Short Story

মায়া প্রপঞ্চময়

কামরার বাতাস এর পর ভারী হয়ে আসে। কথা না বলে দু’জনে চুপচাপ পরস্পরের দিকে তাকিয়ে বসে থাকে।

Advertisement

কানাইলাল ঘোষ

শেষ আপডেট: ১৯ এপ্রিল ২০২০ ০০:০২
Share:

অন্নুর শাড়ির আঁচলে প্রদীপ থেকে আগুন লেগে যাওয়াটা লক্ষ করে মানিক মুহূর্তের মধ্যে যা সিদ্ধান্ত নেওয়ার নিয়েছে এবং কাজে লাগিয়েছে। শুধু অনামিকা যে ও রকম হিংস্র ভাবে বাধা দেবে, সে ব্যাপারটা হিসেবে ধরেনি, ফলে ওর শার্টের বোতামগুলো ছিঁড়েছে, নখের আঁচড়ে বুকের কয়েক জায়গায় চামড়া উঠে রক্ত বেরচ্ছে, চোখের পাশের ক্ষত থেকে রক্তপাত হচ্ছে আর সব চেয়ে যন্ত্রণা যেখানে হওয়ার কথা, সেটা হল জ্বলন্ত প্রদীপের পুরো একটা ছাপ ওর শার্ট পুড়িয়ে বুকের চামড়ায় চিহ্ন এঁকে দিয়েছে। ধরা গলায় অনামিকা বলে ওঠে, ‘‘এ ভাবে ঝাঁপিয়ে না পড়ে চেঁচিয়ে সাবধান করলেও তো পারতে! তুমি আমাকে বাঁচানোর জন্যে এত বড় কাণ্ড করলে আর আমি কি না পাগলের মতো...’’

Advertisement

ওকে থামিয়ে যন্ত্রণাকাতর মুখে মানিক বলে, ‘‘সাবধান করার সময় ছিল না, আমি ও পাশে পুজোর কিছু জিনিসপত্র গুছিয়ে রাখছিলাম। হঠাৎই চোখ তুলে দেখতে পাই যে তোমার আঁচলের প্রান্তে আগুনটা লাগছে। চেঁচিয়ে সাবধান করতে গেলে তুমি যদি বেশি ঘাবড়ে গিয়ে উল্টোপাল্টা কিছু করে ফেলতে, তাতে আগুন আরও তাড়াতাড়ি তোমার কাপড় ধরে নিত। আর দেখছ তো, এ সব কাপড়ে এক বার আগুন ধরলে পুরো জ্বলে উঠতে কয়েক সেকেন্ড লাগে। তাই...’’ কথা অসমাপ্ত রেখে ও চলে যেতে উদ্যত হয়।

কিছু না ভেবেই ওর হাত ধরে ফেলে অনামিকা, লজ্জা আর অনুশোচনা মেশানো গলায় বলে, ‘‘এ ভাবে আমাকে অপরাধী করে কিছুতেই যেতে পারবে না তুমি। অনেক জায়গা থেকে রক্ত পড়ছে, বুকে অমন ভাবে ছ্যাঁকা লেগেছে তোমার! মেয়েদের অনেক কিছু হাতের কাছে রাখতে হয়, আমারও ভ্যানিটি ব্যাগে অ্যান্টিসেপটিক আর পোড়ার ক্রিম আছে, আমি লাগিয়ে দিচ্ছি। আমার নখ লেগেও তো অনেকটা কেটে গিয়েছে, সেখানে তো ওষুধ দিতেই হবে! জানো না, মেয়েদের সারা শরীরেই বিষ? বিশেষ করে নখে আর জিভে! অবশ্য জানবে কী করে? তুমি তো সত্যি-সত্যিই শুকদেব, আমার দেওয়া নামটা ভুল নয়, ভুল হয়েছিল আমার, ক্ষমা করে দাও আমাকে...’’ জীবনে প্রথম কারও কাছে ভুল স্বীকার করে ক্ষমা চাওয়ার মধ্যে কোনও লজ্জা বা গ্লানি অনুভব করল না অনামিকা।

Advertisement

নিজের হাতে ওর রক্ষাকর্তার শরীরের কাটা-ছেঁড়া-পোড়া ক্ষতের উপর ওষুধ লাগিয়েও তৃপ্তি পেল না অনামিকা, মনে হল এগুলো তো ওর শরীরের আঘাতের জন্য, কিন্তু যে মানুষটা না থাকলে ও এত ক্ষণে জ্বলে-যাওয়া মাংসপিণ্ড হয়ে পড়ে থাকত, তাকে অবিশ্বাস করার প্রায়শ্চিত্ত কী ভাবে করবে ও? ও যাকে ভালবেসে মন দিয়েছিল, সে তো তার মর্যাদা রাখতে পারেনি, অথচ সমাজ আর সংসারের কথা না ভাবলে, এখন থেকে ওর নিজস্ব সব কিছু এই লোকটার একটা কথায় স্বেচ্ছায় বিলিয়ে দিতেও কুণ্ঠিত হবে না ও। সত্যিই কি তা চাইবে মানিক? কিংবা সত্যিই কি তা দিতে

পারবে ও?

এর পরের অনেকটা সময় শুধু মনের আনন্দে দিন কাটিয়ে যাওয়ার ইতিহাস— কখন রাতটা কাটবে, কখন দিনের কোনও না কোনও সময় মানিকের সঙ্গে ওর দেখা হবে— সেই ভাবনাতেই সময়ের গায়ে যেন কেউ দু’টো ডানা লাগিয়ে দিয়েছিল! যত দিন ক্ষতগুলো ছিল, তত দিন একটা বাহানা ছিল ওকে খুঁজে বার করে ওষুধ লাগানোর জন্যে জোরাজুরি। এক দিন তো সব ক্ষতেরই নিরাময় হয়, এখানেও ব্যতিক্রম হল না। শুধু অনামিকা এর পর ওর আগের জীবন, পুরনো ভাবনার মধ্যে ছন্দ হারিয়ে ফেলল। ওর জীবনের হাসি-মজা-আনন্দে ঢুকে পড়তে লাগল মানিক, কথা বলার সুযোগ কম থাকায় ওরা লেখার শরণাপন্ন হল।

কথা আর লেখার মধ্যে দিয়ে মনের ভাব প্রকাশ চলতে থাকল ঠিকই, কিন্তু মনের মধ্যে প্রশ্নটার তোলপাড় অন্নু বন্ধ করতে পারল না। এর পর কী? কোথায় গিয়ে শেষ হবে এই অদ্ভুত সম্পর্ক? মানিকের মনের দ্বন্দ্ব অবশ্য অন্নু বুঝে উঠতে পারেনি, বা চায়ওনি হয়তো। সেই ক্রান্তিকালে, সময়ের স্রোতে ভেসে যেটুকু পাওয়া যায়, সেটুকুই অল্প সময়ের মধ্যে আহরণ করে নিতে চেয়েছিল

ওর মনপ্রাণ। ও স্বীকার করেওছিল মানিকের কাছে— বাড়তি কিছু পাওয়ার আকাঙ্ক্ষাই ওকে বাস্তব সমস্যার কথা কিছুটা সময়ের জন্য ভুলিয়ে দিয়েছিল বোধহয়।

মানিকের মনের ভিতর কী চলছিল, তা জানতে বেশ দেরি হয়ে গিয়েছিল। সেই কারণে এক দিন সেই চিরন্তন প্রশ্নটার মুখোমুখি দাঁড়াতেই হয়েছিল ওকে, যার পরে মানিকের সেই চরম সিদ্ধান্ত— চলে যাবে সে সব কিছু ছেড়ে, শুধু অনামিকা বা তার স্মৃতি নয়, সম্পূর্ণ পারিপার্শ্বিক ছেড়ে, চিরদিনের জন্যে।

তার বেশ কিছু দিন পর, হঠাৎ করেই অন্নুর দরকার পড়েছিল ওর অ্যানথ্রোপলজির রিসার্চের কাজে কিছু রেফারেন্সের। সেগুলো আবার কলকাতা ব্রিটিশ সোসাইটি লাইব্রেরি ও সেই সঙ্গে এশিয়াটিক সোসাইটি লাইব্রেরি আর মিউজ়িয়াম ছাড়া কোথাওই পাওয়া সম্ভব নয়। অন্নু কপাল ঠুকে বেরিয়েও পড়েছিল পটনা থেকে। কলকাতায় ওর খুব একটা চেনাজানা কেউ নেই। একটা চিঠি পোস্ট করেছিল মানিককে খবরটা জানিয়ে যে, ও কলকাতা আসছে। তবে আশা করেনি যে, মানিক সময়মতো ওই চিঠি পাবে। কিন্তু মানিক এসেছিল ওর সঙ্গে দেখা করতে, এমনকি কাজ শেষ হওয়ার পর ট্রেনে বেশ খানিকটা রাস্তা এগিয়ে দিয়েও গিয়েছিল ওকে, এক আপনজনের মতোই।

সে দিনই এক সঙ্গে যাত্রাপথের সময়টুকুতে নিজের ভাবনাচিন্তার কিছুটা মানিক মেলে ধরেছিল ওর সামনে। ও-ও নিজের অসহায়তা আর অপারগতার কথা স্বীকার করে নিয়েছিল মানিকের কাছে। ট্রেন প্রাথমিক ধীর গতির বাধা কাটিয়ে তখন জোরদার স্পিড নিয়েছে, মানিক ট্রেনের জানলা দিয়ে ডান দিকে আঙুল তুলে দেখিয়েছিল, ‘‘ওই যে গাঁ-টি যাচ্ছে দেখা, স্যরি, এখান থেকে আমি অনুমান করতে পারছি, কিন্তু দেখাতে পারছি না, স্টেশন থেকে প্রায় আট কিলোমিটার দূর, ওখানেই বাড়ি আমার। আর এই যে স্টেশনের আগে বিশাল উঁচু রেডিয়ো টাওয়ারটা দেখতে পাচ্ছ, এটা হল আমার ছেলেবেলার স্কুলের কাছাকাছি ল্যান্ডমার্ক। ভবিষ্যতে কোনও দিন কারও সঙ্গে কলকাতা এলে হয়তো মনে পড়বে এই অজ্ঞাত জায়গায় মানিক নামে এক অখ্যাত ছেলের বাড়ি!’’

অন্নু যত ক্ষণ দেখা যায় ঘাড় ঘুরিয়ে টাওয়ারটা দেখেছিল। তার পর মানিককে বলেছিল, ‘‘জানি না আর কোনও দিন এ-রাস্তায় আসা হবে কি না, কিন্তু আমি মনে-মনে কামনা করি, তুমি যেন সারা জীবন এই টাওয়ারটার মতোই সোজা আর সরল রাখতে পারো নিজেকে। কোনও চাপ, কোনও প্রাপ্তির বাসনা যেন তোমাকে এতটুকুও বাঁকাতে না পারে! বন্ধু হিসেবে তোমাকে পেয়েছি, তাই এটুকু দাবি আমি প্রিয়তম বন্ধুর কাছে রাখতেই পারি।’’

ম্লান হয়ে গিয়েছিল মানিকের মুখ। বাইরের দিকে কিছু ক্ষণ তাকিয়ে পিছন দিকে ছুটে-যাওয়া গাছপালা, বাড়িঘর, লোকজন দেখতে দেখতে স্বগতোক্তির মতো বলেছিল, ‘‘তুমি যতটা জোর দিয়ে বন্ধুত্বের কথা বলতে পারলে, ততটা মনের জোর থাকলে আমি সম্ভবত তোমার পাশ থেকে সরে যেতাম না। কিন্তু আমাদের সম্পর্কটা একটা স্টেজে গিয়ে আর কৃষ্ণ-দ্রৌপদীর মতো ছিল না, অন্য রকম হয়ে যাচ্ছিল। ফলে আমাকে সরে আসতে হল। এ সব ক্ষেত্রে পাত্রপাত্রী নিজেরা কী ভাবল, সেটা বড় কথা নয়। পারিপার্শ্বিক আর সমাজ কী বলল, আর কী ভাবল, সেগুলো গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে। এ ধরনের সম্পর্ক আমাদের দেশ খোলা মনে মেনে নিতে পারবে না, তা জেনেই আমি সরে এসেছি। সে জন্যে তুমি আমাকে দোষারোপ করলেও আত্মপক্ষ সমর্থনে আমি মুখ খুলব না। নির্বিবাদে মেনে নেব যে, আমিও যতটা পেরেছি, চরম স্বার্থপরের মতো সুযোগ নিয়ে গিয়েছি।’’

জানলার পাশে মুখোমুখি বসে পরস্পরের হাতে হাত রেখে অনেক ক্ষণ বসেছিল দু’জনে, হয়তো একে অপরকে সান্ত্বনা দিতে চাইছিল ভবিষ্যতের চিরস্থায়ী বিচ্ছেদের কথা ভেবে। দুপুরের ট্রেনে অল্প কিছু প্যাসেঞ্জার ছড়িয়ে-ছিটিয়ে বসে, ফলে ওদের নিভৃত আলাপে কোনও বাধা হচ্ছিল না। সিগন্যাল না পেয়ে একটা ছোট স্টেশনে ট্রেন থেমে যেতে কাছের একটা টি-স্টল থেকে আসা রেডিয়োর গান ওদের মগ্নতা ভেঙে দিল। মানিক বলল, ‘‘শুনছ, ‘গাইড’ ছবির ‘আজ ফির জিনে কি তমন্না হ্যায়...’ গানটা হচ্ছে। এর সব ক’টা গানই আমার অনেক বার করে শোনা!’’

অন্নু হাসে, ‘‘তুমি চলে আসার আগে পর্যন্ত তো আমার নিজের হালই এমন হয়েছিল! এই মুহূর্তে তো এটাই আমারও মনের কথা। সারা জীবন যদি ট্রেনটা এ ভাবেই চলত আর আমরাও এ ভাবে যেতে পারতাম! যদি ভেবে নিতে পারতাম, ‘সমাজ-সংসার মিছে সব, মিছে এ জীবনের কলরব’... তা হলে আমি আর কিছুই চাইতাম না!’’

তত ক্ষণে পরের গান শুরু হয়ে গিয়েছে, ‘তেরে মেরে সপনে অব এক রঙ্গ হ্যায়...’ দু’জনে মন দিয়ে শুনে যায়। মানিক বলে, ‘‘রোড-অ্যাক্সিডেন্টে সজ্জন মারা গিয়েছে শুনেছি। ও-ই কিছুটা জোর করে ‘গাইড’ সিনেমাটা আমায় দেখিয়েছিল। গানগুলোও ওর টেপ-রেকর্ডারে বার বার শোনাত। ও বোঝাতে চাইত যে, আমার হাল রাজু গাইডের মতোই হতে চলেছে। তুমি এক সময় নিজের রাস্তায় চলে যাবে আর আমি গেয়ে চলব, ‘কেয়া সে কেয়া হো গ্যয়া, বেওয়াফা তেরে পেয়ার মে!’ আমি অবশ্য ওকে বলেছিলাম দেব আনন্দের অন্য ছবির আর-একটা গান আমার বেশি প্রিয়— ‘ম্যায় জ়িন্দগি কা সাথ নিভাতা চলা গ্যয়া, হর ফিকর কো ধুয়েঁ মে উড়াতা চলা গ্যয়া!’— তবে বাইরের পৃথিবীর কাছে আমি তো রাজু গাইডই হয়ে থাকতাম, তাই না? সে জন্যেই তো বার বার তোমাকে বোঝাতে চেয়েছি যে, আমি আমৃত্যু অনামিকা ত্রিবেদীকে নিজের মতো করে মনে রাখব, অন্নু সিংকে কখনও নয়।’’

কামরার বাতাস এর পর ভারী হয়ে আসে। কথা না বলে দু’জনে চুপচাপ পরস্পরের দিকে তাকিয়ে বসে থাকে। দু’জনেই বোঝে যে, ভবিতব্যকে অস্বীকার করা বা খণ্ডন করতে যাওয়া বোকামি, তাতে সমস্যা বাড়ে। দু’জনের চিন্তাধারা ভিন্ন খাতে বয়ে শেষে একই পরিণতিতে এসে থেমে যায়।

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement