music

এখানকার তারবাদ্যই পৌঁছে যায় দেশের সর্বত্র ও বিদেশে

উলুবেড়িয়ার ছোট্ট গ্রাম দাদপুর। গ্রামের ছেলে তারাপদ হালদার আট বছর বয়সে কলকাতায় এসে শেখেন বাদ্যযন্ত্র তৈরির কলাকৌশল। শেখান গ্রামের জ্ঞাতি-পড়শিদের। ক্রমশ গ্রাম ও দেশের সীমা পেরিয়ে ছড়িয়ে পড়ে এখানকার সেতার, সরোদ, সুরবাহার, সুরমণ্ডল, বীণার সুর। 

Advertisement

কুন্তক চট্টোপাধ্যায়

কলকাতা শেষ আপডেট: ১৯ মার্চ ২০২৩ ০৮:০১
Share:

যন্ত্রনির্মাণ: নিজের কারখানায় সেতারে সুর বাঁধতে ব্যস্ত তারাপদ-পুত্র শ্যামল।

বাবার মৃত্যুর সময় ছেলের বয়স ছিল মাত্র পাঁচ। দরিদ্র পরিবারে আয়ের উপায় খুঁজতে আট বছর বয়সেই নামতে হয়েছিল কাজে। গ্রামে টুকটাক কাজ করে পেট চলত না। তাই কিশোর বয়সেই পাড়ি কলকাতায়, যদি কিছু ভাল কাজ জোটে... মস্ত শহর কলকাতায় এসে যে জীবন বদলে যাবে, তা তখনও ভাবতে পারেননি হাওড়ার উলুবেড়িয়া মহকুমার ছোট্ট গ্রাম দাদপুরের তারাপদ হালদার।

Advertisement

কাজ খুঁজতে খুঁজতে তারাপদ এসেছিলেন কলকাতার গিরিশ পার্কে। সেখানে চায়ের দোকানে কাজও জুটল। ছোটখাটো কাজ, তবে মাসমাইনে আছে। সেই কাজ করতে করতেই চোখে পড়লেন রাধাকৃষ্ণ শর্মার। গিরিশ পার্কে তখন রাধাকৃষ্ণর মস্ত বাজনার দোকান। তাঁর হাতের সেতার, সরোদের খ্যাতিও আছে। তারাপদকে সেই দোকানেই কাজে লাগালেন তিনি। দৈনিক মজুরি দু’টাকা। সেই কাজ শেখার পর থেকেই ভাগ্য বদলাতে শুরু করল। বাদ্যযন্ত্র তৈরির হাতযশে তাক লাগালেন তারাপদ।

প্রায় সত্তর বছর আগের সেই দাদপুর আর নেই। গ্রামের ভিতরে ঢালাই রাস্তা, বাড়িঘরের ছিরিও বদলে গিয়েছে। সেই ‘শ্রী’ বদলের কারিগর অনেকাংশেই যে তারাপদ হালদার, তা একবাক্যে মানেন অনেকেই। কারণ, রাধাকৃষ্ণর দোকানের কারিগর হয়ে থেমে থাকেননি তিনি। চলে গিয়েছিলেন লখনউ। বহু বছর সেখানেই ছিলেন। সংসারও পাতেন। ওস্তাদ কারিগরের জন্য আলাদা বাড়িভাড়াও করে দিয়েছিলেন যন্ত্র কারখানার মালিক। লখনউ থেকে ফিরে দাদপুরে এসে থিতু হন। বাদ্যযন্ত্র তৈরির কাজ শেখান জ্ঞাতি কিংবা প্রতিবেশীদের। সেই বিদ্যের জোরেই তারবাদ্যের বাজারে দাদপুর এখন বিখ্যাত। সরোদ, সুরমণ্ডলের মতো বিবিধ তারযন্ত্রের মধ্যে দাদপুরের সেতার, সুরবাহার বা বীণার কদরই আলাদা! বাড়িতে বাড়িতে সেখানে শুধু বাদ্যযন্ত্রের কারখানা। গ্রামের রাস্তায় পা দিলেই নানা দিক থেকে পাখির কূজনের মতো ভেসে আসে সুর। কারখানায় বসে কারিগরেরা তরিবত করে যন্ত্রে সুর বাঁধেন।

Advertisement

জীবদ্দশাতেই কার্যত কিংবদন্তি হয়ে উঠেছিলেন তারাপদ। তাঁর দোতলা পাকা বাড়ি, উঠোন দেখে কাজের খোঁজে গ্রাম ছেড়ে শহরের পথে পা বাড়ানো সেই কিশোরকে খুঁজে পাওয়া যায় না। বাড়ির সামনে কারখানায় বসে সে সব দিনের কথা শোনান তারাপদর বড় ছেলে শ্যামল হালদার। মেঝেতে মাদুর বিছিয়ে বসেছেন তিনি। চার পাশে থরে থরে সাজানো সেতার এবং সুরবাহার। তাঁর বাবার হাতে এই দু’টি যন্ত্র যেন কথা বলতে শিখত! বাইরে এক ফালি জমিতে সারবন্দি লাউয়ের খোল, টুন কাঠ। যন্ত্র তৈরির আগে কাঠ, লাউকে ‘সিজ়নড’ করা হচ্ছে। প্রৌঢ় শ্যামল বলছিলেন, কলকাতার বিভিন্ন নামী দোকানে তো যন্ত্র যায়, তবে সে সবের থেকেও ব্যবসা বেশি এখন পটনা, লখনউ, বারাণসীতে। দাদপুরের ব্যবসায়ীদের মতে, সুরবাহারের দাম পশ্চিমবঙ্গে তেমন নেই। দেশেও তেমন নয়। বরং বিদেশ থেকে অনেক বেশি সুরবাহারের বরাত আসে।

হাওড়ার দাদপুরের সুবাদে কপাল খুলেছে হুগলির জাঙ্গিপাড়ার পাশপুরের। সেতার, সুরবাহার, বীণার লাউয়ের চাষ সেখানেই হয়। এই ‘সাধের লাউয়ের’ ব্যাপারও কিন্তু সহজ নয়। লাউ পাকলে বাজনার কারবারিরা চলে যান চাষিদের কাছে। ঠিকঠাক মাপের লাউগুলিকে একেবারে দাগ দিয়ে চিহ্নিত করে আসেন। সেই লাউ চাষিরা পৌঁছে দিয়ে যায়। শ্যামল হালদার বলছিলেন, আবহাওয়ার খামখেয়ালিপনা কিন্তু লাউয়ের চাষে প্রভাব ফেলছে। এই লাউ তো মানুষে খায় না, বাজনার জন্যই চাষ হয়। এগুলি শীতের ফসল। গত শীতে যা বৃষ্টি পড়ল, লাউ চাষের তো দফারফা। নিটোল আকার হল না, পাকার পরেও তেমন পোক্তও হল না। প্রাক্‌-বসন্তের নীল আকাশের দিকে তাকিয়ে প্রৌঢ়ের উক্তি, “এ বার বৃষ্টি হয়নি। ভাল লাউ হবে। লাউ যত ভাল হবে, সেতার, সুরবাহারের আওয়াজও তত খুলবে।”

শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের যন্ত্র হলেও সেতারের প্রাচীনত্ব নিয়ে কিন্তু নানা মুনির নানা মত। এ ব্যাপারে গবেষকেরা মোটামুটি এক মত যে, সেতার শব্দটির উৎস ফার্সি ভাষা। ফার্সি শব্দ ‘সি-তার’ (সি অর্থে তিন এবং তার অর্থে তন্ত্রী) থেকে এই নামের উৎপত্তি। তবে কার হাত ধরে এই যন্ত্রের আবিষ্কার, তা নিয়ে পণ্ডিত-মহলে বিস্তর বিতর্ক আছে। প্রাচীনপন্থীদের মতে, এই যন্ত্রের আদি নির্মাতা সুলতানি আমলের সঙ্গীতজ্ঞ-কবি আমির খসরু। সৌরীন্দ্রমোহন ঠাকুরের মতো বহু সঙ্গীতজ্ঞ এই মতকে সমর্থনও করেছেন। ভারতীয় সঙ্গীতে সুলতান আলাউদ্দিন খিলজির সমসাময়িক আমির খসরুর অবদান কম নয়। তিনি নিজেও বহু বাদ্যযন্ত্র বাজাতেন। কিন্তু ত্রয়োদশ-চতুর্দশ শতকে কি সেতারের প্রচলন ছিল? আধুনিক সময়ে সঙ্গীত এবং বাদ্যযন্ত্রের ইতিহাস সংক্রান্ত গবেষকদের অনেকেই দাবি করেছেন, সুলতানি আমলের আমির খসরু সেতার প্রচলন করেননি। অ্যালিন মাইনার তাঁর ‘সিতার অ্যান্ড সরোদ ইন এইটিন্থ অ্যান্ড নাইনটিন্থ সেঞ্চুরিজ়’ গ্রন্থে দেখিয়েছেন, আমির খসরু তাঁর কোনও লেখাতেই সেতার বাদ্যযন্ত্রের উল্লেখ করেননি। সেতারের উৎপত্তির সময় ধরতে অ্যালিন মাইনার সংস্কৃত ভাষায় লেখা সঙ্গীত সংক্রান্ত বিভিন্ন মধ্যযুগীয় গ্রন্থেরও পর্যালোচনা করেছেন। তিনি দেখিয়েছেন, শারঙ্গদেব রচিত ‘সঙ্গীতরত্নাকর’ গ্রন্থে বীণা প্রসঙ্গে একতন্ত্রী বীণার উল্লেখ আছে। এ ছাড়াও, সুধাকলশ রচিত ‘সঙ্গীতোপনিষৎসারোদ্ধার’ গ্রন্থে তেরো প্রকারের বীণার উল্লেখ থাকলেও সেতারের নামগন্ধ নেই।

তা হলে তো প্রশ্ন উঠতেই পারে, হঠাৎ খসরুর নাম এল কেন? সেই প্রসঙ্গের উত্তর দিতে গিয়ে মাইনার হাতিয়ার করেছেন আচার্য কৈলাসচন্দ্র বৃহস্পতির গবেষণাকে। ফার্সি এবং উর্দু ভাষায় রচিত বিভিন্ন তথ্যসূত্র বিশ্লেষণ করে আচার্য বৃহস্পতি দেখিয়েছেন যে, সেতারের স্রষ্টা খুসরু খান। কে এই খুসরু খান তা নিয়েও কম বিতর্ক নেই। সেই প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে গিয়ে মিনার শেষমেশ অষ্টাদশ শতকের খুসরু খানকে স্থির করেছেন। ‘মুরক্কা ই দিল্লি’ গ্রন্থে মোগল শাসক মহম্মদ শাহের দরবারের ছবি খুঁজেছেন মাইনার। সেখানেই খ্যাতনামা দরবারি গায়ক নমত খানের ভাই এবং ভাইপো প্রসঙ্গে সেতারের উল্লেখ আছে। মাইনারের মতে, নমত খানের ভাই খুসরু খানের হাত ধরেই সেতারের প্রচলন হয়।

তবে সেই সেতার বহু বার বদলেছে। সেই বদলের ফলেই বর্তমান সময়ে যে সেতার দেখা যায় সেই রূপ পেয়েছে এই বাদ্যযন্ত্র। তার মধ্যেও অবশ্য দু’টি মূল রকমফের হয়ে গিয়েছে। এক ধরনকে বলা হয়, ‘গান্ধার-পঞ্চম’। অন্যটি ‘খরজ-পঞ্চম’। মূলত তারের সংখ্যা এবং কোন কোন স্বরে তার বাঁধা হচ্ছে তা দিয়ে ফারাক করা যায়। এই দুই ধরনের সেতার ব্যবহারের ঘরানাও আলাদা। ‘গান্ধার-পঞ্চম’ মূলত বাজাতে দেখা যায় ইমদাদখানি ঘরানার শিল্পীদের। উস্তাদ ইমদাদ খানের সুযোগ্য পৌত্র উস্তাদ বিলায়েত খানের সূত্রে এই সেতারকে চলতি কথায় বহু সময় ‘বিলায়েতখানি’ সেতারও বলেন কারিগরেরা। মাইহার ঘরানার শিল্পীদের হাতে থাকে ‘খরজ-পঞ্চম’ সেতার। এই ঘরানার অন্যতম নক্ষত্র পণ্ডিত রবিশঙ্করের সূত্রে চলতি কথায় একে ‘রবিশঙ্কর সেতার’-ও বলা হয়। তবে ফারাক আরও কিছু আছে। শ্যামল হালদার বলছিলেন, “রবিশঙ্কর সেতারে লাউয়ের উপরে অনেক বেশি কাজ হয়। ইমদাদখানি সেতারে সেই তুলনায় কাজ কম। খরজ-পঞ্চম সেতারের মাথায়ও ছোট লাউ লাগানো হয়। গম্ভীর শব্দ যাতে আরও গভীর ভাবে ছড়িয়ে পড়ে তার জন্যই এই ব্যবস্থা।”

বস্তুত, তারবাদ্য প্রাচীনকাল থেকেই এশিয়ার বিভিন্ন জায়গায় পাওয়া যায়। জেমস স্যাডলার হ্যামিলটনের গবেষণায় সেই সব প্রসঙ্গ বিস্তারিত ভাবে পাওয়া যায়। হ্যামিলটন তাঁর ‘সিতার মিউজ়িক ইন ক্যালকাটা: অ্যান এথনোমিউজ়িকোলজিক্যাল স্টাডি’ বইয়ে ছবি-সহ প্রাচীন সময়ের আসিরীয়, মিশরীয় তাম্বুরা, কর্নাটকি বীণার পাশাপাশি তুরস্কের কিউরা, পারস্যের সেহতার, খোরিসানি দুতারের বিবরণ দিয়েছেন। সেই হিসাবে কী ভাবে তিন তারের সেতার বর্তমান সময়ের ‘তরফ’ বা ‘তরব’ (সহযোগী তার যা মূল তারের শব্দের অনুরণন করে) সম্বলিত সেতার হয়ে উঠেছে তাও বুঝিয়েছেন।

ভারতে তারবাদ্যের প্রচলন নতুন নয়। প্রাচীন পর্ব থেকেই এ দেশে বীণা বাজানো হয়েছে। গুপ্ত রাজা সমুদ্রগুপ্তের বীণাবাদনরত মুদ্রা তো স্কুলের পাঠ্যবইয়ের সুবাদে বিখ্যাত। মোগল শাসক ঔরঙ্গজ়েবও বীণা বাজানোয় পারদর্শী ছিলেন। সেতারবাদনের কায়দায় বীণকারদের প্রভাব অপরিসীম। বর্তমানে বীণাবাদনের চল অনেক কমলেও রুদ্রবীণা বা সরস্বতী বীণা কিন্তু এখনও তৈরি হয়। দাদপুরে একমাত্র সনৎ হালদারের কারখানাতেই সেই বীণা তৈরি হয়। বীণা তৈরি নিয়ে কারিগরদের মধ্যে অবশ্য নানা ‘সংস্কার’ আছে। অনেকেই বলছেন, বীণা তৈরি সবার হাতে খাপ খায় না। বিশেষ করে রুদ্রবীণা তৈরি করতে গিয়ে অনেকেই নাকি ঘোর সঙ্কটে পড়েছেন। মিথ বলে, রুদ্রবীণা তৈরি করেছিলেন শিব। এই বীণার গড়নের সঙ্গে নাকি দেবী পার্বতীর অবয়ব মিশে আছে। সরস্বতী বীণার সঙ্গে তো স্বয়ং বাগ্‌দেবী নিজেই জড়িয়ে। তাই বীণা তৈরির সময় কারিগরদের শুদ্ধাচার মানতে হয়।

শুদ্ধাচার মানলেও কুসংস্কার মানতে নারাজ সনৎ। তাঁর ব্যাখ্যা, বীণা তৈরি সহজ নয়। হিসাবের সামান্য ভুলে বাদ্যযন্ত্রই খারাপ হয়ে যেতে পারে। তাতে আর্থিক লোকসান, কারিগরের দুর্নাম। তাই হয়তো লোকমুখে বীণা তৈরি প্রসঙ্গে সাবধানবাণী তৈরি হয়েছে।সনতের বক্তব্য, “আমি তো বহু দিন ধরেই তৈরি করছি। আসলে বীণা তৈরির কৌশল শেখা এবং আত্মবিশ্বাস নিয়ে কাজ করাই আসল। তবে বীণার শেষ পর্যায়ের কাজ, তার লাগানো ইত্যাদির সময় আচার মেনে কাচা জামাকাপড় পরি।” এক সময় রুদ্রবীণা বাজানো তো দূরস্থান, মহিলাদের পক্ষে তা ছোঁয়াও ছিল ‘পাপ’। হয়তো বিরাট আকারের বীণা কোনও মহিলা বাজাবেন, এই ঘটনা পুরুষতান্ত্রিক মন স্বীকার করতে চায়নি। কিন্তু বর্তমানে মধুবন্তী পালের মতো বহু মহিলা শিল্পী সেই সংস্কার ভেঙে রুদ্রবীণা বাজাচ্ছেন। সনতের কাছেও বহু মহিলা শিল্পী বীণা কেনেন। তবে তিনি বলছেন, “এ দেশের থেকে বিদেশেই কিন্তু বীণার কদর বেশি। বরাত পেলে তৈরি করে বাক্সে প্যাক করে পাঠিয়ে দেওয়া হয়।”

সনতের হাতেখড়িও কিন্তু তাঁর ‘তারাকাকার’ কাছেই। পরে উত্তর এবং দক্ষিণ কলকাতার বহু নামী বাদ্যযন্ত্রের দোকানে কাজ করেছেন। সেই চাকরির সুবাদে যেমন বাদ্যযন্ত্র তৈরি বা সারাতে শিখেছেন, তেমনই গুরু ধরে শিখেছেন তবলা, বেহালা বাজানোও। আক্ষেপ, ব্যবসা খোলার পর থেকে সেই সাধনায় ঘাটতি হল। “এখন আর তবলা, বেহালা কিছুই বাজানো হয় না,” নিস্পৃহ উক্তি সনতের। তার পরেই চুপ করে যান। কিন্তু সে নৈঃশব্দ্য স্থায়ী হয় না। কারখানা থেকে ভেসে আসে সেতারের বোল, ডা-ডিরি-ডা-রা।

যন্ত্রশ্রমিকরা সুর বাঁধছেন!

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement