স্টেশনের ভিখিরি

কেউ ছিল দাপুটে ফুটবলার, কেউ ট্রেড ইউনিয়ন নেতা, কেউ প্রাইভেট টিউটর। আজ ঠিকানা স্টেশন চত্বর, পেশা: ভিক্ষে করা।আগের দুনিয়ায় লোকে বলত, যার কিছু নেই তার ভগবান আছে। কিন্তু আধুনিক পৃথিবীতে ভগবানের মৃত্যুর পর ব্যাপারটা এমন দাঁড়িয়েছে— যার কিছু নেই তার স্টেশন আছে। স্টেশন বলতে ভারতীয় রেলওয়ের জংশন স্টেশনের বড় বড় সব চত্বর। এখানে প্রয়োজনে-অপ্রয়োজনে ঘুরতে-ফিরতে মাঝেমধ্যেই মনে হয়েছে, বাতিল জিনিসপত্র ফেলার জন্য যেমন ডাস্টবিন থাকে, বাতিল মানুষ ফেলার জন্য আছে এই সব রেলওয়ে স্টেশন। বাতিল মানুষ বলতে, যেমন ধরা যাক যূথিকা মিত্র। তার সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিয়েছিল মালা ঘোষ।

Advertisement

তমাল বন্দ্যোপাধ্যায়

শেষ আপডেট: ২৪ মে ২০১৫ ০০:০১
Share:

ছবি: সুমন চৌধুরী।

আগের দুনিয়ায় লোকে বলত, যার কিছু নেই তার ভগবান আছে। কিন্তু আধুনিক পৃথিবীতে ভগবানের মৃত্যুর পর ব্যাপারটা এমন দাঁড়িয়েছে— যার কিছু নেই তার স্টেশন আছে। স্টেশন বলতে ভারতীয় রেলওয়ের জংশন স্টেশনের বড় বড় সব চত্বর। এখানে প্রয়োজনে-অপ্রয়োজনে ঘুরতে-ফিরতে মাঝেমধ্যেই মনে হয়েছে, বাতিল জিনিসপত্র ফেলার জন্য যেমন ডাস্টবিন থাকে, বাতিল মানুষ ফেলার জন্য আছে এই সব রেলওয়ে স্টেশন। বাতিল মানুষ বলতে, যেমন ধরা যাক যূথিকা মিত্র। তার সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিয়েছিল মালা ঘোষ।

Advertisement

৮টা ৪৫-এর লোকালটা ধরব বলে এক নম্বর প্ল্যাটফর্মের একটা টিকিট কাউন্টারের লম্বা লাইনের পেছন দিকে দাঁড়িয়ে ছিলাম। সামনের ডেলি প্যাসেঞ্জার ভদ্রলোককে বললাম, পঞ্চাশ টাকার একটা নোট একটু ভাঙিয়ে দেবেন? উনি কাউন্টারের জানলাটার ঠিক বাঁ পাশে দাঁড়ানো এক ভিখারিনির দিকে আঙুল দেখিয়ে বললেন, ‘ওই বুড়িটাকে দিন, ভাঙিয়ে দেবে।’

লাইনে এগোতে এগোতে যখন আমি প্রায় কাউন্টারের মুখোমুখি, বুড়িকে নাগালের ভেতর পাওয়া গেল। টিকিট কেটে বেরিয়ে যাওয়া যাত্রীদের কাছে ফাটা-ফাটা মরা চামড়ায় ভরা ডান হাতটা মেলে ভিক্ষে করছে। দু-এক জন ভাড়া দিতে অসুবিধেয় পড়া যাত্রীকে আবার দিব্যি দশ-বিশ টাকার ছোট নোট ভাঙিয়েও দিচ্ছে। টিকিট কাউন্টারে বসা রেলওয়ে স্টাফেরা ইদানীং খুচরো নিয়ে খুব ঝামেলা শুরু করায়, বুড়িটি বেশ এক ভাল রকম মুশকিল-আসান হয়ে উঠেছে, চলমান খুচরো জোগানোর মেশিন।

Advertisement

আমার নোটটা ওর দিকে বাড়িয়ে চাপা স্বরে বললাম ‘তোমার ভিক্ষেটা রেখে এটা একটু ভাঙিয়ে দাও তো দেখি।’ বুড়ি হাত দেখিয়ে আশ্বস্ত করল। তার পর, কাউন্টারের মুখে পৌঁছনোর ঠিক আগে, সুযোগ মতো আমার হাতে ধরিয়ে দিল চারটে দশ টাকার ময়লা নোট আর চারটে দু’টাকার কয়েন। বৃদ্ধার দিকে মৃদু হেসে কাউন্টারের গর্তে হাত পুরে দিলাম।

টিকিটটা নিতে গিয়ে ডান দিকে তাকাতেই আচমকা চোখে পড়ল, আর এক জন বুড়ি ভিখারিনি। তার অবশ্য একটা হাত সামনে পাতা নেই। ঘোলাটে চোখের নিষ্প্রভ চাহনিতেও কোনও চাওয়া নেই। দেখতে একেবারেই গড়পড়তা মহিলা ভিখারিদের মতো না। নাক-চোখ-মুখ বেশ ধারালো, গায়ের রং বেশ পাকা, মাথাভর্তি ঝাঁকড়া পাকা চুল। বলিরেখায় ভরা পাঁশুটে মুখে থমথমে দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে অনির্দিষ্ট ভাবে।

রাতের দিকে ট্রেন থেকে নেমে টিকিট কাউন্টার লাগোয়া ওই থার্ড ক্লাস ওয়েটিং রুমের করিডর বরাবর এগোচ্ছি, আচমকা নজরে পড়ল, সকালে দেখা সেই বনেদি চেহারার বুড়িটা। গ্রানাইট পাথরে মোড়া মোটা পাথরের আড়ালে হাতের ফাঁকে লুকিয়ে বিড়ি খাচ্ছিল।

স্পষ্ট দেখলাম, আমি ওর দিকে পা বাড়িয়েছি দেখে হাতের তালুর ভেতরে জ্বলন্ত বিড়িটাকে ঢুকিয়ে নিল। আমি যখন একদম পাশে পৌঁছেছি, আমার দিকে অপরাধীর মতো মুখ তুলে তাকিয়ে অযাচিত ভাবেই বলল, ‘ঠান্ডা লেগে গলাটা আঁচড়াচ্ছে, তাই একটু তেজপাতা মুখে দিচ্ছিলাম।’ বলেই মুখ ঘুরিয়ে নিল।

আমি একটু কিন্তু-কিন্তু করে জিজ্ঞেস করলাম, ‘দিদিমা, আপনি কি এখানেই থাকেন? কিছু যদি না মনে করেন, আপনার নাম কী?’ বৃদ্ধা কোনও উত্তর দেওয়ার দিকেই গেল না।

আমাকে অপ্রস্তুতে পড়তে দেখে, হাত চারেক দূরে বিছানা পেতে শুয়ে থাকা মালা ঘোষ চোখের ইশারায় আমাকে ওর দিকে ডেকে নিল। মুখ টিপে হেসে জানাল ‘যুথুদির সঙ্গে এখন কথা বলে লাভ হবে না। পরে এক দিন আসবেন, মর্জি-মেজাজ ভাল বুঝে আমিই আপনার সঙ্গে কথা বলিয়ে দেব।’

ছেঁড়া কম্বলের ওপর পুরু কাঁথা দিয়ে চাতালের মেঝের এক কোণে পাতা বিছানার এক ধারে বসে, মালা ঘোষের মুখেই শুনলাম, ওই ভদ্রমহিলার নাম যূথিকা মিত্র। উনি নাকি এমনিতে বড় ঘরের বউ। ওঁর স্বামী ছিলেন দারোগা। খুব শিক্ষিত মহিলা, বি এ এম এ পাশ। ‘তা হলে এখানে কেন? ছেলেপিলে নেই?’ জিজ্ঞেস করায় মালা ঘোষ ঠোঁট উলটে বলল, ‘অতশত জানি না, যুথুদি তো বেশি কথা বলে না। যেটুকু শুনেছি, তাতে বিয়ের তিন দিনের মাথাতেই ওনার বর মারা যান, তো ছেলেপিলে কোত্থেকে আসবে? আমি এই ইস্টেশনে আছি তাও কম করে বারো বছর হল। এসে থেকেই দেখছি যুথুদিকে। তখন যেমন দেখেচি, এখনও সেই এক রকম। কারও কাছে কিছু চায় না। যে যা দেয়, তাতেই চলে। আমরা ওনাকে বলি মেমসাহেব। নিজের মনে একা বসে বসে ফটর-ফটর করে ইংরিজিতে কী সব বলে। শুধু তাই নয়, ইংরিজি খবরের কাগজ পড়ে।’

ইংরিজি খবরের কাগজ পড়ে শুনে আমার ভুরু কুঁচকে গেল। দেখে আহ্লাদে মাথা দোলাতে থাকে মালা ঘোষ, ‘আমার কথা বিশ্বাস না হয় ওকেই জিজ্ঞেস করেন, ও তো আট কেলাস অবদি পড়েছে। এই নয়ন, তুই বল না! এই দাদা বিশ্বাস করছে না আমাদের যুথুদি ইংরিজি কাগজ পড়ে।’

হাঁক শুনে খানিকটা দূরে পায়ের ওপর পা তুলে শুয়ে থাকা মদির চোখের ফরসা মতো এক জন বছর চল্লিশের পুরুষ উঠে এল। মুখ দিয়ে দিশি মদের ঝাঁজালো গন্ধ বেরচ্ছে, নেশায় চুর লালচে মুখটা থসথস করছে, সোজা হয়ে বসতে পারছে না। আমার ঘাড়ে ভর দিয়ে বলল ‘পড়ে মানে, ওটাই তো ওনার নেশা। পিলাটফর্মের যেখানে ইংরিজি কাগজ পড়ে থাকতে দেখবে, নিয়ে এসে নিজের বোঁচকায় পুরবে। রাতে ভাল চোখে দেখে না, দুপুর-দুপুর এলে দেখবেন বুড়ি রোদে বসে ইংলিশ কাগজ পড়ছে।’

আমাকে অবাক হতে দেখে ছেলেমানুষের মতো দু’হাতে তালি মেরে হেসে উঠল মালা ঘোষ। কোমরে ব্যথা সত্ত্বেও বিছানা ছেড়ে হামাগুড়ি দিয়ে এগিয়ে আমার সঙ্গে কথা বলিয়ে দিল যূথিকা মিত্রের।

মহিলা এমনিতে গম্ভীর প্রকৃতির। ‘এখানে ক’বছর আছেন’, ‘কী করেন’ এই সব পেটেন্ট প্রশ্নের কোনও উত্তর না দিয়ে থম মেরে বসে রইল কিছু ক্ষণ, তার পর অন্যমনস্ক ভঙ্গিতে বলল, ‘আমি আর কী করব? ব্যাচ পড়াই। সকালে একটা, সন্ধেয় একটা।’ ‘কাদের পড়ান? এই প্ল্যাটফর্মের বাচ্চাদের?’ জিজ্ঞেস করায় কিছুটা যেন তাচ্ছিল্যের সঙ্গে খেঁকিয়ে উঠল যুথু মিত্র। ‘এদের পড়াতে যাব কেন? আমি সব ইংলিশ মিডিয়ামের স্টুডেন্ট পড়াই। পার স্টুডেন্ট ৫০০ টাকা।’ বলে ওর স্টুডেন্টদের যে সব স্কুলের নাম করল, সে সব স্কুলই ব্যারাকপুর এলাকার দিল্লি বোর্ডের নামকরা সব ইংলিশ মিডিয়াম।

কৃষ্ণনগর স্টেশনে বসে প্রায় ১০০ কিলোমিটার দূরের ব্যারাকপুর শহরের ছাত্র পড়ানোর কথা শুনে অবাক হওয়ার কিছু নেই। ভদ্রমহিলা বিড়বিড় করে মিনিট দশেক ধরে যে সব কথা বলে গেল, সে-সব কোনও এক চরম বিকারগ্রস্তের অসংলগ্ন প্রলাপ ছাড়া আর কিচ্ছুই নয়।

নয়ন লোকটাও আমার সঙ্গে হাঁ করে বসে বৃদ্ধার কথা শুনছিল, কুচকুচে কালো বেঁটেখাটো এক মহিলার তীক্ষ্ণ ডাকে তার সম্বিত্‌ ফিরল। মহিলা নিশ্চয়ই ওর স্ত্রী, আদেশের স্বরে চিল্লে উঠে বলল, এক্ষুনি যেখান থেকে হোক ওদের ছোট মেয়েকে খুঁজে এনে হাজির করতে। আধ ঘণ্টা হল মেয়েটা নয়নের ডালপুরির দোকান থেকে খাবার আনতে গেছে, এখনও ফেরেনি। আমি কথাটায় একটু অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করে জানলাম, নয়ন ডালপুরির দোকানে ময়দা মাখা, ভাজাভুজির কাজ করে, সেখান থেকে রাতের খাবারটাও ওরা পায়।

যাকগে, নয়ন ছুট্টে চলে গেলে মালা ঘোষ পরিচয় করিয়ে দিল নয়নের বউয়ের সঙ্গে। পরিচয় করিয়ে দেওয়ার পদ্ধতি হিসেবে সে কপালে হালকা চাপড় মেরে, একটু উঁচুতে গলা চড়িয়ে, আক্ষেপের সুরে বলল, ‘সবই নসিব, বুঝলেন দাদাভাই। না হলে এই মেয়ের কিনা শেষে এই ইস্টিশানে জায়গা হয়! এই মাতালটার হাতে পড়েই মেয়েটার আমার কপাল পুড়ল। না হলে আজ যার রেলে চাকরি করে ড্যাং-ড্যাং করে ঘোরার কথা, সে কিনা করছে পিলাটফর্মে ঘুরে ঘুরে ভিক্ষে।’

অপরিচিত আগন্তুকের কাছে হুট করে তার ব্যক্তিগত দুঃখের কথা মেলে ধরায় অপ্রস্তুত মহিলা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, ‘ছাড়ো। আর ও সব কথা বলে কী হবে, যা হওয়ার হয়েছে, ও সব নিয়ে আমি আর ভাবি না।’

‘যা হওয়ার হয়েছে বলতে? কী হয়েছে? রেলের চাকরি মানে? বুঝলাম না।’ অবোধের মতো ফ্যালফেলে চোখে মহিলার দিকে চেয়ে প্রশ্ন করায় মেঘলা হয়ে উঠল শুকনো ফ্যাকাশে মুখটা। কিছুতেই মুখ খুলতে চাইছিল না, তার পর অনেক পীড়াপীড়ি করায় বলল, এখানে সবাই ওকে পুষ্প নামে চিনলেও, কলকাতার মাঠে ওকে সবাই চিনত বুলা হাড়ি নামে। খেলত ইস্টবেঙ্গল ক্লাবের মহিলা ফুটবল টিমে। বেঙ্গলের হয়ে ন্যাশনাল খেলেছে। সেই সময়ের হাফ টু আউটে খেলা ডাকসাইটে খেলোয়াড়। ‘ইস্টবেঙ্গল মাঠের মহিলা কোচ, কর্মকর্তাদের এখনও আমার কথা বললে এক ডাকে চিনবে’, বলতে গিয়ে ধরে এল বুলার গলা।

‘অসম, মণিপুরের সঙ্গে ম্যাচের সেই দিনগুলো এখনও ছবির মতো চোখে ভাসে। জানেন, এই নদিয়া ডিস্ট্রিক্ট স্টেডিয়ামে কত কোচিং করিয়েছি, চাকরিটা হয়ে যাবে এক রকম তো ঠিক হয়ে গিয়েছিল, তার পর কোথা দিয়ে যে কী সব হয়ে গেল! তখনকার দিনগুলোর কথা এখন ভাবলে নিজেরই বিশ্বাস হতে চায় না, তো লোকে কী করে করবে? কী ছিলাম, আর কী হলাম!’ ওর স্বামী নয়ন তত ক্ষণে ওর মেয়েটাকে নিয়ে পাশে এসে দাঁড়িয়েছে। ছলছল চোখের কোণটাকে কাপড়ের আঁচল দিয়ে মুছে নয়নের বউ আবার ঢুকে পড়ে স্মৃতিচারণে।

বুলার করুণ পরিণতির কথা শুনে ভারী মনে প্ল্যাটফর্ম ছেড়ে যাওয়ার আগে মুখোমুখি দেখা হয়ে গেল কৌশিক বিশ্বাসের সঙ্গে। করিডরটার উলটো দিকে যে এটিএম কাউন্টার, তার সিকিয়োরিটির কাজ করে কৌশিকদা। ওর কাছে এক বার যাচাই করলাম, বুলার ঘটনাটাও আবার কোনও প্রলাপ কি না। কৌশিকদা বলল, ও নিজে সাক্ষী, ব্যাপারটা হান্ড্রেড পার্সেন্ট সত্যি। ওই নয়ন বলে লোকটার সঙ্গে প্রেম করে পালিয়ে বিয়ে করার পর এই দিন দেখতে হবে কে জানত!

তার পর কৌশিকদা আঙুল দিয়ে দেখাল বুলা হাড়ির মতোই আর এক বাতিল মানুষকে। দেওয়াল থেকে বেরিয়ে আসা ফ্লোর টাইলস-এ মোড়া স্ল্যাবটার ওপর রাতের ঘুমের বিছানা তৈরির বন্দোবস্ততে ব্যস্ত এক সত্তরোর্ধ্ব বৃদ্ধ।

নাম শিউনারায়ণ সাউ, এক সময়ের পেল্লায় দাপুটে ট্রেড ইউনিয়ন নেতা। হাওড়ার জুটমিলে কাজ করত। লক-আউট হয়ে যাওয়া কারখানা গেটের সামনে গলাবাজি করে হিন্দি মেশানো বাংলায় বক্তৃতা করত। রাস্তায় অ্যাক্সিডেন্টে বাঁ পা-টার হাড় গুঁড়িয়ে ভাঙার পর, সরকারি হাসপাতালের চিকিত্‌সা-বিভ্রাট আর প্লাস্টারের ভেতর পচনের ফলে, এখন এক রকম পঙ্গু। হাঁটুর নীচ থেকে গোড়ালি অবধি দগদগ করছে ঘা। এখন কাঠের একখান ক্রাচ বগলে করে সারা স্টেশন জুড়ে ভিক্ষে করে বেড়ায়।

গায়ে পড়ে আলাপ করতেই টের পেলাম মানুষটার নেতাসুলভ দাপটের ঝাঁঝ। আমায় উলটে এমন জেরা শুরু করে দিল যে তাকে বুঝিয়ে পারি না যে আমি রিপোর্টার না, সাধারণ এক কৌতূহলী প্যাসেঞ্জার মাত্র। লোকটার তবু বিশ্বাস হল না। নিজের শারীরিক বা দৈনন্দিন কষ্টের কথা নিয়ে বিন্দুমাত্র উচ্চবাচ্য না করে, আমাকে খবরের কাগজের লোক ধরে নিয়েই শুরু করে দিল তার জ্বালাময়ী বক্তৃতা। সে কথার তোড়ের মোদ্দা বক্তব্য মোটামুটি বাঁধা গতেই পড়ে। মিলের মালিক পক্ষের বঞ্চনা, অসংগঠিত শ্রমিকদের দুর্দশা, অধুনা ভারত-মার্কিন রাষ্ট্রনেতাদের গা-ঘষাঘষি থেকে উঠে আসা সাম্রাজ্যবাদী চক্রান্তের গন্ধ ইত্যাদি।

সে আমরণ আন্দোলন চালিয়ে যেতে চায়। তার নতুন এজেন্ডা হল, স্টেশন চত্বরে পড়ে থাকা ভিখারিদের সংগঠিত করে আন্দোলন শুরু করা। জেলের কয়েদিরা যদি খাওয়া-পরা ফ্রি-তে পায়, ভিখারিরা কেন পাবে না?

কথাগুলো এতটুকু খারাপ নয়, অভিযোগগুলো তো প্রায় সব ক’টাই সত্যির দিকে হেলে আছে, কিন্তু একটু পরেই বোঝা গেল তার বক্তৃতাটায় কোনও যুক্তি নেই, বাঁধুনি নেই, শুধু অনেকটা রাগ আর ক্ষোভ দিয়ে ভরা চেঁচামেচি আছে, আর হয়তো এক সময়ের অভ্যাস থেকে কয়েকটা বাক্যের পরেই ছেঁড়া ছেঁড়া কতকগুলো আন্দোলন-মার্কা লব্‌জ জুড়ে দিচ্ছে। তার বাইরে আর সেই আগুনে ট্রেড ইউনিয়ন কর্মীর কিচ্ছুই অবশিষ্ট নেই।

বুঝে নিতে অসুবিধে হল না, মনোরোগের শেকড় অনেক দূর অবধি সেঁধিয়ে গেছে। কিন্তু তাতেও কি রক্ষা আছে? ভদ্রলোক জাতে বিহারি হলেও, ইহজীবনে মনে হয় না তার ঘাড় থেকে বাঙালি জাতির টিপিকাল প্রতিষ্ঠানবিরোধিতা আর পুঁজিবাদ-বিদ্বেয আর আমেরিকাকে সব কিছুর জন্য ভিলেন ঠাওরানোর ভূত নামবে।

tamalkrishnagar@gmail.com

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement