ছবি: অমিতাভ চন্দ্র
পূর্বানুবৃত্তি: মালবিকা বিতানকে বললেন সে যেন তার বাবাকে নিজের কাছে নিয়ে গিয়ে রাখে, নইলে তিনি অন্য ব্যবস্থা নেবেন, তার বাবাকে বহু দূরে কোনও বৃদ্ধাশ্রমে রেখে আসবেন। বিতান বাইরে বেরোতে বৃষ্টি নামল। কমলেশ রায় বিভূতিকে গাড়িতে তুলে ময়দানের পাশে এসে থামলেন।
গাড়ির সামনের সিটে বসে দুজন নিচু গলায় কথা বলছে। চালকের আসনে যে সুদর্শন মানুষটি বসে আছেন, তাঁর নাম কমলেশ রায়। তাঁর পাশে দু’দিনের না-কাটা কঁাচাপাকা খোঁচা খোঁচা দাড়ি নিয়ে বসে আছে বিভূতি। বিভূতির দাড়ি না কাটাটা আসলে এক ধরনের ছদ্মবেশ। হেলাফেলা ধরনের ‘কমন ম্যান’ সেজে থাকা।
কমলেশ বললেন, ‘‘তোমার ইনফর্মেশনে কোথাও গোলমাল করছে না তো?’’
বিভূতি বললেন, ‘‘আমি স্যর ডবল চেক করে কাজ করি। আপনার বেলায় তো আমি আরও অ্যালার্ট থাকি।’’
কমলেশ বলল, ‘‘তুমি বাড়িটা দেখেছ?’’
‘‘বাড়ি না। ফ্ল্যাট। উঠে দেখিনি। নীচ থেকে দেখেছি। আর স্যর, শুধু দেখিনি, ফ্ল্যাটের বাসিন্দাদের সম্পর্কে যতটা সম্ভব খোঁজও নিয়েছি।’’
কমলেশ রায় আজ বিভূতিকে পিজি হাসপাতালের সামনে দাঁড়াতে বলেছিলেন। লাঞ্চের ঘণ্টাখানেক পর অফিস থেকে গাড়ি নিয়ে বেরিয়েছেন। দীনেশের কাছ থেকে চাবি চাইলে সে একটু থতমত খেয়ে যায়। কমলেশ হেসে বলেন, ‘‘তোমার পাল্লায় পড়ে গাড়ি চালানো ভুলে না যাই। কত দিন যে স্টিয়ারিংয়ে বসা হয় না! দাও চাবিটা দাও, নিজে ড্রাইভ করে একটা কাজ সেরে আসি।’’
বিভূতিকে ফোনে বলা ছিল কোথায় দঁাড়াবে। সে বাস স্টপে দঁাড়িয়ে নির্বিকার ভঙ্গিতে বিড়ি খাচ্ছিল। লোকটা এমন ভাবে ভিড়ে মিশে যেতে পারে যে চট করে আলাদা করা মুশকিল। কমলেশ রায় ভাবেন, মানুষ কী অদ্ভুত সব পেশা বেছে নিতে পারে। এই যে বিভূতি, ইচ্ছে করলেই তাঁর কাছ থেকে একটা চাকরিবাকরি চেয়ে নিতে পারত। নেয়নি। তাকে অফার করার পরও নেয়নি।
‘‘স্যর, এই কাজ ছাড়তে পারব না।’’
কমলেশ ভুরু কঁুচকে বলেছিলেন, ‘‘কেন পারবে না? গুপ্তচরবৃত্তিতে সম্মানও নেই, অর্থও নেই। কোনও কোনও সময়ে কাজ না থাকলে অবস্থা নিশ্চয়ই খুব খারাপ হয়। তার থেকে একটা কাজকর্ম করাই তো ভাল, সবাই যেমন করে।’’
বিভূতি হেসে বলে, ‘‘সম্মান নেই কে বলল স্যর? যখন খবর এনে দিই পার্টি খুশি হয়, খাতির যত্ন করে। সম্মান স্যর এক-এক জনের কাছে এক-এক রকম। আপনি অফিসের চেয়ারে বসলে যে সম্মান পান, না বসলে কি আর পাবেন? সম্মান ব্যাপারটা অনেকটা বুদ্বুদের মতো স্যর। এই আছে, এই নেই। তার থেকে এটাই ভাল। নিজের মতো আছি। হ্যাঁ, টাকাপয়সার টানাটানি হয় ঠিকই, সে আর কী করা যাবে? তবে স্যর, কাজটাকে ভালবাসি। আমার বাবাও এই লাইনে ছিলেন। উনি ছিলেন দু’নম্বরি-স্পেশালিস্ট। ভেজাল, নকল, জালি জিনিসের খবর রাখতেন। যার যেমন দরকার, টাকা নিয়ে ইনফর্মেশন সাপ্লাই করতেন। বাবার সোর্স ছিল মারাত্মক। আমাকে হাতে ধরে কাজ শিখিয়েছেন। স্যর, পেশা কি আর শুধু টাকা দিয়ে বিচার হয়? এই যে কলকাতা শহরের ফুটপাতে পুরনো বই বিক্রি হয়, কত টাকা লাভ থাকে? অথচ এই পেশাটা উঠে গেলে, শহরটাকে আর কলকাতা বলেই মনে হবে না।’’
এর পর আর কথা বাড়াননি কমলেশ। বুঝেছিলেন, এই লোক কাজটাকে ভালবেসেই করে। কমলেশ রায় আজ বিভূতিকে অতি গোপনীয় কাজে ডেকেছেন। বিভূতি সেই ‘খবর’ জোগাড় করেছে। সে আজ ফোন করেছিল।
কমলেশ গলা নামিয়ে বললেন, ‘‘টেলিফোনে শুনব না। আমার সঙ্গে দেখা করো। আরও কথা আছে।’’
বিভূতি বলল, ‘‘কোথায় যাব স্যর?’’
কমলেশ একটু ভেবে বললেন, ‘‘তুমি এখন কোথায় আছ?’’
‘‘পিজি হাসপাতালের কাছে। একটা কাজে আছি স্যর।’’
কমলেশ বললেন, ‘‘ঠিক আছে, তুমি কাজ সারো, এক ঘণ্টা বাদে আসছি।’’
কমলেশ চল্লিশ মিনিটের মাথায় পৌঁছে গিয়েছিলেন। বিভূতিকে গাড়িতে তুলে রেসকোর্সের সামনে থেকে একটা চক্কর দিয়ে চলে এসেছেন ময়দানে। রাস্তার এক পাশে গাছের তলায় গাড়ি দঁাড় করিয়েছেন। আগে থেকে ভাবেননি এখানে আসবেন। যেতে যেতে মনে হল, এখানে দঁাড়িয়ে কথা বললেও তো হয়। গাড়িতে বসেই বিভূতি ‘খবর’ বলছে।
কমলেশ বললেন, ‘‘ফ্ল্যাটে আর কে থাকে?’’
বিভূতি বলল, ‘‘ছেলে আর মা।’’
কমলেশ বললেন, ‘‘মহিলার বয়স কত? সিক্সটি? নাকি কম?’’
বিভূতি বলল, ‘‘দেখে তো ষাট হয়েছে বলে মনে হল না। তবে কাছাকাছি। ফিফটি সেভেন–এইট হতে পারে।’’
কমলেশ চুপ করে থেকে একটু ভাবলেন। বললেন, ‘‘তার পর?’’
বিভূতি বললেন, ‘‘আগে সাদার্ন অ্যাভিনিউয়ের কাছে একটা ফ্ল্যাটে ছিল। সেই ফ্ল্যাট ছোট। বছরখানেক হল বেচেবুচে এখানে এসেছে। তারও আগে ছিল নর্থ ক্যালকাটায়। টালা পার্কে বাড়ি ভাড়া নিয়ে। স্যর, ওদের অরিজিনাল বাড়ি যে গ্রামে তার নাম... অদ্ভুত নামটা... দঁাড়ান কাগজ দেখে বলছি।’’ কথা থামিয়ে বিভূতি প্যান্টের পকেট হাতড়ে গাদাখানেক কাগজের টুকরো বের করে ঘঁাটতে লাগল।
কমলেশ শান্ত গলায় বললেন, ‘‘কাগজ দেখতে হবে না। আমি জানি। গ্রামের নাম ছায়াপাতা। আর কী জেনেছ? মহিলার পাস্ট?’’
বিভূতি বলল, ‘‘বাবা দেবাদিত্য বসু মারা যাওয়ার পরই মা’কে দেশের বাড়ি থেকে কলকাতায় নিয়ে এসেছিল সৌহার্দ্য। এই ছেলে এখন আপনার আন্ডারে চাকরি করছে। অফিসে ঢোকার কিছু দিনের মধ্যেই সে ম্যানেজমেন্টের নজরে পড়েছে। কেন, এখনও জানতে পারিনি।’’
কমলেশ খানিকটা অধৈর্য গলায় বললেন, ‘‘এ সব আমি জানি। নতুন খবর বলো।’’
বিভূতি মাথা চুলকে বলল, ‘‘সৌহার্দ্যর মা শ্রীকণা বসু কলকাতার মেয়ে। সাধারণ পরিবারের। সাধারণ বললেও কম বলা হবে, বেশ নিম্নবিত্তই ছিলেন। বাবা ছোটখাটো চাকরি করতেন। এক মেয়ে, এক ছেলে। ছেলেটি পরে কাজকর্ম নিয়ে মিডল ইস্টে চলে যায়া। সে আর বাড়ির সঙ্গে যোগাযোগ রাখেনি। কলেজ পাশ করার পর বাড়ির লোক তড়িঘড়ি মেয়ের বিয়ে দিয়ে দেয়।’’
বিভূতির কথা থামিয়ে কমলেশ রায় বললেন, ‘‘তড়িঘড়ি বিয়ে দিয়ে দেয়! কেন? তড়িঘড়ি বিয়ে দিয়ে দেয় কেন?’’
বিভূতি একটু চুপ করে থেকে মাথা চুলকে বলল, ‘‘স্যর এই ইনফর্মেশন এখনও আমি পুরোটা জোগাড় করতে পারিনি। বিয়ের আগে শ্রীকণা যেখানে থাকতেন, সেখানকার ঠিকানা জোগাড় করেছি। দমদমে। এক দিন গিয়েছিলাম, কিন্তু সে বাড়ি আর নেই, ফ্ল্যাট উঠে গেছে। শ্রীকণা বসুর বাবা–মা কেউই সম্ভবত বেঁচে নেই। আমি ওর এক আত্মীয়ের খোঁজ পেয়েছি। তার সঙ্গে কথা বলতে হবে।’’
কমলেশ রায় হালকা বিরক্ত হয়ে বললেন, ‘‘এটা তো তোমার বিষয় বিভূতি। কার সঙ্গে কথা বলতে হবে তুমি জানো। আমি তো বলেছিলাম, এই মহিলার অতীত সম্পর্কে আমি ইনফর্মেশন চাই। বিশেষ করে তার কমবয়সের সময়টা কেমন ছিল, বন্ধুবান্ধব কেমন ছিল, কারও সঙ্গে অতিরিক্ত মেলামেশা ছিল কি না, বিয়ে কী ভাবে হল— এই সব। তার ফ্ল্যাট, বাড়ি, গ্রামের হিসেব নিয়ে আমি কী করব? যত তাড়াতাড়ি সম্ভব এটা আমার চাই। জানি কাজটা টাফ। টাকাপয়সা নিয়ে ভাববে না।’
বিভূতি মাথা নামিয়ে রইল। কমলেশ রায় নিজেকে সামলে নিয়ে বললেন, ‘‘আর এক জনের খবর? বিতান নামের ছেলেটির?’’
বিভূতি সঙ্গে হাতলওয়ালা একটা চামড়ার ব্যাগ এনেছে। আদ্যিকালের ব্যাগ। কালচে হয়ে গেছে। ব্যাগ থেকে একটা নীল রঙের ফাইল বের করে কমলেশের দিকে এগিয়ে বলল, ‘‘স্যর, এর মধ্যে আছে।’’
ফাইলটা নিয়ে কমলেশ প্লাস্টিক কভার উল্টোলেন। ভিতরে বাংলায় ঝকঝকে টাইপ করা দুটো পাতা। কমলেশ অবাক হলেন। ফাইলে টাইপ করা রিপোর্ট বিভূতির সঙ্গে যায় না। একটা কর্পোরেট চেহারা। বিভূতি কমলেশ রায়ের মনের কথা যেন বুঝতে পারল। লজ্জা পাওয়ার মতো হাসি হেসে বলল, ‘‘স্যর, এ সব না করলে আজকের দিনে চলে না। পার্টি পছন্দ করে। তবে স্যর, আমি নিজেই টাইপ করি। সিক্রেট ব্যাপার অন্য কারও হাতে ছাড়ি না। ভাল করেছি না?’’
কমলেশ ভুরু কুঁচকে বললেন, ‘‘এটা করেছ ঠিক আছে, কিন্তু আমার কাজের বেলায় আর কখনও করবে না। লেখা মানে রেকর্ড থেকে যাওয়া। কম্পিউটারে তো থাকলই। এর পর থেকে তেমন হলে আমাকে নিজের হাতে পেনসিলে লিখে দেবে, তার বেশি নয়।’’
বিভূতি বলল, ‘‘স্যরি স্যর।’’
কমলেশ ফাইলটা পাশে রেখে বললেন, ‘‘পরে দেখে নেব। এই ছেলেটা সম্পর্কে সবচেয়ে ইন্টারেস্টিং পয়েন্ট কোনটা মনে হয়েছে?’’
‘‘স্যর, আমার কাছে সব পয়েন্টই সমান গুরুত্বপূর্ণ। তবে এই ছেলেটির ফ্যামিলিতে বড় ধরনের কোনও লাফড়া আছে।’’
কমলেশ মুখ ঘুরিয়ে বললেন, ‘‘লাফড়া!’’
বিভূতি তাড়াতাড়ি জিভ কেটে বলল, ‘‘স্যরি স্যর... গোলমাল। ছেলেটার চালচুলো কিছু নেই। বন্ধুর ফ্ল্যাট পাহারা দেয়। তার বদলে সেখানে থাকতে পেরেছে।’’
কমলেশ ভুরু কঁুচকে ফেললেন। এ কেমন ছেলেকে আহি পছন্দ করেছে! মানিব্যাগ থেকে দু’হাজার টাকার একটা নোট বার করে বিভূতির দিকে এগিয়ে দিলেন।
‘‘নাও ধরো। বাকিটা কাজ শেষ করলে পাবে। তুমি কোথায় নামবে?’’
বিভূতি উজ্জ্বল মুখে টাকা নিল। বলল, ‘‘স্যর, আমাকে পিজির সামনে নামিয়ে দিল। অদ্ভুত একটা কাজ পেয়েছি। এক পেশেন্টকে তার পুরনো বৌ দেখতে আসে কি না নজর রাখতে হবে। আমার অ্যাসিসট্যান্টকে ওয়ার্ডের সামনে দঁাড় করিয়ে রেখে এসেছি। এ বার আমি যাব।’’
গাড়িতে স্টার্ট দিয়ে কমলেশ বললেন, ‘‘পুরনো বৌকে চিনবে কী করে?’’
‘‘আমরা গিয়ে তাকে চিনে এসেছি স্যর।’’
‘‘কত দিনের ডিউটি?’’
বিভূতি কাঁচুমাচু মুখে বলল, ‘‘কিছু মনে করবেন না স্যর, সেটা বলা যাবে না। সিক্রেট।’’
কমলেশ বললেন, ‘‘স্যরি।’’
পিজি হাসপাতালের সামনে গাড়ি দঁাড় করালেন কমলেশ। বিভূতি নামার আগে ‘এক সেকেন্ড’ বলে দ্রুত হাতে ব্যাগ থেকে একটা খাম বের করল। এগিয়ে দিয়ে বলল, ‘‘স্যর, এখানে ফটো আছে।’’
কমলেশ অবাক হয়ে বললেন, ‘‘ফোটো! কার ফোটো?’’
বিভূতি বলল, ‘‘শ্রীকণা বসুর। ভাল ফটো নয় স্যর। দূর থেকে মোবাইলে তোলা। বড় করতে গিয়ে ফেটে গেছে। সেই জন্য দিচ্ছিলাম না। তা ছাড়া আপনি তো ফটো চাননি। ভেবেছিলাম পুরো রিপোর্ট হলে আপনাকে একসঙ্গে...’
ক্রমশ