ছবি: সুমন চৌধুরী
স্মা গলিং চাই— সোনা হিরে গাঁজা চরস, যা হোক; পাঁচটি গানের সিচুয়েশন চাই, তার মধ্যে একটি ভক্তিমূলক হলে ভাল; দুটি নাচ চাই; খান দু-তিন পশ্চাদ্ধাবন দৃশ্য বা চেজ-সিকুয়েন্স চাই— তাতে অন্তত একটি দামি মোটরগাড়ি পাহাড়ের গা গড়িয়ে ফেলতে পারলে ভাল হয়; অগ্নিকাণ্ডের দৃশ্য চাই...’, এর পরই লালমোহনবাবুকে হিট সিনেমার ফর্মুলা ডিক্টেশন দিতে দিতে ফেলুদা বলছেন— ‘নায়কের গার্লফ্রেন্ড হিসেবে নায়িকা এবং ভিলেনের গার্লফ্রেন্ড হিসেবে ভ্যাম্প বা খলনায়িকা চাই।’
ভ্যাম্প কে? শুধু খলনায়িকা বা ভিলেনের বান্ধবী হলেই তাকে ভ্যাম্প বলা যায় না। চরিত্রটিতে হয়তো লাস্য আছে, ছল আছে, ঢলঢল যৌনতা আছে, চরিত্রটি কিছুটা নেগেটিভও বটে, কিন্তু তা হলেও সে ভ্যাম্প না-ই হতে পারে। অভিধান বলছে, ভ্যাম্প সেই রমণী, যে যৌনতা দিয়ে পুরুষকে বশ করে কার্যোদ্ধার করে। বাংলা সিনেমায় ভ্যাম্প বলতেই ‘নষ্ট মেয়ে’। হয় হাতে গেলাস, নয় ঠোঁটে সিগারেট। হয় শরীর বেচে খায়, নয় নাচ-গান। সতী-লক্ষ্মী নায়িকার প্রোটোটাইপের উলটো দিকে, হয় এরা অলক্ষ্মী, নয়তো মোহিনী।
১৯৭৬-এর ‘বহ্নিশিখা’ সিনেমায়, ইস্তানবুলের কুখ্যাত এক নাইট ক্লাবে রাত দেড়টায় ‘মিস ববি’কে নৃত্যরত অবস্থায় দেখতে পায় বাংলা সিনেমার দর্শক। ধাতব ঝালরে ভরা উজ্জ্বল খাটো পোশাকে, স্তনবিভাজিকার মাঝ বরাবর দুই হাত ঘষটে তুলে এনে তালে তালে শুরু হয় তাঁর নাচ। ওই বছরেরই ‘হোটেল স্নো ফক্স’ ছবিতে অবশ্য আরও মাত করে দেন মিস ববি। উত্তমকুমার সেখানে বার-সিংগার। কিন্তু বিপ্লব ঘটাচ্ছেন মিস ববি! স্ট্রিপটিজ! হ্যাঁ, বাংলা ছবিতে। শুরু করছেন সান্ধ্য-দস্তানা বা ইভনিং গ্লাভস দিয়ে। একে একে পোশাকের পরতগুলি খুলে ফেলছেন। শেষে, হাঁটু গেড়ে বসে ঠিক লেন্সের দিকে তাক করে ছুড়ে মারছেন বক্ষবন্ধনীটি!
হোটেল-রেস্তরাঁ-পানশালার প্রেক্ষিতে কাহিনি ঘুরপাক খেলে এমন সিন তৈরি হওয়া স্বাভাবিক। যেমন, ‘চৌরঙ্গী’ (১৯৬৮)। কনির ভূমিকায় সেই নাচে দেহ উন্মুক্ত করছেন ‘বোম্বে’ থেকে আসা জেনি। তার পর শাহজাহান হোটেলের হাতবদল হলে, নতুন ডিরেক্টর ফোকলা চ্যাটার্জি (তরুণকুমার) বলছেন, ‘বেশ ভাল ভাল অ্যাট্রাকটিভ গার্লস নিয়ে এসে নাচে-গানে-আনন্দে ইন্দ্রপুরী করে তোলো এই শাহজাহান হোটেলকে।’
বাংলা ছবিতে বারে বারে দেখানো হয়েছে বাইজি নাচ। সাহেব বিবি গোলাম, জলসাঘর, সন্ন্যাসী রাজা, কলঙ্কিনী কঙ্কাবতী... আরও কত ছবি! ছোট্ট একটা-দুটো সিনেও আঁটোসাঁটো পোশাকের নর্তকী দাগ কেটে যায়, এমন ঢলঢল খল চরিত্রেরও দেখা মেলে। তাদের ভ্যাম্প বলাই যেতে পারে। যেমন, ‘সখী কালো আমার ভাল লাগে না...’ গানটি। ‘স্ত্রী’। বছর বিশেকের অনাথা বিধবা সাদা থান ছেড়ে কৃষ্ণবর্ণ পোশাকে ঝলমল। মদে ভেজা ঠোঁট, কাজল টানা চোখ। সাপের ছোবলের মতো মিষ্টি হাসি। এ গানের লিরিকে আবার ভ্যাম্প চরিত্রগুলির সম্পর্কে সার কথা উঠে আসে। সৌমিত্রর লিপে হেমন্ত মুখোপাধ্যায় গাইছেন— ‘ওর ভেতর কালো, বাইরে কালো, ও যে কলঙ্কেতে কালো...’ জবাবে মান্না দে-র গলায় উত্তমকুমার ওভারট্রাম্প করছেন, ‘ও সে যতই কালো হোক, আমার ভাল লেগেছে। তার পটলচেরা চক্ষু দিয়ে চাক্কু মেরেছে, ভাল লেগেছে!’
প্রথম বাঙালি ক্যাবারে ডান্সার মিস শেফালি, সত্যজিৎ রায়ের ‘প্রতিদ্বন্দ্বী’-তে (১৯৭০) শাড়ি-ব্লাউজ খুলে ব্রা পরে সিগারেট ধরাচ্ছেন, সিদ্ধার্থকে (ধৃতিমান) ছুড়ে দিচ্ছেন ইঙ্গিতবহ প্রশ্ন— ‘তুমিও খাবে নাকি?’ পরে ‘রোদনভরা বসন্ত’, ‘বহ্নিশিখা’-র মতো ছবিতে শেফালির উপস্থিতি মূলত খোলামেলা নাচের জন্যই। ভরসন্ধের নয়, সে সব নাচ গভীর রাতের। ‘বহ্নিশিখা’-র পানশালায় পারফরমেন্স শুরুর আগে সেই ডান্সার বলছেন, ‘আমাদের ঘড়িতে এখন রাত্রি একটা বাজতে পাঁচ মিনিট বাকি।’ গোপন বৈঠক শুরুর সময় হয়ে গিয়েছে, ইঙ্গিতে দুষ্টচক্রের লোকজনদের উদ্দেশে অ্যালার্মের কাজ করছেন তিনি। তার পর মিউজিকের বিটে-বিটে দেহ বিভঙ্গে শুরু হচ্ছে গান— ‘লাইফ ইজ জাস্ট আ গ্যাম্বল...’
এখনও অবধি শেফালির শেষ ছবি ‘পেন্নাম কলকাতা’। সেখানেও তিনি ‘মডার্ন ডান্সার’। শেলি সেন। হদ্দ গাঁ থেকে আসা গোবরা, মানে, গোবর্ধন দলুই (চিরঞ্জিত) যাঁর পোস্টারে পেন্নাম ঠুকে বলছেন ‘সগ্গের দেবী’, যাঁর ‘রূপ দেখলে বুকের ভেতরটা একেবারে হু হু করে’!
