ধারাবাহিক উপন্যাস: পর্ব ৩৩
Bengali Story

দৈবাদিষ্ট

ধৃষ্টদ্যুম্নর শ্বাস দ্রুত পড়ছে। পঞ্জরের মধ্যে বিপুল ঘাতপ্রতিঘাত। বক্ষের উত্থানপতন তুমুল। স্বপ্নদৃশ্যগুলির তীব্র অভিঘাত এখনও তার রুধিরকণিকাগুলিকে চঞ্চল করে রেখেছে, স্নায়ুসূত্রগুলি এখনও বেপমান। 

Advertisement

সৌরভ মুখোপাধ্যায়

কলকাতা শেষ আপডেট: ২৫ ডিসেম্বর ২০২২ ০৯:৫০
Share:

ছবি: রৌদ্র মিত্র

পূর্বানুবৃত্তি: দ্রোণের গৃহে শেষ রাত্রির নিদ্রা বড় চাঞ্চল্যের মধ্য দিয়ে কাটে ধৃষ্টদ্যুম্নর। স্বপ্নে ফিরে আসেন সেই শক্তিমান কৃষ্ণবর্ণ পুরুষ। যিনি প্রস্তরাঘাতে তাঁকে নিধন করতে গিয়েও করেননি। জীবদ্দশাতেই পথ দেখিয়েছেন জন্মান্তরের। যা আপাত ভাবে অবাস্তব, তাকেই সূক্ষ্ণ সূক্ষ্ণ যোজনাকৌশলে সম্ভব করে তুলেছেন সেই তীক্ষ্মধী বীর। দ্রৌপদকে নিশ্চিত ভাবেই পরিচালিত করেছেন তার জীবনের একমাত্র লক্ষ্য দ্রোণবধের অমোঘ অভিমুখে। অবিশ্বাস্য হলেও সত্য সবটাই।

Advertisement

ঘুমন্ত যুবার নিদ্রিত মুখের পেশিগুলিতে নানা অনুভব-আন্দোলন তরঙ্গায়িত। আর-এক বার সে পাশ ফিরতে গেল, এমন সময় তার স্কন্ধে কার হাত এসে পড়ল।

“বৎস দ্রৌপদ!”

Advertisement

এ কার অনুচ্চ কোমল স্বর? এও কি স্বপ্ন?

না! এ তো স্পর্শ, এ তো বাস্তব! আমূল চমকিত হয়ে চক্ষু মেলল পাঞ্চালকুমার, তারপর সবেগে উঠে বসল। অন্ধকারে এক ছায়ামূর্তি তার শয্যাপার্শ্বে!

“আচার্য!”

ধৃষ্টদ্যুম্নর শ্বাস দ্রুত পড়ছে। পঞ্জরের মধ্যে বিপুল ঘাতপ্রতিঘাত। বক্ষের উত্থানপতন তুমুল। স্বপ্নদৃশ্যগুলির তীব্র অভিঘাত এখনও তার রুধিরকণিকাগুলিকে চঞ্চল করে রেখেছে, স্নায়ুসূত্রগুলি এখনও বেপমান।

“বৎস,” শান্ত স্নেহার্দ্র স্বরে দ্রোণ বললেন, “ঊষার আর অধিক বিলম্ব নেই। তোমার অশ্বটিকে প্রস্তুত করেছি। স্নানের জলও।”

“আপনি স্বয়ং এইসব করতে গেলেন, আচার্য! আমি তো নিজেই...”

“আজ তো শেষ দিন, পুত্র! এর পর তো বহু দিন আর দেখা হবে না। এইটুকু ইচ্ছা হল...”

ধৃষ্টদ্যুম্ন চুপ করে রইল কয়েক পল। বলল, “আবার কবে দেখা হবে, গুরুদেব!”

অন্ধকারে দ্রোণের মৃদু হাসি শোনা গেল। “হতেই হবে, বৎস! কোনও রুধিরাক্ত রণাঙ্গনে...!”

“তেমন কোনও রণ যদি আদৌ না হয় কখনও?”

“হবেই। এ-ভবিতব্য অনিবার্য। যজ্ঞসেন দ্রুপদ তাঁর অতীত নিগ্রহের প্রতিশোধ নিতে কুরুর বিরুদ্ধে সমরে অবতীর্ণ হবেনই কোনও উপযুক্ত লগ্নে,” দ্রোণ এখনও সহাস, “এখন তো নিয়তি তাঁর দিকেই প্রসন্নদৃষ্টি রেখেছেন! সেই যুদ্ধে মুখোমুখি হব আমরা, গুরু-শিষ্য— তখন প্রতিদ্বন্দ্বী! তবে জেনো, আমি কিন্তু খুব সহজে তোমাকে পরীক্ষা-উত্তীর্ণ করব না, দ্রৌপদ। আগে দেখব, শিক্ষা কেমন প্রয়োগ করতে পারো!”

