আমেরিকার সেকেন্ড লেডির ভূমিকায় দেখা যেতে পারে এমন একজনকে, যাঁর শিকড় রয়েছে ভারতেই। প্রায় ৪০ বছর আগে তাঁর পূর্বপুরুষেরা ভারত ছেড়ে চলে গিয়েছিলেন। তিনিই হতে চলেছেন আমেরিকার প্রথম ভারতীয় বংশোদ্ভূত ‘সেকেন্ড লেডি’।
তিনি ঊষা চিলুকুরি ভান্স। তাঁর স্বামী আমেরিকার ভাইস প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হওয়া জেডি ভান্স। বছর ৩৮-এর ঊষার শিকড় রয়েছে অন্ধ্রপ্রদেশে। যদিও তাঁর জন্ম, বেড়ে ওঠা, প়ড়াশোনা, সবই আমেরিকার ক্যালিফোর্নিয়ার সান দিয়েগোয়। ভারতের সঙ্গে তাঁর যোগ পিতৃসূত্রে। তাঁর বাবার জন্ম অন্ধ্রপ্রদেশের ছোট্ট গ্রামে। যদিও সেই গ্রামে কখনও আসেননি ঊষা।
খুব শীঘ্রই এক নম্বর অবজ়ারভেটরি সার্কলের বাসিন্দা হতে চলেছেন ভান্স দম্পতি। চার বছর ধরে যেখানে বাস করতেন সে দেশের প্রথম অশ্বেতাঙ্গ ও মহিলা ভাইস প্রেসিডেন্ট ভারতীয় বংশোদ্ভূত কমলা হ্যারিস। কমলা ওই বাসভবন ছেড়ে দেওয়ার পর আরও এক ভারতীয় বংশোদ্ভূতের পা পড়বে আমেরিকার ভাইস প্রেসিডেন্টের বাসভবনে।
১৯৮৬ সালে জন্ম ঊষার। তাঁর বাবা ও মা দু’জনেই উচ্চশিক্ষিত। কর্মসূত্রে সে দেশে পাড়ি দেন তাঁরা। ঊষার বাবা একজন ইঞ্জিনিয়ার এবং মা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক। ইয়েল বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইতিহাসে স্নাতক হন ঊষা। পরে কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে দর্শনে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি লাভ করেন। এর পর তিনি ইয়েল ল স্কুলে যোগ দেন।
সেখানেই আইন পড়তে এসেছিলেন আমেরিকার ভাইস প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হওয়া জেডি ভান্স। দুই ভিন্ন মেরু থেকে উঠে আসা দুই ব্যক্তির আলাপ জমতে অবশ্য বেশি সময় লাগেনি। আলাপ থেকে প্রেম, তার পর বিয়ে। ২০১৪ সালে হিন্দু রীতি মেনেই জেডি ভান্স ও ঊষা চিলুকুরির চার হাত এক হয়। এই দম্পতির তিন সন্তান রয়েছে। ইওয়ান, বিবেক ও মিরাবেল।
স্নাতক স্তরের পড়াশোনা শেষ করে আইনে ডিগ্রি অর্জন করেন ঊষা। এর পর বেশ কয়েক বছর কর্পোরেট দুনিয়ার আইনজীবী হিসাবে কাজ করেন। আমেরিকার সুপ্রিম কোর্টের দু’জন প্রধান বিচারপতির সহকারী হিসাবেও কাজ করেছেন তিনি।
ভান্সের সঙ্গে ঊষার যখন আলাপ, তখন তিনি ছিলেন ঘোষিত ডেমোক্র্যাট। তার আগেও কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ে থাকাকালীন ঊষা বামপন্থী এবং উদারপন্থী সংগঠনগুলির সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। ২০১৪ সালে ডেমোক্র্যাটিক শিবিরে যোগ দিয়েছিলেন।
ভান্সকে বিয়ের পর ধীরে ধীরে তাঁর রাজনৈতিক মতাদর্শে পরিবর্তন আসে। ২০১৮ সালে রিপাবলিকান পার্টিতে নাম নথিভুক্ত করেন তিনি।
বছর ৪০-এর ভান্স ওহায়োর সেনেটর। একদা ডোনাল্ড ট্রাম্পের কড়া সমালোচক থেকে তার রানিং মেট হয়ে ওঠা জেডি ভান্সের সফরও কম আকর্ষণীয় নয়।
ভান্সের জন্ম ওহায়োর মিডলটাউনে। তাঁর ছেলেবেলার অভিজ্ঞতা খুব একটা সুখকর ছিল না। পরিবারের স্থিতিশীলতার অভাবে তাঁর ছোটবেলার বেশির ভাগটাই কেটেছে দাদু-দিদিমার কাছে। ভান্সের মাকেও লড়াই করতে হয়েছে মাদকাসক্তির সঙ্গে। এই পর্যায়ে তাঁদের ছে়ড়ে চলে যান ভান্সের পিতা। কয়েক বছর পরে তিনি মারা যান। জেডি ভান্সকে তাঁর দাদু-দিদিমা দত্তক নেন। বর্তমানে তাঁদের সেই পদবিই ব্যবহার করেন ভান্স।
তাঁর ছাত্রজীবন আর কর্মজীবন বর্ণময়। প্রথমে একটি মুদির দোকানে কাজ করতেন ভান্স। তার পর মিডলটন হাই স্কুল থেকে পাশ করার পর আমেরিকার নৌসেনায় যোগ দেন। পরে ইরাকে মোতায়েন করা হয় তাঁকে। এর পর ওহায়ো স্টেট ইউনিভার্সিটি এবং ইয়েল ল স্কুল থেকে পড়াশোনা করেন।
পরবর্তী কালে সিলিকন ভ্যালিতে বিনিয়োগকারী হিসাবে কাজ শুরু করেন তিনি। ‘হিলবিলি এলেজি’ নামক স্মৃতিকথার সাফল্য তাঁকে জনপ্রিয় করে তোলে। সর্বাধিক বিক্রি হওয়া বইয়ের তালিকায় রয়েছে তাঁর লেখা বইটি। এই বই অবলম্বনে একটি সিনেমাও তৈরি হয়েছে।
এই বইয়ের সাফল্য তাঁকে লেখক হিসাবে বিখ্যাত করে তোলার পাশাপাশি ভাষ্যকার হিসাবেও পরিচিতি দিয়েছিল। কী ভাবে তাঁর পরিচিত মানুষেরা পরিশ্রম করার বদলে সরকারি অনুদানের উপর নির্ভর করতেন, তা তিনি নিজের বইয়ে তুলে ধরেন।
তাঁর ব্যক্তিত্ব ও লড়াকু মনোভাবের কারণে ট্রাম্প তাঁকে ভাইস প্রেসিডেন্ট পদপ্রার্থী হিসাবে মনোনীত করেন বলে মনে করে সে দেশের সংবাদমাধ্যমগুলি। সদ্যনির্বাচিত ভাইস প্রেসিডেন্ট জেডি ভান্সের সাফল্যের নেপথ্যে তাঁর অর্ধাঙ্গিনীর অবদান যে অনেকখানি রয়েছে, তা নির্বাচনী প্রচারে তুলে ধরেছেন ভান্সই।
২০২২ সালে ভান্স সেনেটর নির্বাচিত হন। এর নেপথ্যে ঊষার কঠিন পরিশ্রম রয়েছে বলে স্বীকার করে নিয়েছেন তিনি। কারণ সেই সময় তিনি ভান্সের নির্বাচনী প্রচারগুলির দায়িত্বভার সামলেছিলেন। সম্প্রতি ভান্স একটি আলোচনা সভায় ঊষাকে তাঁর ‘তাত্ত্বিক গুরু’ এবং ‘পথপ্রদর্শক’ হিসাবে উল্লেখ করেন।
ভান্স একটি অনুষ্ঠানে জানিয়েছিলেন, স্ত্রীর সাহচর্যে একটু একটু করে নিজেকে বাস্তবে ফিরিয়ে এনেছেন তিনি। তাঁর জীবনের বিভিন্ন পরিবর্তনে ঊষার ভূমিকার কথাও নির্বাচনী প্রচারে শোনা গিয়েছিল ভান্সের মুখে। তাঁকে বলতে শোনা গিয়েছিল, ‘‘যদি আমি কিছুটা অহঙ্কারী হয়েও উঠি বা নিজেকে নিয়ে সামান্য গর্বিতও হই, আমি শুধু নিজেকে এটা মনে করিয়ে দিই যে ঊষা আমার চেয়ে অনেক বেশি পারদর্শী।’’