শিল্পী: পরিচালকের চোখ হয়ে দৃশ্য নির্মাণ করার আশ্চর্য ক্ষমতা ছিল বংশী চন্দ্রগুপ্তের।
জীবনের শেষ দশটা বছর বংশী চন্দ্রগুপ্ত কাজ করেছেন মুম্বইয়ে। হিন্দি ছবির সেই ইন্ডাস্ট্রিতে, যা বলিউড নামে পরিচিত। কাশ্মীরের ভূমিপুত্র বংশী যেমন তাঁর জীবনের সবচেয়ে বেশি সময়টা আপন করে নিয়েছিলেন বাংলাকে, বলিউডও তাঁকে আপন করতে ছাড়েনি। ভারতীয় ছবির শিল্প নির্দেশনার ইতিহাসে বংশী চন্দ্রগুপ্ত সেই উজ্জ্বলতম জ্যোতিষ্ক, যাঁর দীপ্তি এতটুকু ম্লান হয়নি। বংশী চন্দ্রগুপ্ত আগামী ৬ ফেব্রুয়ারি শতবর্ষ পূর্ণ করবেন বটে, কিন্তু তাঁর কাজ একটুও সেকেলে হয়ে যায়নি। আজকাল শিল্প নির্দেশনা বা আর্ট ডিরেকশনের বদলে প্রোডাকশন ডিজ়াইন বলার চল হয়েছে। সেই কাজের সঙ্গে জড়িয়ে থাকা আমরা প্রতি পদে বাস্তবমুখী বা রিয়ালিস্টিক কাজ করার কথা বলে থাকি। বংশী চন্দ্রগুপ্ত সেটাই অর্ধশতক আগে করে দেখিয়েছেন। বলা যেতে পারে, ওঁর দেখানো পথ ধরেই আমরা এগিয়ে চলেছি।
বংশী চন্দ্রগুপ্তের সঙ্গে মুখোমুখি দেখা হওয়ার সুযোগ আমাদের হয়নি। আমরা বলিউডে বিখ্যাত শিল্প নির্দেশক সমীর চন্দের সহকারী হিসেবে কাজ শুরু করি ২০০০ সালে। সমীরদার মুখে কিন্তু আমরা সব সময় বংশী চন্দ্রগুপ্তের কথা শুনতাম। সমীরদাই বার বার জোর দিয়ে বলতেন, বলিউডে তখন আমরা যে ধরনের কাজ করতে চাইছি, সেটা বংশী চন্দ্রগুপ্ত আগেই করে গিয়েছেন। যেমন সমীরদা আমাদের সব সময় বলতেন ‘উমরাও জান’ (পরিচালনা মুজফফর আলি) ছবিটার কথা। বলতেন, এটা দেখে সবার শেখা উচিত যে বলিউডেও এই মাপের কাজ করা যায়। পরে যখন আমরা সঞ্জয় লীলা ভন্সালীর সঙ্গে কাজ করতে গেলাম, তখন ওঁকেও বার বার বংশী চন্দ্রগুপ্তের কথা, ‘উমরাও জান’-এর কথা বলতে শুনেছি।
ঘটনাচক্রে, বংশীর সঙ্গে একই সময়ে কাজ করেছেন, এমন এক জনের সঙ্গে আমরা এখন একটা কাজ করছি। আমির খানের প্রযোজনায় রাজকুমার সন্তোষী একটা ছবি করছেন, তাতে আমরা প্রোডাকশন ডিজ়াইন করছি। কী কাকতালীয় ব্যাপার! সেই কাজের প্রসঙ্গে কথায় কথায় বংশী চন্দ্রগুপ্তের কথা উঠেছিল। রাজকুমার বললেন, উনি আশির দশকে একটা ছবিতে সহকারী পরিচালনার কাজ করছিলেন, যে ছবিতে শিল্প নির্দেশনা করেছিলেন বংশী চন্দ্রগুপ্ত। বংশীর কাজে মুগ্ধ হয়ে রাজকুমার তাঁরও সহকারী হয়ে উঠেছিলেন প্রায়। রবীন্দ্র ধর্মরাজ পরিচালিত সেই ছবির নাম ‘চক্র’। রাজকুমার বলছিলেন, ওই ছবিতে বংশী চন্দ্রগুপ্তের কাজ দেখে খুব ইচ্ছে হয়েছিল কোনও দিন ওঁর সঙ্গে কাজ করার। কিন্তু সেটা হয়ে ওঠেনি। অল্প কিছু দিন পরেই বংশী মারা যান। আমেরিকায় সত্যজিৎ রায়ের একটি রেট্রোস্পেকটিভ উপলক্ষে সেই প্রথম ওঁর বিদেশ যাওয়া। সেখানেই আকস্মিক মৃত্যু। শুনেছি, অভিন্নহৃদয় বন্ধু বংশীকে এ ভাবে হারিয়ে খুবই ভেঙে পড়েছিলেন সত্যজিৎ।
কম দিনের সম্পর্ক তো নয়! সুভো ঠাকুরের সঙ্গে কলকাতায় এসেছিলেন বংশী। তখন তাঁর পরিকল্পনা ছিল চিত্রশিল্পী হবেন। কিন্তু শেষ অবধি চলে এলেন ফিল্মে। চল্লিশের দশকের বাংলা ছবিতেই বংশীর হাতেখড়ি। ভাবলে আশ্চর্য লাগে, ইন্ডাস্ট্রিতে নবীন এই তরুণকেই জঁ রেনোয়া তাঁর ‘দ্য রিভার’ ছবির শিল্প নির্দেশনার জন্য বেছে নেন। সত্যজিতের সঙ্গে আলাপ অবশ্য আরও আগেই। সত্যজিৎ রায়, বংশী চন্দ্রগুপ্ত আর সুব্রত মিত্র— এই তিন বিস্ময়কর প্রতিভার সম্মিলনই ‘পথের পাঁচালী’ তৈরি করে বাংলা তো বটেই, ভারতীয় ছবির ইতিহাসও বদলে দিল।
‘পথের পাঁচালী’ বা ‘অপরাজিত’ দেখলে বোঝা যায়, শিল্প নির্দেশনা কী ভাবে সিনেমাকে বিশিষ্ট, স্বতন্ত্র করে তুলতে পারে। ‘দেবী’ ছবিতে বংশী চন্দ্রগুপ্তের কাজ দেখলে মনে হয় আমি নিজেই সিনেমার মধ্যে রয়েছি। একটা ছবি সর্বোচ্চ মানে যেতে গেলে পরিচালনা, ক্যামেরা, শিল্প নির্দেশনা— তিন ক্ষেত্রেই দুর্দান্ত সামঞ্জস্যের প্রয়োজন হয়। সত্যজিৎ রায়, সুব্রত মিত্র আর বংশী চন্দ্রগুপ্তের মধ্যে সেটা বার বার হয়েছে। যখন বংশী বাংলা ছবি করেছেন, একটা অদ্ভুত নান্দনিক বোধ ওঁর কাজে দেখা গিয়েছে। বাঙালি সংস্কৃতি আর গেরস্থালির যে খুঁটিনাটি উনি তুলে এনেছেন, দেখলে বিশ্বাস হয় না যে, জন্মসূত্রে উনি বাঙালি নন। ‘গুপী গাইন বাঘা বাইন’, ‘নায়ক’, ‘বাক্স বদল’, ‘মহানগর’— এই ছবিগুলো থেকে আমরা সব সময় শিখি যে কতটা বাস্তবমুখী ছিল ওঁর কাজ।
এখন আমরা অনেকে বলি, এটা বড় সিনেমা, ওটা ছোট সিনেমা। আসলে সিনেমা সবই এক। সিনেমার আবার বড়-ছোট কী! বংশী চন্দ্রগুপ্তের কাজ দেখলে সেটা খুব ভাল করে বোঝা যায়। উনি দেখিয়ে দিয়েছেন, রিয়ালিস্টিক জ়োনের ছবিও যেমন উনি করতে পারেন, তেমনই গ্ল্যামারাস কাজও করতে পারেন। বংশী চন্দ্রগুপ্ত সেই শিল্পী— যিনি ‘অপুর সংসার’-এর মতো আটপৌরে-বাস্তবধর্মী ছবিতেও সেরা, আবার ‘উমরাও জান’-এর মতো ছবিতেও অনন্য। আমাদেরও যখন আজ একই সঙ্গে ‘পদ্মাবত’ আর ‘তলওয়ার’-এর মতো ভিন্ন মেজাজের ছবির কাজ করতে হয়, বংশীই আমাদের কাছে অনুসরণীয় দৃষ্টান্ত হিসাবে থেকে যান।
দুটো বিষয়, যেটা আমাদের বা যে কোনও প্রোডাকশন ডিজ়াইনারেরই বংশী চন্দ্রগুপ্তের কাজ থেকে শেখা উচিত, সেটা হল সারল্য আর সততা। ‘লার্জার দ্যান লাইফ’ কাজও কিন্তু ‘সিম্পল’ হতে পারে। ‘সিম্পল’ মানে যেটাতে দর্শক নিজে ডুবে যাবে। যার মধ্যে একটা নাড়ির টান থাকবে। এমন বিরাট জাঁকজমকপূর্ণ কিছু বানালাম যার সঙ্গে দর্শক একাত্মই হতে পারল না, এমন হলে কিন্তু প্রোডাকশন ডিজ়াইন ব্যর্থ। কাজটা তখনই সফল হবে, যদি প্রোডাকশন ডিজ়াইনার সৎ হন। সৎ মানে ফিল্মের প্রতি সততার কথা বলছি। যেটা বংশী চন্দ্রগুপ্তের সব কাজে আমরা দেখতে পাই। যেমন ‘গুপী গাইন বাঘা বাইন’-এ উনি যে দরবারটা বানিয়েছিলেন, দেখলে মনে হয়, যেন দরবার ও রকম ছাড়া কিছু হতেই পারে না। এই যে দর্শকের মধ্যে এই ‘স্বাভাবিক ব্যাপার’ ধারণাটার জন্ম দেওয়া, এটাই জাদু। সেটা বংশী চন্দ্রগুপ্তের ছিল। যদি ‘উমরাও জান’ নিয়ে কথা বলি, সেখানে বলা যায়, ওই ছবিতে উনি রেখার যে ‘এসেন্স’ বা ‘ফিল’ তৈরি করেছিলেন, সেটাও ওই জাদু। বংশী চন্দ্রগুপ্তের সব কাজই তাই। কোথাও মনে হয় না কম দেখাচ্ছেন বা বেশি দেখাচ্ছেন।
প্রোডাকশন ডিজ়াইনারের কাছে সিনেমার শুরু থেকে শেষ— পুরোটাই গুরুত্বপূর্ণ। যেমন, ‘নায়ক’ ছবিটা। আমরা জানি যে ট্রেনের কামরার দৃশ্য ছবিতে ফুটিয়ে তোলা কতটা কঠিন। কেবল কামরাই নয়, প্রতিটি যাত্রীর সঙ্গে থাকা প্রতিটি জিনিসের দিকে নজর দিতে হয়। কোনও একটা দৃশ্য নিখুঁত করাই এখানে যথেষ্ট নয়। সিনেমা এমন একটা মাধ্যম যা দর্শককে ওই দুনিয়াটায় নিয়ে যায়। সিনেমা হলে দেখে মনে হবে আমি পাশে দাঁড়িয়ে দেখছি। ‘নায়ক’-এ সেটাই হয়, বংশী আমাদের সবাইকে ট্রেনের কামরায় ঢুকিয়ে দেন। বংশী চন্দ্রগুপ্তের কাজের আর একটা গুরুত্বপূর্ণ জিনিস বলা দরকার, সেটা হল ‘প্রপস’। ফিল্মের শুধু সেট বানালেই সব কিছু হয় না। একটা লং শটে এক বার সেটটা না-হয় দেখানো যায়, যে খুব ভাল সেট হয়েছে। কিন্তু বার বার তো লং শট হবে না। মিড শটের ক্ষেত্রে যদি প্রপস ঠিক না হয়, তা হলে শিল্প নির্দেশনা ফ্লপ। সেই দিক থেকেও বংশী চন্দ্রগুপ্ত সব ছবিতে একশোয় একশো। ‘নায়ক’-এ সেটাও বোঝা যায়। যাত্রীদের ব্যাগ, ছোট ছোট জিনিস, প্রত্যেকটা খুঁটিনাটি বংশী চন্দ্রগুপ্তের কাজকে অন্য মাত্রায় নিয়ে গিয়েছিল।
এখন বলিউডে যারা পুণে ফিল্ম ইনস্টিটিউট থেকে পড়ে প্রোডাকশন ডিজ়াইন-এ আসে, সকলকে বংশী চন্দ্রগুপ্তের কাজ নিয়ে পড়াশোনা করতে হয়। আর বলিউডের বিখ্যাত পরিচালকেরা তো আগেই বলেছি, সবাই ওঁর কাজের কথা বলেন। আমাদের আগে যাঁরা প্রোডাকশন ডিজ়াইন করেছেন, এখন করছেন, সকলেই কোনও না কোনও ভাবে বংশী চন্দ্রগুপ্তের কাজ অনুসরণ করেছেন। কারণ এটা একটা লেগ্যাসি, যেটা উনি তৈরি করে গিয়েছিলেন। যেমন আমরা যাঁর কাছে কাজ শিখেছি, সেই সমীর চন্দের ‘মান্ডি’, ‘জ়ুবেদা’ ছবিগুলো দেখলে বোঝা যায়, বংশী চন্দ্রগুপ্তের অনুপ্রেরণা সেখানে রয়েছে। থাকবে না-ই বা কেন? ‘মান্ডি’, ‘জ়ুবেদা’র পরিচালক শ্যাম বেনেগাল নিজে তো বংশীর অত্যন্ত গুণগ্রাহী। শ্যাম বেনেগালের ‘কলযুগ’ বলিউডে বংশী চন্দ্রগুপ্তের অন্যতম সেরা কাজ। বাসু চট্টোপাধ্যায়ের ‘মঞ্জিল’, ‘পিয়া কা ঘর’-এর মতো ছবিতেও বংশীর কাজের কথা বলিউডে এখনও অনেকে বলেন। রাজকুমার সন্তোষীই তো এই সে দিন ‘পিয়া কা ঘর’ ছবিটার কথা তুললেন। সঞ্জয় লীলা ভন্সালীর সঙ্গে কাজের সময় মনে আছে, ‘শতরঞ্জ কে খিলাড়ি’র দরবারটা আমরা পুরো টিম দশ বার করে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখেছিলাম। ভন্সালী ‘জলসাঘর’ ছবিতে বংশী চন্দ্রগুপ্তের কাজের রেফারেন্স খুঁজেছেন আমাদের কাছে।
আরও একটা জিনিস বলা দরকার। বংশী যখন কাজ করেছেন, তখন কিন্তু প্রোডাকশন ডিজ়াইনের জন্য এত কিছু চাইলেই পাওয়া যেত না এখনকার মতো। প্রযুক্তির রমরমা ছিল না, অনেক সামগ্রী পাওয়া যেত না। তাই বংশীর কাজ আরও অনেক কঠিন ছিল। সেই পরিস্থিতিতেও উনি সেরা পরিচালকদের সঙ্গে সব ধরনের ছবিতে কাজ করেছেন। বলা হয়, আর্ট ডিরেক্টর হল ছবির ক্ষেত্রে পরিচালকের চোখ। সেই চোখ হয়ে ছবিকে দেখতে পেয়েছেন বংশী। একটা মজার কথা বললে বোঝা যাবে, বংশী চন্দ্রগুপ্তকে আজও বলিউড কী চোখে দেখে। আমরা বিশাল ভরদ্বাজের ‘রেঙ্গুন’ ছবিটা করেছিলাম। ওই ছবির গল্পে একটা সিনেমা তৈরির প্রসঙ্গ ছিল। সেখানে এক জন শিল্প নির্দেশকেরও ছোট্ট উপস্থিতি ছিল, যে চরিত্রটা বংশী চন্দ্রগুপ্তের ছায়ায় নির্মিত। বিশাল বলেছিলেন, “সুব্রত, তোমাকে মেকআপ করালে বংশী চন্দ্রগুপ্তের মতো দেখতে লাগবে। তুমি ওই চরিত্রটা করো!” ভাবা যায়?
(লেখকদ্বয় হিন্দি ছবির প্রথম সারির প্রোডাকশন ডিজ়াইনার। ‘হায়দার’, ‘উড়তা পঞ্জাব’, ‘পদ্মাবত’, ‘রাজ়ি’, ‘গাঙ্গুবাই কাথিয়াওয়াড়ি’, ‘ডানকি’ ইত্যাদি ছবির শিল্প নির্দেশক)
সাক্ষাৎকার ও অনুলিখন: সুজিষ্ণু মাহাতো