রূপকার: বাণীকুমার। ডান দিকে, প্রথম দিকের স্ক্রিপ্টের পাতা।
কল্পিত সেই সময়যানে চেপে যদি পৌঁছে যাওয়া যেত ১৯৩২-এর ষষ্ঠীর ভোরে, শুনতে পাওয়া যেত আকাশবাণী কলকাতা কেন্দ্রের অন্য রূপের এক প্রভাতী অনুষ্ঠান ‘মহিষাসুরমর্দিনী’। ১৯৩২ সালের দুর্গাপুজোর ষষ্ঠী তিথিতে কলকাতা বেতার, অর্থাৎ সে সময়ের ইন্ডিয়ান স্টেট ব্রডকাস্টিং সার্ভিসের এক নম্বর গার্স্টিন প্লেসের বেতার কেন্দ্র থেকে এ অনুষ্ঠানটি প্রথম সম্প্রচারিত হয়। তবে দুর্গাপুজো উপলক্ষে প্রথম প্রভাতী অনুষ্ঠান সেখান থেকে প্রচারিত হয় তার আগের বছর বসন্তকালে। তখন দুর্গাপুজো মানে বাসন্তীপুজো, আবার তার পরদিনই অন্নপূর্ণা পুজো। এই দুই পুজোর সন্ধিক্ষণে যে অনুষ্ঠানটি প্রচারিত হয়েছিল, তার নাম ‘বসন্তেশ্বরী’। শ্রীশ্রীচণ্ডীর বিষয়বস্তু ছিল ‘বসন্তেশ্বরী’-র উপজীব্য। এটি ছিল চম্পূরচনা অর্থাৎ পদ্য ও গদ্যের মিলিত রূপ। বসন্তেশ্বরী রচনার পর, অনুষ্ঠানটির প্রবল জনপ্রিয়তা বাণীকুমারকে (যাঁর আসল নাম বৈদ্যনাথ ভট্টাচার্য), অনুপ্রাণিত করেছিল ‘মহিষাসুরমর্দিনী’ রচনায়। তিনি লিখেছেন, “আমি সংস্কৃত রূপকের অন্তর্গত ‘বীথী’ (বা oratorio) নাট্যরচনাশৈলী অনুসরণে নবভাবে ‘মহিষাসুরমর্দিনী’ প্রণয়ন করি ১৩৩৯ বঙ্গাব্দে।—বস্তুতঃ মহাশক্তি-বন্দনার এই অর্ঘ্য রচিত হয়েছিল ১৩৩৯ সালে আশ্বিনের দেবীপক্ষে শুভ ষষ্ঠীর প্রত্যূষে। যে গীতি-সম্ভার সজ্জিত হোলো— তা’র মধ্যে কয়েকটি গানের স্বর-সংযোগ করেন পণ্ডিত হরিশ্চন্দ্র ও রাইচাঁদ এবং অধিকাংশ গানের সুর গ্রন্থনা পঙ্কজ কুমারের। আমার পরিকল্পনায় ও নির্দেশে এবং শক্তিমানগণের প্রকৃষ্ট সহযোগে এই বহুবাঞ্ছিত রস-নৈবেদ্য সুসজ্জিত হোলো।”
সেই ‘মহিষাসুরমর্দিনী’-র রূপ ছিল কিন্তু বর্তমানকালে প্রচারিত অনুষ্ঠানের চেয়ে অনেকটাই আলাদা। প্রকৃতপক্ষে প্রতি বারই এই অনুষ্ঠান সম্প্রচারিত হওয়ার পর শ্রোতাদের অজস্র চিঠি এসে পৌঁছত বেতার কেন্দ্রে। সেই সব চিঠি খুবই মনোযোগ সহকারে পড়া হত। পরবর্তী কালে আকাশবাণী ভবনে একটি দফতরও খোলা হয়েছিল শ্রোতাদের চিঠিপত্র পড়ে দেখা, মূল্যায়ন করা এবং সেগুলি নির্দিষ্ট বিভাগে পাঠানোর জন্য। ‘মহিষাসুরমর্দিনী’-র ভাষ্যকার স্বনামধন্য বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্রের লেখায় পাই, “দুপুরবেলায় আমাদের হতো বিরাট এক আড্ডা।... প্রত্যেক আড্ডাধারীকে সপ্তাহে অন্তত একটা করে প্রোগ্রাম সম্বন্ধে নতুন নতুন পরিকল্পনা পেশ করতে হতো। এর উদ্দেশ্য শ্রোতার সংখ্যা আরও কী করে বাড়ানো যায়।”
অনুমান করা যেতেই পারে, শ্রোতাদের কাছে আরও মনোগ্রাহী ও সহজবোধ্য করে তুলতেই বাণীকুমার ‘মহিষাসুরমর্দিনী’ রচনাটি, বেশ কয়েক বার পরিবর্ধন ও পরিমার্জন করেছিলেন। এর পাশাপাশি সক্রিয় ছিল অনুষ্ঠানটিকে সম্পূর্ণ ও সর্বোত্তম করে তোলার জন্য তাঁর প্রকৃত স্রষ্টার মানসিকতা। মহাদেবী দুর্গার আরাধনাকে কেন্দ্র করেই বাংলার সর্ববৃহৎ উৎসব দুর্গোৎসব। তাই এই দেবীর পৌরাণিক কাহিনি অবলম্বনে বাণীকুমার রচনা করেছিলেন এই ‘মহিষাসুরমর্দিনী’। সঙ্গীতপ্রধান অনুষ্ঠানই তখন বেতার-শ্রোতাদের কাছে বেশি পছন্দের ছিল। এ ক্ষেত্রেও সে কথা মনে রেখেছিলেন তিনি। যে হেতু অনুষ্ঠানটি সবিশেষ জনপ্রিয়তা পেয়েছে এবং প্রতি বছরই মহালয়া উপলক্ষে সম্প্রচারিত হচ্ছে, তাই একে যতখানি উন্নত করা যায় ততই তা সমাদৃত ও বৈচিত্রপূর্ণ হবে— এ ভাবনা কাজ করেছিল বাণীকুমারের মনে। তিনি লিখেছেন, “বৎসরে বৎসরে না হোক, এই গ্রন্থকে নানাভাবে সমৃদ্ধ করবার আগ্রহে আমি বিবিধ বিষয়, স্তব-স্তুতি, দেবীসূক্ত, নব-রচিত গান সন্নিবেশ করেছি। অন্ততঃ ছয়-সাত বার এই রচনার পরিবর্তন সাধিত হয়েছে। মহাদেবী চণ্ডিকার প্রায় সমূহ তত্ত্ব ও তথ্য সমাহারে এবং দেবীর নানাবিধ ভাব-রূপ প্রকাশক গীতাবলী-সজ্জায় এই ‘মহিষাসুরমর্দিনী’ সুসম্পন্না হয়ে উঠেছে।”
এ অনুষ্ঠান যে কতখানি ‘সুসম্পন্না’ হয়েছিল, তার পরিচয় নতুন করে দিতে হয় না। বাণীকুমারও দেখেছিলেন, প্রথম সম্প্রচারের ছাব্বিশ বছর পরেও সুদূর জেনেভা, কায়রো-সহ বহু স্থান ও দেশ থেকেও শ্রোতাদের প্রশংসাপত্র এসেছিল আকাশবাণী বেতার কেন্দ্রে। গাঁ-গঞ্জের শ্রোতাদের কাছে রেডিয়োতে ‘মহিষাসুরমর্দিনী’ নয়, ‘মহালয়া’ শোনার জন্য আগের রাতে তাড়াতাড়ি শুয়ে ভোরের আগে উঠে পড়ার রেওয়াজ হয়ে গিয়েছিল। সেই ট্র্যাডিশন সমানে চলেছে। আজও নানা জায়গায় লাউড স্পিকার বা মাইক্রোফোনে শোনানো হয় বিশেষ এই বেতার অনুষ্ঠানটি। গত সাড়ে আট দশক ধরে অনুষ্ঠানটির গ্রহণযোগ্যতা বিস্ময়কর ভাবে অম্লানই থেকে গেল!
