পূর্বানুবৃত্তি: বিদুরের মুখে সন্তানদের শক্তিশালী হয়ে ওঠার কথা শুনে আশ্বস্ত হন কুন্তী। কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেন ধর্ম, ইন্দ্র প্রমুখ দেবগণের প্রতি, যাঁরা তাঁর আহ্বানে দয়াপরবশ হয়ে তাঁকে সন্তান উপহার দিয়ে গিয়েছেন। কিন্তু ধর্মই কি কুন্তীর প্রথম সন্তানের পিতা? এই প্রশ্নে সামান্য সংশয় প্রকাশিত হলেও শিহরিত হন কুন্তী। স্পর্শকাতর বিষয়ে আর কথা বাড়ান না বিদুরও। অন্য দিকে, নিষাদ বালক একলব্য, তার একাকী অরণ্যবাস ও অন্যান্য কর্মকাণ্ডে বিস্ময় বাড়িয়ে তোলে অস্ত্রগুরু দ্রোণের।
চোখের পলক পড়ছিল না দ্রোণের। একেবারে নিখুঁত সরলরেখায় পাশাপাশি গিয়ে কাণ্ডভেদ করেছে পাঁচটি ক্ষুরধার ভল্লমুখ শর, একযোগে তাদের অভিঘাত হয়ে দাঁড়াল গতিশীল করপত্রের মতো। মসৃণ কর্তন সম্পন্ন হল কাণ্ডের মধ্যভাগ থেকে, শাখা-প্রশাখার ভার নিয়ে ঊর্ধ্বাংশ ভূমিশয্যা নিল কয়েক মুহূর্তেই!
বাক্স্ফূর্তি হতে সময় লাগল দ্রোণের। বালকের দিকে তাকিয়ে তিনি বললেন, “এই ক্ষেপণকৌশল, এই বিরল অস্ত্রের অধিকার— এ তো যোগ্য গুরুর দান ব্যতীত লব্ধ হতেই পারে না! একক সাধনায় এত দূর অগ্রসর হওয়া অসম্ভব!”
কৃষ্ণকায় কিশোর সসঙ্কোচে সামান্য হাসে। বলে, “একশো ভাগ ঠিক বলেছেন প্রভু। এ-সবই গুরুর কাছে পাওয়া। নিত্যই গুরুর কাছে শিখছি।”
এবার যাদব সাত্যকি ক্রুদ্ধস্বরে বলে উঠল, “তবে যে বললি তুই একা থাকিস!”
“সে-কথা তো মিথ্যে নয়, কুমার! একাই থাকি। আবার গুরুও সর্বদা আমার কাছেই থাকেন, সে-ও সত্যি,” একলব্য বিনীত ভাবে জানায়।
“প্রহেলিকা রাখো, বালক! স্পষ্ট উত্তর দাও,” দ্রোণ জলদমন্দ্র কণ্ঠে জানতে চান এবার, “বলো, তোমার গুরু কে? কোথায় তিনি?”
“আসুন, প্রভু! আমার গুরুকে দেখে যাননিজের চোখে!”
সশিষ্য দ্রোণ একলব্যকে অনুসরণ করেন। প্রগাঢ় বিস্ময় অপেক্ষা করছিল তাঁদের জন্য! পর্ণকুটিরের ঠিক পশ্চাতে এক মৃন্ময় বেদী, তাঁর উপর একটি নাতিবৃহৎ মৃত্তিকামূর্তি। এক কৃশকায় ব্যক্তি, শ্মশ্রুগুম্ফমণ্ডিত মুখমণ্ডল, বক্ষে উপবীত স্পষ্ট, হস্তে ধনুর্বাণ, স্কন্ধে তূণীর! স্বল্প নিরীক্ষণেই বোঝা যায়, মূর্তি কার!
প্রথম মুখ খোলে অর্জুন, “আচার্য, এ তো...”
১৩
বিদুর জানতে পারলেন না— তিনি যখন কুন্তীর কক্ষে আলাপনে রত, ঠিক সেই সময় রাজা ধৃতরাষ্ট্রের রুদ্ধদ্বার মন্ত্রণাকক্ষে চলেছে উত্তপ্ত বাদানুবাদ। এবং তার বৃহদংশের উদ্দিষ্ট তিনিই!
হস্তিনা-রাজসভার বৃহৎ মন্ত্রণাগারেই গুরুত্বপূর্ণ আলোচনাসভাগুলি আনুষ্ঠানিক ভাবে সংঘটিত হয় সচরাচর। তাতে সমস্ত উচ্চপদাধিকারী মন্ত্রী-অমাত্য এবং রাজবংশের শীর্ষ-ব্যক্তিত্বদের উপস্থিতি বাধ্যতামূলক। সিদ্ধান্তগুলি ঘোষিত হয় সভায়, তার পর প্রচারিত হয় নগরে। কিন্তু তার বাইরে ছোটোখাটো পরামর্শ অনেক সময়েই রাজপুরুষেরা নিজ নিজ ব্যক্তিগত মন্ত্রণাকক্ষে সেরে নেন।
কুরুপ্রধানদের প্রত্যেকেরই নিজস্ব আবাসে নিজস্ব মন্ত্রণা-প্রকোষ্ঠ আছে। ভীষ্মের, ধৃতরাষ্ট্রের, বিদুরের। সত্যবতীর ছিল, পাণ্ডুর ছিল। মন্ত্রণাগারে সেই গৃহের কর্তা বা কর্ত্রী নিজের পছন্দমতো লোকজন নিয়ে আলোচনা করার অধিকারী, সেখানে যে-কাউকে প্রবেশাধিকার-বঞ্চিত রাখাও তাঁর নিজস্ব সিদ্ধান্ত। এমনকি, কুমার দুর্যোধনও সম্প্রতি নিজের জন্য একটি স্বতন্ত্র মন্ত্রণাকক্ষের ব্যবস্থা করেছে। তার নিজস্ব অনুগামী অমাত্য-অভিজাতবর্গ, মাতুল শকুনি এবং তার কয়েক জন অতি-বিশ্বাসভাজন ভ্রাতা— এদের সঙ্গে নিয়ে সে মাঝে মাঝেই নানা গোপন আলাপ করে। মহামন্ত্রী বিদুর এই ব্যবস্থার বিরুদ্ধে আপত্তি জানিয়েছিলেন। বলেছিলেন, এই ধরনের আয়োজন কেবল অভিভাবক ও পদাধিকারীদের জন্যই নির্দিষ্ট। ঘরে ঘরে সামান্য ব্যক্তিরা যদি গুপ্ত মন্ত্রণাগার খুলে বসে, তবে ষড়যন্ত্রের আশঙ্কা বৃদ্ধি পাবে, তা রাজ্যের পক্ষে বিপজ্জনক। ধৃতরাষ্ট্র বলেছিলেন, “দুর্যোধন সামান্য ব্যক্তি নয়, সে ভাবী যুবরাজ!” বিদুর সবিনয়ে সে-কথার প্রতিবাদ করে বলেছিলেন, “যুবরাজ কে হবেন তা এখনও আনুষ্ঠানিক ভাবে ঘোষিত নয়, প্রজাবর্গের মত জানা হয়নি এখনও, সুতরাং এ-বিষয়ে আগে থেকেই দুর্যোধনকে বিশেষ সুবিধাভোগী করে রাখা ন্যায়সম্মত নয়। যুধিষ্ঠির তো এমন কোনও একান্ত মন্ত্রণাগৃহ রাখেননি!” ভীষ্মও বিদুরের বক্তব্যের যৌক্তিকতা সমর্থন করেন। কিন্তু ধৃতরাষ্ট্রের নীরবতা জানিয়ে দেয়, তিনি পুত্রের ইচ্ছার পক্ষেই আছেন। ফলে ব্যবস্থাটি বলবৎ থেকেই যায়।
