ধারাবাহিক উপন্যাস: পর্ব ৯
Bengali Story

দৈবাদিষ্ট

যুধিষ্ঠির আবার বলে, “এমনকি আমার এও সন্দেহ— ধাতু-কর্মশালার বহিঃপ্রাচীরেও আছে কোনও ছিদ্র, যেটির সুবিধা নিয়মিত নিয়ে থাকে এই নিষাদ!

Advertisement

সৌরভ মুখোপাধ্যায়

কলকাতা শেষ আপডেট: ১০ জুলাই ২০২২ ০৬:৪৯
Share:

পূর্বানুবৃত্তি: দেখা গেল, একলব্যের প্রাঙ্গণে দ্রোণাচার্যেরই মৃন্ময় মূর্তি স্থাপিত। কিন্তু এমন অস্ত্রশিক্ষা তো রক্তমাংসের গুরু ব্যতীত লাভ করা অসম্ভব! বিভ্রান্ত দ্রোণ যখন এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজছেন, তখনই হস্তিনাপ্রাসাদের রুদ্ধদ্বার মন্ত্রণাকক্ষে পিতামহ ভীষ্মের কাছে অভিযোগের ঝুলি খুলছেন রাজা ধৃতরাষ্ট্র, সঙ্গী শ্যালক শকুনি। অভিযোগের লক্ষ্য মন্ত্রী বিদুর। ধার্তরাষ্ট্রদের তুলনায় পাণ্ডুপুত্রদের প্রতি বিদুরের অতিরিক্ত পক্ষপাত ধৃতরাষ্ট্রের মনে তীব্র ক্রোধের সঞ্চার করেছে।

Advertisement

তপ্ত-মস্তিষ্ক দ্রোণ বাক্যগুলির মর্মার্থ স্পষ্ট অনুধাবন করতে পারলেন না। তিনি আগের মতোই সক্রোধে বললেন, “উপমা-উৎপ্রেক্ষা ছাড়ো হে। স্পষ্ট করে বলো!”

“আমার অনুমান, গুরুদেব,” যুধিষ্ঠিরের মার্জিত কণ্ঠ শোনা গেল আবার, “এই বালক কোনও ভাবে আপনার অজ্ঞাতেই আপনার বিদ্যাদান-কর্মটি নিয়মিত পর্যবেক্ষণ করে, এবং একাকী অভ্যাস করে সেটি আয়ত্ত করে নেয়। সম্ভবত আশ্রমের কাষ্ঠ-প্রাচীরের যে অরণ্য-সংলগ্ন অংশ, যে দিকে কোনও প্রহরা থাকে না— এ সেখানে কোনও রন্ধ্রপথ আবিষ্কার করেছে। সমস্ত পদ্ধতি সেখান থেকেই এ নিরুপদ্রবে শোষণ করে নেয়!”

Advertisement

একলব্য এক বার জ্যেষ্ঠ পাণ্ডবের দিকে, এক বার দ্রোণাচার্যের দিকে কুণ্ঠিত দৃষ্টিপাত করেই চোখ নামিয়ে নেয়।

যুধিষ্ঠির আবার বলে, “এমনকি আমার এও সন্দেহ— ধাতু-কর্মশালার বহিঃপ্রাচীরেও আছে কোনও ছিদ্র, যেটির সুবিধা নিয়মিত নিয়ে থাকে এই নিষাদ! ফলে, উদ্যানের প্রকাশ্য-বিদ্যা আর কর্মশালার রুদ্ধদ্বার-শিক্ষা— দুই-ই এ সন্তর্পণে অধিগত করে চলেছে। মৃন্ময়-মূর্তির কাছে শিক্ষালাভের প্রতীকী ব্যঞ্জনা এই-ই!”

সাত্যকি এ বার ক্রুদ্ধ বিদ্রুপ ছুড়ে দেয়, “তস্কর! বিদ্যা চুরি করেছিস, নীচ!”

বিস্ময় কাটিয়ে উঠে অশ্বত্থামাও বলে ওঠে, “গুরুর অজ্ঞাতে জ্ঞান সংগ্রহ করা... কপট চাতুর্যের সমান। ধিক্‌!”

যুধিষ্ঠির তাদের সমর্থন করে না। শান্ত ভঙ্গিতে বলে, “না। শাস্ত্রে বলে, একমাত্র বিদ্যাই হল সেই ধন, যা বিতরণে বৃদ্ধি পায়, এমনকি অপহৃত হলেও! তাই, জ্ঞানের তস্করবৃত্তিও ক্ষমার্হ, যদি তাতে প্রত্যক্ষ মিথ্যাভাষণ বা প্রবঞ্চনা না থাকে। গুরুর বিনা অনুমতিতে বা অজ্ঞাতেও যদি বিদ্যা সংগৃহীত হয়, তাতে কোনও অধর্ম নেই— একমাত্র এই পাপ আছে যে, গুরু দক্ষিণাবঞ্চিত হলেন! সেই পাপের ক্ষালনও বিশেষ কঠিন নয়; কেবল গুরুদক্ষিণাটি অর্পণ করলেই প্রায়শ্চিত্ত সম্পূর্ণ। নিষাদপুত্র সরাসরি কোনও মিথ্যা বলেনি; এমনকি সে গুরুর স্বীকৃতিও দিয়েছে আদ্যন্ত, মূর্তি-স্থাপনের মাধ্যমে! সে যা করেছে, ধর্মানুসারে তাতে অতিমাত্রায় দূষণীয় কিছু নেই।... শুধু তা-ই নয়, এই বিদ্যার্থী সম্ভবত নিজের প্রতিভা ও সাধনার বলে গুরুবিদ্যাকে অতিক্রম করেও স্বকীয় কিছু কৌশল উদ্ভাবন করে নিয়েছে। সে তার মৌলিক কৃতিত্ব, ধর্মানুসারে সেখানে অপহরণ-দোষ প্রযোজ্যও হয় না।”

কৃতজ্ঞ চোখে তাকায় একলব্য, মৃদুস্বরেবলে, “ধন্য!”

১৫

ভীষ্ম এত ক্ষণ উপেক্ষা করছিলেন শকুনিকে। আর পারলেন না। সরোষে প্রত্যুত্তর করেন, “বাক্‌ সংযত করো সুবলনন্দন! রাজবধূ কুন্তীর প্রতি কুৎসিত কটাক্ষ সহ্য করা হবে না এখানে!”

“ওহ্‌, তাই নাকি! বিচারের বাণী শুধুই রাজবধূর জন্য? রাজপুত্রের প্রতি কুৎসিত ইঙ্গিত ও তার প্রাণনাশের চেষ্টা... কোন নীতিতে সহ্য করেছিলেন হে শান্তনব? আপনার বিরুদ্ধেও তো পক্ষপাতিত্বের অভিযোগ তোলা চলে সে ক্ষেত্রে!” শকুনি বলেন।

“পক্ষপাতিত্ব!”

“ক্ষত্তার কোনও কর্মের প্রতিবাদ করেছেন কখনও, আপনি, মহান গঙ্গানন্দন? কখনও তাকে জিজ্ঞাসা করেছেন, যেনতেনপ্রকারেণ দুর্যোধনকে অপসারিত করে কুন্তীর জ্যেষ্ঠ পুত্রকে রাজপদে বসানোর জন্য তাঁর আগ্রহ এত তীব্র কেন? কখনও অনুসন্ধান করে দেখেছেন, পাণ্ডুর বনগমনের পর কেন একমাত্র বিদুর অমন ঘন-ঘন সেই দুর্গম পার্বত্য অরণ্যের উদ্দেশে যাত্রা করতেন, একাকী, কোনও অনুচর-সহচর ছাড়াই? রাজপ্রাসাদে থাকাকালীন তো ভ্রাতা পাণ্ডুর প্রতি তাঁর এত ব্যাকুল টান দেখে যায়নি কখনও... তিনি ঋষিপ্রতিম নিরাবেগ মহাত্মা বলেই তো চিরকাল খ্যাত! বনবাসী পাণ্ডুর জন্য তাঁর সহসা এত...”

ভীষ্ম স্তব্ধ হন মুহূর্তের মধ্যে। শকুনির বাক্যগুলির কূট মর্মার্থ অতর্কিতে তাঁর মস্তিষ্কে বিদ্ধ হয়। বিহ্বল হয়ে চেয়ে থাকেন, বাক্যস্ফূর্তি হয় না।

তাঁকে নীরব দেখে রাজশ্যালকের উৎসাহ বৃদ্ধি পায়। সে শিরদাঁড়া সোজা করে বসে এ বার। বলে, “অপুত্রক পাণ্ডুর দুই পত্নী কোন কোন অজ্ঞাত পুরুষের সঙ্গ করে বাকি চার পুত্রকে গর্ভে ধরেছেন তা জানি না। ঋষিরা বলেছেন, তারা দেবতার ঔরসজাত। স্বয়ং দেবরাজও আছেন সেই তালিকায়! ঋষিদের উপর তো কথা চলে না, মুখ বন্ধ রাখাই নিয়ম! তবে, এইটুকু জেনে রাখুন হে ভারতচূড়ামণি ভীষ্ম— কুন্তীর প্রথম পুত্র যে কোনও দেবতার অংশ নয়, তা প্রাসাদের দাসদাসীরাও কানাকানি করেছিল। ধর্ম নামক দেবতার আড়ালে যে রক্তমাংস আছে, তা খুব নিগূঢ় গবেষণা না করলেও ধরা পড়ে। মহান দ্বৈপায়ন ব্যাস তাঁর প্রস্তাবিত মহাগ্রন্থে কি এই তথ্য স্বীকারের সাহস পাবেন?”

“সৌবল! তোমার জিহ্বা...”

“কর্তন করবেন! জানি। হা হা! তাতে কি সত্যকে লুপ্ত করা সম্ভব হবে, মহাভাগ?” শকুনির হাসিতে দ্রুত তীক্ষ্ণ জ্বালাময় শ্লেষ ঝলসে ওঠে, “যুধিষ্ঠিরের অতি-ধার্মিক চরিত্র, তার ধীরস্থির অনুগ্র স্বভাব, ক্ষাত্রতেজের ন্যূনতা... তার পিতৃরক্তের পরিচায়ক। এমনকি, তার মুখাবয়বেও আছে সে অভিজ্ঞান; যদি বিশেষ এক ব্যক্তির শ্মশ্রুগুম্ফ মোচন করা যায়, আপনার চোখেও তা অধরা থাকবে না...”

ভীষ্ম বিমূঢ় ভাবে ধৃতরাষ্ট্রের দিকে তাকালেন। শ্লেষ্মাজড়িত স্বরে বললেন, “এই কুশ্রী আলোচনা, এই পঙ্কিল জল্পনায় রাজার অনুমোদন রয়েছে?”

“জল্পনার পিছনে বাস্তব যদি পঙ্কিল হয়, তাত,” ধৃতরাষ্ট্র নীরস কণ্ঠে বললেন, “তা নিয়ে মানুষের মুখ বন্ধ করা যাবে কেমন করে? আপনিই নিরপেক্ষ ভাবে বলুন, ভ্রাতৃবধূ কুন্তী কী এমন প্রগাঢ় পুণ্যকর্ম করেছে যাতে স্বয়ং অমরবৃন্দ একের পর এক এসে তাকে পুত্রদান করেন? এমনকি উচ্ছলস্বভাবা বিলাসিনী কনিষ্ঠা মাদ্রীকেও? মধ্যম পাণ্ডব ভীমকে দেখে আদৌ দেবপুত্র মনে হয়, মহাত্মন্‌? অমন অসুরাকৃতি নির্লোম-আনন তূবর, পিঙ্গল চক্ষু, তির্যক দৃষ্টি— এ বালক কি আদৌ আর্যগোত্রীয়? অমন অমানুষিক ভোজন, পাশবিক শক্তি, নিষ্ঠুরতা— এই কি দেবাংশের লক্ষণ? ভেবে বলুন পূজ্যবর। প্রথম পাণ্ডবের প্রতি খুল্লতাত বিদুরের কেনই বা এমন স্নেহান্ধ-অতিরেক, যাতে আর এক ভ্রাতুষ্পুত্রকে পথের কণ্টক ভেবে জন্মমাত্র তাকে হত্যার প্রস্তাব দিতেও তার রসনা কম্পিত হয়নি? এই সব প্রশ্ন লজ্জাজনক। কিন্তু অবাস্তব তো নয়, হে গাঙ্গেয়!”

ভীষ্ম মাথা নামালেন। অধোপানে দৃষ্টি স্থাপিত করেই বললেন, “যদি ধরেই নিই... যদি ধরেই নিই রাজবধূ কুন্তীর গর্ভে সন্তান উৎপাদন করেছেন স্বয়ং বিদুর— তাতে দোষের কী? পতির অক্ষমতা বা অবর্তমান হেতু দেবর-কর্তৃক ভ্রাতৃবধূর গর্ভাধান, এ তো ধর্মানুমোদিত! আমি নিজে এ রটনাবিশ্বাস করি না। কিন্তু, কিন্তু... যদি তর্কের সাপেক্ষে তা সত্যও হয়, এতে এত শ্লেষ-নিন্দার কী আছে, অন্তত কুরুরাজবংশে...?”

“সে কী! পরম ধর্মজ্ঞ গঙ্গানন্দনের মুখে এ কী প্রকারের অপযুক্তি, মহারাজ! আমি কি ঠিক শুনছি?” শকুনি প্রায় লম্ফ দিয়ে ওঠে, “যদি কুন্তীর প্রথম সন্তানটি দাসীপুত্র পারশব বিদুরের ঔরসজাত হয়, তবে সেও তো বিদুরের মতোইরাজসিংহাসনের সম্পূর্ণ অনধিকারী হবে! নিয়োগপ্রথায় রানির গর্ভে একমাত্র ঋষি-ব্রাহ্মণের ঔরস স্বীকৃত, অথবা ক্ষত্রিয় দেবরের! ক্ষত্রিয়, হে মহাত্মা দেবব্রত! দেবরকে ক্ষত্রিয় হতে হবে, অথবা ব্রাহ্মণ! শূদ্রাণীজাত ক্ষত্তা নয়!... এও যে আপনাকে স্মরণ করাতে হবে, তা এই অধম সৌবল কখনও কল্পনা করেনি! হা হা!”

ধৃতরাষ্ট্রের কণ্ঠস্বরও নির্মম শোনায়, “শকুনি তিক্ত কথা বলে, তাত— কিন্তু কথাগুলি প্রবল ভাবে যৌক্তিক। ক্ষত্তা-ঔরসজাত হিসেবে পরিচয় ঘোষিত হলে প্রথম কৌন্তেয় তৎক্ষণাৎ রাজকার্যে ব্রাত্য নির্ধারিত হয়ে যেত— তাই সে বাস্তবটি কৌশলে গোপন করে ব্রাহ্মণ-ঋষিদের সহায়তায় নানাবিধ অলৌকিক গল্প নির্মাণ! ধর্মপুত্র! প্রকৃতপক্ষে, ‘ধার্মিকের পুত্র’ মাত্র— এ ছাড়া কিছু নয়!”

ভীষ্ম মুখ তুললেন। এ বার কঠোর হয়েছে তাঁর আননও। গম্ভীর কণ্ঠে বললেন, “পুত্র ধৃতরাষ্ট্র! গুরুজন হিসাবে, ভ্রাতুষ্পুত্র এবং ভ্রাতুষ্পুত্রবধূর কল্পিত কলঙ্ক-চর্চা আমার কাছে অতি অরুচিকর। কুন্তীপুত্রদের পিতৃপরিচয় প্রতিষ্ঠিত, ঘোষিত, স্বীকৃত। এই বিষয়ে পবিত্র হিমালয়ের বিপ্র-মুনি-তপস্বীরা যে সাক্ষ্য দিয়েছেন, তার বিপরীত বক্তব্যের অধিকার বা ক্ষমতা কারও নেই। রাজারও নেই— রাজশ্যালক তো দূর! সুতরাং রুদ্ধদ্বারেই সীমাবদ্ধ থাকবে এই কর্দম-ক্রীড়া— হস্তিনা-রক্ষক ভীষ্মের এই ইচ্ছা। যদি এই কলুষিত জল্পনা ব্যতীত অন্য কোনও আলোচ্যসূচি থাকে তবেই আমি এই কক্ষে অবস্থান করতে প্রস্তুত, অন্যথায় বিদায় নিচ্ছি। ধিক্‌!”

আসন ত্যাগ করে সক্ষোভে উঠে পড়লেন গাঙ্গায়নি। শকুনি একটি শ্লেষহাস্য গোপন করে, ধৃতরাষ্ট্রের দিকে ‘আগেই বলেছিলাম লাভ হবে না’-গোত্রীয় ভঙ্গি করে কাঁধ ঝাঁকালেন। ধৃতরাষ্ট্র অবশ্য তা দেখতে পেলেন না। তিনি অনুমানে প্রস্থানোদ্যত দেবব্রতর দিকে অন্ধ-নেত্র স্থাপনের চেষ্টা করে বললেন, “বেশ। এই চর্চা বন্ধ থাক। কিন্তু অনুগ্রহ করে কক্ষত্যাগ করবেন না, তাত! আমার আরও একটি বক্তব্য আছে। অভিযোগও বলতে পারেন। শ্রবণ করুন হে ভারত!”

“আবার অভিযোগ!” ভীষ্ম যুগপৎ হতাশা ও বিস্ময় ব্যক্ত করেন।

“হ্যাঁ, পূজ্যবর! এ অভিযোগ আপনার নিযুক্ত অস্ত্রশিক্ষক দ্রোণের বিরুদ্ধে।”

“দ্রোণের বিরুদ্ধে! বলেন কী মহারাজ!” দেবব্রতর ভ্রু উত্থিত হয়।

১৬

দ্রোণ গভীর শ্বাস নেন তিন বার। মস্তিষ্কে প্রাণবায়ু প্রয়োজন। তাঁর শিক্ষকজীবনের সবচেয়ে কঠিন সঙ্কটমুহূর্ত উপস্থিত। প্রত্যক্ষ বিদ্যাদানের মাধ্যমে যে সম্পদ তিনি শ্রেষ্ঠ ক্ষত্রিয়-ছাত্রকেও এ যাবৎ দিতে পারেননি— শুধু গোপনে ও দূর থেকে তাঁর প্রশিক্ষণ অনুসরণ করে নীচজাতির বালক তাকে অতিক্রম করে গেল! এ তাঁর দ্বিমুখী অপমান। আচার্য হিসেবে ব্যর্থতা, আবার প্রিয় শিষ্যের কাছেও আস্থাহানি। আরও গুরুতর বিপদের আভাস মিলছে তাঁর ষষ্ঠেন্দ্রিয়ে। এ সমাচার যদি সাধারণ্যে প্রকাশিত হয়ে পড়ে, তবে দ্রোণাশ্রমের যে ব্যতিক্রমী গরিমা, সমগ্র জম্বুদ্বীপে এই গুরুকুলের প্রতি যে ঈর্ষাজড়িত সমীহ, প্রখর নিরাপত্তায় মণ্ডিত শিক্ষায় যে-দুর্লভতার সম্ভ্রম— সব ধূলিসাৎ হবে। দ্রোণ ও তাঁর তথাকথিত গূঢ়-বিদ্যা— দুই-ই হবে হাস্যাস্পদ।

ধর্মবচন উচ্চারণ করে যুধিষ্ঠির সেই সঙ্কট ঘনীভূত করে দিয়েছে, তস্করকে শাস্তিদানের পথটিও বন্ধ। যা বলেছে সব সত্য, অক্ষরে অক্ষরে সত্য— কিন্তু এই কি সত্যনিষ্ঠা ঘোষণার সময়? এই জ্যেষ্ঠ কৌন্তেয়টি গভীর প্রজ্ঞাবান, না কি বাস্তবজ্ঞানরহিত মূঢ়— তা নিয়ে মাঝে মাঝে সংশয় জাগে দ্রোণের! কখনও কখনও মনে হয় এই কুমারের মধ্যে একটা প্রদর্শনকামিতা আছে, পার্থিব লাভের চেয়ে সে যে সত্য ও ধর্মকেই অধিক গুরুত্ব দেয়, স্বার্থহানি হলেও— সে বার্তাটি ছড়াতে অতিরিক্ত উৎসুক এই যুবা! সম্ভবত ভবিষ্যৎ হস্তিনাধিপতি হিসাবে নিজের গ্রহণযোগ্যতা বৃদ্ধি করার এ এক সূক্ষ্ম কৌশল, জনগণের কাছে ধার্মিকতা-মাহাত্ম্যের প্রচার!

কিন্তু দ্রোণ কী করবেন এখন? নিশ্চেষ্ট হয়ে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখবেন নিজের দীর্ঘ সাধনার অপমৃত্যু? যে সুচারু পরিকল্পনা নিয়ে পাঞ্চাল থেকে হস্তিনায় আসা— কুরুকুমারদের অস্ত্রগুরু হিসেবে সুকৌশলে নিজেকে উপস্থিত করানো, বিশেষ পদ্ধতির বিদ্যাদানের মাধ্যমে তাদের অজেয় করে তোলার উদ্যোগ, তৃতীয় পাণ্ডব অর্জুনকে শ্রেষ্ঠ শিক্ষা দেবেন বলে নিজের পুত্রকেও বঞ্চিত করা, প্রতিদ্বন্দ্বী রাধেয় বসুষেণকে প্রতারিত করে বিতাড়ন— সব ব্যর্থ হয়ে যাবে?

হ্যাঁ, কেউ জানে না দ্রোণের অন্তরে কী আছে! স্ত্রী কৃপী, পুত্র অশ্বত্থামা, শ্যালক কৃপ— কারও কাছে তিনি নিজের এই বিশেষ অভিপ্রায়টির কথা উন্মোচন করেননি। কিন্তু কেউ না জানুক, দ্রোণ তো নিজে জানেন এত বিশাল ও সুপরিকল্পিত কর্মকাণ্ডের মধ্যে তাঁর নিজের কী গভীর ও মারাত্মক স্বার্থ নিহিত! সকলে তাঁকে বিষয়বিরাগী শিক্ষাব্রতী, অনন্যচিন্ত ছাত্রপ্রেমী বলে জানে। কিন্তু, বস্তুত, নিখাদ শিক্ষক হয়ে তো তিনি অবতীর্ণ হননি কুরুকুলের অঙ্গনে। এক প্রগূঢ় ব্যক্তিগত অভিসন্ধির হোমানল সদা-জ্বলন্ত তাঁর মানসে, তিনি সেই গুপ্ত যজ্ঞের বিনিদ্র ঋত্বিক! এক কুলশীলমানহীন শীর্ণ কৃষ্ণকায় অপবিত্র অপরিচ্ছন্ন নিষাদ-বালক সেই হোমের আগুনে মূত্রত্যাগ করবে— এ তিনি হতে দিতে পারেন?

দ্রুত ভাবতে থাকেন দ্রোণ। যত সময় অতিক্রান্ত হবে, তত তাঁর পক্ষে পরিস্থিতি বিপজ্জনক।

আগে সম্পূর্ণ তথ্য প্রয়োজন। তাঁর প্রশিক্ষণ কতটুকু আয়ত্ত করেছে নিষাদ, নিজের সাধনায় কতটুকু অতিক্রম করেও গিয়েছে গুরুবিদ্যাকে!

দ্রোণ পরীক্ষা নিলেন একলব্যের। দেখলেন তার যাবতীয় কলাকৌশল। শুধু চমকপ্রদ তিরচালনা নয়, সে অধিগত করেছে গুপ্ত কর্মশালার বিদ্যাও। ধাতুর অভাব সে পূরণ করেছে বন্য পশুরঅস্থি ও শৃঙ্গ দিয়ে। নিজস্ব পদ্ধতিতে নানা আকার-আয়তনের অস্থি বা শৃঙ্গকে প্রস্তর-শাণিত করেএমন সব অস্ত্রফলক সে উদ্ভাবন করেছে— দেখে বিস্ময় জাগে।

ক্রমশ

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement