ব্যতিক্রমী: সহানুভূতি নয়, বিপক্ষের সম্ভ্রম আদায় করাই লক্ষ্য বিরাট কোহলির। ছবি: গেটি ইমেজেস।
হোয়াট???” যাঁর মুখ দিয়ে এমন বিস্ময়সূচক শব্দ বেরিয়ে এল, ১১৫ টেস্টে তাঁর প্রায় আট হাজারের কাছাকাছি রান। তিনি মাইক আথারটন— যেন নিজের চোখে বিশ্বাসই করতে পারছেন না যা দেখছেন!
কী দেখছেন?
না, মধ্যাহ্নভোজের পরে ভারতীয় ইনিংস ফের শুরু হতে যাচ্ছে। দুই আম্পায়ার তখনও মাঠে নামেননি। ফিল্ডিং দলের দেখা নেই। কিন্তু ভারতের অপরাজিত ব্যাটসম্যান গোল দড়ি টপকে দৌড়ে দৌড়ে ঢুকে পড়ছেন। ব্যাট হাতে শ্যাডো করে যাচ্ছেন, বড় বড় চোখ করে প্রতিপক্ষ ড্রেসিংরুমের দিকে তাকাচ্ছেন।
ভাবসাব দেখে ক্রিকেট মাঠের দ্বৈরথ কে বলবে! মনে হবে রণক্ষেত্রে যুদ্ধের প্রস্তুতি, আর সেনাপতি শিঙা ফুঁকে প্রতিপক্ষের উদ্দেশে হুঙ্কার ছুড়ছেন, “কই রে, তোদের সৈন্যসামন্ত কোথায় গেল? এ বার আয়। আমি তো তৈরি!” তাঁর হাতে উঁচু করে ধরা ব্যাটের উপর সূর্যরশ্মি পড়ে কোনও গ্রিক যোদ্ধার অসির মতো চকচক করছে।
যাঁকে দেখে চক্ষুস্থির প্রাক্তন ইংল্যান্ড অধিনায়কের, তিনি বিরাট কোহলি। মনে করিয়ে দেওয়া যাক, চেন্নাইয়ের ঘূর্ণিতে নয়, জো রুটদের ঘরের মাঠে তাঁদেরই বোলারদের উদ্দেশে এমন যুদ্ধের আহ্বান জানাচ্ছিলেন কোহলি। আর ইংল্যান্ড এমন একটা দেশ, যা ক্রিকেটার কোহলির পক্ষে হনিমুন স্পট মোটেও নয়। বরং বরাবর সেখানে কালনাগিনীর মতো অপেক্ষা করেছে জিমি অ্যান্ডারসনের আউটসুইং। অফস্টাম্পের বাইরে ছোট্ট ছিদ্রও রাখা মানে বাসরঘরে ঢুকে শরীর নীল করে দেবে।
বিস্মিত আথারটন তক্ষুনি বলে দিলেন, “আমি এ রকম দৃশ্য কখনও দেখিনি। কোনও শব্দ খুঁজে পাচ্ছি না।” তাঁর পাশে এসে দাঁড়িয়েছেন আর এক প্রাক্তন, ডেভিড লয়েড। উত্তেজিত ভাবে তিনি বলতে শুরু করলেন, “শোনো মাইক, তুমি আর একটা দৃশ্য তো দেখতেই পেলে না। আমি দেখছিলাম। সিঁড়ি দিয়ে বিরাট নামছে, সঙ্গে বডিগার্ড। আমিও এত বছর ধরে ক্রিকেট খেলেছি, কমেন্ট্রি করছি, বহু তারকা-মহাতারকা দেখেছি। কিন্তু কখনও দেখিনি কোনও ক্রিকেটার বডিগার্ড নিয়ে ব্যাট করতে যাচ্ছে!” সারা ক্ষণ এমনই জনতার উপচে পড়া ভিড় তাঁকে ঘিরে।
ক্রিকেট ছাড়ার পরে আথারটন খুব সফল বিশেষজ্ঞ। টিভিতে ধারাভাষ্য দেওয়ার পাশাপাশি লেখালিখিতেও অসাধারণ। ফিল হিউজ়ের মৃত্যুর পরে আথারটনের লেখার সেই অমর শেষ পঙ্ক্তি— ‘‘হিউজ়ের মৃত্যু একটা আতঙ্ক এনে দিয়েছে। সকালে উঠে ছেলের হেলমেটটা আবার দেখলাম। সব স্ক্রুগুলো ঠিক আছে তো? আমার ছেলে যথেষ্ট নিরাপদ তো? হেলমেট মানেই লাল ওই বলটার সামনে জীবন সুরক্ষিত, ওয়েস্ট ইন্ডিয়ান পেস ব্যাটারির মুখোমুখি হয়েও তেমনই তো ভাবতাম। আজ বুঝতে পারছি, কতটা ভুল ভাবতাম!’’