এই গোবর্ধন আর তার স্ত্রী পদ্মকে (শতাব্দী রায়) কাজের লোক করে বাড়ি নিয়ে আসেন শেলি। গোবরকে তাঁর পিএ-র তকমা দেন। তার পর এক সন্ধ্যায়, পদ্ম যখন বাড়ির বাইরে, তাকে ঘরে ডেকে ড্রিংকস আনতে বলেন শেলি। তার পর বলেন, পা টিপতে। স্কার্টের নীচের অংশ কিছুটা তুলে দেন, গোবর যত সেটি নামিয়ে পা ঢেকে দিতে চায়, ততই তিনি টেনে তুলে নেন। মেমসাবের অনুরোধে গোবরকে গানও গাইতে হয়, ‘ওরে ও শয়তান, হ তুই সাবধান, আছে রে আছে রে আছে ভগবান।’ গাঁয়ের যাত্রার বিবেকের গানের সঙ্গে বিচিত্র কনট্রাস্টে সুরাপাত্র হাতে দুলে ওঠে মডার্ন ডান্সারের শরীর। ক্রমে ঘনিষ্ঠ হয়ে গোবরকে জাপটে ধরেন। তাকে নিয়ে অনেক দূরে পালিয়ে যাওয়ার বাসনাও জানান। গোবর স্ত্রী পদ্মর কথা বললে, শেলি হেসে বলেন, ‘ধুর বোকা, তুই বলবি কেন রে’!
নির্বাক যুগ কিংবা সবাক যুগের শুরুর দিকে নিউ থিয়েটার্সের আমলেও বাংলা ছবিতে ভ্যাম্প চরিত্র খুঁজে পাওয়া মুশকিল। দজ্জাল ভিলেন মহিলা হয়তো রয়েছে, কিন্তু তারা ভ্যাম্প নয়। ঝড়ের রাতে ছুটে গেলেও এদের আঁচল এতটুকু খসে না। কাহিনির খেই ধরে কখনও পতিতা, নর্তকী, দেবদাসী এসেছে, কিন্তু ওই পর্যন্তই। ছবিটা কিছুটা বদলাল পঞ্চাশের দশকে এসে। মঞ্জু দে (‘রত্নদীপ’, ‘কার পাপে’) বা রঞ্জনা বন্দ্যোপাধ্যায়ের (‘হাঁসুলি বাঁকের উপকথা’) মতো অভিনেত্রীরা আগের ট্র্যাডিশনের মধ্যেই কিছুটা অন্য রকম হওয়ার চেষ্টা করছিলেন। ঠিক এই সময়েই হিন্দি ছবি থেকে বাংলায় অভিনয় করতে এলেন বেগম পারা।
১৯৫২। বিকাশ রায় অভিনীত শ্যাম চক্রবর্তীর ‘বাগদাদ’। ভ্যাম্প নন মোটেই, কিন্তু যৌন আবেদন আর এক্সপোজারে, ক্লিভেজে, স্তনবৃন্তের আভাসে বেগম পারা তাক লাগিয়ে দিলেন। সে ছবিতে গানের কথা ছিল এই রকম: ‘শরমেরে দূরে ফেলি /আঁখি মোর চুমে নে /সুধা পিয়ে নে’।
চলচ্চিত্র-সাংবাদিক রবি বসু তাঁর ‘সাতরঙ’ বইতে বলছেন ‘বাগদাদ’-এর বিহাইন্ড দ্য সিন কাহিনি। শুরু করছেন অন্য এক জনের কথা দিয়ে— সে কালের দাপুটে অভিনেত্রী-পরিচালক-প্রযোজক প্রতিমা দাশগুপ্ত। সেই সময় যে সামান্য ক’জন অভিনেত্রী নিজের নামের পাশে ‘বি-এ’ লিখতেন, প্রতিমা দেবী ছিলেন তাঁদের অন্যতম। সদর্পে বাইক হাঁকিয়ে তিনি সেটে আসতেন। চল্লিশের দশকে উনি বম্বে চলে যান। ফ্লাইট মেজর মনসুর-উল-হকের সঙ্গে তাঁর বিয়ে হয়। এই মেজরের বোন ছিলেন বেগম পারা।
ইন্দ্রপুরী স্টুডিয়োয় ‘বাগদাদ’ ছবির সেটে সে দিন বেগম পারার স্নানদৃশ্যের শুটিং চলছে। বেগম পারা বাথটবে। তাঁর ঊর্ধ্বাঙ্গ সম্পূর্ণ অনাবৃত। সেই উন্মুক্ত অংশ ঢেকে রেখেছে সাবানের ঘন ফেনা। পরিচালক শ্যাম চক্রবর্তী চাইছেন, আঢাকা শরীর আরও খানিক দেখা যাক, কিন্তু কুণ্ঠাবশত কিছুতেই বেগমকে বলে উঠতে পারছেন না।
ঠিক তখনই বাইরে শোনা গেল বাইকের ভটভট শব্দ। সেটে হাজির হলেন বেগমের বউদি প্রতিমা দাশগুপ্ত। প্রতিমা ছিলেন শ্যাম চক্রবর্তীর পূর্ব-পরিচিত। শ্যামবাবু আশার আলো দেখলেন। প্রতিমাকে কানে-কানে ব্যাপারটা বলামাত্রই প্রতিমা চিৎকার করে হিন্দিতে তাঁর ননদকে বললেন, শরীরটা বাথটব থেকে একটু উপরে তুলে ধরতে!
এর পর রবি বসু লিখছেন—
‘শোনামাত্র বেগম পারা তাঁর সম্পূর্ণ অনাবৃত ঊর্ধ্বাঙ্গ সহ বাথটবের ওপর উঠে বসলেন।
তাই দেখে শ্যামবাবু হাঁ হাঁ করে উঠলেন : আরে না না, অতটা নয়, অতটা নয়। সেন্সরে আটকে দেবে যে!’
কিন্তু এ ভাবে বম্বের অভিনেত্রী নিয়ে এসে বাংলা ছবিতে ‘সাহস’ সাপ্লাই করার প্রভাব কেমন ছিল? এই ‘বাগদাদ’ তৈরি হওয়ার সময়েই ‘শারদীয়া চিত্রবাণী’-র এক সংখ্যায় ‘আমার স্বর্গারোহণ’ নামে এক কল্পকাহিনি লিখছেন ফণীন্দ্র পাল। সেখানে স্বয়ং দেবী সরস্বতীর সঙ্গে তাঁর মোলাকাত হচ্ছে।
তিনি দেবীকে নালিশ জানাচ্ছেন, ‘দেখেছেন আমাদের বাঙলা ছবির প্রযোজকদের কাণ্ডকারখানা। বোম্বাই থেকে বেগমপারা, কুলদীপ, সিতারা, কাক্কুকে এনে ছবির হিরোইন করা হচ্ছে। আমাদের দেশের নিতান্ত সাধারণ শিল্পীর চেয়ে অভিনেত্রী হিসাবে এরা অনেক অযোগ্য হলেও দেহসৌষ্ঠবের ভঙ্গীমায় এরা অনেক স্মার্ট। যে sex-appeal-এর stunt দেখিয়ে হিন্দীওয়ালারা নিজেদের ব্যবসায়কে বেসামাল অবস্থায় টেনে এনেছেন বাঙলার কয়েকটি প্রযোজক সেই stunt দেখিয়ে বাজীমাৎ করবার কথা ভাবছেন।’
নালিশে কাজ হয়নি। দেহসৌষ্ঠবের স্মার্টনেস বা সেক্স অ্যাপিলের স্টান্ট কেবল হিন্দি ছবির অভিনেত্রীদের বাংলায় নায়িকাই করল না, সময় গড়াতে বাংলা ছবিতে টিপিক্যাল ভ্যাম্পের চরিত্রেও অবতীর্ণ হতে থাকলেন হেলেন, বিন্দুরা। সত্তরের সাদা-কালো ‘রাজকুমারী’ই হোক বা আশির রঙিন ‘ত্রয়ী’— হেলেন একই রকম বর্ণময় ও লাস্যময়ী। কেবল ‘ছেড়ে দাও, ওগো পথ ছাড়ো’ এক দশকে বদলে হয়ে যাচ্ছে ‘একটু বোসো, চলে যেও না’। ‘বন্দী’ ছবিতে আবার ভিড় জমছে বলিউডি ভ্যাম্পদের— হেলেন, বিন্দু, পদ্মা খন্না, প্রেমা নারায়ণ! তার আগেই ‘কলঙ্কিত নায়ক’-এ স্বনামে হাজির হয়ে আইটেম নাম্বারে মাত করে দিচ্ছেন মধুমতী। ‘দোলনচাঁপা’-তে অরুণা ইরানি, ‘শত্রু’-তে জয়শ্রী টি, কিংবা ‘অমানুষ’-এ প্রেমা নারায়ণ। নির্লোম বাহুমূল, উন্নত স্তন, ব্লাউজ-বিহীন শরীরে মাতন-ঢেউ তুলছেন— ‘...আমায় নিয়ে খেলা করো, তুমি ওগো নিঠুর বড়।’ চরিত্রটি ঠিক নেগেটিভ নয়, ক্রমে পুরোদস্তুরই পজিটিভ হয়ে উঠছে— ‘দোহাই তোমার আমায় তুমি বিষচোখে চেয়ে দেখো না।’ ‘এক যে ছিল দেশ’-এর মতো কমিক সায়েন্স ফিকশনেও তপন সিংহ প্রেমাকে কাস্টিং করছেন। একেবারেই ভ্যাম্পের খল চরিত্র। স্লিভলেসে, ঘনিষ্ঠতায়, নাচে-গানে উত্তেজক। আবার গীতা সিদ্ধার্থ ‘বারবধূ’-তে সেই পথে গরম হাওয়া আনছেন না, তাঁর আদর্শ ‘ছেনালিপনা’ চরিত্রটিকে ঝকমকে করে তুলছে।
বোম্বাইয়ের বোম্বেটেরাই শুধু নন, বাংলার মলয়জ শীতলাং অভিনেত্রীরাও গুটিগুটি পায়ে ভ্যাম্পের র্যাম্পে হাঁটা শুরু করছেন মুখ্যত ষাটের দশকের শেষ দিক বা সত্তরের দশকের শুরু থেকে। উল্লেখযোগ্য ব্যতিক্রম অবশ্যই উত্তমকুমার-কালী বন্দ্যোপাধ্যায় অভিনীত ‘সোনার হরিণ’-এর বার-গাইয়ে ‘মিস রুবি মৈত্র’— নমিতা সিংহ। পরিস্থিতি তাঁকে ঠেলে দিয়েছে ‘খারাপ কাজ’-এর দিকে। ১৯৫৯ সালের এ ছবিতে স্লিভলেস কালো পোশাকে চূড়ান্ত তাঁর আকর্ষণ। দুলকি চালে গাইছেন, ‘তোমার দুটি চোখে ওই যে মিষ্টি হাসি।’ তার পর ‘এই মায়াবী তিথি, এই মধুর গীতি’-তে যেন সেক্স অ্যাপিল আরও ফুটে বেরোতে থাকে। প্রথম শটেই পা থেকে টিল্ট-আপে গোটা শরীরটি ধরা পড়ে ক্যামেরায়।
তবে সত্তরের দশকে টিপিক্যাল ভ্যাম্প চরিত্রে সব থেকে বেশি অভিনয় করেছেন বোধহয় সুলতা চৌধুরী। ‘স্ত্রী’-র সরলা লারেলাপ্পা নাচে না বটে, ঘোমটাও তার সরে না, কিন্তু চোখে থেকে যায় গোপন ঢলানি। কখনও সে অকিঞ্চিৎকর পরপুরুষের উদ্দেশে বলে, ‘কী গো, গিলে খাবে নাকি, পথ ছাড়ো’, কখনও পাঁচ টাকা অধিক বেতনের প্রতিশ্রুতি পেয়ে নির্দ্বিধায় শক্ত করে হাত ধরে গোপনে পথ দেখায় বউরানির পেয়ারের ক্যামেরাবাবুটিকে।
‘বাঘবন্দী খেলা’-তে সে হয়ে উঠছে ভবেশ বাঁড়ুজ্জের (উত্তমকুমার) আশমানি কবুতর! রাতের সঙ্গী। হাতে গেলাস, মুখে ধোঁয়া। খাটো পোশাকে, গভীর নাভির ঝলকে ‘বাজারের মেয়েমানুষ’। ‘সন্ন্যাসী রাজা’-র বিলাসী দাসী কিংবা ‘মৌচাক’-এর আলট্রা-মডার্ন রিনা সুলতার ভ্যাম্প-অভিনয়কে বৈচিত্রময় করে তোলে।
‘সন্ন্যাসী রাজা’-র শুরুর দিকেই খলনায়ক ডাক্তার আর বিলাসী দাসীর আলাপ বুঝিয়ে দেয় তাদের নিয়তি কোথাও সম্পর্কিত। ডাক্তারবাবুর লোলুপ দৃষ্টিতে বিলাসী মুখ টিপে হাসি চাপে, ঘাড় ঘুরিয়ে আড়চোখে মাপে। ডাক্তারবাবুকে তাঁর ঘর দেখিয়ে দেয়। ভবিষ্যতে সেই ঘরকে পাকাপাকি করে তুলতেও ডাক্তারের সঙ্গে হাত মেলায় সে। এক দিন সোহাগ করে ডাক্তারের গলা জড়িয়ে ধরে জানায়, তারও চাই রানিমার মতো সোনার হার। কিন্তু সোহাগে কাজ না দিলে, এই ভিলেনটিকে ব্ল্যাকমেল করতেও সে ছাড়ে না। বলে, হার না পেলে সে ডাক্তারের সব কুকীর্তি রাজাবাবুকে ফাঁস করে দেবে। পরক্ষণেই ডাক্তার যখন তার হাতে হাত রাখে, গালে আদরের টোকা মারে, বিলাসী বলে ওঠে— ‘এ জীবন থাকতে আপনার ক্ষতি আমি কক্ষনও করব না।’ যদিও শেষমেশ তাতে কাজ হয় না, ডাক্তারের হাতেই মরতে হয় বিলাসীকে।
এখন দজ্জাল শাশুড়ির রোলে অভিনয় করেন বলে পরিচিত হলেও, অনামিকা সাহার শুরুর দিনগুলো অনেকটাই কেটেছিল ভ্যাম্পের আবছায়ায়। ‘প্রতিশোধ’-এ নাচে অপটু সৌমিত্রর সঙ্গে যেমন তিনি তাল মেলাচ্ছেন— ‘কী বিষের ছোবল দিবি কালনাগিনী তুই’! একই ভাবে ‘প্রার্থনা’-তে তাঁর লালপেড়ে শাড়ি আর পিঠখোলা ব্লাউজে নাচের রসাস্বাদন করছেন ভিক্টর বন্দ্যোপাধ্যায়।
আবার নায়িকা হিসেবেই যাঁরা পরিচিত, কোনও কোনও ছবিতে তাঁদের অভিনীত চরিত্রেও স্পষ্ট হয়েছে ভ্যাম্পের লক্ষণগুলি। ‘জীবন জিজ্ঞাসা’-র শেফালি (সুপ্রিয়া দেবী) যেমন খসে পড়া আঁচলে, নেশাতুর আচরণে ভ্যাম্পের কাছাকাছি পৌঁছে যায়। তেমনই ‘কলঙ্কিত নায়ক’-এ ‘ডাকসাইটে বেশ্যা’ হয়ে ওঠে রোজি (অপর্ণা সেন)।
তবে ‘মোহনার দিকে’ ছবিতে অপর্ণা সেন অভিনীত সুচেতা চরিত্রটি সে দিক থেকে অনবদ্য। তাকে প্রথম দেখা যাচ্ছে সুইমিং পুলের ধারে শুয়ে থাকতে, প্রকৃত প্রস্তাবেই ‘আপাদমস্তক’ একটি প্যানে। খোলা উরু, উন্মুক্ত বক্ষবিভাজিকা। এক দিন কলেজ ফ্রেশার্সে যে ছাত্রীটি ‘আছে গৌর-নিতাই নদিয়াতে...’ গাইতে উঠে দর্শকের তুমুল হাততালির চোটে অস্বস্তি বোধ করে তড়িঘড়ি শাড়ির আঁচল টেনে নেয়, পরবর্তী জীবনে সে-ই পানশালায় ‘এই রাতে একটুখানি কাছে, আরও কিছু কাছে আসতে পারো’-র উষ্ণতায় স্বচ্ছন্দ হয়ে ওঠে! স্কচ-সিগারেট ছাড়া তার চলে না। যথেচ্ছ মিথ্যাচারে সে ক্রমে ডুবে যেতে থাকে সমাজের পাঁকে। ছবির গুরুত্বপূর্ণ চরিত্র হয়েও, তার মধ্যে দিয়ে যেন উঠে আসতে থাকে এক আদর্শ ভ্যাম্পের আইডিয়া।
‘এক আধুনিক বিশ্বামিত্রের ধ্যান ভাঙাতে’ মেনকার ভূমিকায় অবতীর্ণ হয় সুচেতা। সৎ আয়কর অফিসার সুশোভন (দীপঙ্কর দে) তার টার্গেট। তার সঙ্গে প্রেমের অভিনয় করে কাজ হাসিল করতে হবে। সস্ত্রীক সুশোভনকে ধাওয়া করে ম্যাকল্যাসকিগঞ্জে পৌঁছে সে বুঝতে পারে, এই সুশোভনের সঙ্গেই কলেজে তার প্রেম ছিল। সেই স্মৃতি ফিরে আসে, কাজ বুঝি আরও কঠিন হয়ে যায় সুচেতার কাছে। এক রাতে মদ্যপ টালমাটাল অবস্থায় একটা সিগারেটের জন্য সুশোভনের ঘরে পৌঁছে যায় সে। বলে, ‘এসো না, তোমার সঙ্গে একটু গল্প করি। ভয় নেই, তোমার বউ জেগে যাবে না।’ তার আচরণে অসন্তুষ্ট হয়ে সুশোভন কলকাতা ফিরে যাওয়ার পরিকল্পনা করলে, এই সুচেতাই তাকে বলে, ‘কথা দিয়েছ কিন্তু, কলকাতা গিয়ে সময় দেবে। কী, আবার বউ-এর পারমিশন-টারমিশন লাগবে না তো!’
কিন্তু সময়ের সঙ্গে সঙ্গে ছবিটা বদলাতে থাকল। হিন্দি ছবিতে যেমন, বাংলাতেও তেমনি ভ্যাম্পের আনাগোনা কমে এল। হবে না-ই বা কেন? ১৯৭৮-এর ‘ডন’-এ হেলেন যা করেছিলেন, ২০০৬-এ করিনা কপূরকে দিয়েই সেই কাজ করালেন ফারহান আখতার। ’৭৫-এর ‘শোলে’-তে হেলেনের যা ভূমিকা ছিল, ২০০৭-এর ‘রামগোপাল বর্মা কি আগ’-এ ‘মেহবুবা মেহবুবা’-য় সেই ভূমিকা পালন করলেন উর্মিলা মাতন্ডকর। পাবলিকও দেখল, এক জন নায়িকাকেই যদি স্বল্পবাসে পাওয়া যায়, তা হলে আর ভ্যাম্প কেন! কাজেই প্রযোজক যখন বলল, ‘একটা দুষ্টু গান ঢোকান না দাদা, দুষ্টু গান ঢোকান’, তখন আইটেম নাম্বার রইল, কিন্তু মার্কামারা ভ্যাম্প অভিনেত্রীদের আর দরকার পড়ল না। সুন্দরী নায়িকারাই সেই সব ‘ম্যাজিক মামনি’দের ভূমিকায় স্বচ্ছন্দ হয়ে উঠলেন।
হালফিলের অঞ্জন দত্তের ‘ব্যোমকেশ বক্সী’ (আদিম রিপু) ছবিতেও তো শিউলি দেবীর ভ্যাম্প চরিত্রে স্বস্তিকা মুখোপাধ্যায়কে দেখি। এই স্বস্তিকাই অঙ্গুরী দেবী হয়ে ওঠেন দিবাকর বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘ডিটেকটিভ ব্যোমকেশ বক্সী’-তে। তাই কেউ যদি প্রশ্ন করেন, ‘ভ্যাম্প-রা সব গেল কোথায়?’ উত্তর হবে, ‘রাতের সব ভ্যাম্পই অাছে দিনের নায়িকার গভীরে।’ আলাদা করে কাউকে ভ্যাম্প সাজানোর দরকার নেই।
আগে, নারীদের যেমনটি হওয়া উচিত, তার চৌকাঠ ধরে তৈরি হত নায়িকার ব্যবহার, আর যেমনটি হওয়া উচিত নয় (কিন্তু যেমনটি হলে পুরুষদৃষ্টির ভারী আরাম ঘটে), তেমনটি ধরে তৈরি হত ভ্যাম্পের চরিত্র। এখন নারীস্বাধীনতা কিছুটা এসে যাওয়ার ফলে, আর বাজারস্বাধীনতাও বেড়ে যাওয়ার ফলে, এ সবের ঠোক্কর ও টক্করে একই নারী কখনও শাড়ি কখনও হটপ্যান্টসে দিব্যি বিরাজ করছেন। চোখ ও মন তা মেনে নিচ্ছে।
আসলে, খাটো পোশাক, মদ, সিগারেট, পুরুষের সঙ্গে অনাড়ষ্ট, ‘কাছে এসো’ ব্যবহার— যে সব উপকরণ দিয়ে আগে ভ্যাম্প চরিত্রগুলিকে গড়া হত, আজ আর তা দিয়ে কাউকে ‘খারাপ মেয়ে’ বোঝানো সম্ভব নয়। অলক্ষ্মীর সংজ্ঞা বদলে গিয়েছে। বদলে গিয়েছে লক্ষ্মীর সংজ্ঞাও। আবার এমনও হতে পারে, সংজ্ঞা মোটামুটি একই আছে, কিন্তু সবাই বুঝে গেছে, সিনেমা দেখতে বসে একই নায়িকাকে একটা দৃশ্যে ভ্যাম্প ভেবে মজা নিতে হবে, আর অন্য দৃশ্যে সতী বলে কেঁদে ভাসাতে হবে! দর্শকদের এই টু-ইন-ওয়ান পেয়ে যাওয়ার তাগিদেই কি নির্বাসনে চলে গেল ভ্যাম্পেরা?
কৃতজ্ঞতা: চন্দন গোস্বামী, বরুণ চট্টোপাধ্যায়