Bengali Feature

আগমন্ডা কবে যেন বদলে গিয়েছে আগনাড়ুতে

সন্দেশের উপকরণের জায়গা নিয়েছে নারকেল আর গুড়। পুজোর মাস জুড়েই বদলে যায় বাঙালির খাওয়ার ধরন। দুর্গাপুজোর চার দিন পেরিয়ে লক্ষ্মীপুজোর নাড়ু-মোয়া-মুড়কি পর্যন্ত এ এক আশ্চর্য স্বাদযাপন।

Advertisement

দীপক দাস

কলকাতা শেষ আপডেট: ২৯ অক্টোবর ২০২৩ ০৬:২৮
Share:

নৈবেদ্য: লক্ষ্মীপুজোয় চালের নৈবেদ্যর উপরে শঙ্কু আকৃতির নাড়ু।

ঢুলিরা বোল তুলেছেন ঢোলে। আওয়াজ উঠছে, ‘কাঁইনানা, কাঁইনানা, গিজদা গিজোড়, গিজোড় গিজোড়’। এমন বোলে ছোট ছোট ছেলেরা নীলে ধোয়া কোরা তাঁতের কাপড় পরে দু’পাছা চাপড়ে নাচত। উনিশ শতকের কলকাতার এ ছিল এক বিশেষ আমোদ।

Advertisement

বাংলাদেশের ঢোলের বোল কবে যেন পাল্টে ‘টাকডুম টাকডুম’ বাজতে শুরু করেছে। ‘কাঁইনানা কাঁইনানা’ করে কাঁসি বাজে এখন। দুর্গাপুজোর নাচ বলতে এখন শুধু ধুনুচি নাচই।

দুর্গাপুজোর আমোদ শুধু বাদ্যিবাজনায় নয়। দুর্গোৎসব মানে ভোজনোৎসবও বটে। চার দিনের আয়োজনের দু’দিনে একটা সর্বজনীন রূপ থাকে। অষ্টমীতে লুচি-ঘুগনি, সুজি ইত্যাদি। নবমীতে পাঁঠা-মুরগি। বাকি দু’দিনেও বাঙালিয়ানা।

Advertisement

উনিশ শতক নিয়েই বাঙালি বেশি গর্বিত। “তখনকার দিনে দুর্গাপুজো হ’লে দশজনকে পাত পাড়াতে হ’ত”— লিখছেন মহেন্দ্রনাথ দত্ত। সেই পাতের রকমে বর্ণভেদও ছিল। যেমন ব্রাহ্মণের বাড়ি হলে ভাত, পাঁচ তরকারি, দই, পায়েস। শাক্ত ব্রাহ্মণ হলে মাছ চলত। আবার কায়স্থের বাড়িতে হত লুচি। ব্রাহ্মণ বাড়িতে নিরামিষ পদের একটা কদর ছিল। ব্রাহ্মণ বাড়িতে উপাদেয় শাকের ঘণ্ট, মোচার ঘণ্ট রান্না হত। পুজোর সময় শাক-মোচার কদর এখনও বাঙালির বাড়িতে রয়েছে।

পুজোর চার দিনের নিরামিষে রকমফের রয়েছে এখনও। পূর্ব মেদিনীপুরের পাঁশকুড়া ব্লকের বিভিন্ন গ্রামে পুজোর তিন দিন নিরামিষের প্রাধান্য। মাংস হয় দশমীতে। বহু বাড়িতে অষ্টমীতে লুচি, সুজি, ঘুগনি, আলুর দম। দুর্গাপুজো হয় না এমন কোনও কোনও গ্রামে নবমীতে শীতলামন্দিরে পুজো দেওয়া হয় ফলমূল, মিষ্টি, ক্ষীরভোগ দিয়ে। ক্ষীর মানে পায়েস। সপ্তমী, অষ্টমী, নবমী নিরামিষ আর দশমীতে আমিষের ঐতিহ্য পাঁশকুড়ার বহু গ্রামের বেশির ভাগ বাসিন্দা মেনে চলেন। আবার পুজোর প্রথম তিন দিনের কোনও এক দিন মাংস বিক্রি করায় জরিমানাও করা হয়েছে মুরগিওয়ালাকে।

নব্বইয়ের দশকের কথা। পুজো উপলক্ষে প্রকাশিত কোনও এক সংবাদপত্রের অতিরিক্ত পৃষ্ঠায় এক কবি জানিয়েছিলেন, তাঁর অতি পছন্দের মুগের ডাল আর আলুর খোসা ভাজা। শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায় ‘বাঙালির মাতৃপূজা’য় লিখেছিলেন, “ব্রহ্মপুত্রের মাদক পরিপ্রেক্ষিতে বেজে উঠল রণদামামার মতো ঢাক। বাজল কাঁসি। তার সঙ্গে মিশল এসে খিচুড়ি আর লাবড়ার গন্ধ।”

পুজোয় নিরামিষ খেতে এখনকার বাঙালির আগ্রহ নেই। বড়জোর অষ্টমী। বাকি ক’দিনে ইলিশ, পাঁঠা, মুরগি, তোপসে, ভেটকি, চিংড়ির অনায়াস চলাচল। এখনকার ট্রেন্ড অনুযায়ী বিরিয়ানি-মুগ্ধতাও ধরতে হবে। তবে পাঁঠা চিরকাল দর বাড়িয়ে রেখেছে পুজোর সময়ে। বিশেষ করে নবমীতে। ভোর-ভোর উঠে মাংসের দোকানের সামনে ফি বছরের ভিড়। এমন পাঁঠা-প্রীতি আগেও ছিল। ‘হুতোম প্যাঁচার নকশা’য় আছে, পঞ্চমীর প্রভাত হল আর ‘পাঁঠার রেজিমেন্টকে রেজিমেন্ট বাজারে প্যারেড কত্তে লাগলো’। ঈশ্বর গুপ্ত কি সাধে ‘পাঁটা’র গুণকীর্তন করে লিখেছিলেন, “ঝোলের সহিত দিলে গোটা গোটা আলু। /লক্ লক্ লোলো লোলো জিভ হয় লালু।”

পুজোর মাসে জঙ্গলমহলে ফোটে কাড়ান ছাতু। দুর্গাছাতু নামেও পরিচিত কাড়ান। বাঁকুড়া, পুরুলিয়া, বীরভূম, ঝাড়গ্রাম, মেদিনীপুরে বহু মানুষের প্রিয় এই ছাতু। এই সব জায়গায় ঘুরতে যাওয়া পর্যটকেরাও অনেকে কিনে আনেন দুর্গাছাতু।

মিষ্টি ছাড়া বাঙালি হয় না। মিষ্টি ছিল, আছে, থাকবেও। ১২৩০ সালে রাজকৃষ্ণ মিত্রের দুর্গোৎসবে এক মন রসকরার দাম ছিল ৯ টাকা। খাসা সন্দেশের মন ছিল ১৫ টাকা। ‘হুতোম প্যাঁচার নকশা’য় আছে, পঞ্চমী থেকেই ময়রারা ‘দুর্গোমোণ্ডা ও আগাতোলা সন্দেশের ওজন দিতে’ আরম্ভ করতেন। ষষ্ঠীতে রাজপথে প্রচুর পসরার সঙ্গে ‘দইয়ের ভাঁড়, মণ্ডার খুলি’ও বিক্রি হত। অর্থাৎ এগুলো খাওয়াও হত। কলাবৌ চান করানোর পরে আগমন্ডা তো থাকতই। থাকত সন্দেশও। কোথাও সন্দেশের বদলে গুড়। প্রতিমা বিসর্জন হত দই-কদমা ভোগ দিয়ে। ঘোল, মাখন, ভয়সা দই, মালাই দইওয়ালাদের চাহিদা বাড়ত পুজোয়।

উনিশ শতকে ‘পুজো আচ্চার সময় আগে ভেনের (ভিয়েনের) বামুনের তৈরি গজা নাড়ু দাঁড়িপাল্লায় ওজন দরে কেনা হত’। মহেন্দ্র দত্ত তাঁর লেখায় খাওয়াদাওয়ার বর্ণনা দিয়েছেন, ‘দুর্গাপুজোর সময়ে সকলকে মিষ্টিমুখ করানো হত’ উল্লেখ করেছেন। বিজয়ার দিন নারকেলছাবা দেওয়া হত। বিজয়ার কোলাকুলিতে সন্দেশ বা অন্য খাবার চলত না।

উনিশ শতকীয় পুজোর মিষ্টির তালিকা সংক্ষিপ্তই হল। রসকরা, আগমন্ডা, দুর্গামন্ডা, গজা ও নাড়ু, সাধারণ সন্দেশ, নারকেলছাবা, কদমা। বোঝা যায়, আগমন্ডার বাড়তি গুরুত্ব ছিল সেই সময়ে। হুতোম বারোয়ারি পুজোর বর্ণনায় লিখছেন, “মূল নৈবিদ্যির আগা তোলা মোণ্ডাটি ওজনে দেড় মন।” নৈবেদ্যের থালায় চালের স্তূপের উপরে আগমন্ডা আসত মোদকের বাড়ি থেকে।

সেই সময়ে নারকেলের কদর ছিল পুজোর মিষ্টিতে। চিনি ও নারকেলের যোগে একাধারে অনেকগুলি মিষ্টান্নের উৎপত্তি হয়েছে, যেমন নাড়ু, চন্দ্রপুলি, রসকরা। রসকরা হল অমৃতকেলি বা ‘নারিকেলক্ষীরী’। এগুলো পুজোয় প্রচলিত ছিল। রসকরার দিন এখন আর নেই। এখন বিজয়া সারতে আসা অতিথির প্লেটে নোনতা আর মিষ্টির বৈচিত্র দেখার মতো। নাড়ু, নারকেলছাবা কোণঠাসা। পরিবর্তন এসেছে নৈবেদ্যের আগমন্ডাতেও। এখন আগতোলা মন্ডাটি অনেক জায়গাতেই সন্দেশ নয়। নারকেল নাড়ুর উপকরণই শঙ্কু আকৃতির করে নৈবেদ্যের চুড়োয় বসিয়ে দেওয়া হয়। সন্দেশও থাকে নৈবেদ্যের উপরে। তবে তা শঙ্কু আকৃতির নয়। সাধারণ।

বিমল করের ‘সেই ধূপের গন্ধ’ স্মৃতিচারণে পুজোকালীন কিছু খাওয়ার কথা মেলে। মিষ্টিরও উল্লেখ আছে। তিনি লিখেছিলেন, “শালপাতার বাটি মতন ঠোঙা তৈরি করে খাবারগুলো হাতে হাতে এসে পৌঁছত আমাদের। পরোটা বা লুচি, কুমড়োর ছক্কা, নারকেল নাড়ু, চন্দ্রপুলি, সুজি। কয়লাকুঠিতে তখন সন্দেশ রসগোল্লার দোকান কোথায়!”

পুরনো কি কিছুই এখন অবশিষ্ট নেই? অবশ্যই আছে। বর্ধমানের মানকরের কদমার নাম রয়েছে। এই জেলারই ভাতারে মন্ডার চাহিদা সারা বছর। যে কোনও পুজোর সময়ে চাহিদা বাড়ে। দুর্গাপুজোতেও। ভাতারেরই বেলডাঙার মোদকেরা দাবি করেন, তাঁদের কদমা বেশ ভাল। মহেন্দ্রনাথ দত্ত লিখেছেন, পুজোর সন্ধ্যায় ছিল এক সরা করে জলপানের ব্যবস্থা। জলপান মানে চিঁড়ে, মুড়ি, মুড়কি ইত্যাদি জলখাবার।

লক্ষ্মীপুজোর মিষ্টিতে কিন্তু নাড়ুরই প্রাধান্য। নারকেলের, তিলের, ক্ষীরের। নৈবেদ্যে আগমন্ডাও দেওয়া হয়। বেশির ভাগ ক্ষেত্রে তা নাড়ুর উপকরণের। সন্দেশ নয়। তাই এ আর আগতোলা মন্ডা নেই। আগতোলা নাড়ু হয়ে গিয়েছে।

এক দিনের পুজো। তাই লক্ষ্মীপুজোয় খাবারের বৈচিত্র কম। যে বাড়িতে পুজো হয় সে দিন রাতে লুচি, ফুলকপির তরকারি, ঘুগনি, আলুর দম ইত্যাদি চলে। কোনও কোনও বাড়িতে খিচুড়ি ও অন্য তরকারি হয়। অনেকে খিচুড়ি করতে চান না চালের জন্য। চাল সিদ্ধ হলে ভাত। সকড়ি। তবে অনেক জেলার কিছু কিছু এলাকায় লক্ষ্মীপুজোরই প্রাধান্য থাকে। জাঁকজমক দুর্গাপুজোর মতোই। ওই এলাকায় বাড়িতে অতিথি সমাগম হয়। উৎসবের মেজাজে আর অতিথি সৎকারে খাবারে বৈচিত্র থাকে।

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement