ধারাবাহিক উপন্যাস: পর্ব ১৩
Bengali Story

দৈবাদিষ্ট

আগ্রাসী মগধ বাধ্যতামূলক ভাবেই বেশ কিছু দিন যুদ্ধবিরতিকে মান্য দিয়েছিল। সমরপ্রিয় মগধেশ পরাঙ্মুখ নিরুদ্যম হয়ে বসে ছিলেন অনেকগুলি মাস-বৎসর।

Advertisement

সৌরভ মুখোপাধ্যায়

কলকাতা শেষ আপডেট: ০৭ অগস্ট ২০২২ ০৫:৫০
Share:

পূর্বানুবৃত্তি: বিদুরের প্রশংসা সন্তুষ্ট করতে পারে না দ্রোণাচার্যকে। তাঁর অন্যমনস্কতা নজর এড়ায় না পুত্র অশ্বত্থামার। দ্রোণাচার্য প্রকাশ করে ফেলেন তাঁর আত্মগ্লানি। ব্রাহ্মণের বৃত্তির পরিবর্তে কুরুরাজের বেতনভুক অস্ত্রশিক্ষক হওয়া তাঁর কাছে পীড়াদায়ক বোধ হয়। অন্য দিকে, মগধরাজ জরাসন্ধ দুশ্চিন্তামগ্ন। কৃষ্ণ আর বলরাম— যাদব বসুদেবের এই দুই সন্তান কখনও অমিত বিক্রমে, কখনও সুচতুর কৌশলে বার বার তাঁর যুদ্ধজয়ের আকাঙ্ক্ষায় ভস্ম-নিক্ষেপ করে দিয়েছে।

Advertisement

অশ্বত্থামা সঙ্গে সঙ্গে কোনও উত্তর দিল না। বেশ কিছু ক্ষণ পরে বলল, “ক্ষমা করবেন, পিতা! এ সবই হয়তো সত্য, কিন্তু... এত কাল পরে শুধু এইটুকু আত্মজিজ্ঞাসাই আপনাকে বিনিদ্র রাখছে, এ আমি মানতে অক্ষম। আমি প্রকৃত কথাটি জানতে ইচ্ছুক।”

Advertisement

দ্রোণ মাথাটি ঈষৎ নত করে দাঁড়িয়ে রইলেন, এইটুকু বোঝা গেল। কিন্তু, নিরুত্তর।

“আত্মজকে প্রতারিত করবেন না, আচার্যশ্রেষ্ঠ! আপনার অন্য কোনও গভীরতর মনোবেদনা আছে। আমি গতকাল দিবালোকে তার নিদর্শন দেখতে পেয়েছি।”

চমকিত হয়ে দ্রোণ বলেন, “কী দেখেছ? কী?”

“অস্ত্র-পরীক্ষার শেষে, বৃক্ষতলে বিজনে দাঁড়িয়ে আপনি নিজ অঙ্গুষ্ঠটি নিয়ে...”

অশ্বত্থামা বাক্য শেষ করল না। অন্ধকারের মধ্যেই সে বুঝতে পারল, দ্রোণ আত্মনিয়ন্ত্রণ হারিয়েছেন। ললাটে করাঘাত করে তিনি বৃক্ষগাত্রে দেহের ভর রাখতে চাইছেন।

দ্রুত অগ্রসর হয়ে পিতাকে স্পর্শ করল অশ্বত্থামা, অনুভব করল, তাঁর দেহ কম্পমান। তিনি উদ্গত রোদনাবেগ রোধের চেষ্টা করছেন প্রাণপণে।

“পিতা! পিতা!” অশ্বত্থামা কখনও তার ধীর-গম্ভীর, স্থৈর্যশীল পিতাকে এমন ভগ্নস্তূপের মতো দেখেনি। সে আকুলকণ্ঠে বলে, “পিতা, স্থির হোন! আমি বুঝি আপনার সুপ্ত আত্মগ্লানি, আপনার নীরব অনুশোচনা! নিষাদের সঙ্গে আপনি যা করেছেন, তা ভুল... কিন্তু...”

“ভুল? ভুল নয়, অশ্বত্থামা, পাপ!” বিকৃত হয়ে আসছে দ্রোণের কণ্ঠ, “মহাপাতক! এর চেয়ে ঘৃণ্য পাপ কোনও শিক্ষক কখনও করেনি পুত্র। সে আমার শিষ্য ছিল, হ্যাঁ, শিষ্যই! আজ আমার চিৎকার করে বলতে ইচ্ছা করে, সে আমার শিষ্য, আমার শ্রেষ্ঠ ছাত্র সে-ই, মহত্তম আধার— রাজপুত্র অর্জুন নয়, একলব্য ব্যাধ!”

“পিতা!” অশ্বত্থামা ত্রস্ত হয়ে ওঠে। বিপজ্জনক কথা বলছেন দ্রোণ, প্রচার হয়ে গেলে ক্ষতি হতে পারে।

“হ্যাঁ পুত্র! আমি প্রলাপ বকছি না। আমার দেওয়া শিক্ষার সর্বশ্রেষ্ঠ প্রকাশ আমি তার মধ্যেই দেখেছি, আমার আশ্রমের সমস্ত শিক্ষার্থীর চেয়ে তার মেধা ছিল উন্নততর! আমি বস্তুত তাকে হত্যাই করেছি, বৎস... আমি হত্যা করেছি আমার বিদ্যা বাহিত হওয়ার শ্রেষ্ঠ সম্ভাবনাকে, শুধু কুরুর অন্নঋণের কথা ভেবে! হস্তিনার বেতনভুক বিপ্রকুলকলঙ্ক দ্রোণ... মহাভারত-কথায় তার কালিমা চিরস্থায়ী হয়ে থাকবে যে! সেই কাব্য-কীর্তনের মাধ্যমে আগামী সমস্ত প্রজন্ম জানবে— দ্রোণ এক শিষ্যঘাতী গুরু, চণ্ডাল, নরপিশাচ!”

“শান্ত হোন, পিতা!” দ্রোণকে জড়িয়ে ধরে অশ্বত্থামা। দ্রোণের শীর্ণ দেহ এখনও অবরুদ্ধ বিলাপের উচ্ছ্বাসে কম্পমান, “কেন আমি রাত জাগি, জানো পুত্র! তার চক্ষু দু’টি কিছুতে বিস্মৃত হতে পারি না যে! সেই চোখ দু’টির অব্যক্ত ভাষা... তাদের মধ্যে ফুটে-ওঠা বিস্ময়-ক্ষোভ-অভিমান-ভর্ৎসনা... উফ্‌ফ্‌...”

অকস্মাৎ তিক্ত-আবেগের প্রস্রবণ অনর্গল হয়েছে, গ্লানির অগ্নিশৈল থেকে শুরু হয়েছে প্রবল উদ্গীরণ! অশ্বত্থামা পিতাকে জড়িয়ে ধরেছেন, কিন্তু সামলাতে পারছেন না! ধুলায় বসে পড়েছেন, অন্ধকারের মধ্যে রুদ্ধস্বরে আর্তনাদ করছেন বিশ্রুতকীর্তি আচার্য দ্রোণ, “পুত্র, আমি একলব্যকে চাই! কোথায় সে? তাকে নিতান্ত প্রয়োজন আমার, খুঁজে এনে দিতে পারো?”

“কী বলছেন... আমি কিছুই...”

“শোনো! আমি নিজহাতে তাকে শ্রেষ্ঠ শিক্ষা দেব, কী ভাবে নরাধম দ্রোণকে বধ করা যায়, কী ভাবে পাষণ্ড গুরুর শির কর্তন করা যায়— সেই শিক্ষা! আমি একলব্যের অস্ত্রের আঘাতে মরতে চাই, প্রিয় অশ্বত্থামা... সেই নিষ্পাপ শিষ্যেরহাতে নিহত না হলে আমার পাপমুক্তি নেই...! প্রায়শ্চিত্ত করব, তাকে এনে দাও, সন্ধান করো, বৎস, তাকে এনে দাও...”

