এক সময় কাস্পিয়ান সাগর থেকে প্রশান্ত মহাসাগর— মাঝের দীর্ঘ সাম্রাজ্য ছিল তাঁর দখলে। জীবৎকালে খুন, অপহরণ, রক্তক্ষয়, প্রতিশোধ ছাড়া একটা দিনও কাটাননি। মৃত্যুর পর তাই ‘একটু শান্তি’ চেয়েছিলেন মোঙ্গল সম্রাট চেঙ্গিস খান। নিজেই নির্দেশ দিয়ে গিয়েছিলেন সৈন্যদের। আদেশ পালন করেছিলেন অনুগতেরা। তাই মৃত্যুর ৮০০ বছর পরেও খোঁজ মেলেনি চেঙ্গিসের সমাধির।
মৃত্যু আসন্ন বুঝে অনুগত সেনাদের নাকি বলে গিয়েছিলেন, তাঁর সমাধিস্থল যাতে চিরকাল গোপন থাকে। কখনও কেউ যেন পৌঁছতে না পারে সেখানে। সৈন্যরা অক্ষরে অক্ষরে পালন করেছিল সে নির্দেশ। মৃত্যুর পর প্রিয় সম্রাটকে কাঁধে করে নিয়ে গিয়েছিলেন অনুগত সেনারা। সকলের চোখে ছিল জল। পথে যাঁরা তাঁদের দেখেছিলেন, তাঁদের খুন করা হয়েছিল। যাতে গোপন স্থান গোপনই থাকে।
মনে করা হয়, মোঙ্গোলিয়ার মরু অঞ্চলে সমাধিস্থ করা হয়েছিল চেঙ্গিসকে। সমাধিস্থান যাতে কেউ শনাক্ত করতে না পারে, তাই তার উপর দৌড় করানো হয়েছিল এক হাজার ঘোড়াকে।
বিদেশি গবেষক, বিজ্ঞানীরা বছরের পর বছর চেঙ্গিসের সমাধি খোঁজার চেষ্টা করেছেন। অভিযান চালিয়েছেন। ন্যাশনাল জিওগ্রাফিক চ্যানেলও অভিযান চালিয়েছিল। উপগ্রহচিত্র তুলে খোঁজার চেষ্টা চালিয়েছিল তারা। কিন্তু তাতে লাভ হয়নি। আসলে মোঙ্গোলিয়রাই চেঙ্গিসের সমাধি কখনও খুঁজতে চাননি। চাননি, কেউ খুঁজে পাক। ১২২৭ সালে তাঁর মৃত্যুর পর থেকে অধরাই থেকেছে সেই সমাধি।
মোঙ্গোলিয়রা যে চেঙ্গিসকে ভালবাসেন না, তা নয়। এখনও তাঁদের কাছে হিরো এই সম্রাট। মোঙ্গোলিয়ার নোটে, ভদকার বোতলে রয়েছে তাঁর ছবি। মোঙ্গোলিয়ার প্রায় প্রতি ঘরে তাঁর ছবি রয়েছে। কিন্তু সম্রাটের সমাধি খোঁজার বিষয়ে মোঙ্গোলীয়দের প্রবল অনীহা। অনেকে মনে করেন, প্রিয় সম্রাটের প্রতি শ্রদ্ধা থেকেই এই পদক্ষেপ।
স্থানীয়দের বিশ্বাস, যে দিন চেঙ্গিসের সমাধির খোঁজ মিলবে, সে দিন নাকি পৃথিবী ধ্বংস হয়ে যাবে। এই প্রসঙ্গে তৈমুর লঙের সমাধির প্রসঙ্গ মনে করিয়ে দেন কিছু কুসংস্কারপন্থী।
১৯৪১ সালে তুর্কি-মোঙ্গোলীয় সম্রাট তৈমুরের সমাধি আবিষ্কার করেন রাশিয়ার বিজ্ঞানীরা। তার পরেই সে দেশ দখল করে হিটলারের নাৎসি বাহিনী। কুসংস্কারপন্থীরা মনে করেন, এই দুইয়ের মধ্যে কার্য-কারণ সম্পর্ক রয়েছে।
৮০০ বছর পরেও চেঙ্গিস খানের সমাধি যে খুঁজে পাওয়া যায়নি, তার নেপথ্যে সম্রাটের ইচ্ছা ছাড়াও অন্য কারণ রয়েছে। সেই কারণ হল দুর্গমতা। গ্রেট ব্রিটেনের যা আয়তন, মোঙ্গোলিয়া তার থেকে সাত গুণ বড়। অথচ ব্রিটেনে মোট যত কিলোমিটার রাস্তা রয়েছে, তার মাত্র দুই শতাংশ রয়েছে এখানে। জনসংখ্যাও কম এই দেশে। সেই কারণে চেঙ্গিসের সমাধি খোঁজা যায়নি।
মোঙ্গোলদের প্রাচীন সমাধি নিয়ে গবেষণা করছেন আর্ডেনেবাটার। ২০০১ সাল থেকে তিনি মোঙ্গোলিয়ার মধ্যভাগে আরখানগাই প্রদেশে ২০০০ বছরের পুরনো বহু সমাধি খনন করিয়ে চলেছেন।
আর্ডেনেবাটার মনে করেন, ওই সমাধিগুলি জিয়োঙ্গনুদের। এই জিয়োঙ্গনুরা চেঙ্গিসের পূর্বসূরি। চেঙ্গিস নিজেও তাই বলতেন। বিজ্ঞানী মনে করেন, চেঙ্গিসের সমাধিও এই জিয়োঙ্গনু সম্রাটদের সমাধির মতো হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে।
মাটির ২০ মিটার গভীরে জিয়োঙ্গনু সম্রাটদের সমাধিস্থ করা হত। কাঠের কফিনে রাখা থাকত দেহ। মাটির উপরে বসানো হত চৌকো পাথর। সেই দিয়েই শনাক্ত করা হত, কার সমাধি। সেই পাথর যদি কোনও ভাবে এক বার সরে যেত, তা হলে সমাধি খুঁজে বার করা এক প্রকার অসম্ভব হয়ে পড়ত। চেঙ্গিসের ক্ষেত্রেও তা-ই হয়েছিল বলে মনে করেন গবেষকরা।
আর্ডেনেবাটারের প্রথম সমাধি উদ্ধার করতে সময় লেগেছিল ১০ বছর। যদিও তাঁর আগেই সেই সমাধিতে পৌঁছে গিয়েছিল ডাকাতেরা। লুটও চালিয়েছিল তারা। কারণ জিয়োঙ্গনুদের সমাধিতে রাখা থাকত মূল্যবান জিনিস। যেমন রোমে তৈরি কাচের জিনিস, দামি ধাতু, রত্ন।
গবেষকরা মনে করেন, চেঙ্গিসের সমাধিতেও রাখা আছে এ রকমই দামি জিনিসপত্র। যত দেশ জয় করেছিলেন চেঙ্গিস, সেই সব দেশের স্মারক রাখা রয়েছে তাঁর সমাধিতে। রয়েছেন মহামূল্যবান সামগ্রিও। সে কারণেই সেই সমাধি খোঁজার চেষ্টা করে চলেছেন গবেষকরা।
জনশ্রুতি, খেন্তি পাহাড়ের মাথায় কোনও এক জায়গায় সমাধিস্থ করা হয়েছিল চেঙ্গিসকে। রাজধানী উলানবাতার থেকে ১৬০ কিলোমিটার উত্তর-পশ্চিমে রয়েছে সেই জায়গা।
ইতিহাস বলছে, যখন চেঙ্গিসের বয়স খুব কম ছিল, তখন ওই খেন্তি পাহাড়ে শত্রুদের ভয়ে লুকিয়ে ছিলেন তিনি। শেষ পর্যন্ত সেখান থেকে বেঁচে ফেরেন। তার পরেই দেশজয়ের উদ্দেশ্যে বার হন। চেঙ্গিসের নাকি ইচ্ছা ছিল, মৃত্যুর পরেও সেই খেন্তি পাহাড়েই চিরশান্তিতে নিদ্রা যাবেন। তবে অনেক গবেষক মনে করেন, চেঙ্গিসের এই ইচ্ছা নেহাতই জনশ্রুতি। এর কোনও ভিত্তি নেই।
মোঙ্গোলিয়ার ইতিহাস বলে, চেঙ্গিসের সমাধির সমস্ত চিহ্ন লোপ করার জন্য তার উপর ছোটানো হয়েছিল এক হাজার ঘোড়া। কিছু গবেষক প্রশ্ন তুলেছেন, পাহাড়ের উপর এক হাজার ঘোড়া ছোটা কী ভাবে সম্ভব? তাঁদের মত, কোনও সমতল মরু এলাকাতেই সমাধিস্থ করা হয়েছিল সম্রাটকে।
এত রকম গবেষণার পরেও মোঙ্গোলিয়রা সম্রাটের সমাধি খুঁজতে কিন্তু খুব একটা আগ্রহী নন। কারণ তাঁরা চেঙ্গিসের শেষ ইচ্ছাকে ভীষণ ভাবে শ্রদ্ধা করেন। পশ্চিমের দেশগুলিতে তিনি পরাক্রমশালী সম্রাট হিসাবে পরিচিত। কিন্তু মোঙ্গোলীয়রা তাঁকে মনে রেখেছেন আরও অনেক কারণে।
চেঙ্গিসের জন্যই সিল্ক রুটে ব্যবসা, বাণিজ্যের প্রসার ঘটেছিল। কূটনীতিকরা আজ যে রক্ষাকবচ পান, এই ধারণা চালু করেছিলেন চেঙ্গিসই। ধর্মীয় স্বাধীনতার হয়ে সওয়াল করতেন তিনি।
কাস্পিয়ান সাগর থেকে প্রশান্ত সাগরের মাঝে বিশাল ভূখণ্ড ছিল চেঙ্গিসের দখলে। এই বিশাল ভূখণ্ডের মধ্যে যোগাযোগ রক্ষা করা হবে কী ভাবে? চেঙ্গিসই ডাক ব্যবস্থা চালু করেছিলেন। চেঙ্গিস প্রথম মুদ্রা হিসাবে কাগজের নোট চালু করেন।
মোঙ্গোলীয়রা দাবি করেন, চেঙ্গিস শুধু দেশ জয় করেননি, নিজের সাম্রাজ্যকে আধুনিকও করে তুলেছিলেন। এ হেন সম্রাটের শেষ ইচ্ছা পূরণ করতে তাই বদ্ধপরিকর সে দেশের প্রতিটি মানুষ। মৃত্যুর ৮০০ বছর পরেও তাই খোঁজ মেলেনি চেঙ্গিসের সমাধির। আর মিলবে বলে আশা রাখেন না বহু ইতিহাসবিদ।