ছবি কুনাল বর্মণ।
পূর্বানুবৃত্তি: যৌবনে নৃপময়ীকে দেখার জন্য তার বাড়ি গেছিলেন নীলমণি। কিন্তু নৃপময়ী তাঁকে বিশেষ গ্রাহ্য করেনি। তার অনেক পরে অমরেন্দ্রনাথের এক গোপন সভায় ফের দেখেছিলেন নৃপময়ীকে। তখন সে যোগিনী মা। শক্তিশালী বোমা তৈরিতে সিদ্ধহস্ত। স্ত্রী বিভাবতীর কাছে অবশ্য নৃপময়ীকে চেনার কথা স্বীকার করেন না নীলমণি। গুয়াহাটি থেকে প্রায় চল্লিশ কিলোমিটার দূরে বিজয়নগর গ্রামে আত্মগোপন করেছেন অমরেন্দ্রনাথ ও কয়েক জন বিপ্লবী। এক কৃষ্ণপক্ষের রাতে সেখানেও হামলা করে পুলিশ। সহবিপ্লবীদের আগে পালাতে দিয়ে শেষে জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে নিজেও পালিয়ে যান অমরেন্দ্রনাথ। আনাজপাতি বেচতে হাটের দিকে যাওয়া চাষির দলে মিশে গিয়ে ফের পুলিশের চোখে ধুলো দেন। অন্য দিকে বাগবাজারের হরপার্বতী নাম একটি ছেলের সঙ্গে বন্ধুত্ব হয়েছে শশিকান্তর। তার সঙ্গে নানা বিষয় আলোচনা করে সে।
শশিকান্তর খুব ইচ্ছে ছিল অমর দত্তর অভিনয় দেখার। দানীবাবু, গিরিশবাবু, চুণীবাবুর অভিনয় সে দেখেছে। কিন্তু অমর দত্তর অভিনয় দেখার সৌভাগ্য তার হয়নি।
হরপার্বতীকে সে কথা বলতেই, সে বলল, “বেশ তো, কালই চলো না! স্টার থিয়েটারে অমর দত্তর অভিনয় আছে। ‘সাজাহান’ নাটকে ঔরঙ্গজেবের ভূমিকায় অমর দত্তের অভিনয় দেখবে। মন ভরে যাবে! আমি দু’বার দেখেছি। মনে হয়, আবার দেখি।”
থিয়েটার হলের বাইরে কথাটা কানে এল শশিকান্তর, অমর দত্ত নাকি আজ অভিনয় করবেন না। খুব অসুস্থ তিনি। হরপার্বতীকে সে কথা বলাতে, সে বলল, “দাঁড়াও, আমি জিজ্ঞেস করে আসছি।”
হরপার্বতী ভিতরে কোথায় চলে গেল। তার পর খানিক বাদে, ফিরে এসে বলল, “হ্যাঁ, কথাটা ঠিক, ওঁর শরীর ভাল নেই। তবে এত দর্শক নাটক না দেখে চলে যাবেন, তা তিনি হতে দেবেন না। তিনি অভিনয় করবেন। চলো, ভিতরে চলো। আর দেরি নেই।”
নাটক চলাকালীন হরপার্বতী ফিসফিস করে শশিকান্তর কানে কানে বলল, “বুঝলে, অমরবাবু আজ অভিনয় না করলেই পারতেন। ওঁর হাঁটাচলা দেখে বোঝাই যাচ্ছে, উনি খুবই অসুস্থ আজ।”
হরপার্বতীর কথাটা শেষ হয়েছে, এমন সময় অমর দত্ত কাশতে শুরু করলেন। কাশির সঙ্গে মুখ দিয়ে রক্ত উঠতে লাগল। দাঁড়িয়ে থাকতে না পেরে, পড়ে গেলেন অমর দত্ত। দর্শকদের মধ্যে শোরগোল পড়ে গেল। উইংসের আড়াল থেকে বেরিয়ে অমর দত্তর শুশ্রূষায় ছুটে এলেন কুসুমকুমারী, বসন্তকুমারী, হাঁদুবাবু, কুঞ্জলাল চক্রবর্তী ও আরও অনেকে। পর্দা ফেলে দেওয়া হল। কুঞ্জলাল ও কুসুমকুমারী দর্শকদের সামনে এসে দাঁড়ালেন।
কুঞ্জলাল বললেন, “গভীর দুঃখের সঙ্গে জানাচ্ছি, আপনাদের প্রিয় অভিনেতা হঠাৎ অসুস্থ হয়ে পড়ায়, আমরা আজকের ‘সাজাহান’ অভিনয় মুলতুবি রাখছি। এই টিকিটেই আপনারা পরের অভিনয় দেখতে পারবেন।”
শুরু হয়ে গেল দর্শকদের কোলাহল। এক জন দর্শক মন্তব্য করল, “এত মদ খেলে আর বেলেল্লাপনা করলে হবে না?”
আর এক জন বলল, “ঠিক বলেছেন ভাই, তারাসুন্দরীকে নিয়ে কম কেচ্ছা করেছে অমর দত্ত? এখন আবার কুসুমে মেতে আছে।”
প্রথম দর্শক হো হো করে হেসে উঠল।
শশিকান্ত অবাক হয়ে ওদের মন্তব্য শুনছিল। এত বড় এক জন অভিনেতা হঠাৎ অসুস্থ হয়ে পড়েছেন, কোথায় তার জন্য সহানুভূতি দেখাবে, দুঃখপ্রকাশ করবে, তা নয়, সমালোচনা করছে!
হরপার্বতী শশিকান্তর একটা হাত ধরে টান দিয়ে বলল, “চলো, এ সব শুনে আর কাজ নেই। দর্শক মাত্রই এ রকম। আজ যার সমালোচনা করছে, কাল তাকে মাথায় নিয়ে নাচবে। যে দিন অমর দত্ত আবার স্টেজে উঠবেন, এই লোকগুলোই অন্য কথা বলবে। এখন চলো, বাড়ির পথে হাঁটি।”
রাস্তায় যেতে যেতে শশী বলল, “টিকিট দুটো তোমার কাছে রাখো হর। আর একটু খোঁজ রেখো, আবার কবে ‘সাজাহান’ হচ্ছে। অমর দত্তকে তো ভাল করে দেখাই হল না।”
“পরের অভিনয়ে দেখে নিয়ো। আমি নির্দ্বিধায় বলতে পারি, অমর দত্ত আমার দেখা সেরা অভিনেতা,” হরপার্বতী বলল।
“বলো কী, গিরিশবাবু, দানীবাবু, চুণীবাবু... এরা কেউ নয়?” শশিকান্ত অবাক হয়ে প্রশ্ন করল।
“এঁদের মধ্যে দানীবাবুকে আমি অমর দত্তর কাছাকাছি রাখতে পারি। আর গিরিশবাবুর অভিনয় দেখেছি ওঁর শেষ বয়সে। সেই অভিনয় দেখে ওঁকে বিচার করাটা ঠিক নয়।”
“গিরিশবাবু তো তোমাদের বাড়ির কাছাকাছিই থাকতেন, তাই না?”
“হ্যাঁ, কাছেই তো। বোসপাড়া লেনে।”
“তুমি কখনও গিয়েছিলে ওঁর বাড়ি? আমার বাড়ির কাছাকাছি হলে, আমি আলাপ করে আসতাম। অত বড় নাট্যকার!”
“না, ঠিক ওই ভাবে আমি যাইনি। তবে আমাকে নিয়ে গেছিল সবাই।”
“কী রকম?”
“সে এক মজার ব্যাপার হয়েছিল, বুঝলে! এমএ পরীক্ষায় আমি প্রথম বিভাগে প্রথম হয়েছিলাম। যে দিন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে দেওয়া স্বর্ণপদক নিয়ে বাড়ি ফিরছি, দেখি ফুলের মালা দিয়ে সাজানো একটা জুড়িগাড়ি প্রস্তুত রেখেছে বাগবাজার স্ট্রিটের ছেলেরা। আমাকে জোর করে সেই গাড়িতে তুলে নটসম্রাট গিরিশ ঘোষের কাছে নিয়ে গেল।”
“তাই নাকি? এটা তো জানতাম না! তা গিরিশবাবু কী বললেন?”
“মাথায় হাত রেখে আশীর্বাদ করলেন। বললেন— ‘অনেক বড় হও। শুধু বাগবাজার নয়, দেশের মুখ উজ্জ্বল করো।’”
“তুমি সৌভাগ্যবান। বাংলা থিয়েটারের প্রাণপুরুষকে সাক্ষাৎ করেছ।”
“তা বলতে পারো। আরও এক অর্থে আমি সৌভাগ্যবান। কেন জানো?”
“কেন?”
“আমি গিরিশবাবুর শেষ অভিনয় দেখেছি। সে একটা দিন, বুঝলে। বাবা এসে জিজ্ঞেস করল, গিরিশবাবুর ‘বলিদান’ নাটক দেখব কি না। আমি তো এক পায়ে খাড়া। কিন্তু, বাদ সাধল বৃষ্টি। সে কী বৃষ্টি! বাবা বললেন, গিয়ে কাজ নেই। আমি নাছোড়বান্দা। শেষ পর্যন্ত আমার জেদাজেদিতে বাবা রাজি হলেন। শুনেছিলাম, এত বৃষ্টির জন্য মিনার্ভা থিয়েটারের মালিক নাটক বন্ধ রাখতে চেয়েছিলেন। কিন্তু স্বয়ং নাট্যকার ও অভিনেতা রাজি হননি। যে কারণে অসুস্থ হয়েও অমরেন্দ্রনাথ নাটক চালিয়ে যাওয়ার পক্ষে ছিলেন, ঠিক সেই কারণেই গিরিশবাবু ওই রকম দুর্যোগের দিনেও নাটক বন্ধের বিপক্ষে ছিলেন। দর্শক নাটক না দেখে ফিরে যাবে, তা কোনও অভিনেতাই চান না।”
কথা বলতে বলতে চুপ করে যায় হরপার্বতী।
শশিকান্ত অবাক হয়। বলে, “কী হল, তুমি হঠাৎ চুপ করে গেলে?”
হরপার্বতী ইশারায় সামনে এগিয়ে আসা এক ভদ্রলোকের দিকে শশিকান্তর দৃষ্টি আকর্ষণ করে। শশিকান্ত ভদ্রলোকের দিকে তাকায়। দীর্ঘকায়। গায়ের রং কালো। শুভ্রকেশ। পরনে ধুতি ও পিরান। পিরানের গলা পর্যন্ত সব ক’টি বোতাম দেওয়া।
হরপার্বতী ওঁকে দেখিয়ে বলে, “উনি আমার বাবার বন্ধু, কৃষ্ণকাকা। মাঝে মাঝে আমাদের বাড়িতে আসেন। বাবার সঙ্গে বেহালা বাজান। ভারী মজার মানুষ। যাবে নাকি কথা বলতে? খুব কথা বলতে ভালবাসেন।”
শশিকান্ত বলে, “না না, দরকার নেই। তার চেয়ে চলো উল্টো দিকের ওই দোকান থেকে কিছু কিনে খাই। খুব খিদে পেয়েছে।”
“বেশ, চলো...” বলে রাস্তা পার হতে গিয়েই কৃষ্ণকাকার মুখোমুখি পড়ে গেল ওরা।
বেলঘরের এক বন্ধুকে নিয়ে শ্যামবাজার মোড়ে মিষ্টি খেতে যাচ্ছে শুনে, হরপার্বতীকে ধমক দিয়ে ভদ্রলোক বললেন, “বাগবাজারের এত কাছে বন্ধুকে নিয়ে এসে বাগবাজারের রসগোল্লা না খাইয়ে, তুমি খাওয়াচ্ছ শ্যামবাজারের মন্ডা, যা ও বাড়ির কাছের দোকানেই পাবে।”
হরপার্বতী শশিকান্তর দিকে তাকাল। ফিসফিস করে বলল, “বাগবাজারের রসগোল্লা খাবে নাকি? এখান থেকে কয়েক পা দূরে।”
খুব ছেলেবেলা থেকেই বাগবাজারের রসগোল্লার কথা শুনে আসছে শশিকান্ত। কিন্তু খাওয়া হয়নি। শশিকান্ত উৎসাহ দেখিয়ে বলল, “চলো যাওয়া যাক। এ দিকে এসেছি যখন, তখন পরখ করতে দোষ কী? নবীন ময়রার নাম কে না শুনেছে বলো!”
হরপার্বতী বলল, “চলো, সেখানেই যাই!”
হাঁটতে হাঁটতে দুই বন্ধু এসে দাঁড়িয়েছে বাগবাজারের একটা ছোট দোকানে। একটা মোটা মতো লোক দোকানদারি করছে। খালি গায়ে তার চকচকে ঘাম। ওদের বলল, “কী খাবেন বাবুরা?”
হরপার্বতী বলল, “রসগোল্লা আছে তো?”
লোকটা একটু হেসে বলল, “রসগোল্লারই তো দোকান এটা ভাই।”
দুই বন্ধু তিন জোড়া করে রসগোল্লা খেল। রসগোল্লা খেয়ে বেরোতেই ফের কৃষ্ণকাকার সঙ্গে দেখা। শশীর দিকে তাকিয়ে বললেন, “তুমি তো বেলঘরে থাকো, তা তোমার বাবা কী করেন?”
সে বলল, “বাবার পাটের কারবার বড়বাজারে।”
“কী নাম বলো তো, তোমার বাবার? বেলঘরের এক পাটের কারবারিকে আমি চিনি। অনেক বার বাগবাজারে বঙ্গ সেনের বাড়িতে দেখা হয়েছে। নামটা বোধহয় রমাপতি।”
“আমার বাবার নাম রমানাথ,” শশিকান্ত ভদ্রলোককে সংশোধন করে দেয়।
“হ্যাঁ, হ্যাঁ, ঠিক। তোমার বাবাকে গিয়ে আমার কথা বলবে, উনি চিনবেন,” ভদ্রলোক বলেন।
“নিশ্চয়ই বলব বাবামশাইকে,” শশিকান্ত বলে।
ভদ্রলোকের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে দুই বন্ধু যখন কলকাতার রাজপথে পা রাখল, তখন সন্ধের অন্ধকার গাঢ় হয়েছে। রাস্তার সব বাতিস্তম্ভে আলো জ্বলে উঠেছে। শশিকান্তর খুব মনে পড়ল লাবণ্যময়ীকে। মনে মনে ঠিক করল, এক দিন লাবণ্যময়ীকে এই দোকানের রসগোল্লা খাওয়াবে।
২৬
খুব অল্প সময়ের মধ্যে এ বাড়িতে দুটো বিবাহ সম্পন্ন হয়ে গেল। ছোট ভাই উমানাথ ও কন্যা কনকবালার বিয়েতে ঘটা কম করেননি রমানাথ। তবু যেন তুল্যমূল্য বিচারে উমানাথের বিয়েতে খরচের বহরটা বেশি হয়েছিল। হ্যারিসন রোড থেকে ব্যান্ড পার্টি এসেছিল। কী তাদের সাজ! ঘোড়ার গাড়ি করে উমানাথ যখন চলেছিল বৌ আনতে, সে এক দেখার মতো দৃশ্য। ছেলে-ছোকরার দল ভিড় করেছিল বাজনা শুনতে। মেয়েরাও বারান্দা, জানালা থেকে উঁকি মেরে বাজনাদারদের দেখে নিচ্ছিল। নহবত বসেছিল। বেনারস থেকে নামকরা সানাইবাদক এসে সানাই বাজিয়েছিল সারা দিন। সারা গ্রামের লোক তো নিমন্ত্রিত ছিলই, এ ছাড়া কলকাতা শহরের কেষ্টবিষ্টুরাও উপস্থিত ছিলেন। ঘোড়ার গাড়ি আর মোটরগাড়ির মেলা বসে গিয়েছিল। তবু যেন সব কিছুকে ছাপিয়ে গিয়েছিল সাহিত্যিক শরৎ চাটুজ্জের উপস্থিতি। তিনি যে মেয়ের মামা! নীলমণির সঙ্গে পরিচিতি থাকলেও, পণের কথা ওঠায় তিনি বেঁকে বসেছিলেন। বলেছিলেন, “ছেলে বিয়ে দিচ্ছ, না ভেড়া বিক্রি করতে এসেছ? এখানে আমার ভাগ্নির বিয়ে দেব না।”
নীলমণি ভাবেননি যে, এতটা রুষ্ট হবেন শরৎবাবু। সামাজিক রীতি অনুসারে পণের দাবি রেখেছিলেন কন্যাপক্ষের কাছে। পরে শরৎবাবুর কথা মেনে বিনা পণে মেয়ে নিয়ে এসেছিলেন।
উমানাথের বিয়ের পর এ বাড়ির পরিবেশ বদলে গেছে। তার স্ত্রী পারুল সংসারের হাল ধরেছে। নীলমণির স্ত্রী তাকে মাঝেমধ্যে বকাবকি করলেও, নিভাননী তাকে স্নেহ করেন। সংসারের কাজ শেখান। ভুল হলে শুধরে দেন।
এক দিন নিভাননী পারুলকে পরামর্শ দেন, “স্বামীকে আঁচলে বাঁধতে শেখো। শুধু চাবির গোছা আঁচলে বেঁধে ঘুরলেই গিন্নি হওয়া যায় না।”
পারুলের চোখ সজল হয়ে ওঠে। নিভাননী কাছে ডেকে বসায়। বলে, “কী হয়েছে তোমার, বৌমা? চোখে জল কেন? নিশ্চয়ই উমা তোমার সঙ্গে খারাপ ব্যবহার করছে।”
পারুল চুপ করে থাকে। নিভাননী বলে চলে, “পুরুষমানুষগুলোই এ রকম। নিজেদের কী যেন মনে করে! দাঁড়াও, আসুক আজ উমা।”
পারুল নিভাননীর হাত দুটো সজোরে চেপে ধরে। বলে, “ওঁকে কিছু বোলো না ঠাকুরঝি। উনি ভারী রাগ করবেন।”
“তা হলে বলো, তোমার চোখে জল কেন?” নিভাননী বলে।
“ওঁর অন্য স্ত্রীলোক আছে।”
“তুমি জানলে কী করে?”
পারুল চুপ করে থাকে। তার চোখের জল গাল বেয়ে নামে।
“কী হল, বলো...” তাড়া দেয় নিভাননী।
আঁচলের খুঁট থেকে একটা ছোট্ট কাগজ বার করে নিভাননীর সামনে মেলে ধরে পারুল।
ক্রমশ