“পিতা! আচার্য!” অশ্বত্থামা তাঁর পৃষ্ঠে-বক্ষে শুশ্রূষার হাত বোলাতে বোলাতে বলেন, “প্রায়শ্চিত্তের সময় ভবিষ্যতে অনেক পাবেন, পিতা। এখন আসন্ন বর্তমানে স্থিত হোন। আর মাত্র ক’দিন পরে হস্তিনার রঙ্গভূমিতে চূড়ান্ত অস্ত্রপরীক্ষার প্রদর্শনী! তার পরেই আপনার এত দিনের যজ্ঞে আহুতি দেওয়ার লগ্ন উপস্থিত হবে। আগত মাহেন্দ্রমুহূর্তের জন্য নিজেকে শক্ত করুন!”

দ্রোণের উত্তেজনা মন্দীভূত হয় সহসা। বোধহয় আত্মবিস্মরণ থেকে জাগ্রত হন, নিজেকে সংযত করেন। অশ্বত্থামা তাঁর দেহে নিজের হাতটি ছুঁইয়ে রেখেই বলেন, “কুরুকুমারদের কাছে দক্ষিণা চাইবেন না? যে জন্য এত কাল ধরে আপনার এত আয়োজন, এত পরিশ্রম?”

অন্ধকারেই দ্রোণ নির্বাক তাকিয়ে রইলেন পুত্রের মুখের দিকে। অশ্বত্থামার কণ্ঠেও এ বার কিঞ্চিৎ আবেগ সঞ্চারিত হয়, “আমিও তো আর বালক নেই, পিতা। আমি কি বুঝি না?”

২২

আগ্রাসী মগধ বাধ্যতামূলক ভাবেই বেশ কিছু দিন যুদ্ধবিরতিকে মান্য দিয়েছিল। সমরপ্রিয় মগধেশ পরাঙ্মুখ নিরুদ্যম হয়ে বসে ছিলেন অনেকগুলি মাস-বৎসর।

সন্ধির শর্ত তো ছিলই। তা ছাড়াও, অগৌরবের স্মৃতি কিঞ্চিৎ বিবর্ণ না হলে, তখনই আবার সেনাদের আহ্বান করতে চাননি জরাসন্ধ। মিত্র রাজাদেরও তৎক্ষণাৎ আর প্ররোচিত করা চলে না। যে অপরাজেয় তথা সম্রাট-পদাভিলাষী জরাসন্ধের ডাকে নিছক সমীহবশতই সৈন্যসাহায্য করেছিল পাঞ্চালের মতো বৃহৎ রাজ্যও— সেই ভাবমূর্তি অনেকটা নষ্ট করে দিয়েছিল ওই শির-নমন। হয়তো অত স্বতঃস্ফূর্ত ভাবে সাড়াও মিলত না আর।

তদুপরি, মৈত্রী-বন্ধনের কিছু শক্তিহ্রাসও হয়। ধূর্ত কৃষ্ণ একের পর এক শত্রু-নিপাত করেছে বলে সংবাদ আসে। মগধরাজের সেই অক্ষশক্তিটি আজ ক্রমক্ষীয়মাণ। তাঁর পরম বান্ধব দুই রাজভ্রাতা, হংস ও ডিম্বক বহু পূর্বেই কৃষ্ণের হাতে নিহত; করবীরপুরের শৃগাল— যে কৃষ্ণকে তাচ্ছিল্য করে নিজেই নিজেকে ‘বাসুদেব’ বলে প্রচার করে বৈষ্ণব-গোষ্ঠীর প্রধান হতে চেয়েছিল— মহিমা খর্ব হয়েছে তার। আর এক ‘বাসুদেব’ উপাধিধারী, পৌণ্ড্রকরাজ, নিজ রাজ্যের অন্তর্কলহে ব্যতিব্যস্ত। কালযবন নামক এক দুর্দান্ত শত্রুকেও ছলের মাধ্যমে পরপারে পাঠিয়েছে কৃষ্ণ।

জরাসন্ধর বিমর্ষ হয়ে থাকার কারণ যথেষ্ট। সম্প্রতি কৃষ্ণ আরও ধরাছোঁয়ার অতীত হয়ে গিয়েছে। সম্পূর্ণ অভাবিত এক পদক্ষেপ নিয়েছে সে, যা আপাতদৃষ্টিতে কাপুরুষোচিত কিন্তু কূটনীতির বিচারে মোক্ষম। মথুরা থেকে নিজ অনুগত জ্ঞাতি-বান্ধবগোষ্ঠী নিয়ে সে পলায়ন করেছে সুদূর পশ্চিমে, সমুদ্রতীরবর্তী রৈবতক পর্বতের দ্বারা সুরক্ষিত কুশস্থলীতে। যাদবদের সেই নতুন রাজধানী দ্বারকা, অতি দুর্ভেদ্য গিরিদুর্গ সেখানে, সহস্র অপরাজেয় যোদ্ধা সেই দুর্গের শতদ্বার রক্ষা করেন। এই পূর্বদেশীয় সমতল থেকে সেই দুর্গম পার্বত্য পশ্চিমে পূর্ণশক্তিতে সেনা-অভিযান করাও কার্যত অসম্ভব।

এই অভিসন্ধি তবে বাসুদেব আগে থেকেই পোষণ করে রেখেছিল— দীর্ঘকালীন অনাক্রম্যতা-চুক্তিটিকে সুচতুর ভাবে রাজধানী-স্থানান্তরের কাজে লাগিয়েছে! এখন আর যুদ্ধঘোষণা করেও কী লাভ?

প্রয়োজন হলেই কৃষ্ণের এই পলায়নপ্রবণতা— জরাসন্ধ আগেও দেখেছেন। সে অটল ক্ষাত্রনীতির পরিবর্তে বাস্তবোচিত কূটবুদ্ধিকেই প্রাধান্য দেয়, সাফল্যের জন্য চাতুরিকে অসঙ্কোচে প্রয়োগ করাই তার পন্থা; তজ্জনিত নিন্দা বা ব্যঙ্গকে উপেক্ষা করে সে নিরাসক্তচিত্তে।

জরাসন্ধের অন্তরের বহ্নি-নির্বাপণের আকাঙ্ক্ষা বুঝি অচরিতার্থই রয়ে গেল!

আপাতত আর একটি বার্তা এসেছে মিত্ররাজ্য বিদর্ভ থেকে, যা মগধাধিপতির ললাট-কুঞ্চন বৃদ্ধি করেছে।

বিদর্ভরাজকন্যা রুক্মিণীর স্বয়ংবরের আয়োজন হয়েছে কুণ্ডিনানগরে। এই সুন্দরী রুক্মিণীরই জ্যেষ্ঠ ভ্রাতা মহাবীর যোদ্ধা রুক্মী, তিনি জরাসন্ধের মৈত্রী-জোটের গুরুত্বপূর্ণ সদস্য, মথুরা-আক্রমণে স্বয়ং উপস্থিত থেকে সক্রিয় সহায়তা করেছেন। তাঁর মনোবাসনা, চেদি-নরেশ দমঘোষ-পুত্র শিশুপাল হোন তাঁর ভগ্নীপতি। চেদিও মগধের বন্ধুরাজ্য। শিশুপাল কৃষ্ণের জ্ঞাতিভ্রাতা হলেও কৃষ্ণদ্বেষী, তিনিও মথুরা-অভিযানে জরাসন্ধের পক্ষে ছিলেন, সেনানায়ক রূপে। তাই জরাসন্ধ এই বিবাহ-প্রস্তাবে উৎসাহ দিয়েছিলেন খুবই। বাহ্যত স্বয়ংবর হলেও, রুক্মী তাঁর ভগিনীকে নির্দেশ দিয়ে রাখবেন— যেন শিশুপালকেই সে বরণ করে সভাস্থলে। এমনই স্থিরীকৃত ছিল পূর্বাহ্ণে।

