Bengali Story

শতবর্ষ আগের দুই বিস্ফোরণ

বাস্তবে নয়, সাহিত্যের মাটিতে। একই বছর প্রকাশিত হয় এলিয়টের কবিতা ‘দ্য ওয়েস্ট ল্যান্ড’ ও জেমস জয়েসের উপন্যাস ‘ইউলিসিস’। সেটা ১৯২২ সাল। দুইয়ের বিরুদ্ধেই দুর্বোধ্যতার অভিযোগ। যৌনতার অভিযোগে নিষিদ্ধ হয় উপন্যাসটি। অথচ সেখান থেকেই আধুনিক সাহিত্যের সূর্যোদয়।

Advertisement

চিন্ময় গুহ

কলকাতা শেষ আপডেট: ২২ জানুয়ারি ২০২৩ ০৪:৫৩
Share:

অবিস্মরণীয়: জেমস জয়েস এবং টি এস এলিয়ট (ডান দিকে)। ছবি: গেটি ইমেজেস।

জেমস জয়েসের ‘ইউলিসিস’ বিশ শতকের সাহিত্যে এক বিস্ফোরক বর্ণমালা। জয়েসের হাতে আখ্যান এক অকল্পনীয় বিস্তারে পৌঁছল, যা অনুষঙ্গ, ব্যাপ্তি আর দুঃসাহসে রাবলে-র ‘গারগাঁতুয়া’ (১৫৩৪) এবং সেরভানতেস-এর ‘দন কিহোতে’ (১৬০৫)-কে স্মরণ করায়। একই বছরে প্রকাশিত এলিয়টের ‘দ্য ওয়েস্ট ল্যান্ড’-এর পর পাশ্চাত্যের কবিতার মানচিত্র সম্পূর্ণ বদলে গেল। একই বছরে দু’টি আণবিক বোমা খুলে দিয়েছিল হাজার দিগন্ত।

Advertisement

সেই বছরই প্রকাশিত হয় ভার্জিনিয়া উলফ-এর উপন্যাস ‘জেকব’স রুম’ এবং হেরমান হেসে-র উপন্যাস ‘সিদ্ধার্থ’। ১৯২২ সাল যেন হয়ে উঠছে ইউরোপের মডার্নিজ়মের ‘বিস্ময় বছর’।

তাঁদের আগের রচনাগুলিতে যেন এলিয়ট ও জয়েস ক্ষেত্র প্রস্তুত করছিলেন। ‘ইউলিসিস’ উপন্যাস ধারাবাহিক ভাবে বেরোয় ‘লিটল রিভিউ’ পত্রিকায়, ১৯১৮-র মার্চ থেকে ১৯২০-র ডিসেম্বর পর্যন্ত। বই আকারে বেরোয় ১৯২২ সালের ২ ফেব্রুয়ারি, জয়েসের চল্লিশতম জন্মদিনে। আর স্নায়বিক ভাবে বিপর্যস্ত এলিয়ট সুইটজ়ারল্যান্ডের লোজানে, এক স্যানাটোরিয়ামে ১৯২০ সালে লিখছিলেন এক এলোমেলো পাণ্ডুলিপি, ‘হি ডু দ্য পোলিস ইন ডিফারেন্ট ভয়েসেস’। সেই দীর্ঘ বিচ্ছিন্ন কবিতাংশগুলিকে বন্ধু এজ়রা পাউন্ড পুনর্নির্মাণ করেন। কবিতাটি ১৯২২ সালের অক্টোবর মাসে প্রকাশিত হয় এলিয়টের নিজের ‘দ্য ক্রাইটেরিয়ন’ পত্রিকায়, ও আমেরিকার ‘দ্য ডায়াল’-এ। ‘ইউলিসিস’ গ্রন্থাকারে প্রকাশ করেন প্যারিসের ‘শেক্সপিয়র অ্যান্ড কোম্পানি’-র সিলভিয়া বিচ। এলিয়টের কবিতাটি গ্রন্থাকারে প্রকাশ করেন লেনার্ড ও ভার্জিনিয়া উলফ।

Advertisement

জয়েসের চেতনাপ্রবাহের সুদূর সহযাত্রী ভার্জিনিয়া উলফ-এর মনে হয়েছিল, ‘ইউলিসিস’ হচ্ছে “আ কোয়েসি আন্ডারগ্র্যাজুয়েট স্ক্র্যাচিং হিজ় পিম্পলস”— স্নাতক স্তরের এক অসুস্থ, বিবমিষাপ্রবণ ছাত্র নিজের ব্রণ খুঁটছে। নিন্দুকেরা ‘দ্য ওয়েস্ট ল্যান্ড’-কে বলেছিল ‘ওয়েস্ট পেপার’। এমন ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া অপ্রত্যাশিত ছিল না। কিন্তু যা বিশেষ ভাবে প্রণিধানযোগ্য, তা হচ্ছে এলিয়টের সতীর্থ রিচার্ড অ্যালডিংটন-এর মনে হয়েছিল জয়েস হলেন ‘প্রফেট অব কেওস’ বা বিশৃঙ্খলার ঈশ্বরপ্রেরিত দূত।

জয়েসের উপন্যাস ডাবলিনের এক বসতিতে শুরু ও শেষ হচ্ছে একই দিনে, ১৯০৪ সালের ১৬ জুন। লেয়োপোল্ড আর মলি ব্লুমের জীবনের আঠেরোটি ঘণ্টা নিয়ে এক আগ্রাসী সৃজনময় গদ্যে রচিত এক অবিস্মরণীয় নির্মাণ। হোমারের ‘ওডিসি’-র ধাঁচে আঠেরো পর্বে বিভক্ত এই উপন্যাসের সঙ্গে হোমারের গ্রিক মহাকাব্যের প্রচুর মিল, প্রতিটি অধ্যায়ই ‘ওডিসি’-র কোনও না কোনও ঘটনা মনে করিয়ে দেয়। ওডিসিউসের চরিত্রের রোমান নাম ‘ইউলিসিস’। এর বিষয় ট্রয়ের যুদ্ধের পর ইথাকায় স্ত্রী পেনেলোপির কাছে ঘরে ফেরা। জয়েস নাকি চার্লস ল্যামের ছোটদের জন্য লেখা হোমারের ‘ওডিসি’-র সংক্ষিপ্ত রূপ ‘অ্যাডভেঞ্চারস অব ইউলিসিস’-এ গ্রিক যোদ্ধা ইউলিসিসের কাহিনি পড়ে বিদ্যুৎস্পৃষ্ট হন।

লেয়োপোল্ড ব্লুম যদি ইউলিসিস হয়, জয়েসের বিকল্প সত্তা স্টিফেন ডেডালাস তা হলে টেলিমাকাস, এবং ব্লুমের স্ত্রী ম্যারিয়ন হল পেনেলোপি। ডেডালাস খুঁজছে তার পিতাকে, আর ব্লুম তার পুত্রকে। উপন্যাস শেষ হচ্ছে পঁয়তাল্লিশ পৃষ্ঠার এক মনোলগ দিয়ে। যৌনতার বিশদ অনুপুঙ্খ দ্রুত এটিকে বিতর্কিত করে তোলে। অশ্লীল বলে চিহ্নিত এই প্রশস্ত চিত্রপট যেন সমকালের এপিক।

প্রথাবদ্ধ চিন্তাকে ভেঙেচুরে নতুন আঙ্গিকে উপস্থাপনার নমুনা চিত্রশিল্পে সেজ়ান, পিকাসো, ব্রাক-এর মতো শিল্পীরা দেখিয়েছিলেন, সাহিত্যে পথ দেখিয়েছিলেন বোদলেয়ার, লাফর্গ, টি ই হিউম, এজ়রা পাউন্ড। আধুনিকতাবাদের তুঙ্গমুহূর্তে শিল্প-সাহিত্যের নানা দিগন্ত গিয়েছিল মিশে, দেশসীমা পেরিয়ে এক ভাষা সেঁধিয়ে যাচ্ছিল অন্য ভাষার ধমনীতে। এলিয়ট প্রথম থেকেইতাঁর কবিতার কোথাও কোথাও ভিনদেশি ভাষা ব্যবহার করছিলেন। এলিয়ট ও পাউন্ড এই নতুন বহুসাংস্কৃতিক, বহুভাষিক ও বহুস্বর বয়ানের অগ্রনায়ক।

প্রথাবিরুদ্ধ কবি ও ঔপন্যাসিক দু’জনেরই নতুন বয়ানের ধর্ম শব্দ ভাঙা, শব্দ তৈরি করা, প্রাচীন ও সমকালীন ভাষা ও সাহিত্য থেকে অক্লেশে ধার করা। ‘দ্য ওয়েস্ট ল্যান্ড’-এ ইটালীয়, জার্মান, ফরাসি ও সংস্কৃত ব্যবহার করেছেন এলিয়ট। ‘ইউলিসিস’-এ কমিক, উদ্ভট ভাষাপ্রয়োগের মধ্যে লাতিন, গ্রিক, হিব্রু, ফরাসি, জার্মান, আইরিশ গ্যালিক, স্প্যানিশ, নরওয়েজীয় ও হিন্দি পর্যন্ত ব্যবহার করেছেন জয়েস। শব্দ ভেঙে নতুন উদ্ভট শব্দবন্ধ তৈরি করার আনন্দিত অভিযান-চিহ্ন ইতস্তত ছড়িয়ে রয়েছে।

‘ইউলিসিস’-এ সময়ের ভাঙচুরকে ধরতে এই ভাঙাচোরা কথন অনিবার্য ছিল। কখনও একটি বা দু’টি শব্দের বাক্য, ক্যাপিটাল লেটার, ইচ্ছানুরূপ কমা, যতিচিহ্নহীন দীর্ঘ বাক্য যা পাতার পর পাতা প্রবাহিত হয়, সাহিত্যের ইতিহাসে যার সমকক্ষ মেলা ভার। এর মধ্যে এমন এক গা-ছাড়া ভঙ্গি রয়েছে, আঠেরো শতকের প্রথাবহির্ভূত উপন্যাস লরেন্স স্টার্নের ‘ট্রিস্টাম শ্যান্ডি’ ছাড়া যা বেশি চোখে পড়ে না। এলিয়টের মতোই কথকতার রাজনীতির গোড়া ধরে নাড়িয়ে দিয়েছিলেন জয়েস।

কেমন ছিল সমকালীন দুই লেখকের সম্পর্ক? ১৯২৩ সালে ‘দ্য ডায়াল’ পত্রিকায় প্রকাশিত সমালোচনায়, ‘ইউলিসিস’ হল ‘সমকালের সর্বশ্রেষ্ঠ অভিব্যক্তি, যার কাছে আমরা সকলে ঋণী’। এই বই তাঁকে দিয়েছে যুগপৎ ‘বিস্ময়, আনন্দ আর ত্রাস’। এলিয়ট জয়েসের রচনা-পদ্ধতির তাৎপর্যের দিকে অঙ্গুলিনির্দেশ করেছেন— যেখানে ‘ওডিসি’-র সমান্তরাল বয়ান নির্মিত হয়েছে প্রতিটি অংশে যথোপযুক্ত শৈলী আর প্রতীক ব্যবহার করে। তাঁর মতে, হোমারের ‘ওডিসি’-র সমান্তরাল ব্যবহার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। মিথ ব্যবহার করে জয়েস এমন পদ্ধতিতেবর্তমান এবং অতীতকে জ্যা-যুক্ত করেছেন যা ‘উত্তরসূরিদের কাছে অনুসরণযোগ্য’।

এ যেন ‘দ্য ওয়েস্ট ল্যান্ড’-এর কবির আত্মকথা, যা তাঁর নিজের মিথ নির্মাণের পদ্ধতির ওপর আলো ফেলে। মনস্তত্ত্ব, এথনোলজি এবং জেমস ফ্রেজ়ার-এর নৃতাত্ত্বিক গ্রন্থ ‘দ্য গোল্ডেন বাও’ তাঁকে এই মিথ পুনর্নির্মাণে সাহায্য করে। এলিয়টের মতে, ‘বর্ণনাত্মক’ পদ্ধতির পরিবর্তে এখন ব্যবহৃত হবে এক ‘মিথিক’ পদ্ধতি, যা এই বিশৃঙ্খল পৃথিবীতে শৃঙ্খলা ও বিন্যাসের দিকে সৃজনকে নিয়ে যাবে। ইয়েটস এ বিষয়ে এলিয়ট-জয়েসের পূর্বসূরি। এলিয়টের কিছু এসে যায় না যদি ‘ইউলিসিস’-কে ‘উপন্যাস’ না বলে ‘মহাকাব্য’ বলা হয়, যত ক্ষণ তা হয়ে থাকে পিচ্ছিল যৌনতাসর্বস্ব পৃথিবীতে এক মিথিক অনুসন্ধান।

সাংস্কৃতিক কাঠামো, মিথ, বয়ান বা ভাষ্য, এবং বৌদ্ধিক শৃঙ্খলাকে নিয়ে খেলা করে জয়েস আধুনিক যুগে পুনর্লিখন করেন ঘরে ফেরার প্রাচীন গাথা। অর্থাৎ আধুনিক অর্থে মানুষের ঘর, যা শূন্যতার মধ্যে এক নির্মাণ। মিথ তো বহুমাত্রিক, তা হতে পারে হারানো অন্বয় আর বিন্যাসের জন্য নস্টালজিয়া, নতুন দ্যোতনা তৈরির উৎকণ্ঠা।

‘দ্য ওয়েস্ট ল্যান্ড’-এর চতুর্থ অংশে বুদ্ধবচনের অনুসরণে ‘দ্য ফায়ার সারমন’ এবং শেষে ‘হোয়াট দ্য থান্ডার সেড’ অংশে বৃহদারণ্যক উপনিষদের উদ্ধৃতি ও শান্তিমন্ত্র পাশ্চাত্যের এক যন্ত্রণাদীর্ণ সত্তার প্রাচ্যের দিকে বাড়িয়ে দেওয়া হাত তুলে ধরে, একই বছরে প্রকাশিত হেরমান হেসে-র ‘সিদ্ধার্থ’-র মতো।

যৌনতার বিশ্বযুদ্ধ-পরবর্তী অভিব্যক্তির ক্ষুরধার প্রকাশ দু’টি রচনারই বৈশিষ্ট্য, যেখানে ক্লিন্নতা আর আনন্দ ঢেউয়ের মতো মিশে। এক অনুর্বর সময়ে মানবিক সম্পর্কের ধস বোঝাতে এলিয়ট ‘দ্য ওয়েস্ট ল্যান্ড’-এ কয়েকটি দম বন্ধ করা নঞর্থক ছবি তুলে ধরেছেন, প্রেম পরিণত হয়েছে যান্ত্রিক পাশবিকতা, ও অপরাধী প্রেমে।

অন্য দিকে, লেখা শেষ হওয়ার আগেই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে অশ্লীলতার অভিযোগে নিষিদ্ধ হয় ‘ইউলিসিস’। ‘নজিকা’ অধ্যায়ে ব্লুমের স্বমেহনের বর্ণনা, শরীরের খুঁটিনাটির বিবরণ, এমনকি মলত্যাগের কথা, সংলাপে লেয়োপল্ড ব্লুমের গণিকালয়ে যাওয়া, নাভির বিবরণ, যৌনাঙ্গের বিবরণ, মার্থার যৌনতাসিক্ত চিঠি, এ রকম শ’খানেক উদাহরণ দেওয়া যায়।

উল্লেখ্য যে, নারীর শ্লীলতা রক্ষার জন্য বইটি নিষিদ্ধ করা হলেও নারীরাই ছিলেন (প্রকাশক সিলভিয়া বিচ, স্ত্রী নোরা, স্পনসর: হ্যারিয়েট শ’ উইভার) এটির প্রধান পৃষ্ঠপোষক।

ইংরেজি ও বাংলা সাহিত্যে ‘দ্য ওয়েস্ট ল্যান্ড’-এর প্রভাব সর্বব্যাপী। জীবনানন্দ দাশ, সুধীন্দ্রনাথ দত্ত, বিষ্ণু দে, সমর সেন প্রমুখ কমবেশি নিজেদের পুনর্নির্মাণ করেছেন। কিন্তু জয়েসের মতো ঐশ্বরিক দক্ষতায় মিথের বয়ান চুরমার এবং পুনঃস্থাপন করা প্রায় দুঃসাধ্য ছিল। বুদ্ধদেব বসু তাঁর ‘তিথিডোর’ উপন্যাসে, ধূর্জটিপ্রসাদ মুখোপাধ্যায় ‘অন্তঃশীলা’-য় এবং জীবনানন্দ ‘মাল্যবান’ ও অন্যান্য উপন্যাসে কিছু শৈলী অনুসরণ করেছেন মাত্র, কিন্তু সেই মিথে দাঁত বসানো তাঁদের সাধ্যাতীত, তার প্রয়োজনও ছিল না। কাজেই কোনও তুলনা অনুচিত হবে।

আজও প্রতি বছর ১৬ জুন ‘ব্লুমসডে’-তে লেয়োপোল্ড ব্লুমকে স্মরণ করে পাঠকেরা উৎসব করেন। সে দিনই জয়েসের সঙ্গে প্রেমিকা ও পরে স্ত্রী নোরার দেখা হয়েছিল। মনে হয়, একশো বছর আগের বিস্ফোরক বর্ণমালা দু’টির মুখোমুখি হওয়ার জন্য ঢাল-তরোয়াল নিয়ে আমরা যেন সবেমাত্র প্রস্তুত হচ্ছি। এখনই শুরু হবে আমাদের পড়া।

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement