তৃণমূল সাংসদ মহুয়া মৈত্রের বিরুদ্ধে অর্থের বিনিময়ে সংসদে প্রশ্নের অভিযোগে গত কয়েক দিন ধরে উত্তাল জাতীয় রাজনীতি। এক সময়ের কাছের বন্ধু এখন সাংসদের ঘোষিত শত্রু। তিনি আইনজীবী বন্ধু জয় অনন্ত দেহদ্রাই। যিনি এখন সাংসদের বিপক্ষের হয়ে মামলা লড়ছেন। পোষ্যের আসল মনিব কে, তাই নিয়ে জটিলতা অব্যাহত।
রটওয়েলার কুকুর। নাম ‘হেনরি’। নামটি কে রেখেছিলেন, তৃণমূল সাংসদ মহুয়া মৈত্র, না কি তাঁর একদা বন্ধু আইনজীবী জয় অনন্ত দেহদ্রাই, তা জানা যায়নি। দু’জনেরই দাবি, কুকুরের আসল মালিক তিনিই। ৩ বছরের ‘হেনরি’র জন্য দেহদ্রাইয়ের বিরুদ্ধে বেশ কয়েক বার থানায় অভিযোগ করেছেন মহুয়া। পাল্টা, পোষ্যের রেজিস্ট্রেশন নিয়ে মুখ খুলেছেন জয় অনন্ত। ব্যাপারটা কী?
মহুয়া এবং জয় অনন্ত, দু’জনের সমাজমাধ্যমের প্রোফাইলে পোষ্য ‘হেনরি’র ছবি আছে। কিন্তু সেই প্রিয় পোষ্যকে চুরি করা হয়েছে বলে প্রাক্তন বন্ধুর দিকে আঙুল তোলেন তৃণমূল সাংসদ মহুয়া।
মহুয়ার অভিযোগ, কুকুরের জন্য তাঁকে কুকথা শুনিয়েছেন জয় অনন্ত। জোর করে তাঁর ঘরে ঢুকেছেন। এমনকি, তাতেও কাজ না হওয়ায় ফোনে খারাপ মেসেজ পাঠিয়েছেন।
জয় অনন্ত পাল্টা পুলিশের কাছে মহুয়ার বিরুদ্ধে অভিযোগ করেন। দেহদ্রাইয়ের দাবি, রটওয়েলার কুকুরটি আসলে তাঁর। তিনি তৃণমূল সাংসদের বিরুদ্ধে চুরি, অবৈধ ভাবে তাঁর পোষ্যকে রেখে দেওয়ার অভিযোগ করেছেন। এমনকি, তাঁর নিজের জীবনহানির আশঙ্কাও প্রকাশ করেন জয় অনন্ত।
সম্প্রতি বিজেপি সাংসদ নিশিকান্ত দুবে এবং আইনজীবী দেহদ্রাইয়ের বিরুদ্ধে মানহানির মামলা করেছেন মহুয়া। দু’দিন আগে দিল্লি হাই কোর্টে সাংসদের প্রাক্তন বন্ধু দেহদ্রাই মারাত্মক অভিযোগ আনেন। তিনি জানান, মহুয়ার আইনজীবী তাঁকে ফোন করে তাঁর মক্কেলের বিরুদ্ধে সব অভিযোগ প্রত্যাহার করে নিতে বলেন। তা হলেই নাকি ‘হেনরি’কে ফেরত দিয়ে দেবেন। কিন্তু দেহদ্রাইয়ের দাবি, কুকুরটি তো তাঁরই। শুধু শুধু তাকে আটকে রেখেছেন মহুয়া।
মহুয়ার প্রাক্তন বন্ধু দেহদ্রাইয়ের দাবি, ২০২১ সালে দিল্লির জনকপুরীর বাসিন্দা জনৈক এবি বহুগুনার কাছ থেকে ‘হেনরি’কে কিনেছিলেন তিনি। বিনিময়ে ৭৫ হাজার টাকা দিয়েছিলেন। প্রথমে ১০ হাজার এবং পরের ধাপে ৬৫ হাজার টাকা দেন তিনি।
মহুয়ার বিরুদ্ধে অভিযোগ জানানোর সময় পোষ্য যে তাঁর, সেই প্রমাণ হিসাবে নথি জমা করেছেন আইনজীবী দেহদ্রাই। তিনি পোষ্যের রেজিস্ট্রেশন নম্বর উল্লেখ করে দাবি করেন, হেনরি যখন ৪০ দিনের, তখন থেকেই তার দেখাশোনা করেছেন তিনি। পোষ্যের কখন কী প্রয়োজন, সে সম্পর্কে শুধু তিনিই ভাল জানেন।
মহুয়া তাঁর পোষ্যকে অপহরণ করে লুকিয়ে রেখেছেন। পুলিশের কাছে এই অভিযোগ জানিয়ে হেনরিকে তাঁর কাছে ফিরিয়ে দেওয়ার আর্জি জানিয়েছেন দেহদ্রাই। তিনি আর্জি জানিয়েছেন, যাতে দ্রুত হেনরিকে তাঁর কাছে ফিরিয়ে দেওয়া হয়।
মহুয়ার দাবি, ‘হেনরি’ আসলে তাঁর। অভিযোগ করেন, তাঁর সরকারি বাসভবনে ঢুকে ‘হেনরি’কে চুরি করেছিলেন দেহদ্রাই। পরে অবশ্য ফিরিয়ে দেন। তবে পরে আবারও একই ঘটনা ঘটেছে বলে দাবি মহুয়ার। সাংসদ জানিয়েছেন, গত ২৫ মার্চ ও ২৩ সেপ্টেম্বর এ নিয়ে দু'টি অভিযোগ জানিয়েছেন তিনি। পরে পুরনো বন্ধুত্বের খাতিরেই অভিযোগ তুলে নেন।
কিন্তু কুকুরের রেজিস্ট্রেশনের ব্যাপারটা কী? কুকুরের মালিক হিসাবে ‘লিটার রেজিস্ট্রেশন’-এর কাগজ দেখিয়েছেন আইনজীবী দেহদ্রাই। তাতে তারিখ উল্লেখ রয়েছে, ২০২১ সালের ২৪ অগস্ট। এবং শংসাপত্রে বার কোড এবং মাইক্রোচিপের বিশদ-সহ ‘হেনরি’র রেজিস্ট্রেশন নম্বর উল্লেখ করা হয়েছে।
বিভিন্ন দেশে কুকুর বা অন্য কোনও পোষ্য নিলে তার রেজিস্ট্রেশন হয়। এ দেশে অবশ্য পোষ্য নথিভুক্তকরণ সংক্রান্ত কোনও বিধিবদ্ধ আইন নেই। তবে ভারতের বিভিন্ন শহরে পুর কর্তৃপক্ষ এই রেজিস্ট্রেশন করে থাকেন।
যখন কোনও ব্যক্তি ব্রিডারের কাছ থেকে কুকুর কেনেন, তিনি একটি মাইক্রোচিপ-সহ কেসিআই শংসাপত্রও পান। কুকুরের মালিকানার জন্য একটি ফর্ম পূরণ করতে হয়। তাতে যে সংস্থা বা ব্যক্তির কাছ থেকে পোষ্য কেনা হচ্ছে, তাদেরও সই থাকে। একে বলা হয় ‘ট্রান্সফার অফ ওনারশিপ’ বা মালিকানা হস্তান্তর। সেই ফর্ম পূরণ করে পুর কর্তৃপক্ষের কাছে জমা দিতে হয়। নির্দিষ্ট ওয়েবসাইটে মোবাইল নম্বর আপলোড করতে হয় মালিককে। সংশ্লিষ্ট লগইন শংসাপত্রও পুরসভা জমা নেয়।
তবে আজকাল এই রেজিস্ট্রেশনের সংখ্যা বাড়ছে। বস্তুত, দেশজুড়ে বণ্যপ্রাণী থেকে পোষ্য পাচারের ঘটনার প্রেক্ষিতে কোনও কোনও শহর এই রেজিস্ট্রেশন নিয়ে কড়াকড়ি করছে।
লখনউ শহরে পোষ্য রাখলে পুরসভা থেকে তার রেজিস্ট্রেশন করে নেওয়া এখন আবশ্যিক। ভারতের অন্য কোনও শহরে এমন কড়াকড়ি নেই। তবু কেউ কেউ নিজের ইচ্ছে মাফিক পোষ্যের রেজিস্ট্রেশন করিয়ে রাখেন।
একটি তথ্য অনুযায়ী, নয়ডায় এখন পোষা কুকুরের জন্য রেজিস্ট্রেশন বাধ্যতামূলক করা হয়েছে। মালিকদের উদ্দেশে একটি নোটিসে বলা হয়েছিল, ২০২৩ সালের ৩১ জানুয়ারির মধ্যে পুরসভার নির্দিষ্ট অ্যাপে পোষ্যের রেজিস্ট্রেশন করিয়ে নিতে হবে। তার পরেও কেউ কেউ রেজিস্ট্রেশন করাননি। তার জন্য তাঁদের জরিমানা দিতে হয়েছে।
এ বছরের জানুয়ারিতে গুরুগ্রামে ৩০০টি পোষ্যের রেজিস্ট্রেশন হয়েছে বলে জানাচ্ছে একাধিক সংবাদমাধ্যম।
অন্য দিকে, গাজিয়াবাদ পুর কর্তৃপক্ষ আবার তিনটি জাতের কুকুর পোষা নিষিদ্ধ করে দিয়েছেন। তার মধ্যে রয়েছে রটওয়েলার, পিটবুল এবং ডোগো আর্জেন্টিনো।
কিন্তু যাঁরা ইতিমধ্যে ওই তিন প্রজাতির কুকুর নিয়ে ফেলেছেন, তাঁদের ক্ষেত্রে কী হবে? পুরসভা জানিয়েছে, ওই পোষ্যদের অবিলম্বে নির্বীজকরণ করতে হবে।
আর দিল্লির ক্ষেত্রে পোষ্য রেজিস্ট্রেশনের নিয়মের কড়াকড়ি কেমন? হ্যাঁ, সেখানেও পুরসভায় পোষ্যের রেজিস্ট্রেশন করিয়ে নেওয়া বাধ্যতামূলক। কর্তৃপক্ষের কাছে রেজিস্ট্রেশন না করিয়ে নিলে রাস্তায় বেরোলে পোষ্যকে আটক করার ক্ষমতাও রয়েছে দিল্লি পুরসভার। তাই দিল্লিতে পোষ্য রাখলে সাংসদ মহুয়া কিংবা আইনজীবী দেহদ্রাইকেও তাই করতে হত। যদিও পোষ্য আসলে কার, তা এখনও স্পষ্ট নয়।