মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পেনসিলভ্যানিয়ার স্প্রিংডেল। বাদামি চুলের মিষ্টি মেয়েটি তাদের ছোট্ট ফ্যামিলি ফার্ম জুড়ে দৌড়ে বেড়াচ্ছে তার ছোট্ট পোষা কুকুর ‘ক্যান্ডি’র সঙ্গে। মাঠের পর মাঠ দাপিয়ে, বুনোফুলের ঝাড় পেরিয়ে, বুনোপাখি, পোকামাকড় আর জীবজন্তুদের সঙ্গে লুকোচুরি খেলার মাঝেই সে খুঁজে চলেছে জীবনের সবচেয়ে আনন্দঘন মুহূর্তগুলি। মায়ের কাছে থেকে সে শিখেছে, কী ভাবে ঝরনার মাছেদের সঙ্গে, জঙ্গলের পাখিদের সঙ্গে গল্প করতে হয়। কী ভাবে আবিষ্কার করতে হয় প্রকৃতির অনন্য বিস্ময়কে।
সমুদ্রের মতো নীলাভ সবুজ চোখের সেই মেয়ে, রেচেল কারসন, যখন স্কুলে ভর্তি হল, সকলের চোখের মণি হয়ে উঠল। সে শুধু শান্ত, মনোযোগী পাঠকই নয়, ভাল লেখকও বটে। তার একাদশতম জন্মদিনের আগেই খবর এল তার প্রিয় পত্রিকা ‘সেন্ট নিকোলাস’-এ পাঠানো তার গল্পটি মনোনীত হয়েছে, ব্যস। তার পর থেকেই একের পর এক গল্প নিয়মিত লিখে গিয়েছে মেয়েটি ‘সেন্ট নিকোলাস’-এর জন্য। এমনকী হাইস্কুলে পড়ার চাপের মাঝেও তার এই লেখায় খামতি পড়েনি।
হাইস্কুলের পাঠ চুকিয়ে রেচেল ভর্তি হলেন পেনসিলভ্যানিয়া কলেজ ফর উইমেন-এ, পড়াশোনা শুরু করলেন ইংরেজি সাহিত্য নিয়ে। কিন্তু কলেজের দ্বিতীয় বছরে হঠাৎ তিনি তাঁর প্রধান বিষয় বেছে নিলেন ‘বায়োলজি’। ক্রমশ বায়োলজি ক্লাসের প্রতি তাঁর আগ্রহ বাড়তেই থাকল। বিশেষ করে সমুদ্রের বিশালতা, সামুদ্রিক প্রাণীদের জীবনবৈচিত্র আকর্ষণ করতে লাগল তাঁকে। ১৯২৯ সালে বায়োলজিতে দারুণ গ্রেড নিয়ে রেচেল যখন কলেজের গণ্ডি টপকালেন, দুটি বড় সুযোগ এসে উপস্থিত হল তাঁর সামনে: মাসাচুসেট্স-এর মেরিন বায়োলজি ল্যাবরেটরিতে কাজ করা, অথবা মেরিল্যান্ডের বল্টিমোর-এ সুপ্রসিদ্ধ জন্স হপকিন্স ইউনিভার্সিটিতে ভবিষ্যৎ পড়াশোনা। সেটা ১৯২০ সাল। সবে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে মহিলাদের ভোটাধিকার স্বীকৃত হয়েছে। সেই সময়ের প্রেক্ষাপটে একটি মেয়ের এই সব সুযোগ পাওয়া একটা বিরাট কৃতিত্বই বলা চলে। এক অসাধারণ মেরিন বায়োলজিস্ট হিসেবে ১৯৩৫ সালে রেচেল যোগ দিলেন ইউএস ব্যুরো অব ফিশারিজ-এ (পরে যা ‘ইউএস ফিশ অ্যান্ড ওয়াইল্ডলাইফ সার্ভিস’ নামে পরিচিত হয়েছিল)। এটি একটি সরকারি সংস্থা, যার উদ্দেশ্য ছিল বন্যপ্রাণীর সংরক্ষণ।
১৯৪১ সালে প্রকাশিত হল রেচেলের প্রথম বই আন্ডার দ্য সি উইন্ড, যা তাঁর সাগর, মহাসাগরের বন্যপ্রাণ সম্বন্ধে গভীর গবেষণার ফল। তাঁর দ্বিতীয় বই দ্য সি আরাউন্ড আস ছিল এক বিশাল জনপ্রিয় বই। এই বইটির সাফল্য তাঁকে আর দমিয়ে রাখতে পারেনি, চাকরি ছেড়ে দিয়ে প্রিয় বিষয় প্রকৃতির ওপরেই লেখালিখিতে মন দিলেন তিনি। বছরের পর বছর ধরে তাঁর বইয়ের জন্য তথ্য সংগ্রহ করতে গিয়ে মেয়েটি পরিবেশ দূষণের ক্ষতিকারক প্রভাব সম্পর্কে ক্রমশই সচেতন হয়ে উঠছিলেন। তাঁর নজর এড়াল না, শহরের কারখানাগুলি নদী আর সমুদ্রে বর্জ্যপদার্থ ফেলে কী ভাবে রাসায়নিক কীটনাশকের যথেচ্ছ ব্যবহারে প্রতিদিন মানুষ এবং পরিবেশের ক্ষতি করেই চলেছে।
১৯৬২ সালে প্রকাশিত হল সাইলেন্ট স্প্রিং। পরিবেশের ওপর লেখা গুরুত্বপূর্ণ এই বইটি তুলে ধরল আমেরিকা সহ পৃথিবীর প্রায় প্রতিটি দেশে রাসায়নিক কীটনাশক ব্যবহারের সুদূরপ্রসারী প্রভাবের কথা। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে ব্যাপক ভাবে ব্যবহৃত এই কীটনাশকের গ্রাস থেকে রক্ষা পায়নি মানুষের বাড়ির অন্দরমহলও। মশামাছি, পোকামাকড় মারার জন্য ডিডিটি-র মতো কীটনাশক স্কুল-রুম থেকে পার্ক, ফার্ম— প্রায় সর্বত্র নির্বিচারে ছড়ানো হচ্ছিল। অথচ এই কীটনাশক শুধুমাত্র পোকামাকড়ই ধ্বংস করছিল না, পাখি, মাছ, বিভিন্ন ধরনের জীবজন্তু এমনকী মানুষের শরীরেরও নানা ক্ষতি করছিল। ১৯৬৩ সালে ওয়াশিংটন ডিসি-তে প্রেসিডেন্ট জন এফ কেনেডির উপস্থিতিতে এক স্পেশাল কমিটির সামনে রেচেল পেশ করলেন তাঁর বক্তব্য। তাঁর প্রামাণ্য তথ্যের ওপর ভিত্তি করে কমিটি কীটনাশকের অতিরিক্ত ব্যবহারে কুফল মেনে নিল। শুধু তা-ই নয়, মানুষ এবং প্রকৃতিকে সুস্থ রাখার জন্য মার্কিন মুলুকের সর্বত্র ডিডিটি ব্যান করার পাশাপাশি মার্কিন কংগ্রেস প্রকৃতিকে নির্মল রাখার জন্য পরিবেশ রক্ষায় এক গুরুত্বপূর্ণ আইন প্রণয়ন করল।
স্বভাবতই রেচেলকে আজ গোটা দুনিয়া ‘মাদার অব এনভায়রনমেন্টাল মুভমেন্ট’ হিসেবে স্মরণ করে। ১৯৬৪ সালে ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়ে রেচেল কারসন মারা যান। ১৯৮০ সালে তিনি মরণোত্তর ‘প্রেসিডেনশিয়াল মেড্ল অব ফ্রিডম’-এ ভূষিত হন।