ছবি: রৌদ্র মিত্র।
একটু হিংসুটেপনা দিয়ে শুরু করি। কে যেন বলেছিল, শীতকালে কড়াইশুঁটির কচুরি যেমন জমে, হিংসুটেপনাও জমে। আদৌ কি কেউ বলেছিল? কে জানে।
এই লেখা নিয়ে বসতেই দেখি গাদাখানেক কবিতার লাইন মাথায় ভিড় করেছে। এটাই স্বাভাবিক। কবিতা ছাড়া ‘শীতকাল’ হয় নাকি? এমন কোনও কবি কি আছেন, যিনি শীতকাল অথবা শীত নিয়ে কবিতা লেখেননি? হয়তো গোটা কবিতা লেখেননি, তবে কোথাও না কোথাও শীতকে রেখেছেন। হয়তো অগোচরে, হয়তো অন্য নামে। কনকনে শীতরাতে আগুন-আঁচের মতো দুরন্ত সব কবিতা লেখা হয়েছে, হয়ে চলেছে। যার কবিতায় মন নেই অত, তিনিও দুটো লাইন বলে দেবেন অনায়াসে।
এখানেই আমার হিংসে। শীতকাল নিতান্ত একপেশে। খুব পক্ষপাতদুষ্ট। কবিরা যেমন তাকে ছাড়ে না, সেও কবিদের ছাড়ে না। মনে হয়, সে কবিতা লেখে। ফেসবুকে দেয় না তাই জানা যায় না। গোপন খাতা রয়েছে। সেখানে নামের জায়গায় লেখা— ‘শ্রী/ শ্রীমতী শীত ঋতু’। বর্ষাকাল যেমন গান করে। সকাল, সন্ধে নিয়ম করে রেওয়াজে বসে। সবাই সে খবর জানে। অনেকটা তেমনই। বর্ষাকাল যদি গানের দলে হয়, শীত কবিদের দলে।
এক জন সামান্য গল্পকার হিসেবে অভিমান আমার। শীতকাল তো গল্পকারদের উপরও মাঝেমধ্যে ভর করতে পারে। পারে না? হাতে গোনা কিছু ব্যতিক্রম থাকতে পারে। কারও কারও গদ্যে নিশ্চয়ই শীতকাল রয়েছে, শীতও রয়েছে। কুয়াশার মতো নরম, পাতা ঝরা ডালপালার মতো রুক্ষ হয়েই রয়েছে। তবে তা মোটেও কবিতার মতো অত বিস্তৃত, দরাজ নয়।
তাই লেখার শুরুতে যতই কবিতা মাথায় আসুক, সে সব সরিয়ে একটা গল্প দিয়ে শুরু করব বলে ঠিক করেছি। হিংসুটেরা যেমন করে আর কী।
তবে সমস্যা একটা হয়েছে। এই গল্প দুঃখের না হাসির বুঝতে পারছি না। আবার দুটোই হতে পারে। তবে ‘শীতের গল্প’ এটা বলতে পারি।
শীতকাল যেমন সত্য, এই গল্পও সত্য। চরিত্ররা সত্য। এই অধম গল্পের মধ্যে না থাকলেও সেই সময় আশপাশে থেকেছে।
শীতভোরে ফুলচোর
বেশ কিছু বছর আগের কথা। ছিমছাম এক শহরতলি। তখনও বাড়িগুলো লম্বা হয়ে আকাশ ঢাকেনি। এলাকায় গাছপালা বেশি, অনেক সবুজ মাঠ, বড় বড় পুকুর। জলে নির্জন দুপুরে গাছের ছায়া পড়ে, মাছ খেলে বেড়ায়। রোদ, ঝড়বৃষ্টি, শীত মানুষের ঘরে ঢোকে ইচ্ছেমতো। শীত, গ্রীষ্ম, বর্ষা ঋতুকে এখনকার মতো ইউটিউব দেখে চিনতে হত না, জানলা খুললেই তারা দেখা দিত। প্রায় প্রতিটি বাড়ির সামনে বা পিছনে এক ফালি বাগান। সেখানে সিজ়ন ধরে ফুলের গাছ, শাকসব্জি ফলত। সবাই যে এলাহি আয়োজন করতে পারত এমন নয়। যার যেমন সামর্থ্য। ‘ভুলি ভেদাভেদ জ্ঞান’ ফুল ফুটত হাসিমুখে। বলার অবকাশ রাখে না, শীতকালে বাগান সব থেকে ঝলমল করত। গাঁদা, গোলাপ, ডালিয়ার সঙ্গে চন্দ্রমল্লিকা, পিটুনিয়া, কসমস, জিনিয়ারা পাল্লা দিত। এ বলে আমায় দেখ, ও বলে আমায়। সেই সময়ের স্কুলে পড়া ছেলেমেয়েদের গাছে, ফুলে, ফলে মন ছিল। মন ছিল জলে ও আকাশে। গাছের ফল যেমন পেড়ে খাওয়া হত, পুকুরে সাঁতার চলত, আকাশে ওড়ানো হত ঘুড়ি। কেউ ছিল এক ধাপ এগিয়ে। আমাদের ক্লাসের অরণি তেমনই এক জন। অঙ্কের ফর্মুলা, ভূগোলের ম্যাপ, ইংরেজির ভার্ব, নাউন তেমন না চিনলেও, ফুলগাছ চিনতে তার ভুল হত না। বেচারির কপাল খারাপ, পরীক্ষায় গাছ চেনার কোনও প্রশ্ন থাকত না। থাকলে তাকে ঠেকাত কে?
যাই হোক, ক্লাস টেনেই অরণি হয়ে উঠেছিল এক জন খুদে ‘বাগান বিশারদ’। বাবার সঙ্গে হাত মিলিয়ে বাগান করত। শীতের মাসখানেক আগেই শুরু হত ব্যস্ততা। সেই ছোটাছুটি চলত শীত শেষ না হওয়া পর্যন্ত। মাটি তৈরি, গাছের চারা পোঁতা, সারে, জলে, রোদে, রাতের হিম, সকালের কুয়াশা মাখিয়ে সেই চারাকে বড় করা, ফুল ফুটলে বিশেষ খাতির যত্ন তো ছিলই। এ ছাড়াও আর এক বড় দায়িত্ব ছিল। পাড়ার ‘দুষ্ট লোক’-এর হাত থেকে ফুলেদের রক্ষা করা চাই। শীতের ফুল রূপে, রঙে মোহময়। হাতছানি দেয়। এলাকার ‘দুষ্ট লোক’রা সেই হাতছানি সামলাতে পারত না। বেশি রাতে, কাকভোরে, নির্জন দুপুরে বাগানে ঢুকে পড়ত পা টিপে। গাছের ফুল তাদের হাতের ব্যাগে ঢুকত অনায়াসে। অরণির বাবা বাগানের বেড়ায় আঁকাবাঁকা হরফে
নোটিস ঝোলালেন।
‘শীতের ফুল বাগানেই সুন্দর’।
অরণি সেই নোটিসের চার পাশে ফুল-পাতা এঁকে বাহারি করল। আমরা বললাম, “এত করিস কেন? দু’-একটা ফুল নিলে নেবে না-হয়।”
অরণি বলত, “তোরা বুঝবি না, গাছের
ফুল ছিঁড়লে বুকে ব্যথা লাগে। পিছনে অনেক খাটাখাটনি থাকে।”
সেই অরণির বুকে লাগল অন্য ব্যথা, সে পড়ল প্রেমে। কিশোরবেলার নাকানি-চোবানি প্রেম। আর পড়বার সময়ও পেল না, পড়ল সেই শীতকালেই। দু’গলি পরে প্রতিবেশী বিশুকাকার বাড়িতে পরীক্ষা শেষের ছুটি কাটাতে ভুবনেশ্বর থেকে এসেছে ভাগ্নি তূর্ণী। লম্বা ছুটি। কলকাতায় থেকে এক দিন চিড়িয়াখানা, এক দিন সার্কাস, এক দিন বনভোজন, এক দিন মিউজ়িয়ম। বাকি ক’দিন মামার বাড়ির আদর। দুই বিনুনি বাঁধা শান্ত তূর্ণী গায়ে রোঁয়া-ওঠা উলের কার্ডিগান পরে মাঝেমধ্যে মামাবাড়ির বারান্দায় এসে দাঁড়াত। বড় বড় চোখ তুলে তাকাত। এক দিন হঠাৎই সেই চোখে চোখ পড়ল অরণির, আর পা পড়ল গর্তে। মনের সঙ্গে পাও মচকাল। শীতে ব্যথা বাড়ে। অরণির বেলাতেও ঘটল তা-ই। মনের ব্যথা, পায়ের ব্যথা দুটোতেই কাবু হল। বাড়িতে ঠাকুমা পায়ের জন্য গরম চুন-হলুদ দাওয়াইয়ের ব্যবস্থা করলেন, আর পাড়ায় বন্ধুরা মনের ব্যথা জন্য দাওয়াই বাতলাল অন্য রকম।
সে দাওয়াই এক কিশোরের জন্য যেমন ভয়ঙ্কর, তেমন রোমাঞ্চকর।
বন্ধুরা বলল, “ওই মেয়েকে তুই প্রেম নিবেদন কর অরি, এখনই কর।”
অরণি কাঁচুমাচু ভাবে বলল, “কী ভাবে? মুখে বলব? সে সুযোগ পাব কী?”
বন্ধুরা বলল, “আগে মুখে নয়, আগে চিঠি। গুছিয়ে চিঠি লেখ দেখি।”
অরণি ভয় পেয়ে বলল, “চিঠি যদি বিশুকাকার হাতে পড়ে যায়? বাবাকে বলে দিলে কী হবে
ভাবতে পারিস?”
“তাও বটে, তুই বরং অন্য কোনও পথে চল।”
অরণি উৎসাহ নিয়ে বলল, “কী পথ?”
এক জন মাথা চুলকে বলল, “ফুলের পথ। প্রতিদিন একটা করে ফুল ফেলে আয় ওই বাড়িতে। সিনেমায় যেমন দেখায়। টিভিতে দেখিসনি? দেখবি, ওই মেয়ের মাথা খারাপের অবস্থা হবে। ফুলওয়ালাকে খুঁজতে শুরু করবে পাগলের মতো। তাকে এক বার চোখের দেখা দেখবার জন্য ছটফট করবে। আর তখনই তুই ধরা দিবি। ওই বাড়ির সামনে গিয়ে হাসিমুখে হাত নাড়বি। ব্যস, কেল্লা ফতে। ‘ফুল্লে ফতে’-ও বলতে পারিস। ফুল দিয়ে হবে কি না।”
এই ‘সিনেমার গল্প’টি অতি পছন্দ হল অরণির। গল্পে তার ভূমিকা হিরোর। প্রেম এ রকমই হওয়া উচিত। আর ফুলের তো অভাব নেই। মধ্যশীতে বাগান আলো হয়ে আছে। পরদিন থেকেই শুরু হল অ্যাকশন। প্রেমের জন্য মানুষ সব পারে, অরণিও পারল। কাকভোরে উঠে পড়ল। শীতে কাঁপতে কাঁপতে বেরিয়ে পড়ত। কখনও চাদরের তলায় চন্দ্রমল্লিকা, কখনও সোয়েটারের নীচে গোলাপ, কখনও মাফলারের ভাঁজে জাম্বো সাইজের গাঁদা, কখনও টুপির নীচে ডালিয়া। ‘বিশুকাকা’র বাড়ির উঠোনে, গেটের সামনে, বারান্দার কোণে সেই ফুলেরা পড়তে শুরু করল ঝপাঝপ আর অরণির বাবার কপালে তত ভাঁজ পড়তে লাগল। গাছের ফুল যায় কোথায়? এত পাহারার পরও কে নেয়?
এক শেষরাতে নিজের ঘরে, জানলা একটুখানি ফাঁক করে, লেপ-কম্বল মুড়ি দিয়ে তিনি রইলেন বসে। উত্তুরে বাতাস লেপ-কম্বল ভেদ করে বিঁধল বটে, ভদ্রলোক হাল ছাড়লেন না। ফুলচোরকে ধরতে হবে।
চোর ধরা পড়ল ভোরে। ‘বিশুকাকা’র বাড়ি পর্যন্ত চাদরে মুখ মাথা ঢেকে চোরকে ফলো করলেন অরণির বাবা। ফলো করার ইতিহাসে এমন ঘটনা আর আছে বলে মনে হয় না। অরণি সদ্য-ফোটা, কুয়াশা-মাখা রক্তবর্ণের গোলাপটি সবে বারান্দা তাক করে ছুড়েছে আর সঙ্গে সঙ্গে ‘খপ’।
ছবি: রৌদ্র মিত্র।
পিতা পুত্রের কান পাকড়াইয়া ধরিয়া বলিলেন, “অরি তুই!” আর ঠিক সেই সময়, দরজা খুলে বারান্দায় এসে দাঁড়িয়েছিল সদ্য ঘুম-ভাঙা গোলাপের মতোই সুন্দর রাজকন্যা তূর্ণী। কোনও কারণে আজ তার ঘুম ভেঙেছে আলো ফোটার মুহূর্তে। ভোর দেখার জন্য বাইরে এসেছে সে। বাড়ির সামনে পিতার হাতে পুত্রের কান দেখে সে হতবাক। এই ছেলেই রোজ ফুল রেখে যায়!
পরের ঘটনায় আর যাব না। বন্ধুদের ব্যাপার। সব ফাঁস করা ঠিক হবে না। যুগে যুগে প্রেমের জন্য প্রেমিককে কত অপমানই না সহ্য করতে হয়েছে, এ তো সামান্য কানমলা। বলার কথা একটাই, এই গল্পের প্রধান চরিত্রটি অবশ্যই শীতকাল। শীতকাল না হলে এই গল্প হতই না। কোথায়ই বা এত রকমারি ফুল জুটত, কোথায়ই বা হত ফুলচুরি?
শীতকালীন খেলাধুলো
শীতকাল এক-এক বয়সে এক-এক রকম। সবার কাছে তা-ই, আমার কাছেও। তবে বাল্য, কৈশোরের শীতকাল বাঁধভাঙা আনন্দের। অনেকের মতো সেই শীতকালের কাছে আমিও ঋণী। মণিমুক্তোর দিন সে সব। সকাল হত কমলালেবুর কোয়ার মতোরং নিয়ে, বেলা ফুরোত ঝরে পড়া পাতার মনকেমনের গন্ধে।
ডিসেম্বরের গোড়া থেকে নতুন বছরের জানুয়ারি পর্যন্ত থাকত লম্বা ছুটি। তখন স্কুলের ফাইনাল পরীক্ষা শেষ হত শীতের ছুটির আগে। তার ফাঁকে স্কুলের বার্ষিক ক্রীড়া প্রতিযোগিতা। স্পোর্টস। ক’টা দিন একেবারে আত্মহারা অবস্থা। মানুষের জীবনের যে ক’টা সেরা মুহূর্ত থাকতে পারে, তার একটা অবশ্যই স্কুলের স্পোর্টস। শীতের রোদে মস্ত আয়োজন। রঙিন বেলুন, সাদা চুনের দাগ, শামিয়ানায় সাজত মাঠ। ট্রোফি, মেডেল আর হরেক প্রাইজ়ে টেবিল যেত ভরে। কুচকাওয়াজ দিয়ে শুরু হয়ে, শেষ হত ‘যেমন খুশি সাজো’তে। পুরস্কার বিতরণীর সময় বন্ধুদের জন্য হাততালি দিতে দিতে হাতের তালু লাল হয়ে যেত। বিশ্বাস করতাম, অনুপম একশো মিটার দৌড়ে, সুমন লং জাম্প, হিমাদ্রি লোহার বল ছোড়ায় নিশ্চয়ই এক দিন অলিম্পিক্সে যাবে। টিফিনে একটা কমলালেবু, এক টুকরো কেক, একটা জয়নগরের মোয়া মিলত। রোদে পিঠ দিয়ে খাওয়া হত। এ সব সুখাদ্য পরে জীবনে অঢেল জুটেছে, কিন্তু সেই টিফিনের স্বাদ আজও মুখে লেগে।
আর একটা কথা চুপিচুপি বলি, স্পোর্টসের ঠিক আগে আমাদের স্কুলের কোনও কোনও ছাত্র গোপনে ‘লেঙ্গি’ প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করত। একশো, দুশো, তিনশো মিটার দৌড়ে ‘লেঙ্গি’ ছিল শেষ অস্ত্র। পাশের জনকে ধরাশায়ী করতে হবে। শুধু স্কুলে নয়, শীতের সময় পাড়ায়, ক্লাবেও স্পোর্টস লেগে থাকত। এখনও থাকে। দেখতে ভাল লাগে, গায়ে ধুলো বালি রোদ মেখে একই রকম মজায় সবাই মেতেছে। নানা দাপটে অনেক মজারই এখন ত্রাহি-ত্রাহি রব। কত খেলা যে এখন মাঠ ছেড়ে মোবাইলের স্ক্রিনে ঢুকে পড়েছে! শীতের লং জাম্প, হাই জাম্প, হাঁড়ি ভাঙা, জিলিপি দৌড়ের আনন্দ কেউ কাড়তে পারেনি। পারবেও না। কারণ এই আনন্দে শুধু হারজিত নেই, শীতের ঝকঝকে আকাশ, ঝলমলে রোদ, কনকনে বাতাসও যে রয়েছে।
গভীর রাতের আতঙ্ক
শীতকালে এলে বাঘের ডাকের কথা এক বার মনে পড়বেই। না, চিড়িয়াখানায় নয়, বেলগাছিয়ায়। বেলগাছিয়ায় বাঘ ডেকেছিল শুনলে অনেকেই আমাকে মারতে আসবে।
‘কোন রাজারাজড়ার আমলে বাছা? তখনও কলকাতা জঙ্গল ছিল বুঝি?’
একেবারেই সে সব নয়। স্কুলে পড়ি তখন। পিঠের নেমন্তন্ন খেতে সুমাল্যর পিসির বাড়ি বেড়াতে গিয়েছিলাম। পিসির বাড়ি পাইকপাড়া অঞ্চলে। অতি উচ্চমার্গের পিঠে বানাতেন। পাটিসাপটা এবং গোকুল পিঠেতে এলাকায় নাম করেছিলেন। প্রতি শীতেই তিনি ভাইপোকে নেমন্তন্ন করেন। ভাইপো এক-এক বছর এক-এক জন বন্ধুকে সঙ্গে নিত। যে বছর যার সঙ্গে গলাগলি থাকত। এই কারণে শীতকাল আসার মাসখানেক আগে থেকে আমরা সুমাল্যর সঙ্গে ‘মধুর’ ব্যবহার করতাম। আমাদের ব্যবহার দেখলেই বোঝা যেত শীত খুব দূরে নয়। মধুর ব্যবহারের পরীক্ষায় যে পাশ করত, সে-ই পেত পিসির পিঠে পুরস্কার। সে বার সুমাল্য আমাকে বাছল। সারা দিন পিঠে সাঁটিয়ে এক রাত কাটিয়ে তবে ফেরা। পিসির বাড়ির তিনতলার ছাদে গেস্ট রুম। সুমাল্য আর আমি বায়না ধরলাম ওখানেই শোব। পিসি চিন্তিত হলেন।
“ভয় পাবি না তো?”
“কিসের ভয়, দু’জনে তো রয়েছি। এক ঘুমে রাত কাটিয়ে দেব।”
এক ঘুমে রাত কাটল না। গভীর রাতে আমাদের ঘুম ভাঙল। লেপের ভিতর থেকে শুনতে পেলাম হুঙ্কার। কে ডাকছে? কান পাততেই বুঝতে পারলাম, এই ‘ডাক’ আমাদের চেনা। রেডিয়োতেশুনেছি, সিনেমায় দেখেছি। পাইকপাড়া এলাকায় বাঘের ডাক!
সুমাল্য বিড়বিড় করে বলল, “এক্ষুনি দরজায় খিল তুলে দে।”
ভাবটা এমন যেন, বাঘ খিল খুলে ঘরে ঢুকতে পারবে না। ঘন শীতের নিঃশব্দ রাতে আবার বাঘ ডেকে উঠল। এ বার আরও জোরে। লেপের ভিতর একেবারে গুটিসুটি মেরে ঢুকে গেলাম দু’জনে। বাঘের ভয়ে সেই শীত রাতে ঘেমেওছিলাম। সকালে ঘুম ভাঙতে মনে হল, মিথ্যে শুনেছি। পাইকপাড়ায় বাঘের ডাক কোথা থেকে আসবে? নিশ্চয়ই স্বপ্ন। অত্যধিক পিঠে ভক্ষণের ফল। পেট গরম। পিসিকে বলতে তিনি মিটিমিটি হাসলেন।
“ঠিক শুনেছিস। ওটা বাঘের ডাকই। টালা পার্কে সার্কাসের তাঁবু পড়েছে। সেখানকার বাঘেরা মাঝেমধ্যে ডাক দেয়। শীতের সময় চার পাশ নিঝুম হয়ে যায়, বাতাসে ওই ডাক উড়ে আসে।”
আমরা যেমন ‘হাঁ’ হলাম, তেমনই উত্তেজিত। পিঠের সঙ্গে এ বার শীতে জুটেছে সত্যি বাঘের ডাক।
শীতে কলকাতা, হাওড়া, আরও নানা জেলা শহরের মাঠে-ময়দানে সার্কাসের তাঁবু পড়ত। কত রকমের নাম ছিল তাদের। প্রধান আকর্ষণ বাঘ, সিংহ, হাতির খেলা। সার্কাস বিনা শীত, কানু বিনা গীতের মতো মনে হত। এক দিন দেখতে যাওয়া ছিল অবশ্যই। কলকাতার গলিতে হাতিদের প্রচার করতে দেখেছি। গলায় ঘণ্টা, পিঠে ঝালর। দোতলা, তিনতলার বারান্দা পর্যন্ত শুঁড় তুলে কলাটা-মুলোটা আদায় করত।
এক বার মার্কাস স্কোয়ারে সার্কাসের হাতির স্নান-খাওয়া দেখতে গিয়েছিলাম। লোহার গেটের বাইরে থেকে অত বড় বড় হাতি দেখে বাড়ি ফেরার রোগা গলিপথ গুলিয়ে গেল। পথ হারিয়ে ফেললাম। যে সঙ্গীর বীরত্বের ওপর নির্ভর করে বেরিয়েছিলাম, সে তো কেঁদেই ফেলল। শেষ পর্যন্ত এক ট্রাফিক পুলিশ এগিয়ে এসে দুই বালককে বাড়ি ফেরার পথ চেনালেন।
এখন আর হাতি দেখতে গিয়ে পথ হারানোর উপায় নেই। হারাবে কী করে, হাতিই তো নেই। শীতের সার্কাস থেকে পশুপাখি বিদায় নিয়েছে। ঠিক হয়েছে। আগে হওয়া উচিত ছিল। পশুপাখিরা এখন সার্কাসের তাঁবুতে নয়, শীত কাটায় জঙ্গলে। উল্টে শীত পড়লে মানুষই এখন তাদের সঙ্গে দেখা করতে তাদের পাড়ায় ছোটে। শীতের জঙ্গলসাফারি সুপারহিট।
রেডিয়ো-টিভি-মাঠের ক্রিকেট
শীতের আর এক রোমাঞ্চ ক্রিকেট ম্যাচ। ইডেন গার্ডেনসের ক্রিকেট ম্যাচ। পাঁচ দিনের টেস্ট ম্যাচ। আহা! কী উত্তেজনা। দুপুর রোদে ছাদে মাদুর পেতে ট্রানজ়িস্টর ঘিরে বসা হত। ‘লাঞ্চ’-এ ঘরে গিয়ে ভাত, ডাল, আলু-ফুলকপি দিয়ে ডিমভরা ট্যাংরা মাছের ঝোল, ‘টি’ব্রেকে নলেন গুড়ের সন্দেশ। এক দিন নরম, তো এক দিন জলভরা কড়াপাক। কমল ভট্টাচার্য, অজয় বসুর ধারাভাষ্য শীতের মিঠে বাতাস আরও মিঠে করে তুলত। তার পর এলেন ‘বাবা টেলিভিশনানন্দ’। রেডিয়োতে খেলা শোনার আনন্দ নিলেন কেড়ে। শীতের সকালে যতই ঠান্ডা লাগুক, টিভি চলত অন্ধকারে, তাকে নিয়ে তো আর ছাদের রোদে মাদুর পেতে বসা যাবে না। অতএব চাদর, সোয়েটার ছাড়া গতি নেই।
যারা সরাসরি ইডেনে খেলা দেখতে যেত, তারা ছিল পাড়ার ‘হিরো’। যেমন আমাদের পল্টুদা। সাদা জামা, সাদা প্যান্ট, সাদা কেডস কেচেকুচে রাখত দশ দিন আগে। সাদা সোয়েটার জোগাড় করত। মাপে একটু বড় হত বটে, সে হোক। সকাল থেকে বাড়িতে লুচি ভাজা নিয়ে হইহই কাণ্ড শুরু হত। সঙ্গে কড়াইশুঁটি দিয়ে আলুর তরকারি। মাঠে গিয়ে পল্টুদা খাবে। টিফিনবাক্স, জলের বোতল নিয়ে পল্টুদা যখন বাসের লাইনে দাঁড়াত, তখন তাকে চেনা মুশকিল। মনে হত খেলা দেখতে তো নয়, খেলতেই চলেছে। সন্ধেয় পাড়ায় ফিরে অন্যের পয়সায় গরম চপে কামড় দিয়ে এমন ভাবে কথা বলত যেন গাওস্কর পল্টুদার কথাতেই সিলি পয়েন্ট থেকে মিড সিলি অফে ফিল্ডার সরিয়েছেন, আর তাতেই ক্যাচ খপাত হয়েছে। এই ‘টেনিদা-ঘনাদা মার্কা’ গপ্পে শীতের সন্ধে যে আরও জমে যেত, তাতে সন্দেহ নেই। আমরা চপের ঝাল আর পল্টুদার কথার ঝাল দুটোতেই ডবল ‘উঃ আঃ’ করতাম। আর মুখ দিয়ে ধোঁয়াশা বেরোত।
শীতের পরব বইমেলা
তারুণ্য, যৌবনের শীতের রোমাঞ্চে এক নম্বরে চলে এল বইমেলা। উত্তুরে বাতাস যেন বইমেলাকে হাত ধরে নিয়ে আসত। একটা সময়ে বইমেলায় গঙ্গা থেকে উড়ে আসত কনকনে বাতাস। পায়জামা পাঞ্জাবি, বুকখোলা হালকা কোট পরার ফ্যাশন বিপদে ফেলত। শীতল বাতাস হাড়ে গিয়ে বিঁধত। বইয়ের গরম আর বান্ধবীর সান্নিধ্যই তখন বাঁচার একমাত্র উপায়। পরে তো বইমেলা গঙ্গা হারাল, তার কনকনে বাতাসও হারাল। ঠাঁইনাড়া হল সে। তবে সময়নাড়া হল না। বইমেলা শীত আঁকড়েই পড়ে রইল। সেই কনকনানি আর নেই বটে, তবে আমেজটি রয়েছে ষোলো আনার উপর।
এই প্রসঙ্গে ‘ভূতে পাওয়া’র মতো ‘শীতে পাওয়া’ এক বইমেলার গল্প না বলে পারা যাচ্ছে না।
তালেগোলে তখন ‘একটু লেখক’ হয়ে গিয়েছি। দক্ষিণবঙ্গের এক বইমেলায় ‘বিশেষ অতিথি’ হয়ে যেতে হল। মাঘ চলছে তখন। ঠান্ডা যে এ রকম হয় জানা ছিল না। শহরের শীতবিলাসী হাড়ে হাড়ে বুঝতে পারলাম, শীত কত প্রকার ও কী কী। জামা, সোয়েটার, কোট, মাফলার, কানঢাকা টুপির যাবতীয় আয়োজন তুচ্ছ করে সে ঘাড় মটকে দিতে চায়। কলকাতা থেকে দীর্ঘ পথের শেষ পর্যায়ে লঞ্চে চেপে যেখানে পৌঁছলাম, শুনলাম তার কাছেই নাকি বাঘের বসবাস। তিনি মাঝেমধ্যে এই লোকালয়ে বেড়াতে আসেনও। ভাবলাম, ভালই হয়েছে, মাঘের শীত খানিকটা বাঘের গায়েও থাক। অপরিসর মাঠে, মেলা অতি সামান্য আয়োজনের। ঘন কুয়াশায় আলো মলিন। স্টলের রং, মঞ্চের সাজ সবই ফ্যাকাসে। উদ্বোধন অনুষ্ঠানে কড়া ব্যান্ড-বাদ্যের ব্যবস্থা থাকলেও তাতে মশা বা শীত কোনওটাই তাড়ানো গেল না। লোকসমাগম কম। সেটাই স্বাভাবিক। এই শীতে কে ঘর ছেড়ে বেরোবে? তার পরেও যারা মেলায় এসেছেন, তারা চাদরে এমন মুড়ি দিয়েছেন যে কারও মুখই দেখা যাচ্ছে না। শুধু চোখটুকুই যা বেরিয়ে আছে। মাঠে লোক না হলেও, উদ্বোধন মঞ্চে লোক হয়েছে। একান্নবর্তী পরিবারের মতো এলাকার নানা ধরনের মেজো, সেজো, ছোট, ন’, রাঙা, ফুল ‘বিশিষ্ট’জনেরা চাদর মুড়ি সহযোগে চেয়ার দখল করে সারি দিয়ে বসে পড়েছেন। শীত তাদের দমাতে পারেনি।
আয়োজকদের এক জন বসেছেন আমার বাঁ পাশে। কানের কাছে মুখ এনে বললেন, “এই নিন চাদর, আপনিও মুড়ি দিয়ে ফেলুন।”
আমি অবাক হয়ে বললাম, “সে কী! এতটা পথ পেরিয়ে আসা বিশেষ অতিথিকে তো কেউ দেখতেই পাবে না।”
“নদী পেরিয়ে সাগর থেকে যে বাতাস আসছে, তাতে নিউমোনিয়া অনিবার্য। ও সব দেখাদেখি বাদ দিন। চাদরে মুড়ি দিন। মনে হচ্ছে, আপনার জন্য কম্বল আনলে ভাল হত।”
আমার মতো নড়বড়ে লেখকরা এমনিতেই নার্ভাস, আয়োজকের কথা শুনে আরও ঘাবড়ে গেলাম। নিজের উপর রাগ হল। মরতে কেন লেখালিখির ফাঁদে পা দিয়েছি? দুনিয়ায় আর কোনও কাজ কি পারতাম না? না লিখলে কে আমায় আজ ‘অতিথি’ বানিয়ে এই বিপদে ফেলতে পারত? দেরি না করে চাদর মুড়ি দিয়ে সবার সঙ্গে এক হয়ে গেলাম। মালা গলায় এক দল ভূত বসে আছে যেন। যা-ই হোক, ভাষণ তো চলতে লাগল। চাদরের ফাঁকে মাইকের মুন্ডু গলিয়ে ব্যবস্থা। এই পর্যন্ত ঠিকই ছিল। আমি ঠান্ডায় কাঁপতে কাঁপতে অপেক্ষা করছি, কখন আমার বলার পালা আসবে। ভয়ও পাচ্ছি, শীত যে ভাবে বাড়ছে, আগেই দাঁতকপাটি লেগে না যায়। কিছু না বললে ছেড়ে কথা বলবে? কিন্তু দাঁতকপাটি লাগা বিশেষ অতিথি কি ভাষণ দিতে পারে?
এই সময় ঘটল ঘটনা। আমার ভাষণের সময় আসার আগেই বিরাট গোলমাল। কোথা থেকে গোটা কতক মুশকো চেহারার লোক মঞ্চের সামনে উদয় হয়ে এক রকম নাচানাচি শুরু করে দিয়েছে। হাতে লাঠিসোঁটা। এক জনের হাতে দা-ও রয়েছে। তারা সবাই চিৎকার করছে।
“ধর বেটাকে, আজ মেরেই ফেলব। আমাদের ভাগ না দিয়ে কোথায় পালাবি? লেকচার দেওয়া বার করছি তোর।”
পাশে বসা আয়োজক আমার হাত চেপে বলল, “এই রে, চণ্ডীপদর অ্যান্টি গ্রুপ এসে গেছে।”
আমি বললাম, “চণ্ডীপদটা কে?”
আয়োজক চাপা গলায় বলল, “স্টেজেই বসে আছে দাদা। আপনার ঠিক পাশেই। চাদর মুড়ি দিয়ে আছে বলে ওরা চিনতে পারছে না।”
আমার তো সত্যি সত্যি দাঁতকপাটি লাগার জোগাড়। শীতে নয়, ভয়ে। কোনও রকমে বললাম, “কী হবে?”
“সেটাই তো ভাবছি, আসল লোককে চিনতে না পেরে আপনাকে ধরে খানিক পিটিয়ে না দেয়। চণ্ডীপদ অনেকটা আপনারই মতো ইয়ে...মানে রোগাভোগা। সতর্ক থাকুন। ভুল লোককে মারধরের ঘটনা প্রায়ই হয়ে থাকে কি না। কাগজে পড়েননি? আপনার দিকে ওরা তেড়ে এলেই স্টেজ থেকে ঝাঁপ দেবেন, তার পর টেনে দৌড় লাগাবেন। বাকিটা আমি বুঝে নেব।”
আর বুঝে নেওয়া! “নিউমোনিয়ার নিকুচি করেছে!” বলে, এক মুহূর্ত দেরি না করে গায়ের চাদর দিলাম ছুড়ে ফেলে। এমনকি মাথার টুপি, গলার মাফলারও। সবাই দেখুক আমাকে, চিনুক। আমি কে সেটা বড় কথা নয়, আমি যে চণ্ডীপদ নই, সেটাই আসল কথা। ওরা যেন ভুল না করে বসে। মোটা পুলওভারটাও খুলব নাকি?
প্রবল ঠান্ডায় এক নার্ভাস লেখকের আবরণ উন্মোচন কাজে দিল। লাঠিসোঁটারা আর ভুল করল না। আমাকে পাত্তাই দিল না। মুখে মিটিমিটি হাসি নিয়ে হাড়-জমানো শীতে বুক ফুলিয়ে বসে রইলাম বাকি সময়টা।
ধূসর শীতের রোমাঞ্চ
যৌবনের শীতে যেমন রোম্যান্স বেশি, তেমন উন্মাদনাও। ক্যামেরা কাঁধে পাহাড়-জঙ্গলে ছুটে বেড়ানো, নদীর ধারে বারবিকিউ, হিম-পড়া রাতে তাঁবুর বাইরে গিটারে গান, গরম পোশাকে প্রাণ ভরে সাজ, রকমারি খাবারে পেট ভরে ভোজ। সুরা আছে, নলেন গুড়ের পায়েসও আছে, আছে জয়নগরের মোয়াও। পরিবারের সবার সঙ্গে বনভোজন আছে, আবার একা প্রিয়জনকে পেয়ে উষ্ণ চুম্বনও আছে। তবে বাঙালির মনে সদা অশান্তি। শীত তো ‘হে ক্ষণিকের অতিথি’। হুট্ বলতে যায় ফুরিয়ে। আবার সেই ঘ্যানঘেনে গরম, প্যাচপেচে জল কাদা। তাই যত পারো, যতটা পারো চেটেপুটে নাও— ‘কেঁপে’ নাও, দু’দিন বই তো নয়!
আচ্ছা, বেশি বয়সের শীত? সে কি উপলব্ধিতে স্থির? যত্নে উষ্ণ? ওই কাচের জানলা বন্ধ, আলো জ্বলা ড্রয়িংরুমে একটু উঁকি মেরে দেখা যাক তো।
সোফায় বসে আছেন দু’জনে। এক জনের হাতে বই। রূপকথার বই। বিদেশ থেকে নাতি এলে গল্প শোনাতে হবে। এক জন বুনছেন উল। নাতনির মাথার টুপি হচ্ছে। সে আসবে বেঙ্গালুরু থেকে।
“তোমাকে একটু কফি করে দিই? শীত শীত ভাবটা কাটবে।”
“তোমাকে হটব্যাগে একটু গরম জল এনে দেব? হাঁটুতে দেবে? ব্যথাটা কমত।”
“কত বছর পর এ বার কেমন সুন্দর ঠান্ডা পড়েছে বলো দেখি।”
“বড্ড বেশি সুন্দর। বুড়োবুড়িতে এই শীতে একটা অ্যাডভেঞ্চার করি চলো।”
“কী অ্যাডভেঞ্চার?”
“শনিবার খুব ভোরে পাখি দেখতে বেরোই। পরিযায়ী পাখি। সারা দিন ঝিলে ঝিলে ঘুরব।”
“ডান। ফ্লাস্কে আমার বানানো কফি আর বক্সে তোমার বানানো কেক নেব।”
“আর আজ কখন বেরোচ্ছি?”
“রাতে। যেমন প্রতি বছর বেরোই।”
“ভাল করে প্রোটেকশন নিয়ো, খুব ঠান্ডা।”
“জিনিসগুলো কোথায়?”
“গাড়ির ডিকিতে। গোছানো রয়েছে।”
দু’জন গাড়ি নিয়ে বেরোন মধ্যরাতে। গরম পোশাক, টুপিতে দু’জনে একেবারে ঢাকাঢুকি। শহরে কুয়াশা নামছে পাখির পালকের মতো নিঃশব্দে ভাসতে ভাসতে। শীতের ওমে মুড়ি দিয়েছে রাজপথ, ঘরবাড়ি, ল্যাম্পপোস্ট। গাড়ি এখন ঘুরবে পথে পথে। যেখানে ফুটপাতবাসী শীতে কাঁপছে, গাড়ি থামবে তার কাছে। অতি যত্নে তাদের হাতে তুলে দেওয়া হবে চাদর, কম্বল, মাথার টুপি। এই দু’জনের নাম কেউ জানবে না। সব প্রচার তুচ্ছ করে এঁরা কুয়াশা চিরে ছুটে যাবেন।
শীতকাল এঁদের স্যালুট জানায়।
পুনশ্চ: ভেবেছিলাম কবিতা ছাড়াই শীত কাটিয়ে দেব। পারলাম না। হিংসের থেকে কবিতার জোর অনেক বেশি। শেষ করি কবিতা দিয়েই—‘শীতের রাতের এই সীমাহীন নিস্পন্দ গহ্বরে/ জীবন কি বেঁচে আছে তবে!’
হ্যাঁ, আছে বইকি।