি চকলেট চোখেও দেখেনি। সময় তার সাত বছরের ছেলেটাকেও মানিয়ে নিতে শিখিয়ে দিয়েছে।
চকলেট কিনে টোটোর অপেক্ষায় ছাতা মাথায় দাঁড়াল রুমকি। হঠাৎ উল্টো দিকের ফুটপাতে চোখ চলে গেল। বাটিক প্রিন্টের শার্ট গায়ে মাঝারি উচ্চতার ছেলেটা অভ্র মনে হচ্ছে! ফুটপাতের গায়ে টেবিল পাতা, উপরে ত্রিপল খাটানো, টেবিলে অসংখ্য লটারির টিকিট। রাস্তা পার হয়ে টেবিলের সামনে গিয়ে নিশ্চিত হল রুমকি। অভ্র লটারির টিকিট কিনছে! একশো টাকার নোট বাড়িয়ে দিল, ফেরত নিল না কিছুই। তার মানে একশোটা টাকা লটারির পিছনে উড়িয়ে দিল অভ্র!
রুমকিকে দেখে অপ্রস্তুত ভঙ্গিতে হাসল অভ্র, “তুই এখানে?”
“এ দিকটায় আয়। লটারি স্টলের সামনে দাঁড়ানোটা ঠিক হবে না।”
অভ্র রুমকিকে জিজ্ঞেস করল, “আবার সাংসারিক কাজে?”
“হুম। তুই লটারির টিকিট কিনিস?”
“মাঝেসাঝে কিনি।”
“কেন? ভাগ্য ফিরবে বলে?” রুমকি শ্লেষের সুরে বলল, “ও ভাবে ভাগ্য ফেরানো যায় না। টিকিটগুলো দেখি।”
“টিকিট দেখে কী করবি?”
“দেখব, জানব। ভাবছি আমিও খেলব লটারি। আমার ইচ্ছে হতে পারে না? কোন লটারি, কখন খেলা হয় জেনে রাখা ভাল।”
বুকপকেট থেকে টিকিটের গোছা বার করে রুমকির হাতে দিল অভ্র, “ডেলি লটারি। প্রতিদিন চার বার খেলা হয়। রাত আটটায় একটা ড্র হয়। ওটার টিকিট কাটলাম।”
ছাতাটা গুটিয়ে টিকিটের গোছাটা কুচি কুচি করে ছিঁড়ে ফেলল রুমকি। চোখ তার জ্বলছে, ঘন ঘন কাঁপছে ঠোঁট। অভ্র কিছু বলার আগেই হাত দেখিয়ে টোটোতে প্রায় লাফিয়ে উঠে পড়ল রুমকি।
ভ্যাবলার মতো সে দিকে তাকিয়েই থাকল অভ্র। চোখের সামনে মুহূর্তে একশোটা টাকা নষ্ট হয়ে গেল। তবে এইমাত্র যা ঘটল, তার কার্যকারণ কিছুই সে বুঝে উঠতে পারল না।
একশো টাকার শোক আদৌ ছুঁতে পারল না তাকে। লটারির টিকিট কেনার আগেই গতকাল বিকেল পাঁচটা নাগাদ সে উদয়পল্লি গিয়েছিল। নিষিদ্ধ খবর মানুষের কানে ঠিক পৌঁছে যায়। কোভিডের দ্বিতীয় ঢেউয়ের জন্য কয়েক মাস বন্ধ থাকার পরে উদয়পল্লির গলিতে আবার হাব্বাডাব্বা খেলা শুরু হয়েছে। পকেটে টাকা ছিল না বলেই সে এত দিন যায়নি। আজকে সে ছ’শো টাকা বাজি রেখে আঠারোশো পেয়েছে। একমাত্র এই
একটি ব্যাপারেই ভাগ্য তার দিকে মুখ তুলে
তাকায়। অত নৈতিকতার কেয়ার করতে তার বয়েই গেছে। দু’নম্বরি ব্যবসায়ী, নেতা, প্রোমোটার সবাই দিব্যি রসেবশে আছে। সে একা আদর্শের শুকনো খই কেন চিবোবে?
রুমকির এত রিঅ্যাকশন দেখানোর কী আছে? চার বছরের সম্পর্ক অনায়াসে ভুলে বিয়ের পিঁড়েয় বসে গিয়েছিল রুমকি। তখন অভ্র বিএড পড়ছে, তিন-চারটি স্টুডেন্ট পড়িয়ে কোনও মতে হাতখরচ চালাচ্ছে। অপেক্ষা না করে নিরাপত্তাকেই বড় করে দেখেছিল সে, চার বছরের প্রেমকে অনায়াসে দরজার বাইরে রেখে এসেছিল। বাড়ির লোকের চাপ নাকি সে আর উপেক্ষা করতে পারছে না! এই ছিল রুমকির সজল চোখের স্বীকারোক্তি। একই শহরের ছেলে নীলার্ণবকে মালা পরিয়েছিল
সে। নীলার্ণব সুপুরুষ, মেধাবী, বহুজাতিক কোম্পানির ইঞ্জিনিয়ার।
খেয়েদেয়ে ছাদে উঠে অভ্র সিগারেট ধরাল।
তখনই তার মোবাইল ফোনটা সুর করে জেগে উঠল। স্ক্রিনে অচেনা নম্বর দেখে আশ্চর্য হল অভ্র। গুটিকয় স্টুডেন্ট আর মল্লার বাদে কেউ তাকে সাধারণত ফোন করে না।
“হ্যালো।”
“আপনাদের বাড়িটা তাঁতকলের কাছে?” ফোনের ও-প্রান্তে এক মেয়ের গলা।
“হ্যাঁ। আপনি কে বলছেন?”
“সুমি বলছি।”
“ঠিক চিনলাম না।”
“পিসি আমার কথা বলেনি আপনাকে?” মেয়েটি বলল।
“আপনি ভুল নম্বরে রিং করেছেন।”
মেয়েটি রাগত ভাবে বলল, “মোটেই ভুল নম্বরে রিং করিনি। আপনি সুপ্রীতি পাইনের ছেলে বলছেন তো? আমার বাড়ি ভালাইডিহা। এ বার চেনা গেল?”
অভ্র লজ্জিত গলায় বলল, “স্যরি। মা আপনার কথা বলেছিল। আমিই ভুলে গিয়েছি।”
“আমাকে আপনি বলতে হবে না। বয়সে আপনার চেয়ে ছোটই হব। এ বার বলুন কোন দিকে যাব? তাঁতকলের সামনে দাঁড়িয়ে আছি।”
“সোজা আসুন, স্যরি এসো। কিছুটা এগোলেই বাঁ দিকে একটা গলি পড়বে। ওই গলি দিয়ে কয়েক পা এগোলেই আমাদের বাড়ি। বাড়ির নম্বর
ডি ইলেভেন।”
“বাড়ির নম্বরটা মনে আছে। পিসি বলেছিলেন। ঠিক আছে, এগোচ্ছি এ বার। না খুঁজে পেলে আবার ফোন করতে পারি। তখন আবার যেন ভুলে না যান। অবশ্য আমি এত ‘আপনি-কোপনি’ করছি কেন? তোমাকে ছোটবেলায় তুমিই বলতাম। কাউকে আপনি বলাটা আমার ঠিক আসে না।”
এই ভরদুপুরে তাদের বাড়িতে সুমির আসার দরকার পড়ল কেন? নিশ্চয়ই কোনও প্রয়োজন আছে। আজকাল মানুষ প্রয়োজন ছাড়া একটি পা-ও ফেলে না।
কিছু ক্ষণ বাদে ছাদ থেকেই অভ্র দেখতে পেল, ছাতামাথায় একটি মেয়ে দ্রুতপায়ে তাদের বাড়ির দিকে হেঁটে আসছে। সম্ভবত এটিই সুমি। বাগানের গেটের সামনে এসে দাঁড়াতেই অভ্র সিঁড়ি দিয়ে নামল। নামতেই সে অবাক হল। তার আগেই মা প্রায় দৌড়োতে দৌড়োতে বাগানের গেটের দিকে যাচ্ছে। এখন দেখে কে বলবে যে, এই মানুষটি মাঝেমধ্যে হাঁটতে গিয়ে সমস্যায় পড়ে! বাপের বাড়ির মেয়ে গেটে আসতেই গন্ধে টের পেয়ে গেল!
সুমিকে নিয়ে গিয়ে মা নিজের রুমে নিয়ে গিয়ে বসাল। তাকে ইশারায় ডাকল। মহা জ্বালা হল! ভেবেছিল বিছানায় লম্বা হয়ে শুয়ে একটা ইন্টারেস্টিং বই পড়বে। তার বদলে এখন দেঁতো হাসির সৌজন্য দেখাতে হবে।
সুপ্রীতি বললেন, “বাবু, এই সেই সুমি যার কথা তোকে বলছিলাম।”
“হ্যাঁ, চিনতে পেরেছি। একটু আগে আমাকে ফোন করেছিল।”
“তোমাকে ফোনে না পেয়ে তোমার ছেলেকে করেছিলাম,” সুমি বলল।
“মোবাইলটার চার্জ শেষ হয়ে গেছে একেবারে। তাই পাসনি।”
“তোমার ছেলের ডাকনাম বাবু? এত ক্ষণে মনে পড়ল। ভালাইডিহাতে সবাই ওই নামেই ডাকত। তা তোমার ছেলের আমাকে মনে নেই। না মনে থাকাই স্বাভাবিক। রাস্তাঘাটে দেখা হলে আমিও চিনতেই পারতাম না,” সুমি হাসল, “ আজ পেশেন্টের ভিড় কম ছিল। তা-ও কি আর ছাড় পেতাম? দুপুরে এক ঘণ্টার ব্রেক পাই। ম্যানেজ করে বেরিয়েছি। কোনও পেশেন্ট হাজির হলে আমাকে কল করবে ওরা। সময় পেয়ে চলে এলাম। আসাই হচ্ছিল না। মেসে এক বার সন্ধে সাতটায় ঢুকে পড়লে আর বেরোতে ইচ্ছে করে না। টায়ার্ড লাগে। খুঁজতে অবশ্য বেশি ক্ষণ লাগল না।”
সুমির পরনে সাদা রঙের কুর্তি আর আসমানি রঙের লেগিংস। উচ্চতা মাঝারি, গায়ের রঙ উজ্জ্বল শ্যামবর্ণ, মুখে সারা ক্ষণ হাসি। অভ্রর মনে হল, মেয়েটা বেশি বকে। মায়ের সঙ্গে বকেই চলেছে। এখানে অভ্র অকারণ দাঁড়িয়ে রয়েছে। তার চেয়ে উপরের ঘরে নিজের মতো থাকাই ভাল।
সে চলে আসার জন্য পা বাড়াতেই সুপ্রীতি উঠে এলেন। নিচুগলায় বললেন, “এক বার দোকানে যেতে হয় যে!’’
“কোন দোকান?’’
“মিষ্টি কিনে নিয়ে আসবি।’’
সুমি বলে উঠল, “পিসি, একদম ও সব নয়। নিশ্চয়ই তুমি ছেলেকে কিছু আনতে পাঠানোর মতলব করছ। ওটি একেবারে চলবে না। ক্যান্টিনে একটু আগেই লাঞ্চ করেছি। এখন কিছুই খেতে পারব না। এ রকম করলে কিন্তু আর আসবই না। তার চেয়ে এখানে এসে বোসো। গল্প করি।’’
“প্রথম বার এলি। কিছু না খাওয়ালে চলে?”
“তা হলে এক গ্লাস জল দাও। পরে যে দিন আসব সে দিন খাইয়ো,” সুমি বলল, “তোমার ছেলেকেও ছাড়ো। মেয়েদের গল্পে ওর থেকে কাজ নেই। এমনিতেই উসখুস করছে।’’
চমকে গেল অভ্র। মেয়েটা কি নিমেষেই তার মন পড়ে ফেলল? স্মার্ট মেয়ে, কথাবার্তায় সাবলীল, কোথাও কোনও জড়তা নেই, একখানা বালিশ নিজেই টেনে নিয়ে কোলে রাখল। মা বলেছিল যে মেয়েটা নাকি সহজ-সরল। তবে এটাও ঠিক যে সুমি নামের কোনও মেয়ের এতটুকু স্মৃতিও নেই তার। নাহ, তার ডিমেনশিয়া হওয়া কেউ ঠেকাতে পারবে না। সে উপরের ঘরে এসে একটা বই খুলে আধশোয়া ভঙ্গিতে পড়তে শুরু করল।
বইয়ের পাতায় তন্ময় হয়ে পড়েছিল অভ্র।
নীচ থেকে সুপ্রীতির ডাকে সে বিরক্ত হয়ে বাইরে বেরিয়ে এল।
“কী হল?”
“এক বার নীচে আয়।”
সে সিঁড়ি বেয়ে নামতেই সুপ্রীতি বললেন, “ওকে ছেড়ে দিয়ে আয়। রোদ-গরমে কেন কষ্ট করে এতটা হেঁটে যাবে বেচারি?”