কোহলি ইংল্যান্ডের মাঠে অতি আগ্রাসী রূপ দেখিয়ে আথারটনদের বিস্মিত করেছেন অনেক পরে। তারও আগে হিউজ়ের মৃত্যুতে তৈরি আতঙ্ক দূর করেছিলেন বীরদর্পে। হিউজ়ের মৃত্যুর পর-পরই অস্ট্রেলিয়া সফরে যায় ভারতীয় দল। হিউজ়কে নিয়ে নীরবতা পালনের পালা তখনও চলছে। টেস্ট সিরিজ়ে প্রথম যে বলটির মুখোমুখি হন কোহলি, সেটাই ছিল মিচেল জনসনের ভয়ঙ্কর বাউন্সার। বুলেটের মতো ঠিকরে এসে লাগল কোহলির ললাটে। জনসন তখন সদ্য অ্যাশেজ়ে ইংল্যান্ড ব্যাটসম্যানদের উপর বম্বিং করে এসেছেন। ঘণ্টায় ১৫০ কিলোমিটার বেগে ধেয়ে আসা তাঁর মিসাইলগুলো মনে করাচ্ছে হ্যারল্ড লারউডের বডিলাইন বোলিংকে। ইয়া মোটা গোঁফ রেখেছেন ব্যাটসম্যানকে ভয় পাইয়ে দেওয়ার জন্য। কোহলির মাথায় ও ভাবে ঘটাং করে লাগায় আঁতকে উঠল অ্যাডিলেড। স্বয়ং জনসন, যিনি তার আগের সিরিজ়ে অ্যাশেজ়ে জোনাথন ট্রটের মতো কয়েক জনকে মানসিক ভাবে বিপন্ন করে অকাল অবসরের দিকে ঠেলে দিয়েছেন, তিনি পর্যন্ত কাতর ভাবে এসে তাকালেন। হয়তো ভাবলেন, ফিল হিউজ়কে লক্ষ্য করা অভিশপ্ত বাউন্সার যাঁর হাত থেকে বেরিয়েছিল, সেই শন অ্যাবটের মতোই না ‘ঘাতক’ আখ্যা বয়ে বেড়াতে হয় সারা জীবন। মাথায় আঘাত লাগা কোহলি সামান্য অপ্রতিভ, হেলমেটটা খুলে এক বার নেড়েচেড়ে দেখলেন। কয়েকটা সেকেন্ড শুধু লাগল ভারসাম্য ফিরে পেতে। তার পরে জনসনকে হাত নেড়ে ইঙ্গিতে বোঝালেন, যা তোর রান-আপে ফিরে যা। না বলেও বুঝিয়ে দিলেন, ‘তোদের সহানুভূতি নয়, সম্ভ্রম পেতে ক্রিকেট খেলি।’
সম্ভ্রম তিনি আদায়ও করে ছাড়েন সেই অস্ট্রেলিয়া সফরে চার টেস্টে অনবদ্য চারটি সেঞ্চুরি করে। ক্রিকেট দুনিয়ায় ‘কিং কোহলি’র উত্থান এই সিরিজ় থেকে। কিন্তু শুধুই সেই ব্যক্তিগত রেকর্ড বা বিরল পরিসংখ্যানই তাঁর প্রাপ্তি নয়। ডনের দেশে সেই সফরের কোহলিকে মনে রাখা হবে অন্য কারণে। হিউজ়-ট্র্যাজেডির পরে মৃত্যুভয়ে ভীত, শঙ্কিত, সন্ত্রস্ত ক্রিকেটের শ্বাসপ্রশ্বাস স্বাভাবিক করে তুলেছিলেন তিনি। জনসন নয়, আতঙ্ককে সে দিন সপাটে বাউন্ডারির বাইরে পাঠিয়েছিলেন কোহলি। অস্ট্রেলিয়া বনাম ভারত নয়, হিউজ়ের দেশে সেই সময় খেলাটা হচ্ছিল যমদূত বনাম ক্রিকেটের।
এর পরে যত এগিয়েছে ক্রিকেটযাত্রা, ততই শিরোনামে এসেছেন কোহলি। কখনও তাঁর অভাবনীয়, অবিশ্বাস্য ব্যাটিংয়ের কারণে। আবার কখনও বিতর্কের দাবানল জ্বালিয়ে। কোহলি মানেই টার্বুল্যান্স, সিটবেল্ট বেঁধে রাখুন। কখনও ব্যাট হাতে মেলবোর্নের মহাকাব্য উপহার দেবেন, কখনও ভারতীয় বোর্ড নিশ্চুপ আছে দেখেও গদি বাঁচানোর তোয়াক্কা করবেন না। মহম্মদ শামির ধর্মকে নিশানা করা আক্রমণকারীদের তুলোধোনা করবেন। কখনও ম্যাচ হেরে গিয়েও পাকিস্তানের ওপেনার মহম্মদ রিজ়ওয়ানকে বুকে জড়িয়ে ধরা ছবিতে জিতে নেবেন বিশ্বের হৃদয়। কখনও স্টিভ স্মিথের বিরুদ্ধে অভিযোগ করতে ছুটে যাবেন আম্পায়ারের কাছে যে, ডিআরএস নিয়ে চোট্টামি করেছে। আবার সেই স্মিথকেই ভারতীয় দর্শকেরা বিদ্রুপ করছেন দেখে তাঁদের দিকে হাতজোড় করে আবদার করবেন, বল-বিকৃতি নিয়ে আর আক্রমণ করবেন না অস্ট্রেলীয়কে। সাজা তো পেয়েইছে।
ইংল্যান্ডে ২০১৪-র সফরে ব্যর্থ হওয়ার পরে জনতার রোষে আক্রান্ত অনুষ্কা শর্মা। প্রশ্ন উঠে গেল অনুষ্কার সফরসঙ্গী হওয়া নিয়ে। কোহলি কী করলেন? না, রবি শাস্ত্রীকে অনুরোধ করলেন, “ভারতীয় বোর্ড থেকে অনুমতি জোগাড় করে দিন প্লিজ়। অনুষ্কাকে নিয়ে যেতে চাই অস্ট্রেলিয়ায়।” বোর্ড অনুমতি দিল, তার পর জনসনদের পিটিয়ে এক-একটি বাউন্ডারি মারেন আর উড়ন্ত চুম্বন ছুড়ে দিতে থাকলেন প্রিয়তমার উদ্দেশে। পাল্টা বিবৃতি পেশ করা যে, ‘দেখ, বান্ধবী মাঠে থাকলে আমি ভালই খেলি। ব্যর্থতার জন্য ওকে কাঠগড়ায় তুলিস না।’
অস্ট্রেলিয়া মানেই যেন কোহলির জন্য অপেক্ষা করে থাকবে কোনও না কোনও নাটক। ২০১৫ বিশ্বকাপে পার্থে প্র্যাক্টিস চলার মধ্যে সাংবাদিককে গালাগাল করে বসলেন। কিছু ক্ষণ পরে এই সাংবাদিককে ডেকে কোহলি বললেন, “ভুল করে ফেলেছি। লোকটাকে চিনতে ভুল করেছি। আমি ভেবেছিলাম, ইংল্যান্ডে আমাদের (তিনি এবং অনুষ্কা) নিয়ে খুব খারাপ-খারাপ কথা লিখেছিল যে, সে এসেছে। একটু বলে দেবেন প্লিজ়, আমি ক্ষমাপ্রার্থী।” কিন্তু যার উদ্দেশে তত ক্ষণে ছাপার অযোগ্য সব শব্দ উগরে দিয়েছেন কোহলি, সে শুনলে তো! ইলেকট্রনিক মিডিয়া ঝাঁপিয়ে পড়ল। জাতীয় টিভি চ্যানেলে চলল কোহলি-বিতর্ক। পরের দিন হোটেলে দেখা হতেই তাঁর উপলব্ধি, “ভুলটা আমি করেছি। তাই এখন যা হচ্ছে, সেটাও সহ্য করতে হবে।” মনে হল, মাঠের ছটফটে, দামাল ছেলেটার অন্দরে কোথাও একটা সমঝদার মনও রয়েছে। ঝড় কেটে যাওয়ার পরে যে নিজের ভুল নিয়ে অনুতপ্ত হয়। নিজেকে বলে, ‘কী দরকার ছিল তোর এ সব ঘটানোর!’
আবার সেই কোহলিই অনড় থাকেন, যদি ভিতর থেকে বিশ্বাস করেন, তিনি অন্যায় করেননি। যেমন অধিনায়কত্ব নিয়ে বিতর্ক। নিজের দেশের বোর্ডের ছুড়ে দেওয়া অপমানে ব্যথিত, রক্তাক্ত হয়েছেন। ছন্দ হারিয়ে প্রবল চাপে পড়েছেন কিন্তু মাথা নিচু করেননি। এর-ওর-তার কাছে ছোটেননি সহানুভূতি, সমর্থনের জন্য। বরং নিজের যোগ্যতা, দক্ষতার উপরে বিশ্বাস ধরে রেখেছেন আর ঈশ্বরে প্রবল ভাবে বিশ্বাসী তিনি বলে গিয়েছেন, “গড ইজ় গ্রেট। উনি সব দেখছেন। সব কিছুর বিচার করবেন।”
তিনি অগ্রজদের সম্মান, শ্রদ্ধা করেন না, এটাও সংবাদমাধ্যমের নির্বাচিত অংশের অপপ্রচার ছাড়া কিছুই নয়। তাঁর সঙ্গে বনিবনা না হওয়ায় কোচের পদ ছাড়তে হয় অনিল কুম্বলেকে। স্বয়ং কুম্বলে লম্বা পোস্ট দেন টুইটারে। কিন্তু কোহলি আজ পর্যন্ত কোথাও মুখ খোলেননি। বরং বার বার জিজ্ঞেস করেও একটাই জবাব পেয়েছি— ড্রেসিংরুমের কথা ড্রেসিংরুমেই থাকুক। এই যে অধিনায়কত্ব নিয়ে বিতর্কে তাঁর সঙ্গে সৌরভ গঙ্গোপাধ্যায়ের সম্পর্ক এমন দৃষ্টিকটু ভাবে ভেঙে পড়ল, কোহলি সৌরভের নাম না নিয়ে ঘুরিয়েও কোনও মন্তব্য এখনও করেননি। এক ওই সাংবাদিক সম্মেলনে তাঁর দিকের বক্তব্য পেশ করা ছাড়া। ভবিষ্যতে কখনও মুখ খুলবেন? সময় বলবে। তবে কুম্বলে অধ্যায়ের মতোই চুপ থাকলে অবাক হওয়ার কিছু থাকবে না।
এক বার ইন্টারভিউ করার মাঝে সচিন তেন্ডুলকরের উত্তরসূরি হিসেবে তাঁকে দেখা হচ্ছে বলায়, সোফা থেকে উঠে পড়েছিলেন কোহলি। হাত জোড় করে বলেছিলেন, “ওই নামটা আনবেন না প্লিজ়। সচিন তেন্ডুলকর আমার কাছে সব কিছু। আমি ক্রিকেট খেলেছি ওঁর কারণেই।” শারজায় সেই যে সচিনের মরুঝড় ইনিংস, ওটাই তাঁর সব চেয়ে বড় প্রেরণা। এর পরেই রাতে বালিশে মাথা গুঁজে শুয়ে ভাবতে শুরু করেন, এক দিন তিনিও ভারতকে জেতাবেন, কোটি কোটি মানুষের হৃদয় জিতবেন। যদিও সচিনের মতো জনতার ডার্লিং তিনি হতে পারেননি। সব সময় জনমত বিভক্ত থেকেছে তাঁকে নিয়ে। কেউ বলেছেন, তাঁর আগের অধিনায়কদের আমলে ভারতীয় দল খুব জোর ছিল জার্মান শেফার্ড। কোহলির নেতৃত্বে তারা পরিণত হয় রটউইলারে। আবার রক্ষণশীলদের মত, তাঁর আমলে ক্রিকেট হয়ে উঠেছে উন্মত্ত, হিংস্র। এত তর্জন-গর্জনেরই বা কী আছে? কোহলি নিজেও জানেন, জনপ্রিয়তায় সচিন কোথায় আর তিনি কোথায়। এক বার সাক্ষাৎকার নেওয়ার সময় বলেছিলেন, “সচিন তেন্ডুলকরকে লোকে শুধুই ভালবাসে। আমায় অনেকে পছন্দ করে না। মানুষের মন জেতায় ধারেকাছেও নেই আমি।”
এ বার টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপ চলার মধ্যে ফের বিতর্ক। তাঁর ঘরে ঢুকে ভিডিয়ো তুলে ফেলল এক আগন্তুক। ঘটনা সেই পার্থে। যেখানে এক দিকে তাঁর জন্য তৈরি থেকেছে বিতর্কের খাদ, অন্য দিকে দর্পের গিরিশৃঙ্গ। ডেনিস লিলি, জেফ টমসনের আগুন ঝরানো পার্থ। যেখানকার নতুন স্টেডিয়ামের বিপজ্জনক পিচে তাঁর টেস্ট সেঞ্চুরি দেখে লিলি এই সাংবাদিককে বলেছিলেন, “এত খারাপ পিচ আমি কখনও দেখিনি। কেউ মারাও যেতে পারত। এই পিচে কোহলির ইনিংসটা আমার দেখা সেরাদের দক্ষতার সমকক্ষ।” লিলির সময়ের ‘সেরা’ বলতে তালিকায় থাকবে কোনও এক ভিভ রিচার্ডসের নাম। পার্থের পুরনো ওয়াকা স্টেডিয়ামে এক সময় লিলি-টমসনরা বল করতেন আর গ্যালারি থেকে চেঁচাত রক্তলোলুপ জনতা— ‘কিল দেম। উই ওয়ান্ট ব্লাড’। সেই শহরে ২০১৮-র ডিসেম্বরে কোহলির ওই ইনিংস ব্যাটিং বীরত্বের সেরা প্রদর্শনী। আর কী দুর্ধর্ষ বোলিং আক্রমণ ছিল অস্ট্রেলিয়ার। মিচেল স্টার্ক, প্যাট কামিন্স, জশ হেজ্লউড, নেথান লায়ন। আগুনে পিচ, আগুনে বোলিং। ২৮৩ রানে শেষ হয় ভারতের ইনিংস। তার মধ্যে একা বিরাট কোহলিরই ১২৩।
কখনও মনে হবে ডব্লিউ জি গ্রেসের উত্তরাধিকারীকে দেখছি। এত নাটুকে চরিত্র আর দুটো হয় না। ব্যাটিংয়ে যে ফরোয়ার্ড ও ব্যাকফুট দুটোই সমান ভাবে দরকার, তা ক্রিকেটবিশ্বকে দেখিয়েছিলেন গ্রেস। আবার কেউ কেউ নামকরণ করেছিলেন ‘গ্রেসলেস গ্রেস’। ভিক্টোরিয়ান যুগের ইংল্যান্ডে জনপ্রিয়তায় তাঁর সমকক্ষ ছিলেন একমাত্র চার্লস ডিকেন্স। কিন্তু আম্পায়ার আউট দিলেও না বেরনোর অসভ্যতা দেখাতে দ্বিধা করেননি। ক্রিকেট লোকগাথায় স্থান করে নেওয়া সেই বিখ্যাত উক্তি— “ওহে, মাঠে এতগুলো লোক এসেছে আমার ব্যাটিং দেখতে, তোমার আম্পায়ারিং নয়!” ব্রিস্টলের ডাক্তারকে নিয়ে আরও একটি মজাদার কাহিনি শোনা যায়। চার্লস কোর্টরাইট নামে এক বোলার তাঁকে প্রথমে এলবিডব্লিউ করলেন। গ্রেসের যথারীতি ক্রিজ় ছেড়ে বেরনোর লক্ষণ নেই। পরের বলে কট বিহাইন্ড। গ্রেস সেই অনড়। পরের বলে বোল্ড করে বোলার এসে বললেন, “ডক্টর, আপনি নিশ্চয়ই এখনও মাঠ ছাড়বেন না। একটা স্টাম্প যে এখনও অক্ষত রয়েছে!”
কোহলি নিশ্চয়ই ডক্টর গ্রেসের মতো আম্পায়ারের বিধান মানতে অস্বীকার করেননি। কিন্তু তাঁর কাছাকাছি তো গিয়েইছিলেন। গ্রেসের দেশেই। ট্রেন্টব্রিজে তাঁকে ৯৭ রানে আউট করেছিলেন ইংল্যান্ডের লেগ স্পিনার আদিল রশিদ। এমন মুখচোখ করে কোহলি বোলার আর পিচের দিকে তাকান যে, রশিদের মনে হতে থাকে তিনি আউট করে ভুল করে ফেলেছেন। সে দিনের খেলা শেষে রশিদকে ইংরেজ সাংবাদিকেরা জিজ্ঞেস করেছিলেন, “কী হল, অমন উইকেট নিয়েও চুপচাপ কী দেখছিলে?” ঘোরের মধ্যে থাকা বোলারের জবাব, “সেলিব্রেট করব কী! বিরাট এমন ভাবে তাকাল, আমার তো মনে হল, উইকেটটা নিয়ে বড় অন্যায় করে ফেলেছি!”
কোহলির দর্পে আঘাত লাগার প্রতিক্রিয়া কী হতে পারে, পরের ইনিংসেই বুঝেছিলেন আদিল রশিদরা। প্রথম ইনিংসে তিন রানের জন্য সেঞ্চুরি হারান। দ্বিতীয় ইনিংসে করলেন ১০৩, সেঞ্চুরির চেয়ে ঠিক তিন রান বেশি। ভারতের কোচ তখন রবি শাস্ত্রী। ট্রেন্টব্রিজে দুর্দান্ত টেস্ট জিতে উঠেছে ভারত। শাস্ত্রী পিঠে টোকা মেরে বলে গেলেন, “হিসাবটা বুঝলেন তো? দুই ইনিংস মিলিয়ে রান কত? ২০০। মানে দু’টো একশো। একেই বলে জাত খেলোয়াড়। একেই বলে জেদ, প্রতিজ্ঞা।”
গ্রেসের মতোই কোহলির পদচারণার মধ্যে যেন নীরব বার্তা থাকে— ‘এই মাঠ, এই মঞ্চটা আমার। নাটকের মুখ্য চরিত্র আমি। বাকিরা এসেছ পার্শ্বচরিত্রে অভিনয় করতে।’ টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপে মেলবোর্নে পাকিস্তানের বিরুদ্ধে অমর ইনিংসেও ছিল গ্রেসের ছোঁয়া। শেষ ওভারে নওয়াজকে ছক্কা মেরে শরীরের ভারসাম্য হারাতে হারাতেও আম্পায়ারকে সিগন্যাল করতে থাকলেন— ‘কী হল? কোমরের উপরে বল, ওয়াইডটা দিন!’ আম্পায়ার দিয়েও দিলেন। পাকিস্তানের ক্রিকেটারেরা ঝামেলা শুরু করল, তোলপাড় চলল। কোহলির কিছু এসে-যায় না। ওই যে লিখলাম, মঞ্চটা কোহলির। বাকিরা সঙ্গত করতে এসেছে।
আবার কখনও মনে হয়, তিনি রঞ্জিত সিংহজির বংশধর। মহারাজার মতোই কব্জির মায়ায় সম্মোহিত করতে এসেছেন ক্রিকেট-দুনিয়াকে। ক্রিকেটে যখন লেগসাইডে খেলার কথা কেউ দুঃস্বপ্নেও ভাবত না, সেই সময়ে রঞ্জি দেখিয়েছিলেন কব্জির জাদু। অফ বা মিডল স্টাম্পের বলকেও তিনি পাঠিয়ে দিতেন লং বা ফাইন লেগ বাউন্ডারিতে। গ্রেস যেমন ফরোয়ার্ড-ব্যাকফুট শেখান, তেমনই রঞ্জি হলেন লেগ গ্লান্সের আবিষ্কর্তা। আর এত দেরিতে শট খেলতে পারতেন যে, বোলারের কাছে হয়ে উঠেছিলেন এক বিভ্রম। কত বার যে বোলার ভেবেছে এলবিডব্লিউ পেয়ে গিয়েছে! বল যখন প্যাডের একদম কাছাকাছি, তখনও রঞ্জি অনড়, অচঞ্চল। একেবারে শেষতম সেকেন্ডে তাঁর শরীর দুলে উঠত, ভারসাম্য স্থানান্তরিত হত সামনের পায়ে, তার পর শিল্পীর তুলিরটানে বল পৌঁছে যেত লেগ বাউন্ডারিতে। বোলারের উচ্ছ্বাস পাল্টে যেত হতাশায়।
এক বার প্রতিপক্ষ দলের আলোচনা চলছে, রঞ্জিকে কী ভাবে আউট করা যায়। এক বোলার বললেন, “আমি জানি কী করতে হবে। স্টাম্পে বল করতে হবে। এলবিডব্লিউ হবেই রঞ্জি।” দলের অধিনায়ক চুপ করে শুনলেন, তার পরে তাঁর প্রতিক্রিয়া, “দারুণ ভেবেছ। সারা দিন ধরে তুমি চেষ্টা করে যাবে আর সারা দিন ধরে রঞ্জি তোমার বল ফাইন লেগ বাউন্ডারিতে পাঠাতে থাকবে। আমরা কুড়িয়ে আনব।”
নেভিল কার্ডাস লিখেছিলেন, “রঞ্জি কি সত্যিই ঘটেছিল? না কি সবই ছিল এক মাঝ-গ্রীষ্মের রাতে দেখা স্বপ্ন?” মেলবোর্নে কোহলির মহাকাব্য দেখে কার্ডাসের লাইন মনে পড়ে যেতে বাধ্য। রঞ্জির মতোই কোহলির ক্রিকেটও কব্জির ক্রিকেট। অফ স্টাম্পের বলকে অনায়াস ঔদ্ধত্যে তিনি ফ্লিক করে পাঠিয়ে দিতে পারেন মিডউইকেট বা স্কোয়ার লেগ বাউন্ডারিতে। যে শটের নামকরণ হয়ে গিয়েছে কোহলি হুইপ শট। রঞ্জির লেগ গ্লান্সের মতোই কোহলির হুইপ শট উদাহরণ হয়ে উঠেছে ক্রিকেটবিশ্বে। ফিল হিউজ়ের কোচের ইন্টারভিউ করতে গিয়ে আবিষ্কার করা গিয়েছিল, ডনের দেশেও কোচিং ম্যানুয়ালে ঢুকে পড়েছেন কোহলি। হিউজ়ের কোচ নীল ডি’কস্টা নিজের মোবাইল খুলে একটি ভিডিয়ো দেখালেন। স্লো মোশনে কোহলির হুইপ শট ধরে রাখা। বললেন, “শটটা দেখুন। বোলারকে ধ্বংস করে দেওয়া শট। কোচিং ক্যাম্পে ছাত্রদের এই ভিডিয়োটাই আমি দেখাই।”
অস্ট্রেলিয়ায় চলতি টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপে বোলারকে, প্রতিপক্ষকে ধ্বংস করে দেওয়া এমন কয়েকটি শট খেলেছেন কোহলি। যেমন পাকিস্তানের বিরুদ্ধে হ্যারিস রউফকে ১৯তম ওভারের শেষ দুই বলে মারা তাঁর দুই ছক্কা। পঞ্চম বলে যে ভাবে চকিতে সরে গিয়ে জায়গা বানিয়ে সোজা বোলারের মাথার উপর দিয়ে ছক্কা মারলেন, অসম্ভব শক্তিশালী কব্জি ছাড়া এমন অবিশ্বাস্য শট খেলা যায় না। পরের বলে ফ্লিক করে ছক্কা। উপেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরী তো সেই কবেই বলে গিয়েছেন, আনাড়ির জোর বাহুতে, শিল্পীর কেরামতি কব্জিতে!
জো রুট, স্টিভ স্মিথ, কেন উইলিয়ামসনরাও রান করেন, বিশ্বের সেরা ব্যাটসম্যানদের অন্যতম। তাঁরা ব্যাট করলেও আলোকিত হয় মাঠ। কিন্তু সেই আলো বিজ্ঞানের আলো, যান্ত্রিক আলো। কোহলির ব্যাটে জোৎস্নার আলো। মেলবোর্নের মতো সুন্দর মাঠে সেই আলো ফুটে উঠলে মনে হয় চাঁদনি রাতের তাজমহল।
পাকিস্তান ম্যাচ জয়ের সময় অশ্বিন ছিলেন কোহলির পার্টনার। বিজয়োল্লাসে জড়িয়ে ধরেন নায়ককে। দেখে কে বলবে, এই অশ্বিনকে না খেলানো নিয়েই ঝড়ের মধ্যে পড়েছেন অধিনায়ক কোহলি। ইংল্যান্ডে একের পর এক টেস্টে দলের তারকা স্পিনারকে উপেক্ষা করে গিয়েছেন অধিনায়ক, তা নিয়ে তাঁর মুণ্ডপাত হয়েছে দেশ-বিদেশের সংবাদমাধ্যমে। দলের মধ্যে অশান্তির গৃহযুদ্ধ শুরু হয়ে গিয়েছে বলে খবর প্রকাশিত হয়েছে। ইংল্যান্ডের প্রত্যেকটা মাঠের ড্রেসিংরুম-বারান্দায় ব্যাঙ্কোর ভূতের মতো বসে থেকেছেন অশ্বিন। তবু অনড় রাজা। ওই যে লিখলাম, যদি মনে করেন তিনিই ঠিক, বিবেক দংশনের বিন্দুমাত্র সম্ভাবনাও নেই।
কোহলির ক্রিকেট শুধু জিমে পড়ে থেকে বানানো শরীরের ক্রিকেট নয়, তাঁর শক্তিশালী মনেরও পরিচয়। তাঁর প্রত্যেকটা শট একটা ভাবনা, একটা নীতি, তাঁর জীবনদর্শনের বহিঃপ্রকাশ। ওই যে রউফকে সরে গিয়ে মাথার উপর দিয়ে মারা ছক্কা, ও ভাবেই তিনি বাঁচতে চান। বীর, চির উন্নত শির হয়ে। আপসহীন, নির্ভীক যোদ্ধার মতো।
ব্যাটসম্যান কোহলির বীরদর্পে ক্রিজ়ের দিকে এগিয়ে যাওয়া ভিভ রিচার্ডসকে মনে করিয়ে দেবে। তা সে স্কোরবোর্ডে যত কম রানই থাকুক না কেন। ভিভের হাতে ভয়ঙ্কর সব ফাস্ট বোলার ছিল। কিন্তু চুইংগাম চিবোতে চিবোতে, প্রতিপক্ষের দিকে শীতল চাহনিতে এগিয়ে যাওয়া দেখে মনে হত, তিনি নিজেই খুনে ফাস্ট বোলার। ব্যাটিংয়ের মধ্যে ভিভ নিয়ে এসেছিলেন ফাস্ট বোলারের আগ্রাসন। কোহলি তেমনই ক্রিকেটীয় আচারের তোয়াক্কা করেন না। ফিল্ডিং দল নামার আগে ব্যাট হাতে পৌঁছে যান মাঠে। বাইশ গজে পদার্পণ দেখে মনে হবে ক্রিকেট নয়, জেমস বন্ডের অ্যাপিয়ারেন্স সিন দেখছি।
কিং রিচার্ডস যেমন ক্রিকেটীয় শিষ্টাচারের গণ্ডিতে আটকে থাকতেন না। এক বার টস করতে গিয়েছেন ভিভ। ইংল্যান্ড অধিনায়ক তাঁদের প্রথম একাদশের নাম পড়ে শোনাচ্ছিলেন। তখনও কাগজে লেখা টিম লিস্ট হাতে তুলে দেওয়ার রীতি আসেনি। দুই অধিনায়ককে পড়ে শোনাতে হত, কারা খেলছেন। ইংল্যান্ড অধিনায়ক ছ’টি নাম পড়তে পেরেছিলেন। ভিভ থামিয়ে দিয়ে বলেন, “ব্যস, ব্যস। আর দরকার নেই। যাকে খুশি খেলাতে পারো, আমার কিছু এসে-যায় না।”
ভিভের ব্যাটে থাকত শাসকের দর্প। যাঁর পূর্বপুরুষদের কাহিনি ‘আঙ্কল টম’স কেবিন’-এর কাহিনি। ক্রীতদাস প্রথার রক্তাক্ত, খুবলে নেওয়া অত্যাচারের কাহিনি। বব মার্লে গেয়েছিলেন, ‘মনকে মুক্ত করো পরাধীনতার শৃঙ্খল থেকে’। মার্লের দেশের ভিভের ব্যাটে থাকত সেই গানের ছোঁয়া। শ্বেতাঙ্গ বোলারদের উপরে যখন সেই ব্যাট আছড়ে পড়ত, মনে হত ক্রীতদাসদের উপর চাবুক বর্ষণের যোগ্য জবাব।
কোহলির ক্রিকেটও তেমনই তাঁর বর্ণের জয়গান। তাঁর হুইপ শট যখন লর্ডস বা ওভালের সবুজ গালিচার উপর দিয়ে ছুটে যায় বাউন্ডারির দিকে আর অসহায়, আক্রান্ত দেখায় ইংরেজ বোলারদের, কোথাও যেন শান্তি পায় নীলকর সাহেবদের চাবুক খাওয়া শ্রমিকদের আত্মা। কোহলি এমন এক দেশের মুখ, যেখানে বিনোদন মানে মৃত্যুর ঝুঁকি নিয়ে আনন্দ দেওয়া। কখনও ট্রাপিজ়ের খেলায় মেতে থাকা তরুণ-তরুণীর দল, কখনও শূন্যে ভেসে থাকা কার্পেটের মধ্যে শুয়ে থাকা শিশুর জাদুবিদ্যা, কখনও লাঠি বা দড়ি বেয়ে উপরে উঠে মনোরঞ্জন চলছে রাস্তার মোড়ে মোড়ে।
কোহলির ক্রিকেট মানে ইংরেজদের আবিষ্কার করা খেলায় ভারতীয় রাজত্ব প্রতিষ্ঠা করার ক্রিকেট। রঞ্জিকে নিয়ে যেমন ছিল বিখ্যাত উক্তি, জীবনে কখনও ‘ক্রিশ্চিয়ান’ শট খেলেননি তিনি। বৃহত্তর বিশ্বমঞ্চে বিরাট তাঁর বর্ণের প্রতিনিধি। শ্বেতাঙ্গদের খেলায় তাঁদের শাসন শেষ করা বাদামি বর্ণের বিরাট-রাজা। যারা লিখেছিল, ‘বেন্ড ইট লাইক বেকহ্যাম’ তাদের দিয়ে বলানো ‘হুইপ লাইক কোহলি’। তাঁর কভার ড্রাইভে গুন্ডাপ্পা বিশ্বনাথের স্কোয়ার কাটের রোম্যান্স। যে দিন তাড়াতাড়ি আউট হয়ে যেতেন ভিশি, গ্যালারিতে অন্ধকার নেমে আসত। যেন মঞ্চ রয়েছে, বাদ্য রয়েছে, গানবাজনাও চলবে কিন্তু উস্তাদ আজ আর সরোদ বাজাবেন না। কোহলির দীর্ঘ সময় ধরে চেনা ছন্দে না থাকার সময় তাঁর কভার ড্রাইভ দেখতে না পাওয়ার এমনই যন্ত্রণা বয়ে বেড়াতে হয়েছে ক্রিকেট-রোম্যান্টিকদের। ক্রিকেটের ইতিহাসে কভার ড্রাইভের সেরা মাস্টারদের এক জন কলিন কাউড্রে। তাঁর দেশের লোকেরাই এখন বলছে, ‘কভার ড্রাইভ লাইক কোহলি’।
থাক না কোহিনুর ইংল্যান্ডের দখলে, আমাদের কিং কোহলি আছে!