পথিকৃৎ ছিলেন ভাঁওরি দেবী

রাজস্থানের গ্রামের নিরক্ষর মহিলা। বাল্যবিবাহ আটকাতে চাওযায় গণধর্ষিতা। তার পর অসম লড়াই, পুলিশ থেকে আদালত— কেউ পাশে নেই। তবু দমে যাননি তিনি। তাঁর লড়াইয়ের ফলেই তৈরি হয়েছিল বিশাখা গাইডলাইনস। #মিটু কেবল বিদেশ থেকে আসা ঝড় নয়। টুইটার, ফেসবুকে প্রতিবাদী লগ্নের আড়াই দশক আগেই লড়াই করেছিলেন সেই দেহাতি মহিলা।রাজস্থানের গ্রামের নিরক্ষর মহিলা। বাল্যবিবাহ আটকাতে চাওযায় গণধর্ষিতা। তার পর অসম লড়াই, পুলিশ থেকে আদালত— কেউ পাশে নেই। তবু দমে যাননি তিনি। তাঁর লড়াইয়ের ফলেই তৈরি হয়েছিল বিশাখা গাইডলাইনস। #মিটু কেবল বিদেশ থেকে আসা ঝড় নয়। টুইটার, ফেসবুকে প্রতিবাদী লগ্নের আড়াই দশক আগেই লড়াই করেছিলেন সেই দেহাতি মহিলা।

Advertisement

শিশির রায়

শেষ আপডেট: ০৩ নভেম্বর ২০১৮ ২২:৩৭
Share:

দৃষ্টান্ত: ভাতেরি গ্রামে নিজের বাড়িতে ভাঁওরি দেবী। ছবি: গেটি ইমেজেস

জয়পুর থেকে তিরিশ মাইলেরও বেশি পথ ভাতেরি গ্রাম। গ্রামে উঁচু জাতের, অবস্থাপন্ন ‘গুজ্জর’দেরই আধিপত্য, আর আছে নিচু জাত ‘কুম্‌হার’রাও। কুম্‌হাররা পেশায় কুমোর, তাদের বানানো মাটির হাঁড়ি-মটকা কেনে গুজ্জররা, পয়সা দেয় কি দেয় না। তবে একটা ব্যাপারে উঁচু-নিচু সব জাত সমান, সে হল বাল্যবিবাহ। গ্রামেরই এক কুম্‌হার-পরিবারের বউ ভাঁওরি দেবীর বিয়ে হয়েছিল কত বয়সে, মনে নেই তাঁর নিজেরও। এক বর্ণ লিখতে-পড়তে জানেন না, বয়সও বলতে পারেন না।

Advertisement

এই কাহিনি ছাব্বিশ বছর আগে, ১৯৯২ সালের। দিনটা ২২ সেপ্টেম্বর। খেতে কাজ করছিলেন ভাঁওরি দেবী ও তাঁর স্বামী মোহনলাল। বিকেল একটু একটু করে ঢলছে সন্ধের দিকে। হঠাৎ মাটি ফুঁড়ে উদয় হল গ্রামের পাঁচ জন। চার গুজ্জর— গেরসা, বদ্রি, রামসুখ, রামকরণ; আর এক ব্রাহ্মণ— শ্রাবণ পাণ্ডা। সবাই লাঠিপেটা শুরু করল মোহনলালকে। সঙ্গে অশ্রাব্য গালিগালাজ। ভাঁওরি দৌড়ে এসে বাধা দিতে গেলেন, কিন্তু পাঁচ পুরুষপুঙ্গবের কাছে তাঁর জোর তো নস্যি! মুহূর্তে রক্তাক্ত, প্রায়-অচৈতন্য মোহনলাল। স্বামীটি তো উপলক্ষ, আসলে ওদের নজর ছিল ভাঁওরি দেবীর দিকেই। রামকরণ, রামসুখ ও শ্রাবণ মাটিতে ফেলে হাত-পা চেপে ধরল, গেরসা আর বদ্রি পরপর ধর্ষণ করল ভাঁওরি দেবীকে। হতবল মোহনলাল দেখলেন শুধু, বাধা দেওয়ার শক্তিটুকুও তাঁর ছিল না!

