NASA

বহু যান্ত্রিক ত্রুটি, একাধিক অসফল অভিযান! তবু সুনীতাদের জন্য কেন বাছা হয়েছিল বোয়িংকেই?

আমেরিকার নভশ্চরদের মহাকাশে পাঠানোর জন্য বেসরকারি দুই সংস্থার সঙ্গে ২০১৪ সালে নাসা একটি চুক্তি করে। রাশিয়ার মহাকাশযানের উপর একক নির্ভরতা থেকে মুক্তি পেতে দেশীয় দুই সংস্থার সঙ্গে গাঁটছড়া বাঁধে নাসা।

Advertisement
আনন্দবাজার ডট কম ডেস্ক
শেষ আপডেট: ২১ মার্চ ২০২৫ ১২:১০
Share:
০১ ২২
sunita and brooch

২৮৬ দিন মহাকাশে কাটিয়ে অবশেষে নিরাপদে পৃথিবীতে ফিরেছেন সুনীতা উইলিয়ামস এবং বুচ উইলমোর। ইলন মাস্কের সংস্থা স্পেসএক্সের ড্রাগন মহাকাশযান ফ্লরিডার সমুদ্রে অবতরণ করে দিন দুয়েক আগে। দীর্ঘ নয় মাস মহাকাশে কাটিয়ে পৃথিবীতে ফেরায় তাঁদের নিয়ে খুশি গোটা বিশ্ব। মহাকাশ থেকে পৃথিবী পর্যন্ত সুনীতাদের এই প্রত্যাবর্তন নিরুপদ্রবেই হয়েছে বলে জানিয়েছে আমেরিকার মহাকাশ গবেষণা সংস্থা নাসা।

০২ ২২
Boeing

৫ জুন সুনীতাদের নিয়ে আন্তর্জাতিক মহাকাশ স্টেশনের উদ্দেশে রওনা দিয়েছিল বোয়িং স্টারলাইনার। আট দিনের সফরে গিয়েছিলেন তাঁরা। সেই আট দিনের সফর দীর্ঘায়িত হতে হতে কেটে যায় কয়েক মাস। বোয়িঙের মহাকাশযানের যান্ত্রিক ত্রুটির কারণে মহাকাশে থাকার দিন ক্রমশ বৃদ্ধি পেয়েছে সুনীতা ও বুচের।

Advertisement
০৩ ২২
sunita and brooch

বোয়িঙের তৈরি প্রথম মহাকাশযানের পরীক্ষামূলক অভিযানে আইএসএস পাড়ি দিয়েছিলেন সুনীতা ও বুচ। কিন্তু তাঁদের যাত্রার মাঝেই যান্ত্রিক গোলযোগ দেখা দেয় যানে। কোনও মতে নিরাপদে তাঁরা আইএসএস পৌঁছলেও ওই মহাকাশযানে পৃথিবীতে ফেরার ঝুঁকি নেওয়া যায়নি। সুনীতাদের ছাড়াই ফিরে আসে যানটি।

০৪ ২২

সুনীতাদের পৃথিবীতে ফিরিয়ে আনতে বোয়িঙের বদলে মাস্কের স্পেসএক্সের মহাকাশযানকে বরাত দেয় নাসা। এই দুই সংস্থার সঙ্গে নাসা চুক্তিবদ্ধ ছিল। নাসা বোয়িং এবং স্পেসএক্সকে বেসরকারি মহাকাশযান তৈরিতে অনুমতি দিয়েছিল ও সেইমতো চুক্তি করেছিল।

০৫ ২২

আমেরিকার নভশ্চরদের মহাকাশে পাঠানোর জন্য বেসরকারি এই দুই সংস্থার সঙ্গে ২০১৪ সালে নাসা একটি চুক্তি করে। রাশিয়ার মহাকাশযানের উপর নির্ভরতা থেকে মুক্তি পেতে দেশীয় এই দুই সংস্থার সঙ্গে গাঁটছড়া বাঁধে নাসা।

০৬ ২২

বোয়িঙের তৈরি মহাকাশযানটির নাম ‘স্টারলাইনার’। সেই স্টারলাইনারে চাপিয়েই এ বার বিভিন্ন দফায় নাসা মহাকাশচারী পাঠানোর সিদ্ধান্ত নেয়। ভূপৃষ্ঠের প্রায় ৪০০ কিলোমিটার উপরের কক্ষপথে প্রদক্ষিণরত আন্তর্জাতিক মহাকাশ স্টেশনে নাসা বিভিন্ন গবেষণা চালাতে দফায় দফায় মহাকাশচারীদের পাঠানোর জন্য চুক্তি করেছিল বোয়িঙের সঙ্গে।

০৭ ২২

ইলনের সংস্থার সঙ্গে একই চুক্তি হলেও সুনীতাদের মহাকাশে পাঠানোর জন্য বোয়িঙকেই প্রথমে বেছে নিয়েছিল নাসা। বোয়িঙের যান ২০১৯ সালে সফ্‌টঅয়্যার সমস্যায় উড়তে ব্যর্থ হয়। দ্বিতীয় চেষ্টাতেও তারা মুখ থুবড়ে পড়ে। ২০২০ সালের অগস্টে পরীক্ষামূলক ভাবে স্টারলাইনার মহাকাশযানটিকে মহাকাশ স্টেশনে পাঠাতে চেয়েছিল নাসা। কিন্তু তার মূল সেফ্‌টি ভালভে কিছু গলদ দেখা দেওয়ায় তা স্থগিত রাখা হয়।

০৮ ২২

পরে নাসার তরফে জানানো হয়, বোয়িং তার মহাকাশযানের সেই গলদ সারিয়ে ফেলেছে। ২০২২ সালে তারা মানুষ ছাড়া একটি যান মহাকাশ স্টেশনে পাঠায়। তার পর এ বারের অভিযান। স্পেসএক্স অবশ্য ২০২০ সাল থেকে নিয়মিত ভাবে তাদের ‘ক্রু ড্রাগন’-এ যাত্রী নিয়ে যাচ্ছে। আন্তর্জাতিক মহাকাশকেন্দ্রে নিয়মিত পণ্য পৌঁছোনোর কাজটিও সমান ভাবে সামলে চলেছে ইলনের সংস্থা।

০৯ ২২

নাসা সূত্রের খবর, বোয়িং এত দিন মূলত যাত্রী ও মালবাহী বিমান তৈরি করা ও সেগুলি চালালেও গত শতাব্দীর শেষের দিক থেকে জড়িয়ে পড়ে আমেরিকার প্রতিরক্ষা বিভাগের সঙ্গে। তৈরি করতে শুরু করে আমেরিকার নৌ ও বিমানবাহিনীর জন্য বিমান। তৈরি করে যুদ্ধবিমান, ক্ষেপণাস্ত্রও। পরে নব্বইয়ের দশকের শেষের দিক থেকে বোয়িং বানাতে শুরু করে রকেট ও মহাকাশযানের গুরুত্বপূর্ণ যন্ত্রাংশও।

১০ ২২

নব্বইয়ের দশকের একেবারে শেষ ভাগে আন্তর্জাতিক মহাকাশ স্টেশন চালু হওয়ার পর থেকেই সেখানে বিভিন্ন গবেষণা ও স্টেশনের রক্ষণাবেক্ষণের জন্য নাসা তার মহাকাশচারীদের পাঠাত নিজেদের বানানো মহাকাশযানে। কিন্তু ২০১১ সাল থেকে সেই প্রকল্প বন্ধ করে দেয় নাসা।

১১ ২২

তার পর গত ১০ বছর ধরে আন্তর্জাতিক মহাকাশ স্টেশনে নিজেদের মহাকাশচারী পাঠানোর জন্য নাসা মুখাপেক্ষী হয়ে থেকেছে রাশিয়ার মহাকাশ গবেষণা ‘রসকসমস’-এর বানানো মহাকাশযানের দিকে। ২০১৪ সালে নাসা সিদ্ধান্ত নেয়, এই পরনির্ভরতার পথ থেকে তারা বেরিয়ে আসবে। তখনই ঠিক হয়, এ বার আন্তর্জাতিক মহাকাশ স্টেশনে নিজেদের মহাকাশচারী ও রসদ পাঠানোর জন্য বেসরকারি দুই সংস্থার তৈরি মহাকাশযান ব্যবহার করবে নাসা।

১২ ২২

অবশেষে আসে ২০২৪ সালের সেই মাহেন্দ্রক্ষণ। অভিজ্ঞ মহাকাশ গবেষক সুনীতা ও বুচকে নিয়ে ৫ জুন বোয়িং স্টারলাইনার মহাকাশে পাড়ি দেয়। তারা যে নিরাপদে মানুষকে মহাকাশে পৌঁছে দিতে সক্ষম, এই অভিযানে তা প্রমাণ করতে মরিয়া ছিল বোয়িং। এটি ছিল তাদের আরও একটি পরীক্ষামূলক অভিযান। তাই মাত্র ৮ দিনের জন্য অভিযানের পরিকল্পনা করা হয়েছিল।

১৩ ২২

প্রথমে নাসা ৬ মে তার সদস্যদের পাঠানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছিল। বোয়িঙের যানে অক্সিজেন ভাল্‌ভে সমস্যা দেখা দেওয়ায় অভিযান স্থগিত করে দেওয়া হয়। যাত্রার দিনক্ষণ পিছিয়ে দিয়ে ১০ মে করা হয়। ভাল্‌ভ পাল্টানো ও নিরাপত্তা ব্যবস্থা খতিয়ে দেখতে সেই পরিকল্পনা পিছোতে পিছোতে ২১ মে করা হয়।

১৪ ২২

এতেও জট পুরোপুরি কাটেনি। নতুন করে সমস্যা দেখা দেয় হিলিয়াম গ্যাস নির্গমন নিয়ে। যান পরীক্ষা করতে গিয়ে ধরা পড়ে তা থেকে হিলিয়াম গ্যাস বেরিয়ে আসছে। যান্ত্রিক ত্রুটির জেরে বার বার যাত্রায় বিলম্ব হতে থাকে। একাধিক গলদের জেরে বোয়িং স্টারলাইনারে মহাকাশে পাড়ি দেওয়া নিয়েই সংশয় তৈরি হয়। সমস্ত জটিলতা কাটার পর কেনেডি স্পেস সেন্টার থেকে আন্তর্জাতিক মহাকাশ স্টেশনে রওনা দেয় মহাকাশযানটি।

১৫ ২২

এই যাত্রাতেও বিফল হয় বোয়িংয়ের মহাকাশযানের ক্যাপসুলটি। স্টারলাইনার ওড়ার আগেও রকেটে হিলিয়াম লিকেজের যে সমস্যা ধরা পড়েছিল, সেই একই সমস্যা শুরু হয়। যাত্রাপথে আরও নানা যান্ত্রিক গোলযোগ দেখা দেয় যানটিতে। রকেটের পাঁচটি ‘ম্যানুভারিং থ্রাস্টার’ খারাপ হয়ে যায়, সমস্যা দেখা দেয় একটি ধীর গতির ‘প্রপেল্যান্ট ভাল্‌ভ’-এও।

১৬ ২২

সুনীতা ও বুচের মতো অভিজ্ঞ মহাকাশচারীরা সেই যান্ত্রিক ত্রুটি সারিয়ে কোনও মতে আন্তর্জাতিক মহাকাশ গবেষণা কেন্দ্রে অবতরণ করে। কিন্তু ত্রুটিপূর্ণ যানে করে সুনীতাদের মহাকাশ থেকে পৃথিবীতে ফিরিয়ে আনতে চায়নি নাসা। অতীত থেকে শিক্ষা নিয়ে দুই নভশ্চরকে মহাকাশ গবেষণা কেন্দ্রেই রেখে দেয় তারা। তাঁরাও গবেষণার কাজ জারি রাখেন।

১৭ ২২

অভিযান অসম্পূর্ণ রেখে পৃথিবীতে ফিরে আসে স্টারলাইনার। ৬ সেপ্টেম্বর ফিরতি অভিযান শুরু করে যানটি। এর পর থেকেই সুনীতাদের ফিরিয়ে আনার জন্য বিকল্প ব্যবস্থা নেওয়ার পথ খুঁজতে শুরু করে নাসা।

১৮ ২২

নাসার এই সমস্যায় ত্রাতার ভূমিকায় অবতীর্ণ হয় ইলন মাস্কের সংস্থা স্পেস এক্স সংস্থার তৈরি ক্যাপসুল ক্রু ড্রাগন। বোয়িঙের অভিযানের চার বছর আগেই স্পেস এক্সের যানটি মহাকাশে গবেষকদের পৌঁছে দেওয়ার অভিযান সফল ভাবে সম্পন্ন করে এসেছে। এবং তুলনামূলক কম খরচে।

১৯ ২২

২০১৯ সালের হিসাবে বোয়িং স্টারলাইনার যেখানে মহাকাশযানে এক জন মহাকাশচারীকে পাঠাতে ৭৭৬ কোটি টাকা খরচ করেছে, ইলনের সংস্থা সেই খরচ কমিয়ে ৪৭৫ কোটি টাকায় করেছে বলে বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমে দাবি করা হয়েছে। স্টারলাইনার সুনীতাদের ছাড়াই ফিরে আসার ফলে সংস্থার বিপুল ক্ষতি হয়। অন্তত সাড়ে ১২ কোটি ডলারের ক্ষতির সম্মুখীন হয়েছে বোয়িং, ভারতীয় মুদ্রার হিসাবে যা প্রায় ১০৪৮ কোটি টাকা।

২০ ২২

ওই স্টারলাইনারেই যাতে সুনীতাদের ফিরিয়ে আনা যায়, সেই চেষ্টা করেছিল নাসা। স্টারলাইনারের প্রোগ্রাম ম্যানেজার মার্ক ন্যাপ্পি জানিয়েছিলেন, ‘‘আমরা বিশ্বাস করি, মহাকাশচারীদের ফিরিয়ে আনার জন্য আমাদের যথেষ্ট ভাল মহাকাশযান রয়েছে।’’ পরে অবশ্য মহাকাশচারীদের নিয়ে সেটি ফিরতে পারেনি। সেই কারণে শেষ মুহূর্তে নতুন সিদ্ধান্ত নেয় নাসা।

২১ ২২

নাসা পরিকল্পনা করতে শুরু করে স্পেস এক্সের যানে সুনীতাদের পৃথিবীতে ফিরিয়ে আনার জন্য। তার পর থেকে একাধিক বার তাঁদের পৃথিবীতে ফিরিয়ে আনার চেষ্টা হয়েছে। কিন্তু বার বার তা পিছিয়ে গিয়েছে। মার্কিন প্রেসিডেন্ট হিসাবে ট্রাম্প দায়িত্ব নেওয়ার পর মাস্ককে সুনীতাদের বিষয়টি দেখার অনুরোধ করেছিলেন। তার পর মহাকাশে স্পেসএক্সের যান পাঠানোর কাজ আরও গতি পায়।

২২ ২২

অবশেষে সুনীতাদের নিয়ে ফেরে স্পেস এক্সের ড্রাগন যান। বুধবার আটলান্টিক মহাসাগরের ফ্লরিডা উপকূলে মহাকাশচারীরা নিরাপদে অবতরণ করেন। তাঁদের আনার জন্য পৌঁছে গিয়েছিল মার্কিন নৌসেনা। অবসান হয় দীর্ঘ মহাকাশবাসের।

সব ছবি: সংগৃহীত।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
Follow us on:
আরও গ্যালারি
Advertisement