কিন্তু চর যে গূঢ় সন্দেশ এনেছে, তা সাংঘাতিক। এখানেও অনুপ্রবিষ্ট হয়েছে যাদব কৃষ্ণ! রুক্মিণীর সঙ্গে তার গোপন প্রণয়। ভ্রাতা রুক্মী কৃষ্ণকে নিমন্ত্রণ-বঞ্চিত রাখবে জেনে, রাজকন্যা প্রেমিককে সঙ্কেত প্রেরণ করেছে গোপনে। সম্ভবত অনাহূত ভাবেই সেই কূটবুদ্ধি যদুপতি উপস্থিত হবে স্বয়ংবরে। হয়তো আসর চলাকালীন অভাবিত কোনও ছলের আশ্রয় নেবে, হয়তো সেনাদল নিয়ে আসবে যুদ্ধঘোষণা করেই, বলপূর্বক কন্যাহরণ করবে!

এক বার বিদর্ভের জামাতা হয়ে বসতে পারলে, কৃষ্ণের রাজনৈতিক গুরুত্ব বৃদ্ধি পাবে বহুল পরিমাণে। রাজা ভীষ্মক তো বটেই, ভবিষ্যতে হয়তো রাজকুমার রুক্মীও ভগ্নীপতির প্রতি পূর্ববৎ বিদ্বিষ্ট থাকতে পারবেন না...

না, অগ্রিম সংবাদ পেয়ে যাওয়ার পর এ বিষয়ে আর নিশ্চেষ্ট থাকা চলে না কিছুতেই! বরং এ এক পরম সুযোগ, বৈরীবিনাশের!

নিজরাজ্যের বাইরেই চেপে ধরতে হবে কপট রণছোড় যাদবকে। সম্ভব হলে, কুণ্ডিনার স্বয়ংবর-সভাতেই। স্বয়ংবরে যুদ্ধবিগ্রহ বেধে যাওয়া নতুন কিছু ঘটনা নয়। সে ভালই; সন্ধির শর্ত লঙ্ঘন হবে না, যাদবদের রাজ্য আক্রমণের প্রয়োজন পড়বে না, মহাবীর রুক্মীর থেকে সর্বতোপ্রকার সহায়তা মিলবে, অন্য মিত্র রাজারাও নিতান্ত অসম্মত হবেন বলে মনে হয় না। জরাসন্ধের নিজের বাহিনীর শ্রেষ্ঠ অংশটি নিয়োজিত হবে এই পরিকল্পনায়।

কক্ষে অস্থির পদচারণা করতে করতে জরাসন্ধ নানাবিধ প্রকল্প নিয়ে নিজের মনেই অক্ষক্রীড়া করে চলেছিলেন। তাঁর এত দিনের অবসন্ন ভাব যেন একটু-একটু শমিত হচ্ছে, উদ্দীপনা জাগছে নতুন করে!

“মহারাজের জয় হোক!” প্রতিহারী এসে জানাল, “নিষাদ একলব্য রাজ-সাক্ষাৎপ্রার্থী। অনুমতি হলে ভিতরে আনব।”

একলব্য! ...নামটি বেশ কিছু কাল পরে শোনা গেল; চকিত হলেন মগধরাজ। অনুমতি দিলেন।

এই নিষাদপুত্রকে স্নেহ করেন জরাসন্ধ, এর পিতা হিরণ্যধনু তাঁর দীর্ঘ কালের পরিচিত। মগধ ও পুণ্ড্র-কিরাত— এই দুই রাজ্য-সীমান্তবর্তী আরণ্য-ভূভাগের এক গুরুত্বপূর্ণ গোষ্ঠীনেতা সে। এই তরুণ নিজে অত্যন্ত প্রতিশ্রুতিমান ধানুকী, অত্যল্প বয়স থেকেই চমকপ্রদ ছিল এর ধনুর্বিদ্যা-কৌশল!

জরাসন্ধের মনোবাসনা ছিল, এই তরুণকে তিনি তাঁর ধানুকী-বাহিনীর প্রধান করবেন। তাঁর পরামর্শেই শ্রেষ্ঠ গুরুর সন্ধানে বেরিয়েছিল সে, কিন্তু এক দুর্দৈবের কবলে পড়ে...

তরুণ নিষাদ কৃতাঞ্জলিপুটে সামনে এসে দাঁড়াল। স্কন্ধে ধনুঃশর, পরনে চর্ম-বল্কল, মাথায় একখণ্ড চর্মবেষ্টনীতে খগপুচ্ছ গ্রথিত। কোমরবন্ধনীতে একটি খড়্গ লম্বিত। ঋজু ও দীপ্ত উপস্থিতি। এই অন্ত্যজগন্ধী বেশভূষা না থাকলে বুঝি ক্ষত্রিয়সন্তান বলেই ভ্রম হত! সুন্দর দেহগঠন, সুকুমার মুখমণ্ডলে নবীন দূর্বার মতো রোমরাজি উদ্গত হয়ে শোভাবৃদ্ধি করেছে। তেজোময় কিন্তু আপাত-সংযত শরীরী ভাষা।

“অনেকদিন পর আত্মপ্রকাশ! বড় হয়ে গিয়েছ হে, বাঃ বাঃ!” দীর্ঘ কাল পরে একলব্যকে দেখে বেশ খুশি হলেন জরাসন্ধ। তার পর, তার ডান হাতের তালুটির দিকে কয়েক মুহূর্ত তাকিয়ে রইলেন।

২৩

মন্ত্রণাগারের শ্বেত কুট্টিমে অঙ্গারখণ্ড দিয়ে একটি আলেখ্য এঁকে, বলরাম ও সাত্যকিকে নিজের পরিকল্পনার কথা বলছিলেন কৃষ্ণ। বিদর্ভরাজ্যের মানচিত্র, কুণ্ডিনানগরের প্রবেশ-নিষ্ক্রমণ-মার্গ, রাজপথ ও তার শাখাপ্রশাখাগুলি, রাজপ্রাসাদ ও তার সন্নিহিত অঞ্চলের অন্ধিসন্ধি। স্বয়ংবর-সভাগৃহের রেখচিত্র। নিজ হস্তে অঙ্কন করে সমস্ত জলবৎ বুঝিয়ে দিচ্ছেন।

যে কোনও প্রকল্পে অগ্রসর হওয়ার সময়, নিজস্ব গূঢ়-বার্তাবাহকদের মাধ্যমে তদ্বিষয়ক সমস্ত ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র বিবরণ বাসুদেব সংগ্রহ করে ফেলেন পূর্বাহ্ণেই। তার পর লব্ধ তথ্যসম্ভার নিয়ে সুচারু বিশ্লেষণ ও গবেষণা। সম্ভাব্য পন্থাগুলি নিয়ে নিজের মনে গভীর পর্যালোচনা, তাদের প্রতিটির সম্ভাব্য রন্ধ্র নিজেই অনুসন্ধান করা এবং তদনুরূপ প্রতিবিধান-ব্যবস্থার সিদ্ধান্ত। এই প্রক্রিয়ার শেষে যে বিকল্পটি সর্বাপেক্ষা নীরন্ধ্র ও ঘাতসহ বিবেচিত হবে নিজের কাছেই— সেটি নিয়ে ঘনিষ্ঠ ও আস্থাভাজন যাদব-নায়কদের সঙ্গে আলোচনায় বসেন কেশব। গুরুত্ব দিয়ে শোনেন অন্য মস্তিষ্কগুলি থেকে উঠে-আসা সংশয়-সন্দেহগুলি। যুক্তি-প্রতিযুক্তি দিয়ে বিচার-আন্দোলন হয় সমবেত ভাবে, প্রয়োজন হলে সংশোধন-পরিমার্জনও।

বিদর্ভ-অভিযানের পরিকল্পনার ক্ষেত্রেও ব্যতিক্রম হচ্ছে না। নিপুণ কৌশল ফুটে উঠছে কৃষ্ণের রেখাচিত্রে। বৌদ্ধিক কৌশল, সামরিক কৌশল, কূট সৈন্যাপত্যের কৌশল।রুক্মিণী-স্বয়ংবরে উপস্থিত থাকার জন্য বিদর্ভরাজের আহ্বান আসেনি দ্বারকাপুরীতে। আহ্বান আসার সম্ভাবনাও ছিল না।

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement