শাড়ি পরে ক্যামেরা কাঁধে

ছবি তুলতেন ভারতের প্রথম মহিলা চিত্রসাংবাদিক হোমাই ভ্যারাওয়ালা। তিরিশ থেকে ষাটের দশকের বহু ঐতিহাসিক মুহূর্তের ছবি ক্যামেরাবন্দি করেছেন তিনি।ছবি তুলতেন ভারতের প্রথম মহিলা চিত্রসাংবাদিক হোমাই ভ্যারাওয়ালা। তিরিশ থেকে ষাটের দশকের বহু ঐতিহাসিক মুহূর্তের ছবি ক্যামেরাবন্দি করেছেন তিনি।

Advertisement

ঊর্মি নাথ

শেষ আপডেট: ১০ মার্চ ২০১৯ ০০:০০
Share:

ক্লিক: ক্যামেরা হাতে হোমাই ভ্যারাওয়ালা। ছবি: এএফপি

মে ১৯৫৬। সিকিমের নাথু লা । গৌতম বুদ্ধের ২৫০০তম জন্মদিন উপলক্ষে লাসা থেকে তিব্বতের ধর্মগুরু চতুর্দশ দলাই লামা তেনজিং গিয়াতসো ঘোড়ায় চেপে ভারতে আসছেন। সঙ্গে আসছেন আরও অনেকে। বুদ্ধগয়া-সহ নানা বৌদ্ধ তীর্থে যাওয়ার জন্য আমন্ত্রিত তাঁরা। গৌতম বুদ্ধকে নিয়ে বক্তৃতাও দেবেন তিব্বতি ধর্মগুরু।

Advertisement

দলাই লামা আসবেন হিমালয়ের কোলে ছোট্ট দেশ সিকিম হয়ে। সিকিম তখনও ভারতের অন্তর্ভুক্ত হয়নি। কিন্তু ব্রিটিশ আমল থেকেই নাথু লা তিব্বত ও ভারতের গুরুত্বপূর্ণ বাণিজ্যপথ।

সেই পথ দিয়ে আসছেন আমন্ত্রিত অতিথি। এ পারে হোমরাচোমরাদের ভিড়, তারই মাঝে এক জন মহিলার দিকে চোখ চলে যাচ্ছে উপস্থিত প্রায় সকলেরই। বড় একটা ক্যামেরা কাঁধে নিয়ে দাঁড়িয়ে আছেন তিনি। দলাই লামা ভারতে প্রবেশ করতেই তাঁর ক্যামেরায় শাটারের শব্দ। মেয়েটির নাম হোমাই ভ্যারাওয়ালা। ভারতের প্রথম মহিলা চিত্রসাংবাদিক।

Advertisement

শেষ বয়সের এক সাক্ষাৎকারে হোমাই বলেছিলেন, তাঁর তোলা সেরা ছবি কোনটা তা আলাদা করে বলা মুশকিল। কিন্তু প্রায়ই যে ছবি তোলার স্মৃতি তাঁর মনে পড়ে, তা চতুর্দশ দলাই লামারই!

১৯৪৭-এর ১৬ অগস্ট, লালকেল্লায় ভারতের পতাকা প্রথম উত্তোলন; মহম্মদ আলি জিন্নার ভারতে শেষ সাংবাদিক সম্মেলন; ১৯৪৮-এর ২৬ জানুয়ারি, রাষ্ট্রপতি ভবনে মাউন্টব্যাটেনের গান স্যালুট, রাষ্ট্রপতি ভবন থেকে সংসদ ভবনে যাওয়ার সময় বিজয় চকে জনস্রোতের মাঝে ঘোড়ার গাড়িতে মাউন্টব্যাটেন, কংগ্রেসের মিটিংয়ে খান আবদুল গফফর খানকে পাশে নিয়ে মহাত্মা গাঁধী, ১৯৫০–এ প্রজাতন্ত্র দিবসে দিল্লিতে প্যারেড, ১৯৫১ সালে দিল্লিতে এশিয়ান গেমসে মায়ের পাশে একই চেয়ারে ভাগাভাগি করে ছোট্ট রাজীব ও সঞ্জয় গাঁধী, দোলনায় মার্কিন ফার্স্ট লেডি জ্যাকলিন কেনেডির সঙ্গে ইন্দিরা গাঁধী, মহাত্মা গাঁধী ও জওহরলাল নেহরুর শেষকৃত্য— এ রকম অজস্র ঐতিহাসিক মুহূর্ত ক্যামেরাবন্দি করেছিলেন হোমাই।

গুজরাতের ছোট্ট মফস্‌সল নভসারিতে এক পার্সি পরিবারে হোমাইয়ের জন্ম, ১৯১৩ সালে। হোমাইয়ের বাবা থিয়েটারে অভিনয় করতেন। একটা সময় মেয়ে ও স্ত্রীকে নিয়ে চলে আসেন মুম্বইয়ে। বম্বে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতক হলেন হোমাই। তার পর জে জে স্কুল অব আর্ট থেকে ডিপ্লোমা। ছোটো থেকে হোমাইয়ের ফোটোগ্রাফির প্রতি টান। আর্ট স্কুলে পড়ার সময় প্রেমে পড়েন ফ্রিলান্স ফোটোগ্রাফার মানিকশ’ জামশেদজি ভ্যারাওয়ালার। মানিকশ’র চোখে পড়ল হোমাইয়ের ফোটোগ্রাফি-প্রেম।

প্রেম থেকে বিয়ে, সময় নিল না বিশেষ। বিয়ের পরে স্ত্রীকে ফোটোগ্রাফি শেখানোর ইচ্ছে বেড়ে গেল মানিকশ’র। আর্ট কলেজের শিক্ষকদেরও চোখে পড়েছিল হোমাইয়ের ফোটোগ্রাফি-প্রীতি। প্রথম কাজ পেয়েছিলেন কলেজ থেকেই। বম্বের উইমেন ক্লাবের মেয়েদের পিকনিকের ছবি তুলতে হবে তাঁকে। বাঁধাধরা ফ্রেমের বাইরে গিয়ে ছবি তুললেন। কাজটা এতটাই ভাল হয়েছিল যে, বেশ কয়েকটি ছবি প্রকাশিত হল তখনকার ‘বম্বে ক্রনিক্‌ল’ পত্রিকায়। প্রথম সাম্মানিক হিসেবে পেলেন ১ টাকা।

‘বম্বে ক্রনিক্‌ল’-এর পরে হোমাই কোমর বেঁধে নামলেন। ভারী ক্যামেরা ঘাড়ে করে বিভিন্ন জায়গায় ঘুরে ছবি তুলতেন তিনি। আর মানিকশ’ ঘণ্টার পর ঘণ্টা ডার্করুমে বসে যত্ন নিয়ে সে ছবি প্রসেস করতেন। হোমাই তখন নিয়মিত ছবি পাঠাচ্ছেন ‘ইলাস্ট্রেটেড উইকলি অব ইন্ডিয়া’ পত্রিকায়। ক’দিন পরে পত্রিকার সম্পাদক হোমাইকে নিজেই ফোন করে কাজ দিতে শুরু করলেন।

চল্লিশের দশের গোড়ার দিকে যখন মেয়েদের বাড়ির বাইরে গিয়ে চাকরি করাটাই বিরল, সেখানে শাড়ি পরে, ক্যামেরা কাঁধে নিয়ে মাঠে-ময়দানে পুরুষ ফোটোগ্রাফারদের পাশে একা মহিলার কাজ করতে অসুবিধা হত না? উত্তরে তিনি বলেছিলেন, মোটেই অস্বস্তি হত না। কারণ ম্যাট্রিকুলেশন ক্লাসে ছাত্রদের মধ্যে একমাত্র ছাত্রী ছিলেন তিনি। ছেলেদের সঙ্গে কাজ করার অভিজ্ঞতা তাঁর অনেক আগেই তৈরি হয়ে গিয়েছিল। তবুও তাঁর পোশাক নিয়ে কখনও-সখনও ব্যঙ্গ করতে ছাড়েনি পুরুষ সহকর্মীরা। কিন্তু তাতে পাত্তা দিতেন না হোমাই।

এত সব কিছুর পরেও হোমাইয়ের অধিকাংশ ছবি প্রকাশিত হয় তাঁর স্বামীর নামে, নয়তো ‘ডালডা ১৩’ ছদ্মনামে। তাঁর গাড়ির নম্বর ছিল— ডিএলডি ১৩। এখান থেকেই তাঁর ছদ্মনাম। ১৯৪২ সালে মুম্বই ছেড়ে হোমাই ও মানেকশ’ দুজনেই ব্রিটিশ ইনফর্মেশন সার্ভিসে চাকরি নিয়ে চলে আসেন দিল্লি।

দিল্লি দ্রুত চিনে নেয় তাঁকে। চল্লিশের দশকের মাঝামাঝি, এক দিকে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ, অন্য দিকে ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রাম—রাজনৈতিক পরিস্থিতি যথেষ্ট তপ্ত তখন। কিন্তু যে কোনও সময়ে ক্যামেরা কাঁধে দেখা যেত হোমাইকে। রাজনীতিক, আমলাদের কাছে তিনি তখন রীতিমতো পরিচিত মুখ। এক বার একটি সভায় তাঁর ঠোঁটে ব্যান্ডেজ দেখে ভারতের প্রাক্তন রাষ্ট্রপতি ডক্টর সর্বপল্লী রাধাকৃষ্ণন মঞ্চ থেকেই ইশারায় জানতে চেয়েছিলেন তাঁর কী হয়েছে। হোমাই উত্তর না দিয়ে এমন ভান করেন যেন তিনি রাধাকৃষ্ণনকে দেখতেই পাননি। সভা শেষে রাধাকৃষ্ণন তাঁর পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় ফিসফিস করে বলে যান, ‘স্বামীর হাতে মার খেলেন

না কি?’

১৯৫৪, জওহরলাল নেহরু দিল্লি এয়ারপোর্টে অপেক্ষা করছেন তাঁর বোন বিজয়লক্ষ্মী পণ্ডিতের জন্য। নেহরুর পিছনে ‘ছবি তোলা নিষেধ’ বোর্ড। মজার ফ্রেমটা মিস করলেন না হোমাই। তিনি বলতেন, নেহরু তাঁর ‘অল টাইম ফেভারিট সাবজেক্ট।’ নেহরুর শেষকৃত্যের ছবি তুলতে গিয়ে সহকর্মীর কাঁধে মুখ লুকিয়ে কেঁদে ফেলেছিলেন। ‘‘একটা

বাচ্চা তাঁর প্রিয় খেলনা হারিয়ে ফেললে যেমন কষ্ট পায়, নেহরুর মৃত্যুতে আমারও তাই হয়েছিল,’’ বলেছিলেন হোমাই।

তিনি ভারতের প্রথম নারী চিত্রসাংবাদিক— শুধু এই কারণে তাঁকে নিয়ে এত হইচই নয়। হোমাইয়ের মৌলিকতা তাঁর ক্যানডিড শটে। গড়পড়তা শটের বাইরে গিয়ে অন্য ভাবে ভাবতে পারতেন। ১৯৫১ সালে প্রজাতন্ত্র দিবসের প্যারেডে ছবি তোলার জন্য অন্য ফোটোগ্রাফাররা যখন রাস্তার পাশে দাঁড়িয়ে, তখন ইন্ডিয়া গেটের মাথায় উঠে গিয়েছেন হোমাই। উপর থেকে প্যারেডের এরিয়াল ভিউ তুলেছিলেন।

শোক কখনও ছাপিয়ে যায়নি তাঁর পেশাদারিত্বকে। মহাত্মা গাঁধীর হত্যা মেনে নিতে পারেননি, তার চেয়েও বেশি মানতে পারেননি গাঁধীর হত্যার ছবি ফসকে যাওয়া। ১৯৪৮-এর ৩০ জানুয়ারি গাঁধীর সঙ্গে তাঁর থাকার কথা ছিল। কিন্তু স্বামীর কথায় ঠিক করেন পরের দিন গাঁধীর সঙ্গে দেখা করবেন। আমৃত্যু মানেকশ’ও আফসোস করেছেন এই জন্য।

১৯৭০ সালে স্বামীর মৃত্যু বড় আঘাত ছিল হোমাইয়ের কাছে। ছেড়ে দিলেন ফোটোগ্রাফি। ২০১২ সালে মৃত্যুর আগে সব ছবি দিয়ে গিয়েছেন দিল্লির এক সংস্থাকে। একমাত্র পুত্র মারা যাওয়ার পরে বডোদরায় বাড়িতে বাগান নিয়েই ব্যস্ত থাকতেন। মৃত্যুর এক বছর আগে পেয়েছিলেন পদ্মবিভূষণ সম্মান। সাবিনা গাড়িহোক তাঁর জীবন নিয়ে লিখেছেন ‘ইন্ডিয়া ইন ফোকাস: ক্যামেরা ক্রনিক্‌লস অব হোমাই ভ্যারাওয়ালা’ বইটি। ব্রিটিশ আর্ট কাউন্সিল ‘ডালডা ১৩’ নামে একটি তথ্যচিত্রও তৈরি করে

তাঁর উপর।

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement