স্বতন্ত্র: সুমিত্রা সেন
কুমোরটুলি। ধ্রুপদী, ডাকের সাজের লাবণ্যময়ী মা সরস্বতীকে খুঁজছে স্মাৰ্টফোনে নিমজ্জিত বা নির্বাসিত এখনকার স্কুলপড়ুয়ারা। কাঠামোর উপর রূপটানের কাজ চলছে। প্রস্তুতি দেখতে ক্লাস ফাঁকি দিয়ে চলে এসেছে ওরা। বড় ক্লাসের এক দিদি বলে, “আমরা চাইছি ধ্রুপদী হলেও মুখটা যেন খুব সুইট হয়। দেবী-দেবী ভাব চাইছি না।” হঠাৎ কোথাও এফএম রেডিয়োয় বেজে উঠল একেবারে বেখাপ্পা ঋতুর গান, ‘মেঘ ছায়ে সজল বায়ে/ মন আমার উতলা করে সারা বেলা...’। কে এক জন বললেন, “সুমিত্রা সেন চলে গেলেন।” আর এক জন তার মাঝেই স্বগতোক্তির মতো জানান, “এই গানের প্রতিমার মতো ঠাকুর চাইছি আমরা। সব ব্যাকরণ থাকবে, শৈলী থাকবে, কিন্তু টোটাল এফেক্ট যেন খুব আধুনিক আর এলিগ্যান্ট হয়।”
লুপ্ত হাসির সুপ্ত বেদনার ‘মেঘ ছায়ে’ বাজছে। তার পরই ‘মোর সন্ধ্যায় তুমি’। আঠার মতো আটকে থাকে কান। এ কী গান গেয়েছেন শিল্পী! বকুলমালার এমন দরদি প্রচ্ছদ বাঙালি আর কারও কণ্ঠে পেয়েছে কি? যেমন দরদি, তেমনই স্বরলিপিনিষ্ঠ। ওঁর চিরদিনের সেই হাসিটির মতো। এত দিনের শিক্ষকতা জীবনের শ্রমক্লান্তি সেই হাসিকে রুক্ষ শুষ্ক করতে পারেনি।
এখানেই শিল্পীর জিত। খুব হাসতেন রবীন্দ্রনাথের গান কেউ বিকৃত করে গাইলে। টিভিতে এক মহিলা প্রায় উন্মাদের মতো গেয়ে চলেন বিকৃত সুরে রবীন্দ্রসঙ্গীত। সুমিত্রাদি তারও শ্রোতা। বলতেন, “মজা না দেখে ওকে কেউ সুষ্ঠু ভাবে গাওয়াটা তো দেখিয়ে দিতে পারে!” এখানেই সুমিত্রা সেন অন্য রকম। নেতিবাচক ভাবকে আমল দেননি কোনও দিন। তাই দুঃখের গানেও সদর্থক সেই অমলিন কণ্ঠ। ‘আমার সকল দুখের প্রদীপ’ রেকর্ডিংটির কথাই ধরা যাক। অযথা লয় ফেলে গানকে ব্যথাতুর রূপ দেওয়ার একটা চেষ্টা থাকে এ গানে। সুমিত্রা সেন সেই লয়ে গানটি ধরেননি। অস্তরবির ছবির সঙ্গে পূজার হোমানলকে মিলিয়ে দিয়েছেন কণ্ঠের আপাত ললিত দৃঢ় প্রজ্ঞায়। তাই ব্যথার পূজা যেন হাজার দুঃখের মাঝেও অন্যতর এক প্রতিজ্ঞার কথা বলে।
এই আলাদা হয়ে থাকাটাই ওঁদের সময়ে সাধনার অন্যতম লক্ষ্য ছিল। মায়া সেন হয়ে বনানী ঘোষ, বাণী ঠাকুর, অদিতি সেনগুপ্ত, সুমিত্রা রায়, গীতা ঘটক, পূর্বা দাম, ঋতু গুহ, সুমিত্রা বসু, স্বপ্না ঘোষাল, বন্দনা সিংহ এবং সে সময়ের জনপ্রিয় বাকি সকলেই রবীন্দ্রসঙ্গীতের একই পাখি। কিন্তু বর্ণে, চলনে একে অপরের থেকে আলাদা। বোঝা যায় কেন ঋত্বিক ঘটক জ্যোতিরিন্দ্র মৈত্রকে নির্দেশ দেন ‘কোমল গান্ধার’ ছবিতে সুমিত্রা সেনকে দিয়ে গাওয়াতে।কেন গৌরীপ্রসন্ন মজুমদারের ট্রানজিস্টার সেট-এ গলা শুনে উত্তমকুমার ফোন করে গান গাওয়ার আবদার জানান তাঁকে। কেনই বা দেবব্রত বিশ্বাস আকাশবাণীতে গান শুনে উদ্বেল চিত্তে লিখে ফেলেন চিঠি, “আপনার গান শুনে মনে হচ্ছে আমিই যেন গাইছি।”
যেমন, ‘আজ জ্যোৎস্নারাতে সবাই গেছে বনে’। সুপ্রিয়া চৌধুরীর ঠোঁটে, ঋত্বিক ঘটকের ‘কোমল গান্ধার’ ছবির গান। বহতা নদীর মতো গায়ন। এ গান তো অবিস্মরণীয় কণিকা বন্দ্যোপাধ্যায় আর গীতা ঘটকের কণ্ঠে। গীতা গানের বাক্প্রতিমাকে নাটকের সংলাপের মতো দৃশ্যমান করেন, কণিকা সেখানে অন্তর্গত এবং একান্ত ব্যক্তিগত উচ্চারণে অনন্যা। পাশাপাশি সুমিত্রার গান আর সুপ্রিয়া চৌধুরীর চাহনির যে সহজ জোড়, এই নির্মাণে তা আগের দু’টি পরিবেশনের থেকে আগাগোড়া আলাদা। অথচ সুর এক, বাণী এক, তাল এক। কিন্তু নিজস্বতায় আলাদা। আজকের রবীন্দ্রসঙ্গীতে এই নিজস্বতা ডোডো পাখির মতো। সেখানেই সুমিত্রা সেন আরও প্রাসঙ্গিক।
এক পা এগিয়ে বলি, সুমিত্রার দুই কন্যাও মায়ের ধারা অক্ষুণ্ণ রেখেছেন। ‘শ্বেতপাথরের থালা’ ছবিতে ‘আমার প্রাণের পরে চলে গেল কে’ এবং সুমিত্রাকণ্ঠে অবিস্মরণীয় ‘ভালোবাসি ভালোবাসি’ সাহসভরে গেয়েছেন ইন্দ্রাণী। কণ্ঠ আলাদা, প্রকাশ ভিন্ন। কিন্তু মায়ের কাছে নেওয়া পাঠ যে গানের রূপকল্প নির্মাণে বড় ভূমিকা নিয়েছে, গান শুনে তা ধরে ফেলা যায়। পরে ‘উৎসব’ ছবিতে ‘অমল ধবল পালে লেগেছে’ শুনিয়েছেন শ্রাবণী সেন। উচ্চারণ শুনে, শব্দের ধরা-ছাড়া শুনে স্পষ্ট বোঝা যায়, এ অনুভব ওঁর মায়ের কাছ থেকে ধার করা। আরও দু’কদম এগিয়ে এ-ও বলা অত্যুক্তি হবে না, লাবণ্য আর তৈরি-কণ্ঠের মিশেলে রবীন্দ্রগানে আজ জয়তী চক্রবর্তী যে জনপ্রিয়তা পেয়েছেন, তার সলতে পাকিয়েছেন কিন্তু সুমিত্রা সেনই। ব্যাকরণকে আপন চেতনার রঙে রাঙিয়ে নেওয়াই হল জাত-গাইয়ের অক্ষয় ধন। শ্রাবণী, জয়তী তা ধরতে পেরেছেন। সেই কারণেই অক্ষয় অব্যয় হয়ে থাকবে সুমিত্রা সেনের গান ও গায়কি।
কিন্তু ধন্দ জাগে অন্যত্র। দীর্ঘ সময় শিক্ষকতাও তো করেছেন এক কালে। বিশ্ববিদ্যালয় ছাড়াও ব্যক্তিগত অনেক ক্লাসে নিয়মিত দেখা গিয়েছে ওঁকে। এত সব সামলে কণ্ঠটিকে এমন তাজা রাখলেন কোন উপায়ে? ভাবতেই হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের উদাহরণ চলে আসে সামনে। বলতেন, “আগে দেখবে কোনটি তোমার গাওয়ার। যে গান গেয়ে নিজের ভাল লাগবে না, সে গান অপরকে শোনানো বা শেখানোর দরকার কী?” সুমিত্রাদির ‘ঘরেতে ভ্রমর এল’ থেকে শুরু করে ‘ওগো তোমার চক্ষু দিয়ে’ পর্যন্ত রবীন্দ্রসঙ্গীতের যে দীর্ঘ পরিক্রমা, সেখানে দেখা যাবে মিড়াশ্রয়ী শ্লথগমনের গানই কিন্তু পক্ষপাত পেয়েছে। স্বরলিপি ছাড়াও সব গানে জায়গা রয়েছে নিজস্ব ব্যক্তিত্ব যুক্ত করার। সেখানেই তাঁর শিল্পী-সত্তার জিত। ভানুসিংহের পদাবলী-র একাধিক গানে তার প্রমাণ আছে। শব্দবন্ধ তাঁর কণ্ঠে যেন নির্ভার বেনারসি পানমশলার মতো। ‘শাওন গগনে’ বা ‘সতিমির রজনী’ মন দিয়ে শুনলে বোঝা যাবে, ব্রজবুলি মৈথিলী শব্দের উচ্চারণে দীর্ঘ এবং সযত্ন চর্চা করেছেন তিনি। তাই সুর এমন চমৎকার শব্দবন্ধের খাপে খাপে সেঁটে গিয়েছে অনায়াসে।
গান এ ভাবেই আপন হয়ে ওঠে। আপন না হলে তা ছবির গান হয়ে উঠবে কী করে? যাত্রিকের পরিচালনায় ‘কাঁচের স্বর্গ’ ছবিতে কাজল গুপ্তর লিপে ‘আগুনের পরশমণি’ মনে পড়ে? সময়ের বিচারে আশ্চর্য সংবেদনশীল সে গান। কিংবা মানবেন্দ্র মুখোপাধ্যায়ের সঙ্গীত পরিচালনায় ‘অনুষ্টুপ ছন্দ’? পীযূষ বসুর সে ছবিতে সুমিতা সান্যালের লিপে ‘চোখের আলোয় দেখেছিলেম’ সুমিত্রাদির নিজের প্রিয় গানের একটি। তবে নাম হয়েছিল বেশি সুচিত্রা সেনের লিপে ‘গৃহদাহ’ ছবির ‘এদিন আজি কোন ঘরে গো’ গানে। প্রায় সব প্রধান নায়িকার কণ্ঠেই গান আছে সুমিত্রা সেনের। আবার শুধু গানেও ছবি আঁকা যায়। সুমিত্রা সেনের বেসিক নানা গান তাই মিউজ়িক ভিডিয়ো না হয়েও সিনেমা। ‘সখী, ভাবনা কাহারে বলে’, ‘ভরা থাক স্মৃতিসুধায়’, ‘তুমি আমায় ডেকেছিলে’ যখন শোনেন শ্রোতা— সে গান ঘিরে ব্যক্তিগত অনুভূতির রঙে রাঙানো ছবি অবধারিত ভাবেই চোখে ভেসে ওঠে।
তিনি থাকবেন শুদ্ধ লাবণ্যময় সঙ্গীত ও শিষ্টাচারের প্রতীক হয়ে। গত বছর বাগদেবী-আরাধনার পর পরই আমরা হারিয়েছি লতা মঙ্গেশকর ও সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়কে। এ বছর তার আগেই জীবনদীপ নিভল আর এক প্রণম্যার। বহু গুণী ছাত্রছাত্রী তৈরি করেছেন, রেখে গিয়েছেন অজস্র রেকর্ড। ২০১২ সালে রবীন্দ্রসঙ্গীতে শেষ সঙ্গীত নাটক অকাদেমি পুরস্কার প্রাপক এই মানুষটির নব্বই বছরের জন্মদিন-উৎসব আগামী মার্চে। সাজো সাজো রব পড়ে গিয়েছিল। সে উৎসবের পূর্বমুখ ব্যথার পূজার ফুলে ঢাকা পড়ল।