ছবি: সুমন চৌধুরী
এই কথা বললে, শুধু ফেমিনিস্টরাই নন, লোকাল ট্রেনের মেল শভিনিস্ট ডেলি প্যাসেঞ্জাররাও হাঁ হাঁ করে উঠবেন। কিন্তু তথ্য বলছে, বছরের পর বছর ধরে এ দেশে যতগুলি বধূ নির্যাতনের মামলা হয়, তার প্রায় চোদ্দো আনার ক্ষেত্রেই অভিযোগ কিচ্ছুটি প্রমাণ করা যায় না। বেশির ভাগটাই নাকি ভুয়ো! স্বামী আর শ্বশুরবাড়ির লোকজনকে অপদস্থ করার কৌশল। অথচ ১৯৮৩ সালে এই আইনের জন্মই তো হয়েছিল বরপণের দাঁত-নখ থেকে গৃহবধূদের রক্ষা করতে। তা হলে ব্যাপারটা ১৮০ ডিগ্রি ঘুরে গেল কী করে? আইনি পরিভাষায় এ আইনটি ‘অ-জামিনযোগ্য’, মানে, আদালতে হাজিরা না দিলে জামিনের আবেদন করা যায় না। এবং ‘কগ্নিজেবল’, অর্থাৎ কিনা অভিযুক্তকে জেলে পুরতে হলে আদালতের নির্দেশ বা নিদেনপক্ষে কোনও প্রাথমিক তদন্ত কিংবা ওয়ারেন্টেরও ধার ধারতে হয় না পুলিশকে। স্রেফ তোলো, আর পোরো! এই ‘সোজা’ রাস্তাটিকেই কাজে লাগাতে থাকলেন বহু ভদ্দরমহিলা। চোখে তাঁদের গ্লিসারিন— ‘সাজা’ মানে তো আর শুধু ‘পানিশমেন্ট’ নয়, ‘মেক-আপ’ও বটে! ব্যাপারটা এতটাই ব্যাপক যে, সম্প্রতি সুপ্রিম কোর্টকে রায় দিতে হয়েছে, ৪৯৮এ ধারায় বধূ নির্যাতনের অভিযোগ পাওয়া মাত্রই পুলিশ আর হুটহাট অভিযুক্তকে গ্রেফতার করতে পারবে না। আগে প্রাথমিক তদন্ত করে দেখতে হবে গ্রেফতার করা আদৌ জরুরি কি না। এক দিন যা ঢাল ছিল, আজ যে তা অস্ত্র হয়ে দাঁড়িয়েছে, স্বীকার করছে খাস সুপ্রিম কোর্ট। বছর নয়েক আগেও দেশের শীর্ষ আদালত এই আইনকে ‘লিগাল টেররিজ্ম’ আখ্যা দিয়েছিল। দেশের বহু হাইকোর্টেও বার বার সমালোচিত ৪৯৮এ-র ক্রমবর্ধমান এই অপব্যবহার।
দেশে বা এই রাজ্যে আজও বহু নারীই যে চার দেওয়ালের আড়ালে স্বামী ও শ্বশুরবাড়ির হাতে প্রবল লাঞ্ছিত অত্যাচারিত হন, তা চরম সত্য। কিন্তু তার মানেই তো এটা হতে পারে না যে, সব স্বামীই প্রেম চোপড়া আর সব স্ত্রীই নিরুপা রায়। ভারত সরকারের ন্যাশনাল ক্রাইম রেকর্ডস ব্যুরো-র সম্প্রতি প্রকাশিত তথ্য বলছে, গত বছর এ দেশে গড়ে প্রতি ৮ মিনিট ১২ সেকেন্ডে এক জন করে স্বামী আত্মহত্যা করেছেন। ২০১৩ সালে ভারতে বিবাহিত পুরুষের আত্মহত্যার সংখ্যা আত্মঘাতী বিবাহিত মহিলার দ্বিগুণেরও বেশি। পারিবারিক সমস্যার কারণে আত্মহত্যার অনুপাতটাও প্রায় একই রকম। গত বছর ২১,০৯৬ জন পুরুষ আত্মহত্যা করেছেন কেবল পারিবারিক ঝামেলা থেকে চিরমুক্তি পেতে। পাশাপাশি, একই কারণে আত্মঘাতী মহিলা ১১,২২৯ জন। সব ক’টি আত্মহত্যাই দুর্ভাগ্যজনক, কিন্তু এই তথ্য চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেয়, পুরুষও কোনও অংশে কম চাপে নেই। থাকার কথাও কি ছিল?
৪৯৮এ-র রাস্তায় হাঁটা কী হারে বাড়ছে, ২০১২ আর ২০১৩ সালের তুলনাই তা বলে দেয়। মাত্র এক বছরে বৃদ্ধির হার ১১.৫%-এরও বেশি। সবচেয়ে বেশি মামলা দায়ের হয়েছে এই পশ্চিমবঙ্গেই। অথচ এ রাজ্যে অপরাধ প্রমাণিত হয়েছে মাত্র ২.৩% ক্ষেত্রে। গোটা দেশেই, বিগত বছরগুলির মতো ২০১৩ সালেও, এই ধারায় বেশির ভাগ মামলারই কোনও গতি হয়নি। দেশ জুড়ে দোষী সাব্যস্ত করা গিয়েছে মাত্র ১৬% ক্ষেত্রে।
এত এত ভুয়ো ৪৯৮এ দায়ের হওয়ার নেপথ্যে দুষ্ট মহিলাদের হাত নেই— এমন একটা ‘প্রায়-স্বতঃসিদ্ধ’ ঝুড়ি-কোদাল সহযোগে প্রমাণে নারীবাদী সমাজকর্মী ও আইনজীবী ফ্লেভিয়া অ্যাগনেস-এর মন্তব্য প্রায়শই উদ্ধৃত হয়— নিম্ন আদালতের কিছু উকিল ও দুর্নীতিগ্রস্ত পুলিশই নাকি ৪৯৮এ ব্যবহারে মূল কালপ্রিট। আবার একই সঙ্গে যুক্তি দেওয়া হয়— ৪৯৮এ-র ক্ষেত্রে চার্জশিট দেওয়ার মাত্রা যথেষ্ট উচ্চ, মানে, পুলিশ তদন্ত চালিয়ে অভিযোগ যথাযথ মনে করেছে এবং চার্জশিট দিয়েছে। অর্থাৎ, একই পুলিশ যুগপৎ সৎ ও অসৎ! শ্রডিংগারের বেড়ালের মতো এখানে দুর্বোধ্য কোয়ান্টাম ফিজিক্স কাজ করতে পারে, ৪৯৮এ পারে কি!
অতঃ কিম? বিবাহের ঠিক পরেই যে স্বামীটি মনেপ্রাণে বাঁচতে চেয়েও ধনেপ্রাণে মরতে বসে, তাকে অক্সিজেন দেবার উপায়? তার সব বুকে-ব্যথা তো গ্যাস অম্বল থেকে হয়নি— কিছু বেদনার জন্ম প্রিয়তমা স্ত্রীর কাছ থেকে আসা আকস্মিক আঘাতে, কিছু বা তজ্জনিত হার্ট অ্যাটাকে! কেউ বলছেন, ‘৪৯৮বি’ নামে পুরুষের অধিকার নিয়ে আইন প্রণয়ন হোক। বিচারপতি মলিমথ কমিটি পরামর্শ দিয়েছে, ৪৯৮এ-কে জামিনযোগ্য (বেলেব্ল) ও মীমাংসাযোগ্য (কম্পাউন্ডেব্ল) করার। আইনটিকে আগাগোড়া ঠান্ডাঘরে পাঠাতেও চাইছেন অনেকে। কেউ বলছেন, ৪৯৮এ থাকুক, কিন্তু বদলাক— এ ধারায় মামলা করার আগে বাধ্যতামূলক করা হোক কাউন্সেলিং। তাঁরা একমত, সময় বদলেছে, যুগের সঙ্গে আইনেরও বদল দরকার— পারস্পরিক কলহের কেন্দ্রে আজ আর শুধু পণের গয়না কি ক্যাশটুকুই নেই— চ্যাট আছে, ফেসবুকও আছে। আসলে, আমাদের বোঝার সময় এসেছে— আইপিসি ৪৯৮এ সত্য, কিন্তু শেষ সত্য নয়।
আর, একটু মনোযোগ দেওয়ার সময় এসেছে— গত শতকের শেষ দিকে মার্কিন সমাজকর্মী ওয়ারেন ফ্যারেল-এর ঠাট্টা-ছলে বলা খাঁটি কথাটির প্রতি: In the past quarter century, we exposed biases against other races and called it racism, and we exposed biases against women and called it sexism. Biases against men we call humor.
susnatoc@gmail.com