জাদুকর: সেনাবাহিনীতে যোগ দেওয়ার পরই হকিতে মন দেন ধ্যানচাঁদ
ইতিহাস-গবেষকেরা মনে করেন, হকি খেলার উৎপত্তি গ্রিসে। সম্ভবত খ্রিস্টপূর্ব পঞ্চম শতকে গ্রিকরা মাথার দিকে বাঁকানো একটি লম্বা লাঠি ও বল নিয়ে যে খেলা খেলত, পরবর্তী কালে তা থেকেই হকির উদ্ভব বলে মনে করা হয়। প্রাচীন গ্রিস ছাড়াও রোম, স্কটল্যান্ড, মিশর, দক্ষিণ আমেরিকার মতো নানা দেশে এই খেলা নানা নামে পরিচিত ছিল। প্রত্নতত্ত্ববিদেরা আথেন্সের এক প্রাচীন দেওয়ালে একটি খোদাইচিত্র আবিষ্কার করেছিলেন। তাতে আঁকা দু’জন লোক দু’টি লাঠি দিয়ে একটি বল নিয়ন্ত্রণের জন্য লড়ছে। অন্যরা পাশে দাঁড়িয়ে তাদের লড়াই দেখছে। গবেষকদের মতে, এই ছবি হকির প্রাচীনত্বকেই নির্দেশ করে। প্রায় তিন হাজার বছর আগেকার একটি পিরামিডেও হকি খেলার এমন দৃশ্য লিপিবদ্ধ রয়েছে বলে জানিয়েছেন অনেক গবেষক।
যত দূর জানা যায়, প্রথম আন্তর্জাতিক হকি খেলা শুরু হয় ১৮৯৫ খ্রিস্টাব্দে। মোটামুটি ভাবে গ্রিসে হকি খেলার জন্ম হলেও সতেরো ও আঠারো শতকে ইংল্যান্ডে হকি খেলা হত। বর্তমানে আন্তর্জাতিক হকি খেলার প্রচলিত নিয়মগুলির বেশির ভাগই ইংল্যান্ডে তৈরি। ১৮৯৫ সালে প্রথম আন্তর্জাতিক ম্যাচে ইংল্যান্ডের মুখোমুখি হয়েছিল আয়ারল্যান্ড। এই খেলায় ইংল্যান্ড ৫-০ গোলে জয়লাভ করে। ১৯০৮ সালে হকি খেলা অলিম্পিকের অন্তর্ভুক্ত হয় এবং ১৯৪২ সালে আন্তর্জাতিক হকির নিয়ন্ত্রক সংস্থা ‘ফেডারেশন ইন্টারন্যাশনাল দ্য হকি’ প্রতিষ্ঠিত হয়। ১৯৫৮ সালে প্রথম হকি বিশ্বকাপ আয়োজিত হয়। বর্তমানে আন্তর্জাতিক হকির প্রধান নিয়ন্ত্রক সংস্থা হল ‘ইন্টারন্যাশনাল হকি ফেডারেশন’। এদের উদ্যোগেই হকি বিশ্বকাপ আয়োজিত হয়।
এই ভূমিকাটুকু আসলে এই কথা বলার জন্যই যে, বিশ শতকে বিশ্ব হকি প্রতিযোগিতার একটি বড় শক্তি হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেছিল ভারত। এই উত্থানের সঙ্গে অঙ্গাঙ্গি ভাবে জড়িয়ে ধ্যানচাঁদের নাম। এই কিংবদন্তি হকি খেলোয়াড়ের জন্ম ১৯০৫ সালের ২৯ অগস্ট। তাঁর সম্মানে এই দিনটি পালিত হয় ভারতের জাতীয় ক্রীড়া দিবস হিসেবে। তাঁর বাবা সামেশ্বর সিংহ সেনাবাহিনীতে চাকরি করতেন। সেই সূত্রে ছেলেবেলায় ঝাঁসিতে চলে আসেন ধ্যানচাঁদ। তাঁর বাবা সেনা দলে নিয়মিত হকি খেলতেন। তবে ধ্যানচাঁদের ছেলেবেলার প্রধান আকর্ষণ ছিল কুস্তি, হকি নয়। মাত্র ১৬ বছর বয়সেই ধ্যানচাঁদ নিজেও সেনাবাহিনীতে যোগ দেন। সেখান থেকেই ধ্যানচাঁদের হকি খেলা শুরু। ধ্যানচাঁদের আসল নাম ছিল ধ্যান সিংহ। তিনি রাতেও সমানে প্র্যাকটিস করতেন। বলা হয়, সারা রাত জেগে থাকতেন বলেই সতীর্থরা তাঁর নামের সঙ্গে ‘চাঁদ’ শব্দটি জুড়ে দেন। ধ্যান সিংহ হয়ে ওঠেন হকির জাদুকর ধ্যানচাঁদ।
কিংবদন্তি এই খেলোয়াড়কে নিয়ে প্রচলিত রয়েছে নানা লোকশ্রুতি। ১৯৩২ সালের অলিম্পিকে একটি মজার ঘটনা ঘটেছিল। সে বার অলিম্পিক হকিতে ভারত, আমেরিকাকে হারিয়েছিল ২৪-১ ব্যবধানে। আর জাপানকে ভারত হারিয়েছিল ১১-১ ব্যবধানে। তাতে ধ্যানচাঁদ গোল করেছিলেন ১২টি। আর তাঁর ভাই রূপ সিংহ করেছিলেন ১৩টি গোল। ভারতের মোট ৩৫টি গোলের মধ্যে তাঁদের ঝুলিতেই ছিল ২৫টি। ১৯৩৬ সালের বার্লিন অলিম্পিক্সকে অনেকে ‘ধ্যানচাঁদময়’ বলেই অভিহিত করেন। এই সময়ে অলিম্পিকের সময়ে গোটা বার্লিন শহর জুড়ে পোস্টার পড়েছিল এই বলে যে, ‘অলিম্পিক্স স্টেডিয়ামে আসতে ভুলবেন না। সেখানে পারফর্ম করবেন এক ভারতীয় জাদুকর। নাম ধ্যানচাঁদ।’ তাঁর খেলার প্রভাব ও দর্শকের বিস্ময়মুগ্ধতা ছিল এতটাই। ক্রীড়া গবেষণায় যুক্ত অনেকেই মনে করেন, এই পৃথিবীতে আর কোনও খেলার সঙ্গেই যুক্ত কোনও এক জন খেলোয়াড়ের এতখানি সর্বাত্মক প্রভাব ছিল কি না তা বলা মুশকিল।
শোনা যায়, ১৯৩৬ সালের অলিম্পিক্সের পর ধ্যানচাঁদের খেলা দেখে মুগ্ধ হয়ে অ্যাডলফ হিটলার নাকি চেয়েছিলেন, ধ্যানচাঁদ জার্মান নাগরিকত্ব নিন আর সে দেশের সেনাবাহিনীতে যোগ দিন। কিন্তু ধ্যানচাঁদ তাঁর প্রস্তাব নাকচ করে দেন। পরবর্তী সময়ে ভারত সরকারের পদ্মভূষণ সম্মান পেয়েছিলেন এই খেলোয়াড়। তাঁর হাত ধরে যে পরম্পরা তৈরি হয়েছিল, পরবর্তী সময়ে তাকে সার্থক ভাবে পালন করেছিলেন ভারতের দিকপাল হকি খেলোয়াড়েরা।
তবে নিছক পরিসংখ্যানের নিরিখে ধ্যানচাঁদের খেলোয়াড় জীবনকে মাপতে গেলে ভুল হয়ে যাওয়ার আশঙ্কা রয়েছে অনেকটাই। মনে রাখতে হবে, যে সময়ে ধ্যানচাঁদ খেলোয়াড় হিসেবে আত্মপ্রকাশ করছেন, সেই সময়ে হকি কিন্তু ক্রিকেট বা ফুটবলের মতোই সাহেবদের খেলা হিসেবে পরিচিত ছিল। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পরেও একটা দীর্ঘ সময় ধরে এই খেলায় ছিল ইংরেজদের আধিপত্য। সেই আধিপত্যকেই প্রথম প্রশ্নের মুখে ফেলেছিলেন এই খেলোয়াড়। এ কথা ঠিক যে, তিনি খেলেছিলেন ব্রিটিশ শাসনাধীন দেশের হয়ে, কিন্তু সেই সময়ে ভারতীয়রাও যে বিশ্বের অন্য সব দেশের সঙ্গে চোখে চোখ রেখে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে পারে, সেই আত্মবিশ্বাস গড়ে তোলার অন্যতম পুরোধাপুরুষের নাম ছিল ধ্যানচাঁদ। পরবর্তী সময়ে ইংরেজদের দলকে হারিয়ে হকিতে জয়লাভ করেছিল ভারতীয় দল। মনে হয়— সে দিনের জয়ী খেলোয়াড়রা নিশ্চয়ই দেশের ভূতপূর্ব শাসকদের হারানোর সঙ্গে সঙ্গে মনে প্রাণে স্মরণ করেছিলেন হকির জগতে কিংবদন্তি এই পূর্বসূরিকেও।