বাংলা ১৩৩৯, অর্থাৎ ইংরেজি ১৯৩২ থেকে ১৯৬২ সাল পর্যন্ত ‘মহিষাসুরমর্দিনী’ সরাসরি সম্প্রচারিত হয়েছিল। প্রথম দিকে চল ছিল না টেপ রেকর্ডিংয়ের, সব অনুষ্ঠানই সরাসরি সম্প্রচারিত হত, পরিভাষায় যাকে বলা হয় ‘লাইভ’। টেপ রেকর্ডিং ব্যবস্থা চালু হওয়ার আগে ছিল ডিস্ক রেকর্ড, যাকে তখন বলা হত চাকতি রেকর্ড। প্রসঙ্গত, রবীন্দ্রনাথের স্বকণ্ঠে তাঁর কবিতা আবৃত্তি রেকর্ড করা হয়েছিল সেই চাকতি রেকর্ডেই। ষাটের দশকেই শুরু হয় আগে থেকে রেকর্ড করে রাখা অনুষ্ঠান সম্প্রচার।
টেপ রেকর্ডিং যেমন ছিল না, তেমনই সে কালে না ছিল কম্পিউটার, না ছিল ফোটোকপি মেশিন। নাটক থেকে শুরু করে কথিকা, গীতি আলেখ্য ইত্যাদি সবই ছিল হাতে লেখার বিষয়। আর এ জন্যই ‘কপিয়িস্ট’ নামে একটি পদ সৃষ্টি করে সেই পদে নিয়োগ করা হয়েছিল শ্রীধর ভট্টাচার্যকে, পরবর্তী কালে বিশিষ্ট বেতার নাট্যব্যক্তিত্ব হিসেবে যিনি খ্যাতিমান হন। প্রতিলিপিকার হিসেবে তাঁকে বহু অনুষ্ঠানের কপি লিখতে হত। কার্বন পেপারে এক এক বারে চার কপির বেশি করা সম্ভব হত না, কাজটি শ্রমসাধ্যও ছিল। ভারী চমৎকার ছিল তাঁর হস্তাক্ষর। বন্ধু হেমন্ত মুখোপাধ্যায় লিখেছিলেন, “আকাশবাণীর সঙ্গে যুক্ত ছিল শ্রীধর। ও ছিল শ্রীবাণীকুমারের ডান হাত। ওর হাতের লেখা ছিল মুক্তোর মতো। ওর হাতের লেখার স্ক্রিপ্ট নিয়ে কাড়াকাড়ি পড়ে যেত রেডিয়ো আর্টিস্টদের মধ্যে।”
‘মহিষাসুরমর্দিনী’-র শিল্পী ও কলাকুশলীদের জন্যেও শ্রীধরবাবুকে মূল রচনার অনেকগুলি প্রতিলিপি তৈরি করতে হত। ১৯৩৯ সালে তিনি যোগ দিয়েছিলেন কলকাতা বেতার কেন্দ্রে। সরাসরি সম্প্রচারের সেই যুগে বাণীকুমার ‘মহিষাসুরমর্দিনী’-র নতুন নতুন যে লিপিগুলি রচনা করেছিলেন, তার ক’টিই বা পাওয়া গেছে জানা নেই। জানি না, ‘বসন্তেশ্বরী’-র পাণ্ডুলিপি বা তার কোনও প্রতিলিপি কোথাও আছে কি না। তবে শ্রীধরবাবুর হাতে লেখা, সম্ভবত ১৯৪২ সালে সম্প্রচারিত ‘মহিষাসুরমর্দিনী’-র অন্তত একটি কপির বেশ কিছু অংশ আজও আছে তাঁর পুত্র সনৎ ভট্টাচার্যের সযত্ন সংরক্ষণের দৌলতে। ছাব্বিশ পৃষ্ঠার সেই প্রতিলিপিতে চোখ রাখলেই বোঝা যায়, ভাষ্যের ভাষা, সঙ্গীত, বিন্যাস ইত্যাদির কতই না পরিবর্তন সাধিত হয়েছিল নানা সময়ে বাণীকুমারের রচনার এক একটি সংস্করণে। সৃজনশীল রচয়িতা কখনও থিতু হতে পারেননি, বার বার আরও সুন্দরের লক্ষ্যে ঘটিয়েছেন কাঙ্ক্ষিত পরিবর্তন। সেই ‘মহিষাসুরমর্দিনী’-র কপিটির উপরে ডান দিকে রোমান পদ্ধতিতে সাত সংখ্যাটি লেখা দেখে বোঝা যায়, সেটি ছিল সাত নম্বর প্রতিলিপি। বাণীকুমার যেমন ‘ওঁ নমশ্চণ্ডিকায়ৈ’ লিখে এই রচনাটি শুরু করতেন, শ্রীধরবাবু তার প্রতিলিপির শিরোদেশে লিখতেন ‘ওঁ ভারতী’। সেখানে প্রথমেই আছে চণ্ডীস্তব, তার পরই ‘গম্ভীর সঙ্গীত-শঙ্খ’। এর পর লেখা আছে ‘ভাষ্য’ নয়, ‘কথা’ শব্দটি। সূচনার সেই কথা বা ভাষ্যটি ছিল— “আজ ভগবতী মহামায়ার বোধন। দিকপ্রান্তে বনে বনান্তে, নীল আকাশে বাতাসে, স্বর্গে-মর্ত্ত্যে মহিষাসুরমর্দিনী দুর্গার পূজা বৈভব ব্যাপ্ত হোলো। দেবীর আবির্ভাব হবে... সপ্তলোক তাই আনন্দময়।…”
প্রতিলিপির যতখানি উদ্ধার করা গিয়েছে, তার মধ্যে অন্তত আট বার শঙ্খধ্বনির কথা লেখা, কখনও ‘মৃদু’ কখনও বা ‘শঙ্খনিনাদ’। আর এই সূত্রেই স্মরণযোগ্য ‘মহিষাসুরমর্দিনী’-র প্রথম বেতার সম্প্রচার সম্পর্কে বিখ্যাত গায়ক, লেখক তথা বেতার ব্যাক্তিত্ব নলিনীকান্ত সরকারের উক্তিটি। তিনি লিখেছেন, “ষষ্ঠীর দিন ভোরে উঠে শ্রোতারা অপেক্ষা করে আছে বেতার যন্ত্রটি নিয়ে। নির্দিষ্ট সময়ে অনুষ্ঠানটির ঘোষণা হওয়ামাত্র শাঁখ বেজে উঠলো। সারা কলকাতা শহর মন্দ্রিত হয়ে উঠলো শঙ্খধ্বনিতে। পূজামন্দির হয়ে উঠলো কলকাতা শহর।”
বাণীকুমার তাঁর রচনার বেশ খানিক অংশ সংস্কৃত থেকে অন্য সংস্করণে বাংলায় লিখেছিলেন। বাংলা ও সংস্কৃতের মিশ্রণও ঘটিয়েছিলেন। এর ফলে এক দিকে তা যেমন শ্রোতাদের কাছে সহজবোধ্য হয়েছিল, রচনাটিতে যথোচিত গাম্ভীর্য এবং দেবী-আরাধনার যথার্থ আবহ সৃষ্টিরও সহায়ক হয়েছিল।
সেই পুরাতন ভাষ্য থেকে খানিক উদ্ধৃতি দিই—
“ঈষৎসহাসমমলং পরিপূর্ণচন্দ্র— বিম্বানুকারি কনকোত্তমকান্তিকান্তম্।অত্যদ্ভুতং প্রহৃতমাপ্তরূষা তথাপিবক্ত্ৰং বিলোক্য সহসা মহিষাসুরেণ॥ষোড়শ কলানিধি পূর্ণচন্দ্রনিন্দী সুনিৰ্ম্মল উত্তম স্বর্ণকান্তি মৃদুহাস-বিমোহন দেবীর কান্তমুখ দর্শন ক’রেও মহিষাসুর রোষবশে সহসা দেবীকে প্রহারে উদ্যত— এ পরম বিস্ময়।… দেবীর সঙ্গে মহিষাসুরের সংগ্রাম আরম্ভ হোলো। দেবীর অস্ত্রপ্রহারে দৈত্য-সেনা ছিন্ন-ভিন্ন হ’তে লাগ্লো। মহিষাসুর ক্ষণে ক্ষণে রূপ পরিবর্তন করে নানা কৌশল বিস্তার করলে। মহিষ থেকে হস্তীরূপ ধারণ করলে, আবার সিংহরূপী দৈত্যের রণোন্মত্ততা দেবী প্রশমিত করলেন।”
কখনও আবার আরও সহজ সরল ভাষায় বাণীকুমার কাহিনি বর্ণনা করেছেন—“দেবীর আবির্ভাবের এই শুভবার্তা প্রচারিত হোলো। দেবদেবী মহাদেবীকে বরণ করলেন গীতিমাল্যে। সেবা করলেন রাগ চন্দনে… তোমাকে প্রণাম করি— জগন্মাতা চণ্ডিকা।… তুমি আপন মহিমায় দ্যাবা পৃথিবী ও সৃষ্টির মধ্যে পরিব্যাপ্ত হয়ে অবস্থান করো— পরমচেতনারূপা। আজ ফিরিয়ে এনে দাও স্বাধিকার— হিংসায় উন্মত্ত দানবগণকে করো বিনাশ। তোমার উদ্দেশে প্রাণের আরতি নিবেদন...”
একটা সময়ের পর ‘মহিষাসুরমর্দিনী’ তার বর্তমান রূপভাষ্যে স্থিতি লাভ করেছে। এই অনুষ্ঠান এখন ক্যাসেট, সিডির যুগ পেরিয়ে ইউটিউবেও সহজলভ্য। তবু এর আকর্ষণ এতটুকুও কমেনি। যেমন কমেনি পিতৃপক্ষের শেষ ব্রাহ্মমুহূর্তে এই অনুষ্ঠানটি শোনার আগ্রহ, যে অনুষ্ঠান সম্প্রচারের সঙ্গে সঙ্গে কাঠি পড়ে পুজোর ঢাকে, বদলে যায় রোদের রং আর বাতাসে মিশে যায় শিউলির গন্ধ।