বিরক্তি গোপন রেখে অভ্র বলল, “আচ্ছা।”
সুমি বলল, “না, থাক। কী দরকার? আমি দিব্যি হেঁটে যেতে পারব। বড় রাস্তায় উঠলে টোটো পেয়ে যেতে পারি।”
সুপ্রীতি ধমকের স্বরে বললেন, “তুই থাম তো। বাইকে একটু ছেড়ে দিয়ে আসবে। অত কিন্তু-কিন্তু করার কী আছে?”
বাইকের পিছনে সুমি সওয়ার হতেই অভ্র জিজ্ঞেস করে, “স্টার্ট করব?”
“হ্যাঁ।”
বাইক চালাতে চালাতে অভ্রর মনে হল, দু’-একটা কথা না বললে অভদ্রতা হবে।
সে জিজ্ঞাসা করল, “এটা তোমার প্রথম জব?”
“না। এটা তিন নম্বর। আগে ঘাটালে ছিলাম। এখানকার মতো অত পেশেন্ট হত না, মাইনে কম দিত। এটায় সুযোগ পেয়েই তাই আর ভাবিনি।”
“আচ্ছা।”
“পিসি বললেন যে তুমি কয়েকটা টিউশন করো। অন্য কিছু আর করো না?”
অভ্র গম্ভীর ভাবে বলল, “তেমন কোনও সুযোগ তো জোটেনি।”
“চাকরির আশায় বসে না থেকে স্বাধীন ব্যবসা করার কথা ভাবোনি?”
অভ্র খুব বিরক্ত হল। বেকার যুবককে সবাই ফ্রি-তে জ্ঞান দেয়। এই মেয়েটা, বয়সে তার থেকে ছোটই হবে, অল্প পরিচয় হতেই তাকে উপদেশ দিচ্ছে। মাত্র পনেরো হাজার টাকার চাকরি করে নিজেকে স্বাবলম্বী ভাবছে?
“রাগ করলে নাকি?”
“না তো!”
সুমি বলল, “পিসি দেখলাম ঘুরেফিরে তোমার কথাই বলল। তোমাকে নিয়ে পিসির খুব চিন্তা।”
“চিন্তা হওয়াটা স্বাভাবিক। যদিও চিন্তা করে কোনও সমাধান হয় না।”
“তা ঠিক। তবে আমি চিন্তা করার থেকে কাজে বেশি বিশ্বাস করি। আচ্ছা, তুমি ট্রেডিং করো?”
“সেটা আবার কী?”
সুমি অবাক গলায় বলল, “জানো না?”
“না।”
“পরে একদিন তোমাকে বুঝিয়ে দেব। আমার সম্পর্কে কিছু জানো? শোনোনি কিছু?”
অভ্র আবার বিরক্ত হল। এই মেয়েটির সম্পর্কে তার জানার কোনও আগ্রহ নেই, জানতে বয়ে গেছে তার। নিজেই নিজের সম্পর্কে বলতে চাইছে।
সে নিস্পৃহ গলায় বলল, “না।”
“জেনে যাবে। তোমার মামাবাড়ির ও দিকে আমার খুব সুনাম।”
“ওহ,” অভ্র চুপ করে গেল। সে উৎসাহ দেখাল না। অন্যের কথা অত শুনে তার কাজ নেই।
জীবনদীপ নার্সিংহোমের সামনে সুমিকে নামিয়ে দিল অভ্র।
সুমি ঘাড় নেড়ে হাসল, “থ্যাঙ্ক ইউ।”
বাপের বাড়ির মেয়েকে পেয়ে মাকে যেমন বিগলিত দেখাল, তাতে এ বার এক দিন বাড়িতে ডেকে খাওয়ালেও অবাক হবে না সে। সে অবশ্য আপত্তি করবে না। করার কারণও নেই। পেনশনের পুরো টাকাটাই মা তার হাতে তুলে দেয়, মা তার পছন্দমতো কিছু করতেই পারে।
প্রফেশনাল কোর্স করলে কাজের অভাব হয় না, প্রথমে মাইনে কম থাকলেও পরে উন্নতির সুযোগ থাকে। এই সহজ সত্যটা সে দেরি করে বুঝেছে। সুমির মতো মেয়েরা প্রত্যন্ত গ্রামে থেকেও ঠিক নিজের রাস্তা খুঁজে নিয়েছে।
সে জন্ম থেকে জেলাশহরে থেকেও বলার মতো কিছুই করতে পারল না! অভ্র দীর্ঘশ্বাস ফেলে বাইকের স্পিড বাড়াল।
ক্রমশ