গলা পর্যন্ত ঋণে ডুবে দেশ। যত সময় গড়াচ্ছে, ততই বাড়ছে ধার করা অর্থের পরিমাণ। পরিস্থিতি যা, তাতে ঠাটবাট বজায় রাখাই দায়! ফলে কপালে চিন্তার ভাঁজ পড়েছে দুনিয়ার তাবড় অর্থনীতিবিদদের। আটলান্টিকের পারের ‘সুপার পাওয়ার’ রাষ্ট্রটি দেউলিয়া হলে তার আঁচ থেকে যে অন্যেরা বাঁচতে পারবেন, এমনটা নয়।
ঋণের ভারে বেঁকে যাওয়া দেশটির নাম আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্র। বর্তমানে যার জাতীয় ধারের পরিমাণ রেকর্ড উচ্চতায় উঠেছে। সরকারি তথ্য বলছে, যুক্তরাষ্ট্রের মোট ঋণের পরিমাণ বাড়তে বাড়তে ৩৬ লক্ষ কোটি ডলারে পৌঁছেছে। এর মধ্যে চলতি বছরে ধারের পরিমাণ দু’লক্ষ কোটি ডলার বাড়িয়েছে আটলান্টিকের পারের ‘সুপার পাওয়ার’ দেশটি।
আগামী বছরের (পড়ুন ২০২৫) জানুয়ারিতে শপথ নেবেন আমেরিকার নবনির্বাচিত প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প। আর্থিক বিশ্লেষকদের দাবি, কুর্সিতে বসার পর জাতীয় ঋণের মাত্রাছাড়া অঙ্ক কমানোই হবে তাঁর সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ। ফলে তাঁর উচ্চাকাঙ্ক্ষী একাধিক নীতিতে জল পড়ার আশঙ্কা প্রবল।
তথ্য বলছে, গত কয়েক দশকে অস্বাভাবিক দ্রুততায় বেড়েছে যুক্তরাষ্ট্রের ঋণ নেওয়ার অঙ্ক। চলতি শতাব্দীর গোড়ায় আমেরিকার জাতীয় ঋণের পরিমাণ ছিল পাঁচ লক্ষ ৭০ হাজার কোটি ডলার। কিন্তু ২০২০ সালে সেই সংখ্যাই বেড়ে ২৩ লক্ষ ২০ হাজার কোটি ডলারে গিয়ে পৌঁছয়। পরবর্তী বছরগুলিতে জাতীয় ঋণের সূচক লাফিয়ে লাফিয়ে বেড়েছে।
২০২০ সালে দুনিয়া জুড়ে শুরু হয় কোভিড অতিমারি। এর ধাক্কায় মারাত্মক ভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয় আমেরিকার অর্থনীতি। সেই জায়গা থেকে ঘুরে দাঁড়াতে করোনা পরবর্তী সময়ে ঋণের উপর ঋণ করেছে যুক্তরাষ্ট্র। এই সিদ্ধান্ত ওয়াশিংটনের বিপদ বাড়িয়েছে বলেই মনে করেন আর্থিক বিশ্লেষকেরা।
আমেরিকার কেন্দ্রীয় ব্যাঙ্ক ‘ফেডারেল রিজার্ভ’ জানিয়েছে, কোভিড-পরবর্তী বছরগুলিতে মোট ১৬ লক্ষ কোটি টাকা ঋণ নেওয়া হয়েছে। নভেম্বরের ৩০ তারিখ থেকে শেষ ৩১৬ দিনে জাতীয় ধারের অঙ্ক প্রতি দিন বেড়েছে ৬৩০ কোটি ডলার। ফলে বর্তমানে এক জন গড় আমেরিকানের মাথার উপর ঝুলছে এক লক্ষ আট হাজার ডলারের ঋণ।
আতঙ্কের এখানেই শেষ নয়। যুক্তরাষ্ট্রের জাতীয় ঋণ এখন দেশটির মোট অভ্যন্তরীণ উৎপাদন বা জিডিপির ১২৫ শতাংশে পৌঁছেছে। আগামী দিনে ঋণ ও জিডিপির অনুপাত ২০০ শতাংশে যেতে পারে বলে মনে করা হচ্ছে। সে ক্ষেত্রে জাতীয় ধার ওয়াশিংটনের অর্থনীতির দ্বিগুণ আকার ধারণ করবে।
ঋণের পরিমাণ এই ভাবে বৃদ্ধি পাওয়ায় আর্থিক বিশ্লেষকদের তরফে পাওয়া গিয়েছে সতর্কবার্তা। তাঁদের কথায়, ধার যে ভাবে বেড়েছে তাতে আগামী দিনে সুদের পিছনে বিপুল টাকা খরচ হবে আমেরিকার। অন্য দিকে, পরিকাঠামো, শিক্ষা, স্বাস্থ্য-সহ বহু গুরুত্বপূর্ণ ক্ষেত্রে ব্যয় বরাদ্দে কাঁটছাঁট করবে সরকার।
ঋণের সূচক ঊর্ধ্বমুখী হওয়ায় এখনই দিনে ১০০ কোটি ডলারের বেশি সুদ বাবদ খরচ করতে হচ্ছে আমেরিকাকে। বিশেষজ্ঞদের অনুমান, চলতি বছরে এক লক্ষ কোটি ডলারের গণ্ডি অতিক্রম করবে যুক্তরাষ্ট্রের ঋণের খরচ। এই অঙ্ক ওয়াশিংটনের জাতীয় নিরাপত্তা ব্যয়ের চেয়েও বেশি।
বিষয়টি নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন ‘বাইপারটিসান পলিসি সেন্টার’-এর এগজ়িকিউটিভ ডিরেক্টর সাই আবাকাশ। আমেরিকার সংবাদ সংস্থা ‘ফরচুন’কে তিনি বলেছেন, ‘‘এখনকার পরিস্থিতিতে ঋণের অঙ্ক সুদের হারে ঊর্ধ্বমুখী চাপ দিচ্ছে। ফলে চড়ছে বন্ধকি হারের সূচকও।’’
সাই আরও বলেছেন, ‘‘সাধারণত জাতীয় ঋণ বৃদ্ধি রাষ্ট্রের আর্থিক উন্নতির পথের কাঁটা হয়ে থাকে। আমেরিকার ক্ষেত্রেও সেই ছবি খুব শিগগিরি দেখতে পাওয়া যাবে। দেশ ধারে ডুবে থাকলে নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসের দাম বাড়বে। বৃদ্ধি পাবে সংসার খরচ। অন্য দিকে, ভবিষ্যৎ প্রজন্মের উন্নতির কথা ভেবে কোনও বিনিয়োগ করতে পারবে না সরকার।’’
বিশ্লেষকদের অনুমান, জাতীয় ঋণ কমাতে সরকারি খরচে লাগাম টানায় নজর দেবেন প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প। ইতিমধ্যেই ‘ডিপার্টমেন্ট অফ গভর্নমেন্ট এফিসিয়েন্সি’ নামের একটি নতুন মন্ত্রক তৈরির কথা ঘোষণা করেছেন তিনি। এর নেতৃত্বে ধনকুবের শিল্পপতি ইলন মাস্ক এবং ভারতীয় বংশোদ্ভূত রিপাবলিকান নেতা বিবেক রামস্বামীকে রেখেছেন তিনি।
সূত্রের খবর, নতুন এই দফতরের মাধ্যমে অযোগ্য সরকারি কর্মচারী এবং বিভাগগুলিকে চিহ্নিত করা হবে। এর পর প্রশাসন থেকে তাঁদের ছেঁটে ফেলার নির্দেশ দেবেন তিনি। মাস্ক জানিয়েছেন, এর মাধ্যমে কোটি কোটি ডলারের বাজে খরচ আটকানো যাবে। পাবলিক ব্রডকাস্টিং বাজেট হ্রাসেরও প্রস্তাব দিয়েছেন যুক্তরাষ্ট্রের এই ধনকুবের।
পাশাপাশি, আগামী দিনে স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন, আইনজীবীদের ফার্ম এবং গর্ভপাতের অধিকার নিয়ে আন্দোলন চালানো গোষ্ঠীগুলিকে সরকারি তহবিল থেকে অর্থ বিলি বন্ধ করতে পারেন ট্রাম্প। এ ছাড়া সরকারি কোষাগার ভর্তি করতে কর কাঠামোর বড় সংস্কারের পথেও হাঁটতে পারেন তিনি।
নির্বাচনী প্রচারে আয়কর পুরোপুরি তুলে দেওয়ার কথা বলতে শোনা গিয়েছিল ট্রাম্পকে। যদিও আর্থিক বিশ্লেষকদের যুক্তি, কুর্সিতে বসে সেই রাস্তায় হাঁটলে ভুল করবেন তিনি। এতে কর্পোরেট সংস্থা এবং ধনীদের যতটা উপকার হবে, মধ্যবিত্তরা তার সিকিভাগও পাবেন না। ফলে বাড়বে আর্থিক ঘাটতি।
আমেরিকার ‘জয়েন্ট সেন্টার ফর পলিটিক্যাল অ্যান্ড ইকোনমিক স্টাডিজ়’-এর ভাইস প্রেসিডেন্ট জেসিকা ফুলটন নবনির্বাচিত প্রেসিডেন্টের আয়কর নীতির কড়া সমালোচনা করেছেন। ফুলটনের কথায়, ‘‘কর্পোরেট করের হার কমিয়ে ১৫ শতাংশ করার কথা বলেছেন ট্রাম্প। অর্থাৎ যাঁরা টাকা দিতে পারবেন তাঁদের থেকেই অর্থ নেবে না সরকার।’’
একই সুর শোনা গিয়েছে ‘ম্যানহাটন ইনস্টিটিউট’-এর সিনিয়র ফেলো ব্রায়ান রিডলের গলায়ও। তাঁর কথায়, ‘‘জাতীয় ঋণের জেরে আর্থিক ঘাটতির পরিমাণ তিন গুণ হওয়ার পর কর মকুব মূর্খামি।’’ ট্রাম্পের কর সংস্কার নীতি নিয়ে তাঁর নিজের দল রিপাবলিকান পার্টির অন্দরেও একাধিক প্রশ্ন রয়েছে।
কোভিড অতিমারি পরবর্তী সময়ে ঋণের ক্ষেত্রে সুদের হার উল্লেখ্যযোগ্য হারে বৃদ্ধি পেয়েছে। ফলে তা আমেরিকান উপভোক্তাদের উপর চাপ তৈরি করছে। উদাহরণ হিসাবে আমেরিকার ট্রেজ়ারি নোটের মূল্য হ্রাসের কথা বলা যেতে পারে। ২০২০ সালের এপ্রিলে এতে ০.৬ শতাংশ পতন দেখা গিয়েছিল। বর্তমানে তা ৪.৪ শতাংশ উঠে এসেছে।
যুক্তরাষ্ট্রের ঋণের বোঝা কমানো ট্রাম্পের কাছে যথেষ্ট চ্যালেঞ্জের বলে উল্লেখ করেছেন আর্থিক বিশ্লেষকেরা। কারণ ইতিমধ্যেই চিন, রাশিয়া-সহ ‘ব্রিকস’ভুক্ত দেশগুলির পণ্যের উপর ১০০ শতাংশ শুল্ক চাপানোর হুঁশিয়ারি দিয়েছেন তিনি। এই শুল্ক-যুদ্ধ আমেরিকার অর্থনীতিতে নেতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে বলেও সতর্ক করেছে ওয়াকিবহাল মহল।
এ ছাড়া ভারত, রাশিয়া, চিন ও ব্রাজ়িল-সহ বেশ কিছু দেশ ডলারকে বাদ দিয়ে আন্তর্জাতিক বাণিজ্য বাড়ানোর চেষ্টা চালাচ্ছে। এর জন্য ব্রিকসভুক্ত দেশগুলি আলাদা মুদ্রা চালু করতে পারে। সে ক্ষেত্রে ডলারের অবমূল্যায়নের আশঙ্কা রয়েছে। এতে ক্ষতিগ্রস্ত হবে আমেরিকার অর্থনীতি। ফলে ঋণের জাল কেটে বেরিয়া আসা আরও কঠিন হয়ে পড়বে।