এই বিশেষ প্রসঙ্গটিতে এত প্রত্যক্ষ বাক্যবিনিময় আগে কখনও ঘটেনি এই দু’জনের মধ্যে। যেন সেই অকথনীয়ের চাপেই, বাক্য হারিয়ে যায় উভয়ের। আবার কয়েক মুহূর্তের নৈঃশব্দ্য। তারপর ধৃষ্টদ্যুম্ন গাঢ়স্বরে বলল, “আগে কখনও বলিনি। আজ তো বলতেই হবে! ভবিষ্যতে যে দৈব-নির্ধারিত মুহূর্তটি অপেক্ষা করে রয়েছে, তার জন্য আমাকে ক্ষমা করবেন, আচার্য— এই প্রার্থনা আজ অগ্রিম জানিয়ে রাখলাম। নিষ্ঠুর অকুস্থলে হয়তো সুযোগ পাব না!”

“তুমিও... আমাকে... ক্ষমা করে দিয়ো, পুত্র! আমিও তো আগে কখনও বলার সুযোগ পাইনি, আজ বললাম,” দ্রোণ পাঞ্চালকুমারের দক্ষিণ-করতলটি নিজের দুই তালুর মধ্যে নিলেন।

“আপনাকে... ক্ষমা! আপনাকে কিসেরক্ষমা, আচার্য?”

দ্রোণ অনেক ক্ষণ কোনও উত্তর দিলেন না। শুধু দ্রৌপদের হাতটি ধরে রইলেন, যেন পরম স্নেহে আদর করছেন তার করতলটিকে।

এ কী! সহসা চমকিত হল ধৃষ্টদ্যুম্ন। সে অনুভব করল, দ্রোণ যেন তার অঙ্গুষ্ঠটিতেই বিশেষ করে আদর বুলিয়ে দিচ্ছেন! আশ্চর্য, আশ্চর্য! সে কি ভুল ভাবছে? না, ভুল তো নয়! ঠিক তার বৃদ্ধাঙ্গুষ্ঠতেই বারবার...

“আচার্য! এ আপনি...” বিস্ময়োক্তিটিকে গোপন করতে পারে না যুবা।

দ্রোণ অনুচ্চ স্বগতোক্তির মতো বলে চলেছেন, “বড় পাপ করেছিলাম হে... বড় নিষ্ঠুরতা... খুব যন্ত্রণা হয়েছিল, তাত? খুব কষ্ট...?”

“এ সব... কী বলছেন?” প্রাণপণে নিজেকে সংযত করার চেষ্টা করে দ্রুপদনন্দন। হাতটি সরিয়ে নিতে চায়।

ম্লান হাসেন দ্রোণ। একটি ক্ষুদ্র শ্বাসের সঙ্গে বলেন, “জানি হে, জানি... আর কেউ না জানুক...”

“কী জানেন? কী?”

“আমি-যে সীবনচিহ্নগুলি দেখেছি, পুত্র! ত্বকের বর্ণের বৈষম্যও! পরিচয়ের প্রথম দিনেই দেখেছি। খুব অস্পষ্ট, কিন্তু দ্রোণের চক্ষুতে ধরা পড়বে না এমন নয়! তার পর চিনেছি— দৃষ্টি! সব কিছু পরিবর্তন করা যায়, দৃষ্টি নয়! তখনই বুঝেছি, পুত্র, আমার কৃতকর্মই চক্রপথে আমার নিয়তি হয়ে প্রত্যাগত,” দ্রোণ আবার শান্তকণ্ঠে বলেন, “বন্য চিকিৎসকেরা অঙ্গপ্রতিস্থাপন করতে পারে সে আমি অল্পস্বল্প শুনেছি... হয়তো বহিরঙ্গের রূপটিও তাদের হাতেই পরিবর্তিত! অবশিষ্ট বৃত্তান্ত আর জানার উৎসাহ নেই, শুধু জানি আমার প্রায়শ্চিত্তের পথটি আমার সম্মুখে! বুঝে, আমি আনন্দিত হয়েছি, বৎস দ্রৌপদ! দৈবের এই অপূর্ব দণ্ডাজ্ঞায় আমি সন্তুষ্ট... কালের বাঞ্ছা পূর্ণ হোক! কিন্তু ভয় কোরো না, পুত্র, এ-কথা আমি সম্পূর্ণ নিজের মধ্যেই রাখব...”

উত্তর-প্রত্যুত্তর হয় না আর। একটিও শব্দ উচ্চারণ করে না কেউ। কালচক্র কি স্তব্ধ? এই রাত্রি কি অনন্ত রাত্রি?

আর কোনও অন্তরাল নেই। অন্ধকারেই যেন পরম এক উন্মোচন! পরস্পরকে স্পর্শ করে বহুক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকে দুই অসমবয়সি পুরুষ। সেই স্পর্শের মধ্য দিয়ে যেন সহস্র মূক অনুভব-আবেগের তরঙ্গ বিনিময় হয়ে চলে। বিচিত্র সেই উপলব্ধি-স্রোতে তোলপাড় হতে থাকে কাল-নাট্যের দুই কুশীলব! ...অমোঘ নিয়তির তাড়না, অবিশ্বাস্য ঘটনাবর্ত, আশ্চর্য সম্পর্কমাত্রা। আচার্য ও বিদ্যার্থী। প্রতারক ও প্রতারিত। আঘাতকারী ও আহত। হন্যমান ও হন্তারক। অতীত-বর্তমান-ভবিষ্যৎ মিলে এ কী অভাবনীয় বহুকৌণিক জাল বিতত হয়ে রইল এই দু’জনকে ঘিরে!

বিপুলা এই বসুধায় এমন কল্পনা করেছে কেউ কখনও? দু’টি মানুষের মধ্যে এমন অদ্ভুত সব বিপ্রতীপ চেতনার সংযোগ! শ্রদ্ধা ও ঘৃণা, বঞ্চনা ও স্নেহ, প্রতিহিংসা ও প্রায়শ্চিত্ত...

বাস্তবিকই, মহান বেদব্যাস ঠিক বলেন। মহাভারত নামক অনন্ত প্রহেলিকাময় জগৎ ভিন্ন এমন অভাবনীয়ের সাক্ষাৎ আর কোথায়ই বা মিলবে! কিন্তু, সর্বদ্রষ্টা দ্বৈপায়ন ব্যাসেরও কিজ্ঞাত আছে এই অত্যাশ্চর্য গুপ্ততথ্যগুলি? জ্ঞাত থাকলেও কি তিনি তাঁর জয়কাব্যটিতে এই সমস্ত কিছু অকপটে...

দ্রোণ একটু অন্যমনস্ক হলেন। তারপর ভাবলেন, থাক!

সব সত্যই তো আর সর্বথা প্রকাশনীয় নয়! বৃহৎ স্বার্থ, মর্যাদা, অভিসন্ধি, রাজনীতি জড়িত থাকেই সমস্ত বৃহৎ উদ্যোগের সঙ্গে, এমনকি তা কোনও শিল্পসৃষ্টি হলেও। নিরঙ্কুশ-উন্মোচন... ইতিহাস অনুমোদন করে না সর্বদা। মহাভারতেও কিছু রহস্য গুণ্ঠনাবৃতই থাকবে, নিশ্চিত! তা থাকুক। পরবর্তী কাল নিজের মতো করে অনুধাবন করে নেবে।

কাব্যরচয়িতা ঋষি কী লিখবেন, কী ভাবে কতটুকু সত্য উদ্ঘাটিত করবেন, সে নিয়ে নগণ্য অস্ত্রশিক্ষকের এত ভাবিত হওয়া নিষ্প্রয়োজন।

শেষ বার প্রণত হয় তরুণ, শেষ বার তাকে আলিঙ্গন করেন প্রবীণ।

“আশীর্বাদ করবেন না, আচার্য?”

“তুমি দৈবাদিষ্ট! বহু যন্ত্রণা আর সাধনার অগ্নি থেকে উত্থান তোমার। মহাকালের তর্জনী-নির্দেশ বিধৃত তোমার মধ্যে। আমার তুচ্ছ আশীর্বাদ বিনা-ই তুমি সফল হবে, পুত্র!”

পূর্বাচল যখন রক্তাভা ধারণ করল, পাঞ্চাল-রাজপুত্রের অশ্ব তখন সীমান্ত-প্রান্তরের মধ্য দিয়ে দূর বনান্তরালে লীন। ধুলা উড়ছে তার চলে-যাওয়ার পথটি জুড়ে। তার ক্ষুরধ্বনি মিলিয়ে আসার অনেক ক্ষণ পর পর্যন্ত বৃদ্ধ দ্রোণাচার্য তাঁর মাটির গৃহের দ্বারটিতে দাঁড়িয়ে ছিলেন। চিত্রার্পিতের মতো, মৌন, নিশ্চল। তাঁর দীর্ঘ দক্ষিণ বাহুটি তখনও, বিদায়-অভিবাদনের ভঙ্গিমায়, শূন্যে উত্থিত।

[লেখকের নিবেদন: বহু যুগে বহু হাতের প্রক্ষেপ-কণ্টকিত মহাগ্রন্থ মহাভারত, দেশে-বিদেশে এবং অন্য নানা গ্রন্থে তার কাহিনি-কাঠামোর রূপভেদও প্রচলিত। নিষাদ একলব্য জরাসন্ধের অনুগত হয়ে কৃষ্ণের বিরুদ্ধে অস্ত্রধারণ করেছিল, এই প্রাথমিক ভিত্তিটি মোটামুটি সাধারণ হলেও, তার অন্তিম পরিণতি নিয়ে নানা বয়ান মেলে নানা পাঠান্তরে। গ্রন্থভেদে ও কথন-ভেদে সব মিলিয়ে, মূলত তিন ভাবে তার পরিণাম বিধৃত হয়েছে— ১) জরাসন্ধের জীবৎকালেই, রুক্মিণীহরণের সময় কৃষ্ণকে বাধা দিতে গিয়ে কৃষ্ণের হাতে মৃত্যু, ২) জরাসন্ধের নিধনের পর, প্রতিশোধার্থ, পৌণ্ড্রক-শাল্বের হয়ে দ্বারকা আক্রমণ করতে গিয়ে কৃষ্ণের হাতে মৃত্যু, ৩) যুধিষ্ঠিরের রাজসূয় যজ্ঞে অংশগ্রহণ এবং পরে কুরুক্ষেত্র যুদ্ধে দুর্যোধনের পক্ষে যোগদান (এই বয়ানে অন্তিম পরিণাম অস্পষ্ট)। তৃতীয় বিকল্পটি নস্যাৎ হয় যখন কুরুক্ষেত্রে ঘটোৎকচ-বধের পর কৃষ্ণ স্বয়ং বলেন যে, তিনিই পূর্বে পাণ্ডব-মঙ্গলার্থে একলব্যকে হত্যা করেছেন (তা হলে সেটা কুরুযুদ্ধের আগেই নিশ্চিত, কারণ এখানে কৃষ্ণ অযুধ্যমান)। প্রথম দু’টি বিকল্পের মধ্যে যেটি কালানুক্রমে প্রথমে ঘটেছে (একই মূল-কাহিনির বয়ান-ভেদে যদি কোনও ব্যক্তির মৃত্যুর কথা দু’টি ভিন্ন সময়ে বলা থাকে, তবে প্রথম ঘটনাটিই আমার কাছে গ্রাহ্য) সেটিকেই আমি সম্ভাব্যতার সহজ যুক্তিতে গ্রহণ করেছি, পরবর্তী বয়ানটিকে প্রক্ষিপ্ত মেনেছি। কিন্তু এই বিন্দুতে এসে, মহাভারতের একটি ইন্দোনেশিয়ান পাঠভেদ থেকে পাওয়া আশ্চর্য একটি সূত্র আমাকে চমকিত করে। সেখানে বলা হচ্ছে, কৃষ্ণের হাতে নিহত হওয়ার পূর্বমুহূর্তে একলব্য বর চায়, পরজন্মে যেন দ্রোণের উপর সে প্রতিশোধ নিতে পারে। কৃষ্ণ তা মঞ্জুর করেন ও সেই অনুযায়ী একলব্যই দ্রুপদ-যজ্ঞের আগুন থেকে ধৃষ্টদ্যুম্ন রূপে পুনর্জন্ম নেয়। যজ্ঞাগ্নি থেকে সরাসরি পূর্ণবয়স্ক যোদ্ধৃবেশধারী পুত্র কীভাবে উৎপন্ন হয়, সে-বিষয়ে আমার দীর্ঘকাল সংশয় ছিল— এই ‘পুনর্জন্ম’-তত্ত্বটি উঠে আসার পরে আমার সামনে ভাবনার বহু দিগন্ত উদ্ভাসিত হয়ে ওঠে, মহাগ্রন্থের আরও বহু জট খুলে যায়। সেই উদ্ভাসেরই ফসল এই উপন্যাস, যা এক অর্থে বাস্তব-সন্ধানী কল্পনা এবং যুক্তিভিত্তিক পুনর্কথনের প্রয়াসও বটে। ‘এমন হলেও হতে পারত’ এই উদার কল্পনার পক্ষবিস্তার যে-সব পাঠক উপভোগ করেন, এই উপন্যাস একান্ত ভাবেই তাঁদের উদ্দেশে নিবেদিত।

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement