ছবি: অমিতাভ চন্দ্র
পূর্বানুবৃত্তি: গাড়িতে বসেই বিভূতি কমলেশ রায়কে জানাল, সে সৌহার্দ্য-শ্রীকণারও যেমন খবর এনেছে, তেমনই বিতান সম্পর্কেও খোঁজ নিয়েছে। বিতানকে নিয়ে সে দু’পাতার টাইপ-করা রিপোর্ট কমলেশের হাতে তুলে দিল। গাড়ি থেকে নামার সময় দিল একটা খাম, সেখানে শ্রীকণা বসুর কয়েকটা ফোটো আছে, মোবাইলে তোলা।
কমলেশ কথার মাঝখানেই হাত বাড়িয়ে খামটা নিলেন। তাঁর ইচ্ছে করছিল এখুনি খাম খুলে দেখেন, কিন্তু নিজেকে সামলে নিলেন। বিভূতির সামনে এতটা কৌতূহল ঠিক হবে না। বিভূতি গাড়ি থেকে নেমে যাওয়ার পরও পাশে পড়ে থাকা খামে হাত দিলেন না। তাড়াহড়ো কিছু নেই।
অফিসে ঢুকে কমলেশ রায় খবর পেলেন, কম্পিউটার সিস্টেমে বড় ধরনের গোলমাল হয়েছে। সার্ভার ডাউন হয়ে গিয়েছিল। তাকে চালু করা গিয়েছে, কিন্তু তাতে নতুন জটিলতা হচ্ছে। চেয়ারে বসতেই মনোজ ত্রিপাঠীর ফোন।
‘‘স্যর, আপনি কি কম্পিঊটার অন করেছেন?’’
কমলেশ বললেন, ‘‘না, শুনলাম কী গোলমাল করছিল। ঠিক হয়েছে?’’
ত্রিপাঠী বলল, ‘‘বেসিক প্রবলেম ঠিক হয়েছে, কিন্তু এখনই কম্পিউটার খুলবেন না। ফাইল ডিলিট হয়ে যাচ্ছে।’’
কমলেশ বললেন, ‘‘সে কী! সে তো ভয়ঙ্কর!’’
ত্রিপাঠী বললেন, ‘‘আমাদের ইঞ্জিনিয়ার কাজ করছে। বাইরে থেকেও এক্সপার্ট কল করা হয়েছে।’’
‘‘তা হলে এখন গোটা অফিসে কাজ বন্ধ?’’
ত্রিপাঠী শুকনো গলায় বলল, ‘‘এক রকম তা-ই। সবাই মেশিন খুলতে ভয় পাচ্ছে। যদি ফাইল ডিলিট হয়ে যায়!’’
কমলেশ চিন্তিত গলায় বললেন, ‘‘দেখো কত তাড়াতাড়ি নরমালসি রেস্টোর করা যায়। জানিয়ো।’’
কমলেশ রায় দরজার বাইরের ‘বিজ়ি’ আলো জ্বালালেন। ইন্টারকম তুলে চা পাঠাতে বললেন। বলে দিলেন বাইরে থেকে ফোন এলে বুঝেশুনে লাইন দিতে হবে। সব ফোন দেওয়ার দরকার নেই। পরে করলেই হবে। ইন্টারকমের রিসিভার নামিয়ে টেবিলের উপর ফেলে রাখা খামটা টানতে গিয়ে থমকে গেলেন কমলেশ রায়। এটা পরে, আগে বিতানের ফাইলটা দেখা দরকার। ফাইল নিয়ে দ্রুত চোখ বোলালেন কমলেশ। যত এগোতে লাগলেন তত ভুরু কোঁচকাতে থাকল তাঁর।
নবনী বরং কম করে বলেছে। ছেলেটার শুধু কাজকর্ম করার ইচ্ছে নেই এমনটাই নয়, মনে হয় যোগ্যতাও নেই। একটার পর একটা চাকরি ছেড়ে দেয়। অথবা তাকে ছাড়িয়ে দেওয়া হয়। বাবা দ্বিতীয় বার বিয়ে করে ছেলেকে বাড়ি থেকে সরিয়ে দিয়েছে। তার পরেও সেখানে যাতায়াত আছে। কেন যাতায়াত সে ব্যাপারে বিভূতির রিপোর্টে স্পষ্ট করে কিছু লেখা নেই। তবে ইঙ্গিত আছে। মনে হয়, টাকা চাইতে যায়। অন্য কোনও উদ্দেশ্যও থাকতে পারে। ভদ্রলোকের দ্বিতীয় পক্ষের স্ত্রীর একটি মেয়ে আছে। সেই মেয়ে কলেজে পড়ে। মেয়েকে নিয়েই মহিলা বিতানের বাবার কাছে এসে উঠেছিল। ছেলেটি কেন ওই বাড়িতে যাতায়াত করবে? আহি কি এত সব জানে?
ফাইল পড়া শেষ হলে কমলেশ রায় চুপ করে বসে রইলেন কিছু ক্ষণ। নবনী ঠিক বলেছে। মেয়ের সঙ্গে কথা বলতে হবে। অবশ্যই বলতে হবে। আহি এই ছেলেকে নিয়ে জীবনে চলার কথা ভাবলে বিরাট বিপদে পড়বে। কিন্তু কী ভাবে তাকে আটকানো যাবে? আহি আর পঁাচ জনের মতো নয়। সে সেন্সিটিভ, জেদি। নিজে যা ভাল বুঝবে করবে। আজ পর্যন্ত কোনও বিষয়ে সে ভুল করেনি। এই কনফিডেন্স তাকে সমস্যায় ফেলবে। ঠিক মানুষ অনেক সময় মাত্র একটা ভুলে নিজের সাজানো-গোছানো জীবন লন্ডভন্ড করে ফেলে। এই ছেলে কোনও ভাবেই আহির সঙ্গে ম্যাচ করবে না। প্রেমের উন্মাদনা কেটে গেলে আহির সমস্তটাই বৃথা মনে হবে। তবে সবার আগে জানা দরকার, আহি এই ছেলেকে সত্যি কতটা পছন্দ করে।
কমলেশ ফাইল সরিয়ে রেখে চেয়ারে হেলান দিলেন। জটিল সমস্যায় পড়া গেল! মেয়ে তাকে বিশ্বাস করে। বাবা তার ভালবাসার মানুষকে সরিয়ে দিতে চাইছে, সে ভাবতেই পারবে না। তা হলে?
চায়ের কাপে শেষ চুমুক দিলেন কমলেশ। সোনালি বর্ডারের শৌখিন কাপ। কাপটা রাখতে গিয়ে থমকে গেলেন। সে দিন সৌহার্দ্য নামের ছেলেটা এই রকমই একটা কাপ ভেঙেছিল না? ভাঙেনি, ওর হাতে লেগে পড়ে গেল।
আপনা থেকেই ভুরু কুঁচকে গেল কমলেশের। টেবিলের কোনায় রাখা কাপটার দিকে ভাল করে তাকালেন। কাপটা সে দিন কী ভাবে পড়েছিল? হাতে লেগে? না কি হাতের ধাক্কায়? হঠাৎ এ রকম একটা অদ্ভুত প্রশ্ন মাথায় আসার কারণ কী? অস্বস্তি শুরু হল কমলেশের। তিনি মাথা ঝঁাকালেন। এ রকম একটা তুচ্ছ বিষয় নিয়ে মাথা ঘামাচ্ছেন কেন? নিজের ওপর বিরক্তি হল। ঘটনাটা যেন উড়ে এসে মাথার ভিতর জুড়ে বসল। বেরোতে চেষ্টা করলেন, পারলেন না। খচখচ করছে।
কাপটা টেবিলের কোনায় রাখলেন কমলেশ। যত কোনায় রাখলে সামান্য ধাক্কায় পড়ে যেতে পারে, ততটা কোনায়। তার পর হালকা ভাবে হাত লাগালেন। পড়ল না। আরও এক বার হাত দিলেন। ডিশের উপর রাখা কাপ সামান্য নড়ল, কিন্তু এ বারও পড়ল না। বোঝা-ই যাচ্ছে, কাপ টেবিল থেকে ফেলতে গেলে অল্প হলেও ধাক্কা লাগবে। হাতে ধাক্কা লাগলে কি বোঝা যাবে না? তার থেকেও বড় কথা, ধাক্কায় কাপ নীচে পড়লে একেবারে জানা যাবে না, এটা হতে পারে না। অথচ সে দিন সৌহার্দ্য এমন ভাবে ঘর থেকে বেরোল যেন কিছুই জানতে পারেনি! কাপটা পড়ল, ভাঙল, তার পরেও নির্বিকার ভাবে বেরিয়ে গেল। তবে কি সে ইচ্ছে করে কাপটা ফেলে দিয়েছিল? তার কোনও রাগ, ঘৃণা জানিয়ে গেল?
কমলেশ ঝিম মেরে বসে রইলেন। এ সব তিনি কী উল্টোপাল্টা ভাবছেন! কেনই বা ভাবছেন? তিনি কি কোনও অপরাধবোধে ভুগতে শুরু করেছেন? মনে হচ্ছে তা-ই। হাত বাড়িয়ে টেবিলে পড়ে থাকা খামটা টানলেন। তার মন বলছে, তিনি যা ভাবছেন সেটাই সত্যি। বিভূতির ‘খবর’ সে দিকেই ইঙ্গিত করেছে। সৌহার্দ্যও মায়ের নাম বলে, কাপ ভেঙে সে কথা বুঝিয়ে দিয়ে গেছে।
পোস্টকার্ড সাইজের ফোটোটা দেখে কমলেশ রায় চমকে ওঠার বদলে মুচকি হাসলেন। মনে মনে নিজেকে তারিফ করলেন। ঠিক বুঝতে পেরেছিলেন তিনি। কর্পোরেট জগতের শুকনো জীবন মানুষের মনকে পুরোপুরি দুমড়ে-মুচড়ে দিতে পারে না। পারে না বলেই শ্রীকণাকে তিনি এক বারে চিনতে পারলেন।
সাঁইত্রিশ বছরে শ্রীকণা পুরোটাই বদলে গিয়েছে, কিন্তু তার চোখের মায়া এখনও মোছেনি। এই মায়া সে তার পুত্রের মধ্যেও রেখে দিয়েছে। প্রথম দিন সৌহার্দ্যর চোখ দেখে তাই মনে হয়েছিল, কোথায় যেন দেখেছি। শ্রীকণার চোখ দেখেই এক দিন তিনি তার প্রেমে পড়েছিলেন।
‘‘তুমি আমাকে এত ভালবেসেছ কেন কমলেশ? কী পাও আমার মধ্যে?’’
‘‘তোমার চোখ আমার মাথা খারাপ করে দেয়।’’
‘‘ও! তা হলে আমাকে নয়, তুমি আমার চোখের সঙ্গে প্রেম করো?’’
‘‘শ্রীকণা, মানুষের মনের ভিতরটা চোখেই প্রকাশ পায়। যার চোখ এমন মায়া-মাখা, তার মনটাও না জানি কত মায়ার।’’
‘‘ধুস, পাগল একটা।’’
‘‘পাগল হব কেন? রবীন্দ্রনাথই তো লিখে গিয়েছেন, কার চোখের চাওয়ার হাওয়ায় দোলায় মন, তাই কেমন হয়ে আছিস সারা ক্ষণ।’’
কমলেশের মুখ থমথমে হয়ে গেল। এই ভাবে কি হুড়মুড়িয়ে সব মনে পড়বে? তরুণ বয়সের যাবতীয় ছেলেমানুষি!
মোবাইল তুলে নম্বর টিপলেন কমলেশ।
‘‘স্যর বলুন।’’
কমলেশ চাপা গলায় বললেন, ‘‘বিভূতি, শ্রীকণা বসুর ফাইলটা বন্ধ করে দাও। তার সম্পর্কে আমার আর কিছু জানার প্রয়োজন নেই।’’
বিভূতি এক মুহূর্ত থমকে বলল, ‘‘আচ্ছা স্যর।’’
কমলেশ বললেন, ‘‘চিন্তা কোরো না। বাকি পেমেন্ট তুমি পুরোটাই পাবে।’’
ফোন রেখে কমলেশ আর এক বার ফোটোটা হাতে তুললেন। শ্রীকণার চুলে পাক ধরেছে। মুখটা ভারী হয়েছে। কিন্তু চিবুকের কাছের তিলটা এখনও একই রকম আছে। জীবন খুব অদ্ভুত। কম্পিউটারের ফাইলের মতো। মনে হয়, কত ফাইল ডিলিট হয়ে গেছে। আসলে হয় না, থেকে যায়। ফিরে আসে।
ইন্টারকম বেজে উঠল। কমলেশ ফোন ধরলেন।
‘‘স্যর, ত্রিপাঠী।’’
‘‘সিস্টেম ঠিক হয়েছে?’’
ত্রিপাঠী গম্ভীর গলায় বলল, ‘‘হ্যাঁ স্যর, ডিলিট ফাইলগুলো পাওয়া যাচ্ছে।’’
কমলেশ বললেন, ‘‘গুড। কাজ তা হলে শুরু করা গেছে।’’
ত্রিপাঠী বলল, ‘‘করা গেছে। তবে একটা জরুরি কথা আপনাকে বলার ছিল।’’
‘‘বলো।’’
ত্রিপাঠী প্রায় ফিসফিস করে বলল, ‘‘স্যর, মনে হচ্ছে, সিস্টেমে কোনও সাবোটাজ হয়েছে।’’
কমলেশ বললেন, ‘‘সে কী!’’
১১
আহিরীকে দেখতে পেয়ে বিতান হাত তুলল। বিতানের মুখ হাসি-হাসি। রাস্তার ও পাশে থাকলেও বিতানের হাসি বোঝা যাচ্ছে।
আহিরীর বুক ধক করে উঠল। বিতানের মুখে হাসি মানে নিশ্চয়ই আবার গোলমাল হয়েছে। গোলমাল হলে এই ছেলের মুখ হাসি-হাসি হয়ে যায়। এ আবার কেমন রসিকতা? এত দিনেও মেনে নিতে পারেনি আহিরী।
বিতানের রিয়েল এস্টেটের কাজটা সম্পর্কে আহিরীর কোনও আশা নেই। ওটা ঠিকঠাক কোনও কাজই নয়। আজ আছে কাল নেই। থাকলেও বা কী? টাকাপয়সা খুব কম। লোককে বলাও যাবে না। আজকের ইন্টারভিউটার দিকে সে তাকিয়ে আছে। আইটি কোম্পানির এই কাজটা যদি হয়ে যায়, খানিকটা স্বস্তি পাওয়া যাবে। এর আগে তিন–তিনটে কাজ ছেড়েছে বিতান।
প্রথমটা ছিল সেলসের চাকরি। একটা নতুন কোম্পানির ওয়াটার পিউরিফায়ার বেচতে হবে। দু’মাস যেতে না যেতে কাজটা ছেড়ে দিয়েছিল সে।
আহিরী জিজ্ঞেস করেছিল, ‘‘কেন? সমস্যা কী? বেশ তো শহরেই কাজ করতে পারতে। এই কাজে প্রসপেক্টও ভাল ছিল। মানুষ এখন খুব হেলথ কনশাস। হাইজিন খোঁজে।’’
বিতান বলল, ‘‘তা হয়তো পারতাম, কিন্তু বেশি দিন মিথ্যে বলা পোষাল না। ফুলিয়ে ফঁাপিয়ে গুণের কথা বলতে হত। হয়তো আছে পঁাচ, বলতে হত পঞ্চাশ। মনে হচ্ছিল, লোক ঠকাচ্ছি।’’
আহিরী বলল, ‘‘ঠকানোর কী আছে! সেলসের চাকরিতে একটু বাড়িয়ে তো বলতেই হয়। ও সব কাস্টমার কনভিন্সড করার কায়দা।’’
বিতান বলল, ‘‘হতে পারে, কিন্তু আমি বুঝেছিলাম ও কাজ আমার দ্বারা হবে না। কোনও কিছু ফুলিয়ে ফঁাপিয়ে বলাতে আমি নেই। দুনিয়ার সব কায়দা তো সবার জন্য নয় আহিরী।’’
আহিরীর এই যুক্তি পছন্দ হয়নি। তবে সে মুখ ফুটে বলেনি কিছু। পরের কাজটা ছিল কোনও এক স্ট্যাটিসটিক্যাল প্রোজেক্টের ফিল্ড ওয়ার্কারের। ঘুরে ঘুরে ডেটা সংগ্রহ করতে হত। বিতান গল্প করেছিল।
‘‘বুঝলে আহিরী, কাজটা বেশ ইন্টারেস্টিং ছিল। নাম ছিল ‘আরবান ডিসকমফর্ট’। নাগরিক জীবনে সমস্যা। পলিউশন, ট্রাফিক জ্যাম, স্বার্থপরতা, নিঃসঙ্গতা, র্যাট রেস— সব এর মধ্যে পড়ে। রাস্তায় ঘুরে ঘুরে লোকের সঙ্গে কথা বলতাম। মজা লাগত। চার ঘণ্টা কাজে চারশো টাকা। সেই সময়ে আমার জন্য তো বেশ ভালই রোজগার। আমার কাজও ওদের পছন্দ হচ্ছিল। বলল, এটা শেষ হলে নতুন প্রজেক্টে নেবে। কিন্তু এক দিন ফিল্ড অফিসারের সঙ্গে ঝগড়া হয়ে গেল। আমি নাকি যে ফর্ম দেওয়া হয়েছে তার বাইরে প্রশ্ন করে বেড়াচ্ছি। ব্যস, কাগজপত্র ছুড়ে ফেলে চলে এলাম। ভাল করেছি না?’’
ক্রমশ