তারকা: গোলাপের পাপড়ির মধ্যে দুটি কোহিনুর পান ও আতর।
ঔরঙ্গাবাদের বাড়ি থেকে পালিয়ে সোজা মুম্বই। বছর উনিশের ছেলে মহম্মদ সরফুদ্দিনের একটাই স্বপ্ন ছিল হিন্দি ছবির নায়ক ধর্মেন্দ্রের সঙ্গে দেখা করা। কারণ হিন্দি ছবির নায়ক তাঁকেও হতে হবে। হবেই।
বছরও ঘুরল না। খানখান মন নিয়ে ঘরের ছেলে ফিরল ঘরে। তার পর কয়েক বছর, এই কাজ সেই কাজ। কিন্তু কোনও কাজেই মন বসল না সরফুদ্দিনের।
মা নাজমার চোখ এড়াল না ছেলের ব্যাজার মুখ। হাকিম খানদানের মেয়ে নাজমার রোগ বুঝতে দেরি হয় না। গয়না বিক্রি করে ছেলের হাতে তুলে দিলেন অনেকগুলো টাকা। বললেন, ‘‘পানের দোকান খোল।’’ মায়ের প্রস্তাবে ছেলে স্তব্ধ। কিছুটা আহতও। যে কিনা সুপারস্টার হতে চেয়েছিল, তাকে শেষ পর্যন্ত পানের দোকান চালাতে হবে! মা বোঝালেন, কোনও কাজই ছোট নয়। লোকে কী ভাবল, তা-ই নিয়ে মাথা ঘামালে কোনও কাজ করা যায় না।
দিল্লি দখলের লড়াই, লোকসভা নির্বাচন ২০১৯
অনিচ্ছা সত্ত্বেও পানের দোকান খুললেন সরফুদ্দিন। সালটা ১৯৭০। দোকানের নাম রাখলেন ‘তারা পান সেন্টার।’ তারকা হওয়ার সুপ্ত ইচ্ছেটা প্রকাশ পেল দোকানের নামে। প্রায় ৫৬ ধরনের পান পাওয়া যায় এই দোকানে। নবাব, রসিলা, এয়ারপোর্ট, নবরত্ন— ৫০ টাকা থেকে ৩০০ টাকা, এক-একটি পানের দাম। তবে এই দোকানের তারকা পান ‘কোহিনুর’। যার দাম পাঁচ হাজার টাকা! যে পানের স্বাদে নাকি লুকিয়ে থাকে এক বিশেষ অনুপান— সেই তাম্বুলরাগে মিশে যায় কামনার সন্দীপ্ত সংরাগ।
পানের দাম পাঁচ হাজার শুনে চমকাবেন সকলেই। কিন্তু আরও চমকাবেন এটা শুনে যে, প্রতিদিন এই কোহিনুর কিনতে হুড়োহুড়ি পড়ে যায়। অর্ডার আসে দিল্লি, মুম্বই, হায়দরাবাদ, পুণে, ইনদওর, আমদাবাদের মতো বহু শহর থেকে। কুরিয়ারেও পাঠানো হয় কোহিনুর। অর্ডার আসে বিদেশ থেকেও। দিনে প্রায় একশোটা কোহিনুর বিক্রি হয়! প্রতিদিন সব মিলিয়ে পান বিক্রির অঙ্ক কম করে দশ হাজার টাকা।
ঔরঙ্গাবাদে এমন কোনও বিয়েবাড়ি নেই, যেখানে এই দোকান থেকে বর-বধূর জন্য কোহিনুর যায় না। বিরাট কোহলি ও অনুষ্কা শর্মার বিয়েতেও এই দোকান থেকে কোহিনুর পান গিয়েছে। ‘‘জানেন, আমার দোকানের সঙ্গে বাংলার কানেকশনও আছে। এই দোকানের সব পান আসে মেদিনীপুরের মেচেদা থেকে। অন্য কোনও রাজ্যের মাটিতে এমন পান হবে না,’’ হাসতে হাসতে বললেন সরফুদ্দিন।
পান প্রস্তুতকারক মহম্মদ সরফুদ্দিন
কিন্তু কোহিনুরের রহস্যটা কী? ‘‘এ হল আমার মা নাজমা বেগমের গুপ্ত ফর্মুলা। বিয়ের প্রথম রাতে মা আমার স্ত্রী সালমা ও আমাকে নিজের হাতে দুটো পান তৈরি করে দিয়েছিলেন। সেই স্বাদ আজও ভুলতে পারিনি,’’ কথার মধ্যেই ফুটে উঠল বিয়ের পরে সরফুদ্দিনের প্রথম ‘পানস্ফূর্তি’।
বিয়ের গল্প পরে। তার আগে অন্য কাহিনি। তখনও সরফুদ্দিনের ব্যবসা তেমন জমে ওঠেনি। সেই সময়ে মায়ের পীড়াপীড়িতে বিয়ে করতে হল তাঁকে। বিয়ের রাতে নাজমা ছেলে ও পুত্রবধূকে পান খাওয়ালেন। ছেলেকে সেই পান তৈরির রহস্যটাও জানিয়ে দিলেন পরদিন। মায়ের দেওয়া ফর্মুলা মাথায় পেতে নিলেন সরফুদ্দিন। তৈরি করে ফেললেন কোহিনুর।
বাকিটা ইতিহাস। এক দিন তিনি তারকা হতে ঘর ছে়ড়েছিলেন। আজ নিজের অজান্তে কোহিনুর পানই তাঁকে করে তুলল পান সাজার অদ্বিতীয় তারকা।
কোহিনুর দেওয়া হয় সুদৃশ্য এক বাক্সে। তাতে গোলাপের পাপড়ির মধ্যে শোয়ানো থাকে দু’টি পান ও একটি আতরের শিশি। একটি পুরুষের, অন্যটি স্ত্রীর। পুরুষের পানে থাকে দু’লক্ষ টাকা কেজির কেশর আর সেই গুপ্ত উপাদান। স্ত্রীর পানে আশি হাজার টাকা কেজির গোলাপ ফুল চূর্ণ, ষাট হাজার টাকা কেজির সাদা মুজলি আর গুপ্ত উপাদান। যে উপাদানের কথা আজও সরফুদ্দিন তাঁর ছেলেকে বলেননি। ‘‘ছেলে আগে বিয়ে করুক। কোহিনুর পান খাক। তার পর ওকে কোহিনুর তৈরির রহস্যটা বলে দেব। যেমন আমার মা আমাকে বলেছিলেন,’’ পরম্পরা ধরে রাখতে চান সরফুদ্দিন।
নয় মেয়ে ও এক ছেলের বাবা সরফুদ্দিনের দোকানের কোনও প্রচার নেই, বিজ্ঞাপন নেই। তিনি ও তাঁর পান জনপ্রিয় শুধুমাত্র লোকের মুখে-মুখে। আর এই লোকশ্রুতির টানে ঔরঙ্গাবাদে সরফুদ্দিনের হাতে তৈরি পান খেতে এসেছেন অমিতাভ বচ্চন, ধর্মেন্দ্র, অনিল কপূর, হেমা মালিনী, শ্রীদেবী, জয়া প্রদা, মাধুরী থেকে শাহরুখ, সলমন খান। এক বার নয়, একাধিক বার!