ছবি: অমিতাভ চন্দ্র
পূর্বানুবৃত্তি: আহিরী পরীক্ষার হল-এ একটি মেয়েকে ধরল, সে ওড়নার নীচে মোবাইল রেখে উত্তর টুকছিল। শর্মিষ্ঠা দত্তের ঘরে যাবে বলে বেরতেই শোনা গেল, ছাত্রছাত্রীরা খুব চিৎকার করছে, কাচ ভাঙছে। কলেজের গেট আটকে সিঁড়িতে বসে পড়ল ওরা। আহিরী বিতানকে ফোন করে জানাল,আজ সে দেখা করতে পারবে না।
বিতান অল্প হেসে বলল, ‘‘আরে বাবা, আমি কিছু মনে করিনি। আমাকে কখনও মনে করতে দেখেছ?’’
আহিরী নরম গলায় বলল, ‘‘সেই জন্যই তোমাকে বলি। এখন রাখছি। দেখি, গোলমাল কত দূর গড়াল।’
ফোন বন্ধ করে আহিরী টিচার্স রুমে আসে। বিতানের জন্য তার মন কেমন করে উঠল।
৩
‘‘তোমার বাবার নাম কী?’’
‘‘স্যর, বাবার নাম শ্রী দেবাদিত্য বসু, মায়ের নাম শ্রীমতী শ্রীকণা বসু।’’
কমলেশ রায় এত ক্ষণ টেবিলে রাখা কাগজপত্র নাড়াচাড়া করতে করতে টুকটাক কথা বলছিলেন। তার মাথা বেশির ভাগ সময়েই ছিল নিচু। মাঝে মাঝে হাত বাড়িয়ে বোন-চায়নার ফিনফিনে সাদা কাপ তুলে চুমুক দিচ্ছিলেন আলতো করে। কাপের গায়ে সরু সোনালি বর্ডার। চায়ের রংও সোনালি। দার্জিলিঙের ক্যাসলটন বাগানের চা। এই চা শুধুমাত্র জেনারেল ম্যানেজার এবং তার চেম্বারে আসা লোকজনকে দেওয়া হয়। চওড়া টেবিলের উলটো দিকে বসা ছেলেটির সামনেও একই রকম কাপে চা দেওয়া হয়েছে। পাশে একটা ছোট প্লেটে কয়েকটা কুকিজ। ছেলেটি এখনও পর্যন্ত কোনওটাই ছোঁয়নি। হাত গুটিয়ে জড়সড় হয়ে বসে আছে। এ ঘরে তার জড়সড় হয়ে বসে থাকারই কথা। কোনও অফিসে জেনারেল ম্যানেজারের ঘরে নতুন কোনও এমপ্লয়ি ঢুকলে সে খানিকটা জড়সড় হয়েই থাকে। যথেষ্ট স্মার্ট হলেও থাকে। এই ছেলেও প্রথম ঢুকেছে। চাকরির ইন্টারভিউয়ের সময় কমলেশ রায়কে একে দেখেছিল। কনফারেন্স রুমে তিনি অনেকের সঙ্গে বসেছিলেন। কোনও প্রশ্ন করেননি। মুখ তুলেও তাকাননি। ফাইল দেখছিলেন। সেও তো অনেক দিন হয়ে গেল।
ছেলেটির জবাব শুনে কমলেশ রায় ভুরু কোঁচকালেন। ভুরু কোঁচকানো অবস্থাতেই মুখ তুললেন।
‘‘কী নাম বললে?’’
ছেলেটি গলা নামিয়ে বলল, ‘‘দেবাদিত্য বসু এবং শ্রীকণা বসু।’’
এত ক্ষণ এই ছেলেটির চোখের দিকে কমলেশ সে ভাবে তাকাননি। ঘরে ঢোকার সময় এক ঝলক দেখেছেন। ঝকঝকে চেহারা। সুদর্শন এবং স্মার্ট। কালো ট্রাউজারের ওপর হালকা নীল চেকের সরু ফর্মাল শার্ট পরেছে। তখনও চোখমুখ খেয়াল করেননি। এ বার করলেন। ছেলেটির চোখে এক ধরনের মায়া রয়েছে। খুব প্রকট কিছু নয়, ছায়ার মতো লেগে আছে। নজর করে দেখলে বোঝা যায়। পুরুষমানুষের চোখে মায়া মানায় না। এই ছেলেটির ক্ষেত্রে মানিয়েছে। তাকে সুন্দর লাগছে।
কয়েক মুহূর্তের অস্বস্তি। নিজেকে দ্রুত সামলালেন কমলেশ। ফের কাপ তুলে আলতো চুমুক দিলেন। ধুস, এ সব কী ভাবছেন! কর্মচারীর চোখে মায়া না নিষ্ঠুরতা তা নিয়ে মাথা ঘামাচ্ছেন কেন? ভুরু কোঁচকানোর মতোই বা কী ঘটেছে? শ্রীকণা অন্য কারও নাম হতে পারে না? কমলেশ নাম কি শুধু তার একারই রয়েছে? মোটেও নয়। জগতে কত জনের নাম যে ‘কমলেশ’ তার ঠিক নেই। স্কুলেই তো আরও দু’জন কমলেশ ছিল। ছেলেরা সকলকে আলাদা আলাদা নামে ডাকত। এক জন ছিল লম্বা। তাকে ডাকা হত ‘ঢ্যাঙা কমলেশ’। দ্বিতীয় কমলেশেরও একটা নাম ছিল। ক্লাস এইটে এসে ভর্তি হল সেই ছেলে। নাকি নাইনে? ছোটখাটো চেহারা। নামটাও হয়েছিল মজার। কী যেন নাম? নাহ্, এখন আর মনে পড়ছে না। তবে নিজেরটা মনে আছে। বন্ধুরা তাকে ডাকত ‘ফুল মার্কস কমলেশ’। পরীক্ষায় ফুল মার্কস পাওয়ার কল্যাণে এই নাম। কেউ কেউ ছোট করে বলত, ‘ফুল কমলেশ’। ছোটকাকা এই নাম শুনে বলল, ‘‘ঠিকই আছে। ফুল মার্কস পাওয়া ছেলেরা বেশির ভাগ সময়ই ‘ফুল’ হয়। স্কুল-কলেজের পরীক্ষার নম্বর নিয়ে এত ব্যস্ত হয়ে থাকে যে জীবনের বাকি পরীক্ষাগুলোয় কখন জিরো পেয়ে বসে আছে জানতেই পারে না। যখন জানে তখন নিজেকে বোকা মনে হয়।’’
‘কমলেশ’ এতগুলো থাকলে, ‘শ্রীকণা’ থাকতে অসুবিধে কী? এ বার মনে মনে লজ্জা পেলেন কমলেশ। জীবনের অনেকটা সময় পার হয়ে গেছে। নদীতে অনেক ঢেউ এসেছে, আবার চলেও গেছে নিজের মতো। তীরে পড়ে থাকা নুড়ি–পাথরের দাগ বারবার মুছে দিয়েছে। নুড়ি পাথরের সেই সব দিনগুলোর কথা কেউ মনে রাখে না। তিনিও রাখেননি।
সামনে বসা ছেলেটির প্রতি আরও এক বার প্রসন্ন হলেন কমলেশ। এই ছেলে সত্যি ভাল। সাধারণ ‘ভাল ছেলে’দের মতো নয়, তার থেকে বেশি ভাল। বাবার নাম জিজ্ঞেস করায়, একসঙ্গে মায়ের নামও বলল। বাঙালি ছেলেমেয়েদের মধ্যে এই অভ্যেস একবারেই নেই। যেন বাবার পরিচয়ই শেষ কথা। মায়ের কথা মনে থাকে না। যুগ যুগ ধরে এই বিশ্রী অভ্যেস চলে আসছে। তিনি নিজেও তো তাই। কখনও কি বাবার সঙ্গে মায়ের নাম বলেছেন? মনে পড়ছে না। এখন কি আর এই অভ্যেস বদলানো যাবে? এই বয়সে? অবশ্য এখন তো আর কেউ তাকে বাবা-মায়ের নাম জিজ্ঞেস করবে না। করলে ভাল হত। নিজেকে শুধরে নেওয়া যেত।
কমলেশ নরম গলায় বললেন, ‘‘তোমার বাড়ি কোথায় সৌহার্দ্য?’’
‘‘স্যর, এখন টালিগঞ্জে। আগে থাকতাম হুগলিতে, জনাইয়ের কাছে।’’
‘‘জনাই! এক সময়ে ওখানে আমার এক মাসি থাকতেন। বাড়িতে পুজো হত। ছোটবেলায় যেতাম। জনাইয়ের কোথায়?’’
‘‘ঠিক জনাইতে নয় স্যর। আরও খানিকটা যেতে হত। গ্রামের নাম ছায়াপাতা।’’
কমলেশ বললেন, ‘‘ছায়াপাতা! এই নামের মানে কী?’’
‘‘এই নামে আমাদের গ্রামে একটা নদী আছে। মনে হয় সেখান থেকে গ্রামের নাম হয়েছে।’’
কমলেশ অল্প হেসে বললেন, ‘‘নদীর নাম ছায়াপাতা! সুন্দর নাম।’’
‘‘নদী ছোট স্যর। গরমের সময় হেঁটে পার হওয়া যেত।’’
কমলেশ একটু অবাক হলেন। এই ছেলের হাবভাব, কথাবার্তার মধ্যে গ্রাম, নদীর চিহ্নমাত্র নেই। তার বদলে যদি বলত, ছোটবেলায় মুম্বইয়ের দাদার বা বেঙ্গালুরুর কোরামঙ্গলায় থাকতাম, তা হলে মানাত। নিশ্চয়ই অনেক ছোটবেলায় চলে এসেছে। কমলেশ নিজেকে সামলে বললেন, ‘‘ভেরি গুড। নিজেদের বাড়ি?’’
‘‘হ্যঁা স্যর। নিজেদের বাড়ি ছিল।’’
ছিল! এখন নেই? কমলেশ ভুরু কোঁচকালে সৌর্হাদ্য নিজে থেকেই বলল, ‘‘বাবা মারা যাওয়ার পর আমি আর মা কলকাতায় চলে আসি। আমি অবশ্য তার আগে থেকেই কলকাতার হোস্টেলে থেকে ইঞ্জিনিয়ারিং পড়া শুরু করেছিলাম।’’
কমলেশ নিচু গলায় বললেন, ‘‘ওহো, স্যরি।’’
অফিসের কর্মচারীদের সঙ্গে এত ব্যক্তিগত স্তরে নেমে কমলেশ কথা বলেন না। কর্মীদের সঙ্গে দূরত্ব রাখাটা ম্যানেজারদের ডিউটির মধ্যে পড়ে। তাঁর মতো জেনারেল ম্যানেজারের জন্য তো বটেই। ভীষণ জরুরি কিছু না থাকলে জেনারেল ম্যানেজারের ঘরে তার ঢোকার সুযোগও পাওয়ার কথা নয়। সৌহার্দ্য অবশ্য এই ঘরে নিজে থেকে ঢোকেনি, তাকে ডেকে পাঠানো হয়েছে। কমলেশ নিজেই ডেকেছেন। গত শনিবার লাঞ্চের পর ফিনান্স ম্যানেজার মনোজ ত্রিপাঠী ইন্টারকমে তাঁকে ধরেন। সবাই ‘ত্রিপাঠী’ নামে চেনে। এই অফিসে তার পজিশন কমলেশ রায়ের পরেই। কমলেশ সব বিষয়ে এঁর ওপর নির্ভর করেন।
ত্রিপাঠী বলল, ‘‘স্যর, দশ মিনিট টাইম
দিতে হবে।’’
কমলেশ বলেছিলেন, ‘‘অসম্ভব। গাদা কাজ নিয়ে বসে আছি। তোমরা যেখানে যত জট পাকাও, আমাকে খুলতে হয়। আজ শনিবার ভেবেছিলাম তাড়াতাড়ি বেরিয়ে যাব, বুঝতে পারছি রাত হয়ে যাবে। এ বার চাকরিবাকরি ছেড়ে পালাব।’’
ত্রিপাঠী হেসে বললেন, ‘‘আপনি তো কম বার পালাতে চেষ্টা করেননি স্যর। রেজিগনেশন পাঠিয়ে দিয়েও মুক্তি পাননি। কোম্পানি ছাড়েনি। ছাড়বেও না। আপনি যত ব্যস্ত থাকুন, আমি আপনার ঘরে যাচ্ছি স্যর। নতুন প্রোজেক্টের ফাইলটা কালকের মধ্যে ব্যাঙ্কে না পাঠালে লোন আটকে যাবে। এই নিয়ে ওরা তিন বার অ্যালার্ট করেছে। আজও তো রীতিমত থ্রেট করল। বলল, আর দেরি করলে লোন প্রোপোজাল ক্যানসেল হয়ে যাবে।’’
কমলেশ বললেন, ‘‘তুমি ছেড়ে দাও ত্রিপাঠী।’’
ত্রিপাঠী বললেন, ‘‘হবে না স্যর। কয়েকটা বিষয় আপনাকে ওয়াকিবহাল করতে হবে। অত টাকার ব্যাপার, ব্যাঙ্ক যখন-তখন ফোন করে আপনার কাছে কোয়্যারি করতে পারে। জাস্ট ফিফটিন মিনিটস স্যর।’’
সেই পনেরো মিনিটের মিটিঙেই সৌহার্দ্যের ঘটনা জানতে পারলেন কমলেশ। কাজ করতে করতেই ত্রিপাঠী বলে দিলেন।
‘‘অফিসে নতুন একটি ছেলে অ্যাকাউন্টসের অদ্ভুত একটা ভুল ধরেছে।’’
কমলেশ বলেন, ‘‘অ্যাকাউন্টসে কাজ করা ছেলে, হিসেবে ভুল ধরেছে এ আর ইন্টারেস্টিং কী হল? তার কাজই তো ভুল ধরা।’’
ত্রিপাঠী হেসে বলেন, ‘‘না স্যর, ওই ছেলে অ্যাকাউন্টসে জয়েন করেনি, হি ইজ অ্যান ইঞ্জিনিয়র। আমরা নতুন প্রোজেক্টের জন্য নিয়েছি। বাচ্চা ছেলে, কিন্তু ইতিমধ্যেই এক্সপিরিয়েন্স-রিচ। বেশ ক’টা কোম্পানিতে কাজ করে এসেছে। ইন্টারভিউয়ের সময় আপনি ছিলেন।’’
কমলেশ বললেন, ‘‘মে বি। মনে নেই আমার। ওর হাতে অ্যাকাউন্টস গেল কী করে?’’
ত্রিপাঠী বললেন, ‘‘প্রোজেক্ট তৈরির সময় ও হিসেবপত্রের কিছু কাগজ চেয়েছিল, ভায়াবিলিটি প্রোজেকশন তৈরি করতে। তখনই ভুলটা মার্ক করেছে। তার পর কম্পিউটারে বেশ কয়েক বছরের ট্যাবুলেশন দেখে, ভুল সম্পর্কে কনফার্মড হয় আর আমাকে জানায়। আশ্চর্যের বিষয়, বেশ কয়েক বছর ধরে এই ভুল চলছিল। ফলে অতি সামান্য হলেও কোম্পানিকে একটা লোকসান বেয়ার করতে হয়েছে। সেই লোকসানের পরিমাণ বিন্দুর মতো, কিন্তু এত বছরের বিন্দু যোগ করলে পরিমাণ একেবারে উড়িয়ে দেওয়ার মতো নয় স্যর। হিসেবের এমন জায়গায় ভুলটা মাথা নিচু করে লুকিয়ে ছিল যে কারও চোখে পড়েনি। ছেলেটি ধরল।’’
কাজ থামিয়ে দেন কমলেশ। মুখ তুলে প্রশংসা ভরা গলায় বলেন, ‘‘বাহ্, নাম কী ছেলেটির?’’
ত্রিপাঠী উৎসাহের সঙ্গে বলে, ‘‘সৌহার্দ্য, সৌহার্দ্য বোস। সবে জয়েন করেছে।’’
কমলেশ বললেন, ‘‘ছেলেটির সঙ্গে আমার আলাপ করতে ইচ্ছে করছে।’’
ত্রিপাঠী এ বার আরও উৎসাহ নিয়ে বলেন, ‘‘করুন না স্যর, খুব ভাল হয়। ছেলেটির ভাল লাগবে। তা ছাড়া... তা ছাড়া এই ধরনের কাজ করলে কোম্পানি পাশে থাকে, সেটাও বুঝবে।’’
কমলেশ বললেন, ‘‘ঘটনাটা অফিসের সবাই জেনেছে?’’
‘‘সবাই নয়, অ্যাকাউন্টস ডিপার্টমেন্টের স্টাফরা জেনেছে। তবে বুঝতেই তো পারছেন, বিষয়টা এমন নয় যে সবার পছন্দ হবে। এত বছর পরে একটা জিনিস ধরা পড়ল, আর সেটা করল কিনা এক জন নিউকামার। যার এক্তিয়ারে অ্যাকাউন্টস পড়েই না। জেলাসি তো হবেই। সেই কারণেই আপনি যদি ডেকে কথা বলেন, অফিসে একটা মেসেজ যাবে। আমি আজ এক বার দেখা করতে বলি?’’
ক্রমশ