বিদুরকে বাদ দিয়ে রাজ-আলোচনাসভা হয় না কদাপি। দেবব্রত নিজে সব গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রণা মহামন্ত্রীর সমক্ষেই করার পক্ষপাতী। তাঁর রাজনীতি তেমনই অনুমোদন করে। বিশেষত, বিদুর কুরু-পরিবারেরও স্তম্ভবিশেষ। ফলে, অন্যান্য রাজ্যে যেমন হয়— একান্ত পারিবারিক ক্ষেত্রে মন্ত্রণা সীমাবদ্ধ থাকলে সেখানে বহিরাগত মন্ত্রী-অমাত্যদের বর্জন করে রাখাই রীতি— কুরু-রাজপুরীতে তার প্রয়োজন হয় না। এ এক বিরাট সুবিধে। কিন্তু আজ স্বয়ং রাজা ধৃতরাষ্ট্র চেয়েছেন, এই সভা হোক মন্ত্রীর অনুপস্থিতিতেই। রাজ-ইচ্ছার উপর কথা চলে না।
কিন্তু গঙ্গাপুত্র মন্ত্রণার প্রারম্ভেই জানতে চাইলেন ধৃতরাষ্ট্রের কাছে। কী কারণে এমন এক ব্যতিক্রমী সভার আহ্বান, যাতে মন্ত্রীকে অনুপস্থিত রাখতে হল? রাজশ্যালক সৌবল শকুনি উপস্থিত, অথচ রাজভ্রাতা মহামতি বিদুর অনামন্ত্রিত!
ধৃতরাষ্ট্র আজ প্রথম থেকেই উত্তেজিত। তিনি উত্তেজনা প্রকাশ করবেন বলেই ডেকেছেন সভাটি।
“কারণ আছে, তাত দেবব্রত! আজকের আলোচনা রাজকর্ম-বিষয়ক কোনও সিদ্ধান্ত নেওয়ার জন্য নয়! আজ রাজা ধৃতরাষ্ট্র নয়, আপনার পুত্র ধৃতরাষ্ট্র— অন্ধ ধৃতরাষ্ট্র— মহান শান্তনব ভীষ্মের কাছে অভিযোগ জানাতে চায়। আজ সে কুরুবংশের প্রবীণ অভিভাবকের কাছে বিচারপ্রার্থী এক পিতা; নিজের সন্তানের জন্য সে সুবিচার প্রত্যাশা করে।”
“তোমার বক্তব্য এবং প্রকাশভঙ্গির মধ্যে সাযুজ্য নেই, পুত্র ধৃতরাষ্ট্র!” ভীষ্ম গম্ভীরস্বরে বললেন, “তোমার স্বর ক্রুদ্ধ ও উচ্চ। তোমার অঙ্গুলি মুষ্টিবদ্ধ। চিবুক কঠিন। এই ভঙ্গিতে কেউ বিচার প্রার্থনা করে না। তোমার দেহের ভাষা যেমন দেখছি, তা একমাত্র দ্বন্দ্বযুদ্ধে আহ্বান করার সময় হয়ে থাকে। প্রার্থনার সময় নয়।”
ধৃতরাষ্ট্র দমিত হলেন না। পূর্ববৎ ক্ষুব্ধস্বরেই বললেন, “তাই যদি মনে হয়, তবে... বেশ! আমি যুদ্ধই আহ্বান করছি, হে পূজ্য তাত! আমার পুত্রদের বিরুদ্ধে দীর্ঘদিন ধরে যে অপশক্তি এই প্রাসাদের অভ্যন্তরে এবং বাইরে ধূমায়িত হচ্ছে— আমি সেই চক্রান্তের বিরুদ্ধে আজ যুদ্ধ ঘোষণা করলাম! আপনি হোন সেই দ্বন্দ্বযুদ্ধের বিচারক!”
“চক্রান্ত! কে করছে, কারা করছে— চক্রান্ত, তোমার পুত্রদের বিরুদ্ধে! কোন অপশক্তিরকথা বলছ?”
গান্ধার-রাজ শকুনি এত ক্ষণ উপাধানে ঈষৎ এলায়িত হয়ে গুম্ফে অঙ্গুলি তাড়না করছিলেন। ভীষ্মের দিকে বক্র দৃষ্টিপাত করে বলে উঠলেন, “আজকের সভার আমন্ত্রণ-তালিকা থেকেও কি এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজে পাচ্ছেন না, মান্যবর?”
ভীষ্ম একবার অপাঙ্গে তার প্রতি দৃষ্টিপাত করলেন মাত্র। এই ব্যক্তিকে তিনি যথাসম্ভব উপেক্ষা করেন। নিজের রাজ্য ফেলে হস্তিনার প্রাসাদে বসে আমোদ-বিলাসের অন্তরালে কুরুবংশের রক্তপান করছে এই কীট! তিনি আবার ধৃতরাষ্ট্রের দিকে ফিরে বললেন, “ধর্মাত্মা বিদুরকেই তুমি অপশক্তি এবং চক্রান্তকারী বলে অভিযুক্ত করতে চাইছ, এমন কথাও কি বিশ্বাস করতে হবে আমাকে?”
ধৃতরাষ্ট্র নিজের ললাটে করাঘাত করে বললেন, “এ-দুর্ভাগ্য যে কখনও হবে, তা আমিও কোনও দিন ভাবিনি, তাত! বিদুর আমার কনিষ্ঠ। একই পিতার ঔরসে আমাদের জন্ম। কিন্তু আমার পুত্রদের উপর তার এমন জাতক্রোধ, হে গাঙ্গেয়! তার কী ক্ষতি করেছে আমার সন্তানেরা যে, তাদের এমন অহিতাকাঙ্ক্ষী সে? এইটুকু আপনি আমাকে বলুন!”
“বিদুর তোমার পুত্রদের অহিত কামনা করেন, এমন ধারণা কেন, ধৃতরাষ্ট্র? সেই শিশুকালে দুর্যোধনের সম্পর্কে অশুভ ভবিষ্যদ্বাণী করেছিলেন... সেই কথা নিয়ে কি এখনও তোমার...”
“অশুভ!” ধৃতরাষ্ট্র আবার তপ্তকণ্ঠে বললেন, “তাত, কী অসম্ভব নিষ্ঠুর কথা বলেছিল সে সেই লগ্নে, আপনি বিস্মৃত হয়েছেন! সে বলেছিল, এই শিশুকে হত্যা করা হোক— এর ক্রন্দনধ্বনি কর্কশ! নবজাত অবোধ শিশু, তার ক্রন্দনের মিষ্টত্ব বিচার... আর একেবারে প্রাণদণ্ড! রাজপুরীর কোনও নারীপুরুষের কানে তা বিঘ্ন সৃষ্টি করল না, শুধু বিদুর একা অস্থির হয়ে উঠল! তার পর সেই বক্তব্য তেমন সমর্থন পাচ্ছে না দেখে সে জাতকের কোষ্ঠীচিত্র নিয়ে বসল... এবং পুনরায় ঘোষণা করল, এই শিশু হবে কুলক্ষয়ী...”
ভীষ্ম একটু নীরব রইলেন। কথাগুলি সত্য। বিদুরের সেই সময়কার ভূমিকা তাঁকেও কিঞ্চিৎ বিস্মিত করেছিল। স্থিতধী ধর্মপথগামী শুদ্ধাত্মা বিদুর শুধু কর্কশ ক্রন্দনের অপরাধে সদ্যোজাত রাজপুত্রকে হত্যার নিদান দিচ্ছেন, এটি বেশ পীড়াদায়ক নয়?
“আপনার নিশ্চয় স্মরণে আছে তাত, এই বিদুরই তার ঠিক কিছু আগে যুধিষ্ঠিরের জন্মসম্ভাবনায় কেমন উৎফুল্ল হয়েছিল?... যাকে সে চাক্ষুষ দেখেনি পর্যন্ত তখনও! ভ্রাতা পাণ্ডুর প্রথম পুত্রটি আমার প্রথম পুত্রের চেয়ে বয়োজ্যেষ্ঠ, এ কথা প্রমাণের জন্য সে যেন মরণপণ হয়ে উঠেছিল! তাকে ভাবী যুবরাজ বলেও প্রচার করতে তার বাধেনি। রাজার পুত্রই যে যুবরাজ হয়, এই নিয়ম কি অজানা ছিল তার?”
ভীষ্ম মাথা নেড়ে মৃদুস্বরে বললেন, “দুর্যোধনের যুবরাজ হওয়ার বিষয়টি নিয়ে তোমার বক্তব্যটিও অবশ্য রন্ধ্রহীন নয় পুত্র। এখানে বিচার বহুমাত্রিক ও দুরূহ। যুক্তিগুলি সূক্ষ্ম ও দ্বিমুখী। দুর্যোধন বর্তমান রাজার জ্যেষ্ঠপুত্র, এ অবশ্যই গুরুত্বপূর্ণ কথা।কিন্তু, মনে রাখা দরকার, তুমি আজ যে-সিংহাসনটিতে অধিষ্ঠিত তা কিন্তু প্রকৃত প্রস্তাবে মৃত রাজা পাণ্ডুর আসন! তিনি স্বেচ্ছায় তোমাকে তা দান করে বনে গিয়েছিলেন। ফলে, যিনি প্রকৃত অধিকারী রাজা ছিলেন— তাঁর জ্যেষ্ঠপুত্রের যে ওতে একেবারেই দাবি নেই, এমন বলা চলে না। ক্ষুব্ধ হোয়ো না, এটি একটি অনস্বীকার্য সত্য যে, রাজপদে অধিষ্ঠিত হওয়া তো তোমার সম্ভবই হত না, পুত্র ধৃতরাষ্ট্র! তোমার যে দৈহিক প্রতিবন্ধকতা, তা তো রাজা হওয়ার পক্ষে...”
“কিন্তু সে-প্রতিবন্ধক তো রাজপুত্রের নেই, মহাত্মন! কুমার দুর্যোধন সম্পূর্ণ সক্ষম-সবল, ঈশ্বরের কৃপায় ও শত্রুর মুখে ভস্ম নিক্ষেপ করে একটু বেশিই সবল, হেঃ হেঃ! ” শকুনি পুনরায় তির্যকোক্তি করেন, “এবং তার দেহে বিশুদ্ধ রাজরক্ত প্রবাহিত, এ নিয়েও কারও মনে বিন্দুমাত্র সংশয় নেই! এ এমন রাজপুত্র যার মাতা অন্তঃপুরচারিণী সতী, যারজন্ম রাজপ্রাসাদে, যার জন্মের সাক্ষী রয়েছে প্রচুর! পতি ও সপত্নীর দেহান্তের পর অরণ্য-পর্বতের অন্তরাল থেকে আত্মপ্রকাশ করে— পাঁচরকমের পাঁচখানি বয়ঃপ্রাপ্ত পুত্তুর সমেত হাজির হয়ে, ‘এই যে রাজকুমার এনেছি, দেবতারা দিয়ে গিয়েছেন’ বলে হাস্যকর কুনাট্যে নামতে হয়নি দুর্যোধনের জন্মদাত্রীকে!”
১৪
“আজ আমি কিছু গোপন করব না, প্রভু! আপনি— আচার্য দ্রোণই আমার গুরু, আপনার মূর্তিকে পুজো করেই আমার সাধনা এগিয়েছে। কিন্তু এ-কথা সত্যিই বলেছেন আপনি যে, শুধু মাটির মূর্তির ক্ষমতা নেই শিক্ষা দেওয়ার, তার জন্য জীবন্ত শিক্ষকের প্রয়োজন!... ঠিক, একেবারে ঠিক কথা। মূর্তি তো প্রতীক শুধু। কিন্তু, ভগবন্, প্রতীকের পিছনে সত্যিটাই তো লুকনো থাকে। মিথ্যের প্রতীক-রূপ হয় না। এই মূর্তিকে-যে আমি গুরু মেনেছি, তার পিছনেও একটা সরল সত্যিই আছে। আমার সমস্ত জ্ঞান ও সামর্থ্য আসলে সেই সজীব আচার্যের কাছেই সরাসরি পাওয়া— যিনি মূর্তি হয়ে এখানে রয়েছেন!”
“এ কথার অর্থ?” ক্রুদ্ধ-বিস্মিত দ্রোণ উচ্চস্বরে জানতে চান।
তাঁর উত্তেজনার সঙ্গত কারণ রয়েছে। সম্মুখে দাঁড়ানো অর্জুনের কৃষ্ণ মুখে কৃষ্ণতর ছায়া নেমে আসছে একলব্যের উক্তি শুনে— এ তিনি স্পষ্ট দেখছেন। অভিমান-অবিশ্বাস-ক্ষোভ-দুঃখ মিশ্রিত হয়ে রয়েছে কৌন্তেয়র কুঞ্চিত ভ্রূ-যুগলে, কঠিন চোয়ালে আর স্ফুরিত অধরে। এত দীর্ঘকাল ধরে দ্রোণ এই রাজকুমারকে পরিপূর্ণ স্নেহ-প্রশ্রয়-উৎসাহ দিয়ে অনুপ্রাণিত করেছেন— বারংবার তাকে তার শীর্ষস্থান সম্পর্কে নিরঙ্কুশ আশ্বাস দিয়ে এসেছেন। ‘ভূমণ্ডলে তোমার তুল্য কেউ নেই, আমি তোমাকে অবিসংবাদী শ্রেষ্ঠত্বে নিয়ে যাব’— এই বাণী শুনেই সে অভ্যস্ত। সে আস্থা রাখে, গুরুর সর্বোৎকৃষ্ট ও গূঢ়তম বিদ্যাগুলি একান্তভাবেই তাঁর জন্য সঞ্চিত আছে। এমনকি নিজের সন্তানকেও আচার্য তা দেবেন না— শুধু পার্থকে শ্রেষ্ঠ ধনুর্ধর হিসাবে নির্মাণ করবেন বলে!
কিন্তু আজ এই নিষাদবালক এ কী বলছে? গুরু দ্রোণের কাছ থেকেই এই সব বিদ্যা সে অধিগত করেছে, প্রত্যক্ষ ভাবে! তাই তো বলল! গুরু কি তবে প্রতিজ্ঞাভঙ্গ করলেন অর্জুনের কাছে?
দ্রোণ অর্জুনের মন স্পষ্ট পড়তে পারছিলেন। আর ততই অপমানিত, ক্রুদ্ধ হচ্ছিলেনঅন্তরে। প্রকাশ্যে তাঁকে প্রিয় শিষ্যের সমক্ষে মিথ্যাবাদী, বিশ্বাসহন্তা প্রতীত করে তুলছে এই নীচজাতিসম্ভূত বালক!
“কবে কখন তোমাকে আমি শিক্ষা দিলাম, নিষাদ! নির্লজ্জের মতো অসত্য বলছ!”
একলব্য গুরুর ক্রোধ বুঝতে পারে। সংকুচিত ভঙ্গিতে বলে, “আমার বলার মধ্যে দোষ হয়ে থাকলে ক্ষমা করবেন, প্রভু! আপনি আমাকে নিজে শিক্ষা দিয়েছেন— এমন আমি কিন্তু বলিনি আদৌ। শুধু বলেছি, আপনার কাছ থেকে আমি শিক্ষিত হয়েছি, শিক্ষা লাভ করেছি— এইটুকুই শুধু!”
“অর্থ কী, এমন অদ্ভুত কূটাভাসের?”
“আচার্য, ভেবে দেখুন। রাজপথে যখন গো-গাড়িতে করে বণিকের ভরা মধুর ভাঁড় যায়,তা থেকে উপচে মধুর ফোঁটা তো পথের পাথরে পড়তে থাকে! ভিক্ষুক-সন্তানেরা বণিকের অজান্তে মধুর ফোঁটাগুলো পাথর থেকেই চেটে খায়। এ থেকে কি বলা চলে যে, বণিক নিজে তাদের মধু দান করে গেল? না। কিন্তু পথশিশুরা মধুর স্বাদ তো নিল, বণিকের কাছ থেকেই নিল— এও তো মিথ্যে নয়!”
ক্রমশ