কেন এই ধর্ষণ? আশির দশকের মাঝামাঝি থেকেই ভাঁওরি দেবী রাজস্থান সরকারের নারী উন্নয়ন প্রকল্পে আড়াইশো টাকা মাসমাইনের ‘সাথিন’। তাঁর কাজ গ্রামের ঘরে ঘরে গিয়ে মহিলাদের (সেই সূত্রে পুরুষদেরও) বোঝানো, বাল্যবিবাহ খারাপ, গ্রামে উপযুক্ত শৌচ-ব্যবস্থা চাই, মেয়েদের অধিকারটুকু বুঝে নিতে হবে, ইত্যাদি। নিজের এই অকিঞ্চিৎকর জীবনেই ভাঁওরি বেশ বুঝে গিয়েছিলেন প্রত্যন্ত এই গ্রাম্য সমাজের কিলবিল ভুলগুলো। তাঁর নিজের ছেলেমেয়েরও বিয়ে হয়ে গিয়েছে ছোট থাকতেই। নেহাত ভাঁওরির স্বামী, রিকশাওয়ালা মোহনলাল ভালমানুষ, অন্য গুজ্জর বা কুম্‌হারদের মতো উঠতে-বসতে বউকে পেটায় না, তাই ভাঁওরি একটু ভাল আছেন। এ লোকটা বউয়ের ঘরের বাইরে বেরোনো, কাজ করাও মেনে নিয়েছে।

Advertisement

কিন্তু যে মানুষটা গ্রামের ‘সাথিন’, সে বাল্যবিবাহ মানবে কী করে! ‘আখা তিজ’, মানে অক্ষয়তৃতীয়া তিথিতে রাজস্থানের গ্রামে গ্রামে সে সময় ব্যাপক হারে বাল্যবিবাহ হত। সে বছর আগে থেকেই সরকার সাথিনদের বলেছিল: যে করেই হোক বাল্যবিবাহ থেকে মুখ ঘোরাতে হবে গ্রামের মানুষের। সোজা কথায় কাজ না হলে প্রকল্পের ‘দিদি’দের জানাবে, তাঁরা প্রশাসনকে বলে পুলিশ ডাকবেন। ভাঁওরি দুটো বাল্যবিবাহ ঠেকাতে নেমে পড়লেন; গ্রামের পয়সাওয়ালা গুজ্জর রামকরণের মেয়ের বিয়ে (যার বয়স তখন এক বছরও পেরোয়নি!), আর একটা নিজের বাড়িতেই নাবালক দেবরের! অক্ষয়তৃতীয়ায় রামকরণের বাড়িতে পুলিশ এল। বিয়ে সে দিনের মতো বন্ধ হল, বরপক্ষের মুখ লাল আর রামকরণের মুখ কালো হল। দুধের শিশুকন্যাটির বিয়ে যদিও আখেরে ঠেকানো যায়নি। পরের দিনই হয়েছিল। আগের রাতে ধমকি দিয়ে যাওয়া পুলিশ পরের দিন লাড্ডুও খেয়ে গিয়েছিল আমন্ত্রিত হয়ে। কিন্তু বিয়ে মিটতে রামকরণের রাগ গিয়ে পড়ল ভাঁওরির উপরে। ‘‘বদলা নেব এর, তৈরি থাকিস,’’ হুমকি পেয়েছিলেন ভাঁওরি দেবী। ২২ সেপ্টেম্বরের ধর্ষণ সেই বদলারই প্রতিশব্দ!

এর পরের ঘটনা হতেই পারত ধর্ম-বর্ণ-পেশা-সামাজিক অবস্থান নির্বিশেষে ভারতীয় নারীর লজ্জা লুকিয়ে রাখার, কান্না গিলে ফেলার, আজীবন দগ্ধ হওয়ার চিরচেনা আখ্যান। কিন্তু রাজস্থানের অজ গ্রামের ‘আনপড় অউরত’ ভাঁওরি দেবী যে ইতিহাসের অভিমুখ পাল্টে দিয়ে, নিজেও হয়ে উঠবেন ইতিহাস, তা কে জানত! সে দিন যা যা হয়েছিল, পরের সকালেই জানালেন আত্মীয়-পরিজনদের। কিন্তু সবাই ডরপুক, প্রভাবশালী ও সংখ্যাগরিষ্ঠ গুজ্জরদের বিরুদ্ধে কে কী করবে? ভাঁওরি জানালেন নারী উন্নয়ন প্রকল্পের দিদিদের, যাঁরা এর পর থেকে হয়ে উঠবেন দীর্ঘ লড়াইয়ে তাঁর সহ-সাথিন। প্রাথমিক স্বাস্থ্যকেন্দ্রে গেলে ডাক্তার পরীক্ষা করলেন না, মহিলা ডাক্তার নেই বলে। অন্য হাসপাতালে রেফার করলেন, তাও ধর্ষণ হয়েছে কি না সেই পরীক্ষার জন্য নয়, নোটে লেখা— ‘বয়স পরীক্ষার জন্য’! যতক্ষণে পরীক্ষা হল, তার মধ্যে পেরিয়ে গেছে ৫২ ঘণ্টা, স্বাভাবিক শারীরবৃত্তীয় কারণেই অনেক প্রমাণ ততক্ষণে অন্তর্হিত। থানায় গেলে সইতে হল পুলিশ, এমনকি মহিলা পুলিশেরও টিটকিরি: কে করেছে? কী করেছে? কেমন করে করল বল তো? থানায় ওরা ভাঁওরির পরনের দোমড়ানো, ভেজা ঘাগরাটা খুলে রেখে দিল, অথচ পরার জন্য আর কিছু দিল না। মোহনলালের কাছে কাপড় ছিল এক টুকরো, তাই জড়িয়ে ঘরে ফিরলেন ভাঁওরি।

কিন্তু এ কোন ঘর? দেবরের বিয়ে না হওয়ায় শ্বশুর-শাশুড়ি এর মধ্যে সম্পর্ক ত্যাগ করেছেন ছেলে-বউয়ের সঙ্গে। গুজ্জররা শলা করে একঘরে করল ভাঁওরি-মোহনলালকে। ওদের হাঁড়ি-কলসি কেউ কিনবে না। ওদেরকে কেউ দুধ বেচবে না! তাঁরা স্বজাতি কুম্‌হারদের কাছে গেলেন, তাঁরাও উল্টা বুঝিলি রাম। গ্রামের পথে বেরোলেই কু-ইঙ্গিত, টিপ্পনী, গালাগাল, হুমকি। সময় ও পরিস্থিতি এই অবধি গড়ানোর আগেই কতশত মেয়ে আত্মহত্যা করে, খবরকাগজের অজস্র রিপোর্ট সাক্ষী। কিন্তু যে মেয়ে ইস্কুলে এক অক্ষরও পড়েনি, ‘নারীবাদ’ আর ‘মানবাধিকার’-এর মতো শব্দগুলো যাঁর কাছে এক্কেবারে অজানা, সেই ভাঁওরি দেবী পথে নামলেন। গেলেন আদালতে।

প্রধান সংবাদমাধ্যমে ভাঁওরির খবর বেরোতে পেরিয়ে গিয়েছিল অনেকটা সময়। আর অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে পুলিশের চার্জশিট দিতে— পাক্কা এক বছর! এই পুরো সময়টায় ভাঁওরি আর মোহনলাল দেখেছেন, ক্ষমতা আর অর্থ হাত মিলিয়ে কেমন একা, বিপন্ন করে দেয় ন্যায়বিচারপ্রার্থী মানুষকে। যে জেলা ও দায়রা আদালতে বিচার চাইতে যাওয়া, সেখানেও তো ঘিনঘিনে প্রশ্ন সব। কে তোমার হাত-পা চেপে ধরেছিল? ধর্ষণের সময় তোমার পা দুটো কতটা... তোমার কি অগ্যার্জ়ম হয়েছিল? ঘাগরা ভিজে গিয়েছিল?

তিন বছর ধরে চলা মামলায় বিচারক পাল্টেছিল ছ’বার। তার পর? ১৯৯৫-এর ২৫ নভেম্বর আদালতের রায়ে বিনা প্রমাণে খালাস পেয়েছিল পাঁচ অভিযুক্তের প্রত্যেকেই! ভাঁওরি দেবী ও মোহনলালের সাক্ষ্যকে পাত্তাই দেওয়া হয়নি। ২৬-পাতার রায়ে ভারতের মহামান্য বিচারব্যবস্থার এক-একটা পর্যবেক্ষণ শুনলে তাজ্জব বনতে হয়। ‘যে পুরুষ অগ্নিসাক্ষী করে তাঁর স্ত্রীকে রক্ষার সংকল্প করেছে, সে তাঁর স্ত্রীকে ধর্ষিতা হতে দেখেও শুধু দাঁড়িয়ে থাকবে, কিছু করবে না, এ অসম্ভব।’ ‘অভিযুক্তদের মধ্যে চার জন গুজ্জর ও এক জন ব্রাহ্মণ; কিন্তু গ্রামাঞ্চলে দুষ্কৃতীরা সাধারণত মিশ্র জাতিগোষ্ঠীর হয় না, তাই এই অভিযুক্তদের পক্ষেও ধর্ষণের মতো অপরাধের সম্ভাবনা খাটে না।’ ‘ধর্ষণ করে অল্পবয়সি কিশোররা, অভিযুক্তরা তো মধ্যবয়স্ক, প্রৌঢ়।’ ‘ভারতের গ্রামীণ সমাজ এত নীচে নামেনি যে এক গ্রামবাসী বয়স আর জাতের মর্যাদা ঠেলে সরিয়ে কোনও মহিলার উপরে ঝাঁপিয়ে পড়বে।’ আদালতের মতে, এই মামলা নাকি ভারতীয় সংস্কৃতি আর মনস্তত্ত্বেরই বিরোধী!

ভাঁওরি এর পরেও হাই কোর্টে গেছেন। এত বছরে তাঁর মামলার শুনানি হয়েছে মাত্র একবার। ১৯৯২-এ সোশ্যাল মিডিয়া ছিল না, থাকলে হয়তো লাভ হত। তবে পাশে পেয়েছেন জয়পুর ও দিল্লির নারী সংগঠনগুলিকে, পরে সাধারণ মানুষকেও। ১৯৯৪-এ নীরজা ভানোট স্মৃতি পুরস্কার পেয়েছেন, ’৯৫-এ গিয়েছেন বেজিংয়ে রাষ্ট্রপুঞ্জের নারী সম্মেলনে। কিন্তু সবচেয়ে বড় কথা, তাঁর মামলার সূত্রেই ১৯৯৭-এ তৈরি হয়েছে যৌন হয়রানির মোকাবিলায় ‘বিশাখা গাইডলাইনস’, পরে ২০১৩ সালে যা রূপ পেয়েছে কর্মক্ষেত্রে নারীদের যৌন হয়রানি বিরোধী আইনে। আজকের #মিটু আন্দোলনের উৎস-সন্ধানে যাঁরা হলিউড তথা পশ্চিমমুখী, তাঁরা এক বার ফিরে দেখতেই পারেন ‘শ্রীমতী ভাঁওরি দেবী ভার্সাস দ্য স্টেট অব রাজস্থান’ মামলা। ভাঁওরি ইংরেজি জানেন না বলে #মিটু লেখেননি বটে, ইতিহাসই লিখে গিয়েছেন!

শিক্ষা থেকে সাহস আসে। কিন্তু আপনি এত সাহস কোথা থেকে পেলেন? উত্তরে বলেছিলেন, ‘‘আমি যদি সুবিচার না পাই, তা হলে আমার চেয়েও দুর্বল যে মেয়েরা, তারা কোথায় যাবে?’’

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement