ছোটগল্প

ফাঁড়া

নিভাও তার ব্যতিক্রম নয়। সঙ্গে পোঁ ধরার জন্য দুই যমজ পুত্র গৌর- নিতাই। দিনরাত ‘বাবা ইলিশ, বাবা ইলিশ’ করে করে প্রণয়বাবুর কান ঝালাপালা করে দিলেন। ধাড়ি ধাড়ি ছেলে, কুড়ি-বাইশ বছর বয়স হল, পড়ার নাম করে কলেজে নাম লটকে ঘুরে বেড়াচ্ছে।

Advertisement

রাজশ্রী বসু অধিকারী

শেষ আপডেট: ১৭ জুন ২০১৮ ০০:০০
Share:

ছবি: তারকনাথ মুখোপাধ্যায়

অনেক চেষ্টা করেও ফাঁড়াটা এড়ানো গেল না। সেই ঘাড়ে এসে পড়লই। গত এক মাস ধরে কম তো কৌশল করেননি। আসছে, আসবে, আগে আসুক, ইত্যাদি করে করে এক মাস পিছলে বেড়িয়েছেন নিভার হাত থেকে। ছেলেপুলেদের তো ধমকে থামানো যায়। সমস্যা এই মহিলাটিকে নিয়ে। গত তিনখানা রবিবার, শনিবার আর দু’খানা বন্ধের দিন... এ দিক-ও দিক করে কাটিয়েছেন প্রণয়বাবু। সেই কবে থেকে খবরের কাগজ খুললেই শুধু ইলিশের আগমন সংবাদ। ‘আসছে আসছে’ করে কাগজওয়ালারা এমন বাড়াবাড়ি করছে যে খাদ্যরসিক বাঙালির রসনায় কল্পনার ইলিশ সাঁতরে বেড়াচ্ছে সিজ়নের অনেক আগে থেকেই।

Advertisement

নিভাও তার ব্যতিক্রম নয়। সঙ্গে পোঁ ধরার জন্য দুই যমজ পুত্র গৌর- নিতাই। দিনরাত ‘বাবা ইলিশ, বাবা ইলিশ’ করে করে প্রণয়বাবুর কান ঝালাপালা করে দিলেন। ধাড়ি ধাড়ি ছেলে, কুড়ি-বাইশ বছর বয়স হল, পড়ার নাম করে কলেজে নাম লটকে ঘুরে বেড়াচ্ছে। ঘরের খেয়ে বনের মোষ তাড়াচ্ছে। এক পয়সা আয়ের মুরোদ নেই। ওই বয়সে প্রণয়বাবু কেরানির চাকরিতে ঢুকে গিয়েছেন। বাবাকে মাস গেলে এক হাজার করে দিতেনও। আর এদের শুধু নিত্যনতুন বায়না। আজ চিকেন আনো তো কাল মটন, পরশু পাড়ার দোকান থেকে বিরিয়ানি.... সঙ্গে তাল দিচ্ছেন তাদের খুকি মা! দিন দিন তার কচিপনা বেড়েই চলেছে।

এ বারে বৃষ্টিটাও ঝেঁপে এসেছে। তা হোক। বৃষ্টির সঙ্গে কোনও শত্রুতা নেই প্রণয়বাবুর। বরং বেশি বৃষ্টিতে দোকান-বাজার যাওয়া বন্ধ হলে খরচ কম হয়। কিন্তু যত বৃষ্টি তত অশান্তি খবরের কাগজের কল্যাণে। এমন প্রবন্ধ লিখবে যেন বঙ্গোপসাগর থেকে ঝাঁকে ঝাঁকে ইলিশের দল দিঘা, মন্দারমণি, মেদিনীপুর, তমলুক হয়ে লাফিয়ে লাফিয়ে গেরস্থর রান্নাঘরে ঢুকে পড়ছে। এত সস্তা তত সস্তা... যত্ত সব! প্রণয়বাবু ভাল করেই জানেন ও সব ভাঁওতাবাজি।

Advertisement

আরে বাবা, চারাপোনার মতো পুষ্টি আর কিসে আছে! কম তেলে আলু-ঝিঙে-পটল দিয়ে রাঁধলে সপাসপ এক থালা ভাত টানা যায়। দামটাও পকেটসাধ্য। তা সেই চারাপোনার ঝোল দিয়েই চলছিল। কিন্তু ভাতের থালার সামনে বসতেই শুরু হয় গজরগজর।

“মা, আমার মাথার পিছনটা একটু দেখে দিও তো,’’ ভাল মুখ করে ছোট পুত্র নিতাই বলে। আঁতকে ওঠে নিভা, “কেন রে? কী হল আবার? ফুটবল খেলতে গিয়ে লেগে গেল না কি?”

“না... না। মনে হয় একটা চারাপোনার গাছ গজাচ্ছে মাথায়। দেড় সপ্তাহ ধরে খাচ্ছি তো রোজ...” গম্ভীর মুখে বলে নিতাই। আর অমনি তার সুযোগ্য ধেড়ে দাদাটি মুখে ভাত নিয়ে ফ্যাকফ্যাক করে হাসতে গিয়ে কাশতে কাশতে বিষম খেল। প্রণয়বাবু দাঁত খিঁচিয়ে বলতেই যাচ্ছিলেন, “এইটুকু জোটানোর মতো যোগ্যতাও তো এত দিনে হল না!’’

কিন্তু তার আগেই ছেলের মাথায় হাত বুলিয়ে নিভা কথা দিয়ে বসে, “আচ্ছা আচ্ছা, এই রবিবার ইলিশ আনতে বলব বাবাকে। এখন তো দাম কমেছে দেখছিলাম। তার পরেই আহ্লাদে গলায় বায়না, “শোনো না, সত্যিই তো বলেছে নিতু। রোজ এই এক ছাতার মাছ কি খাওয়া যায়? সামনের রবিবার ইলিশ এনো না গো... কী গো?’’

এই গলন্ত আওয়াজের সামনে খেঁচানো দাঁত বুজেই রাখতে হয়। নইলে আবার রাত দুপুরে কী নাটক শুরু হবে কে জানে।

কপাল ভাল ছিল। সেই রবিবার নিতাই ধেইধেই করে বন্ধুদের সঙ্গে ডে স্পেন্ড নাকি ঘোড়ার মাথা করতে চলে গেল। ছোট ছেলে বাড়ি নেই। তাই বড়টাও আর বিশেষ ঝামেলা করেনি। নিভাও চুপচাপ ছিল। তার পরের রবিবার যাদবপুর সুপার মার্কেটের কে এক জন দোকানদার চলে গেলেন ইহলোকের মায়া ছাড়িয়ে। নিভা পইপই করে বলে দিয়েছিল ইলিশ আনতে। ব্যাজার মুখে বাজারে গিয়ে প্রণয়বাবু সব দোকান বন্ধ পেলেন। অটো স্ট্যান্ডের সামনে দাঁড়িয়ে মনে মনে পরলোকগত ব্যক্তির অক্ষয় স্বর্গবাস কামনা করে গুনে গুনে চার জনের চারটি ডিম কিনে ফিরে এলেন। অবশ্য দু’পা গলি দিয়ে এগোলেই সাউথ সিটির মোড়। সেখানে তো ঝাঁ-চকচকে মাছের দোকান আছেই, তারও আগে কাটজুনগরে রাস্তার উপরে আছে বেশ বড় লোকাল বাজার। এই সব দিকে ইলিশ পাওয়াই যেত। কিন্তু এক জন অচেনা লোকাল ব্যবসায়ীর অকাল প্রয়াণে প্রণয়বাবু এতই ব্যথিত হয়ে পড়লেন যে আর অন্যত্র যাওয়ার কথা ভাবতেই পারলেন না। কোমর বেঁধে তেড়ে আসা নিভাকেও তা-ই বলে শান্ত করেছিলেন।

গত রবিবার তো দুই ছেলে আর তাদের মা বাজারে আসার আগে রীতিমতো হুমকি দিল প্রণয়বাবুকে। ইলিশ ছাড়া বাড়ি ঢুকলে হয় ওরা থাকবে, নয় প্রণয়বাবু।

রবিবারের সকালে বাজার জুড়ে কেমন একটা উৎসব-উৎসব ভাব থাকে। অদৃশ্য ছাপ মারা বেশ কিছু অর্থবান মানুষ পকেটভর্তি টাকা নিয়ে বাজারের সমস্ত ব্যাপারির আকর্ষণ-আপ্যায়নের কেন্দ্রবিন্দু হয়ে ঘুরে বেড়ায়। তাদের চোখে চোখ পড়লেও হীনমন্যতা জাগে ভিতরে। নিজের সঙ্গে নিজে লড়াই করে অকস্মাৎ অনেক বেশি দাম দিয়েও কিনে ফেলতে ইচ্ছে হয় অসময়ের ফুলকপি।

তাই কোনও দিকে তাকান না প্রণয়বাবু। কিন্তু এত প্রলোভনে নিজেকে ঠিক রাখা মুশকিল। তার উপর কানে বাজছে নিভার বাণী, ছেলেদের বিদ্রুপ। চার দিকে উঁচু উঁচু করে সাজিয়ে রাখা লাল সবুজ হলুদ নানা রঙের আনাজ। সরু পিচ্ছিল মোহময় পথ ধরে প্রণয়বাবু কেমন পথভ্রষ্ট সাধুর মতো এসে হাজির হলেন মাছ-মাংসের জগতে।

মাছ! আহ... মাছের এত রূপ! কয়েক মিনিটের জন্য আত্মবিস্মৃত হয়ে যান তিনি। মোটা মোটা পাঁচ-ছ’ কিলো কাতলার সঙ্গে অভিমানী চোখের তিন-চার কেজির রুই, লোহার গামলায় খলবল করা জ্যান্ত কইয়ের পাশে শুঁড়-তোলা গলদা কিংবা ‘আমি বাংলাকে ভালবাসি’ কাব্যময়তায় ভরানো পাবদার আলিঙ্গনে গেরস্থর ডিপ ফ্রিজে স্থান পেতে উদ্‌গ্রীব চিরবান্ধব সতেজ ভেটকি! প্রণয়বাবুর বিমোহিত দৃষ্টি প্রায় ট্যারা হয়ে যায় ইলিশের বাহার দেখে। উফফফ! রূপোলি চকচকে জীবন্তপ্রায় নয়নমনোহর প্রাণহরণকারী ইলিশ !

গত রবিবার ওই ইলিশের দিকে সত্যি সত্যিই এক পা দু’পা এগিয়েছিলেন প্রণয়বাবু। তিনি নিজে আলতু-ফালতু খবরের গুজবে কান দেন না। কিন্তু কানে বাজছিল নিভার রেকর্ড। এ বার ইলিশের রেকর্ড আমদানি। দাম অনেক কম। এ বছর বাঙালি প্রাণ ভরে ছড়িয়ে ছিটিয়ে ইলিশ খেয়ে বাঁচবে... ইত্যাদি ইত্যাদি। মৎস্যমন্ত্রী উবাচ।

“ও ভাই... এইটা... এই মাছটা কত করে কেজি দিচ্ছ?” একখানা দু’আড়াই কেজি বেশ স্মার্ট চেহারার ইলিশের পেট টিপে ধরে জিজ্ঞেস করেন প্রণয়বাবু।

“আজকের কেনা দাম দিচ্ছি... আঠারোশো।’’

“কীইইইই? তবে যে শুনি দাম নাকি কমেছে এ বার?” আঁতকে উঠে পেট টিপে ধরে থাকা হাতটা ছেড়ে দেন প্রণয়বাবু। সপ্রতিভ দোকানি আপনজনের মতো হেসে ওঠে, “ঠিকই তো শুনেছেন। গত সপ্তাহেও বাইশশো টাকায় বেচেছি।’’ আর কোনও কথা জোগায়নি প্রণয়বাবুর মুখে। যদি দু’কেজিও ওজন হয় তো আঠেরো দু’গুণে ছত্রিশ, তার মানে প্রায় চার হাজার টাকা দিয়ে এক দিন মাছ খেয়ে কি বাকি দিনগুলো উপোস দেবেন? দিলেও কি তা স্বাস্থ্যের পক্ষে উপযুক্ত হবে? মুহূর্তে প্রণয়বাবু আবার ধ্যানী বুদ্ধের মতো চিন্তাশীল হয়ে পড়েছিলেন। তাঁকে অত চিন্তা করতে দেখে দোকানি অন্য পথ বাতলে দিয়েছিল।

পাশে রাখা একটু ছোট একটি ইলিশের শরীরে মায়াবী হাত বুলিয়ে মোটা কালো ঠোঁটে মেদুর হেসে বলেছিল, “এইটা নিন বরং, কমে হবে।’’

“কত?”

“দেড় হাজার। আপনার জন্য চোদ্দোশো নেব।”

কী একেবারে মাথা কিনে নেবে একশো টাকা কমিয়ে! যাহা বাহান্ন তাহা তিপান্ন। প্রণয়বাবু দেড়হাজারি যুবতী ইলিশ থেকে চোখ সরিয়ে আরও একটু পাশে সরে যান।

“এইটা? এইটা?”

“ওটা বাবু জলের দর। আটশো।”

উফফফ! এরা কী মাছ বিক্রি করতে বসেছে না কি মানুষ খুন করতে! ব্যাজার মুখে প্রণয়বাবু আর একটু ছোট থেকে আরও একটু ছোট, ক্রমান্বয়ে সিঁড়িভাঙা অঙ্ক কষে কষে নেমে আসেন। দামটা সাড়ে সাতশো, ছ’শো থেকে পাঁচশোয় আটকে যায়। আর কিছুতেই নড়ে না। অবশেষে চিরপরিচিত চারাপোনার দিকেই এগোচ্ছিলেন। পিছন থেকে ডাক আসে উদার কণ্ঠে।

“ইলিশ কিনতে বেরিয়ে অন্য দিকে যেতে নেই বাবু, ভগবান পাপ দেবেন।’’

“কী! রসিকতা হচ্ছে?”

“না বাবু... আপনি বরং এইটা নিন... দেখতেও ইলিশের মতো, খেতেও অনেকটা তাই। আর দামেও আপনার পোষাবে।’’ মাছওয়ালা ঝুড়ির তলা থেকে টেনে বের করে ইলিশ মাছের রেপলিকা। এটা তো খোকা ইলিশ। এতে কি আর বাবুদের মন উঠবে? বিপাকে পড়া মুখ নিয়ে অনেক ক্ষণ ভাবনাচিন্তার পর প্রণয়বাবু এই সিদ্ধান্তে পৌঁছলেন যে গৌর-নিতাই ছেলেমানুষ, খোকা আর খোকার বাবার পার্থক্য ধরতেই পারবে না। নিভারও অত বেশি সাংসারিক বুদ্ধি নেই যে কেটেকুটে নিয়ে গেলে আসল নকল চিনতে পারবে। বেশ নিশ্চিন্ত মনে আড়াই কেজি ইলিশের দশ ভাগের এক ভাগ দাম দিয়ে সেই খোকা ইলিশ বাড়ি নিয়ে গিয়েছিলেন প্রণয়বাবু। প্রাণে একটাই শান্তি ছিল যে খামোখা অতগুলো বাজে খরচ থেকে বেঁচে গেলেন। কত কষ্ট করে যে টাকা জমাতে হয় তা ওরা আর কী বুঝবে? সারা জীবন হেসে খেলেই কাটিয়ে দিল এই বান্দার ঘাড়ে ঠ্যাং তুলে।

আত্মপক্ষ সমর্থন করতে করতে সেই খোকা ইলিশের পুঁটুলি নিয়ে বাড়ি এসেছিলেন গত রবিবার।

তার পর যে কী হয়েছিল তা ভাবলেও গায়ে কাঁটা দেয়। নিভার যে এত জ্ঞান কে জানত! বাজারের ব্যাগ খুলে চুপ মেরে গেল। কোনও মতে দুপুরের খাওয়া সেরে ব্যাগ গুছিয়ে সোজা বেলঘরিয়া বাপের বাড়ি। ফোন করে জানা, ক’টা দিন থাকবে এখন। কবে আসবে বলা যাচ্ছে না।

এক জন পঞ্চাশ বছরের মানুষের বউ একটা গোটা দিন না থাকলেই অসুবিধার শেষ থাকে না। আশি বছরের অসুস্থ মা থেকে মানিকজোড় দুই ধেড়ে খোকার চারবেলার জোগান... খুবই সমস্যা।

নিজের ব্যাঙ্ক ব্যালেন্সের প্রতি প্রণয়বাবুর যত প্রণয়ই থাকুক, তেইশ বছরের বিয়ে করা বউও তো গায়ের চামড়ার মতোই হয়ে গিয়েছে। তাকে আলাদা করে ঘষা মাজা পালিশ না করলেও, ভুলে থাকাও তো যায় না।

শেষে অনেক সাধ্যসাধনার পর নিজের দামড়া ভাইটাকে নিয়ে গত কাল বাড়ি ফিরেছে নিভা। এই শর্তে যে, আজ সত্যি সত্যি ইলিশ মাছ আনতেই হবে। ভাইকে বড় মাছ না খাওয়ালে নাকি মান থাকবে না। হাড় হারামজাদা এই শ্যালক এমনিতেই দু’চোখের বিষ প্রণয়বাবুর। হাত উপুড় করার নাম নেই, ব্যাটার খালি বড় বড় বোলচাল। নিভার জন্যই সহ্য করতে হয়। নিভার অর্ডারি সেই মাছ আনতেই সকাল সকাল বাজারের দিকে চলেছেন তিনি। মেজাজ আরও খিঁচিয়ে আছে। কারণ বেরোনোর সময় দিদি বা ভাই কারও দেখা পাওয়া গেল না। ভাইকে পেয়ে একেবারে পৃথিবী ভুলে গিয়েছে! আদিখ্যেতার সীমা নেই। এত বছর পরও বাপের বাড়ির লোক পেলেই হল, সংসার মাথায় করে নৃত্য শুরু।

আর তাঁর বেলায় শুধু হুকুম। রেগে হোক কেঁদে হোক হুকুম তামিল করিয়েই ছাড়বে। আজ আর কোনও ভাবেই বাঁচার আশা নেই। গত সপ্তাহে আঠারোশো ছিল, আজকে কত কে জানে!

মাথা নিচু করে বিমর্ষ মুখে বাজারমুখী হাঁটছিলেন প্রণয়বাবু। হঠাৎ সামনের দিকে চোখ পড়তেই থেমে যায় পা।

যাদবপুর সুপার মার্কেট থেকে এগিয়ে এসে, অটো স্ট্যান্ড পার করে যেখানে নর্থ রোডের মুখ শুরু হচ্ছে সেইখানে অন্তত কেজি তিনেক ওজনের একখানা চকচকে ইলিশমাছ, নাকে দড়ি বেঁধে হাতে ঝুলিয়ে দুলকি চালে এ দিকেই আসছে শ্যালকবাবু। পাশে গদগদ হাসিতে মুখ ভাসিয়ে তার দিদি। প্রথমটা থমকে যান প্রণয়। এই মাছটা তো দেখেই বোঝা যাচ্ছে সাংঘাতিক উঁচু দরের মাছ। প্রায় হাজার তিনেক তো দাম হবেই। একটা দোকানের ভিতর ঢুকে দাঁড়ান তিনি, যাতে ভাইবোনের চোখে না পড়ে যান। সকাল সকাল শ্যালকবাবু তা হলে কর্তব্য করতে বেরিয়েছে! মনে মনে আরাম হয় ওঁর। যাক, বিয়ের তেইশ বছর পরেও যে দামড়া শ্যালকটার কর্তব্যজ্ঞান হয়েছে এই অনেক। তা ছাড়া মাছটার চেহারাটাই এমন যে মনের মধ্যে একটা পরকীয়া বোধের সঞ্চার হবেই হবে অতি বড় বেরসিকেরও। পকেটটাও রয়ে গেল যেমন কে তেমন, এটাই বড় শান্তি !

পায়ে পায়ে বাড়ি ফেরেন প্রণয়বাবু। ফাঁকা ব্যাগটা নামিয়ে দিয়ে টুক করে ঢুকে পড়েন নিজের ঘরে।

দুপুরে খাওয়াটা বড্ড জম্পেশ হল। নিভা রেঁধেওছিল বড্ড ভাল। ভাজা ভাপা দই সর্ষে কালোজিরে কাঁচালঙ্কা... যত রূপে হয়, সাজিয়ে-গুছিয়ে পেটিগুলোকে সকলের সামনে ধরে দিয়েছিল। তখন সবার ধ্যানজ্ঞান সব থালায় কেন্দ্রীভূত। আর অদ্ভুত ভাবে দামড়া শ্যালকটার উপর পুষে রাখা এত দিনের রাগটাও হাপিস হয়ে গেল। আহা, এত দিনে হলেও তো শিখেছে, বুড়ো জামাইবাবুর উপর ওরও কিছু কর্তব্য আছে। যাক, বেটার লেট দ্যান নেভার।

প্রচুর খেয়েছেন। শুতেই হল একটু। দিবানিদ্রা ছাড়া দুপুরের ইলিশ উৎসব মিসম্যাচ। সুন্দর একখানা ঘুম চোখের উপর নেমে আসছে, এমন সময় ঘরে ঢোকে নিভা। বহু দিন পরে দিনের বেলায় দরজা ভেজিয়ে বক্ষসংলগ্ন হয়।

“তুমি কী ভাল গো, মিথ্যেই তোমায় রাগঝাল করি। আমাকে ক্ষমা করে দাও।”

জড়িয়ে আসা চোখে নিজের এবং নিভার দু’জনের টোটাল ভুঁড়ি একসঙ্গে বেষ্টন করে প্রণয় বলেন, “তুমি আমাকে ক্ষমা করে দাও নিভু। তোমার ভাইকে কত গালমন্দ করেছি। কিন্তু কত ভাল, কত উদার আমার শ্যালকবাবু। কত কর্তব্যজ্ঞান! কেমন সুন্দর একটা ইলিশ নিয়ে এল আজ!”

“ও মা... ওটা ও কোথায় আনল? ওটা তো আমি কিনলাম। তোমার মান রাখলাম।”

মুহূর্তে চোখ থেকে উবে যায় ঘুম। এক ঝটকায় নিভাকে সরিয়ে উঠে বসেন প্রণয়বাবু।

“কো... কো... কোথা থেকে ট... ট... টাকা পেলে তুমি?” তোতলাতে শুরু করেন। বিস্ফারিত চোখ থেকে যেন মণি খুলে বেরিয়ে আসছে।

নিভা নতুন বউয়ের মতো গলন্ত গলায় বলে, “আহা... আমি যেন জানি না! আলমারির ভিতরের ড্রয়ারের পিছনের চেম্বারে... খবরের কাগজের তলায় তুমি টাকা রাখো! আমি বউ হয়ে জানব না?”

“ওইখান থেকে তুমি টাকা নিয়েছ?’’ আর্তনাদ করে ওঠেন প্রণয়, “আমার একটু একটু করে জমানো টাকা! আমার চারাপোনার ঝোল খেয়ে খেয়ে জমানো টাকা!’’

নিভা আহ্লাদী গলায় হাসে, “হ্যাঁ নিলাম। তোমার টাকা তো আমারও টাকা। তোমার সম্মান আমার সম্মান...’’

আর কিছু বলতে বা শুনতে পান না প্রণয়বাবু। তিরবেগে ছুটে যান বাথরুমের দিকে। চকচকে ইলিশ কেবলই পেটের মধ্যে ঘাই মারছে, ভিন্ন রূপে।

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement