আন্তর্জাতিক অর্থভান্ডার। সংক্ষেপে আইএমএফ। পাকিস্তান থেকে শ্রীলঙ্কা কিংবা ভূমিকম্পবিধ্বস্ত তুরস্ক এবং সিরিয়া— বার বার অর্থনৈতিক বিপর্যয়ে উঠে এসেছে এই সংস্থার নাম।
বিশ্বে অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা আনার উদ্দেশ্যে ১৯৪৪ সালে আইএমএফ তৈরি করা হয়েছিল। টাকার অভাবে যাতে কোনও দেশকেই দেউলিয়া না হয়ে যেতে হয়, তা নিশ্চিত করতে চেয়ে আইএমএফের জন্ম।
আইএমএফ রাষ্ট্রপুঞ্জের অন্তর্গত। ১৯৪৪ সালে আমেরিকায় একটি আন্তর্জাতিক কনফারেন্সে এই সংস্থা তৈরির বিষয়ে সিলমোহর দিয়েছিল সব পক্ষ। তার পরেই জন্ম নেয় আইএমএফ। একই সঙ্গে বিশ্বব্যাঙ্কও তৈরি হয়েছিল।
বিশ্বের প্রায় সব দেশই আইএমএফের সদস্য। মোট ১৯০টি দেশ আন্তর্জাতিক অর্থভান্ডারের সদস্যপদ গ্রহণ করেছে। সদস্য নয় কেবল কিউবা, পূর্ব তিমোর, উত্তর কোরিয়া, মোনাকো, লিচটেনস্টেইন, তাইওয়ান এবং ভ্যাটিকান সিটি।
বিশ্বের অর্থনৈতিক রক্ষাকর্তা বলা হয় আইএমএফকে। যে কোনও দেশ বিপদে পড়লে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেয় এই সংস্থা। আইএমএফের সদর দফতর ওয়াশিংটনে।
অর্থনৈতিক প্রতিকূলতার সঙ্গে লড়াই করতে সাহায্য করে আইএমএফ। রাষ্ট্রপুঞ্জের এই সংস্থার কাছে বিভিন্ন খাতে টাকা সঞ্চিত থাকে। বিপদের দিনে ভাঁড়ার খোলে অর্থভান্ডারের।
অর্থনৈতিক দিক থেকে পিছিয়ে পড়া দেশগুলিরই আইএমএফকে বেশি প্রয়োজন হয়। দুর্দিনে তাদের রক্ষাকর্তা হিসাবে ময়দানে নামে এই সংস্থা।
ঋণের দায়ে জর্জরিত দেশ, প্রাকৃতিক দুর্যোগে লন্ডভন্ড দেশ কিংবা যুদ্ধে বিপর্যন্ত কোনও সরকার— আইএমফ সকলের শেষতম ভরসা।
আইএমএফের অর্থভান্ডারের উৎস কী? মূলত সদস্য দেশগুলির টাকাতেই চলে এই ভান্ডার। প্রত্যেক সদস্য দেশ নিজেদের সামর্থ্য অনুযায়ী আইএমএফে টাকা দেয়। সঙ্কটের দিনে সেই তহবিলই কাজে লাগে।
আইএমএফের কাছে বর্তমানে ৭৪টি দেশের ঋণ রয়েছে। এই দেশগুলির কাছ থেকে মোট দু’হাজার ৮০০ কোটি টাকা পায় আন্তর্জাতিক অর্থভান্ডার।
অর্থনৈতিক সাহায্য শুধু নয়, প্রয়োজন বুঝে দেশগুলিকে ঋণ দেওয়ার ব্যবস্থা করে আইএমএফ। কখনও কখনও প্রতিকূল পরিস্থিতির মোকাবিলায় দেয় গুরুত্বপূর্ণ পরামর্শও।
আইএমএফের কাছ থেকে যে দেশ ঋণ নেয়, তাদের নিজেদের অর্থনৈতিক নীতি পরিবর্তন করতে সম্মত হতে হয়। পূর্বের নীতি বহাল থাকলে আবার একই প্রতিকূলতা আসতে পারে। তা যাতে না হয়, নিশ্চিত করতে চুক্তিবদ্ধ হতে চায় আন্তর্জাতিক অর্থভান্ডার।
গত কয়েক বছর ধরে দেশে দেশে অর্থনৈতিক সঙ্কটের পরিস্থিতি তৈরি হচ্ছে। সাহায্যের পাশাপাশি পরামর্শ, আর্থিক অনুদান দিতে হচ্ছে আইএমএফকে।
আইএমএফ-এর কাছে বড় চ্যালেঞ্জ ছিল করোনা অতিমারি। এই ভাইরাসের সংক্রমণের কারণে বহু দেশ বিপর্যস্ত হয়। অর্থনীতি ভেঙে পড়ে। মানুষ চাকরি হারায়। গৃহবন্দি অবস্থায় দিন কাটাতে থাকে। যার ফলে বাণিজ্যিক লেনদেনও ঠেকে তলানিতে।
২০২০ সালে করোনা অতিমারির প্রথম বছরে মোট ৮৩টি দেশকে সাহায্য করেছে আইএমএফ। মোট অর্থসাহায্যের পরিমাণ ছিল প্রায় সাড়ে ১৬ হাজার কোটি ডলার।
তবে আইএমএফ কিছু কিছু ক্ষেত্রে নানা মহলে সমালোচনার মুখেও পড়েছে। অভিযোগ, এই সংস্থা নিরপেক্ষতার মোড়কে কাজ করলেও আদতে নিরপেক্ষ নয় মোটেই। এর উপর আমেরিকা-সহ পশ্চিমের দেশগুলির প্রভাব রয়েছে বলে দাবি নিন্দকদের একাংশের।
বিশেষজ্ঞদের দাবি, কোনও কোনও দেশকে অর্থসাহায্য করলেও ঋণশোধ করার জন্য তাদের উপর কড়া নিয়ম আরোপ করে আইএমএফ। ওই দেশের উন্নয়নের বদলে আইএমএফের শর্তাবলি আরও অবনমন ডেকে আনতে পারে। বিশেষত উন্নয়নশীল দেশগুলির ক্ষেত্রে এটি প্রযোজ্য।
তবে আইএমএফের কাজ বিশ্বের নানা মহলে নানা সময়ে প্রশংসিত হয়েছে। শ্রীলঙ্কার অর্থনৈতিক সঙ্কটে পাশে দাঁড়িয়ে এই সংস্থা। পাকিস্তানকেও বিপদের গহ্বর থেকে আইএমএফ টেনে তুলেছে একাধিক বার।
বিশেষজ্ঞদের মতে, যে লক্ষ্য, উদ্দেশ্য নিয়ে আইএমএফ পথ চলা শুরু করেছিল, তা অনুসরণ করে চলতে হবে। কোনও রাজনৈতিক কারণে বা উচ্চ ক্ষমতাসম্পন্ন দেশের অঙ্গুলিহেলনে যাতে আইএমএফ প্রভাবিত না হয়, তা নিশ্চিত করা গেলেই আন্তর্জাতিক অর্থভান্ডার হয়ে উঠবে সবচেয়ে নির্ভরযোগ্য সংগঠন।