ফিল্মি দুনিয়ার নানা মুখরোচক খবর জানতে সিনেপ্রেমীদের অনেকেই মুখিয়ে থাকেন। কোন নায়কের সঙ্গে কোন নায়িকার প্রেম চলছে? কোন নায়িকার ঘর ভাঙল? আবার কোন অভিনেতা নতুন সম্পর্কে জড়ালেন? এমন নানা ‘গসিপ’ ঘিরে দর্শক মহলে কৌতূহলের অন্ত নেই। রুপোলি পর্দার অন্দরমহলের সেই সব নানা রটনার ডালি সাজিয়ে রাখে বিভিন্ন ধরনের ফিল্মি ম্যাগাজিন। সিনেপাড়ার তেমনই সব খবর ছাপতে গিয়ে ৭৯ বছর আগে খুন হতে হয়েছিল এক সাংবাদিককে।
তখনও দেশ স্বাধীন হয়নি। হিন্দি সিনেমার পাশাপাশি দেশের বিভিন্ন রাজ্যে আঞ্চলিক ছবিরও তখন পথচলা শুরু হয়েছে। তামিল ছবিতে সেই সময় ছাপ ফেলেছেন অভিনেতা এম কে ত্যাগরাজা ভগবাতর। যিনি এমকেটি নামেই বেশি পরিচিত।
তামিল ছবির দুনিয়ায় অন্যতম সেরা অভিনেতা বলা হয় এমকেটিকে। চল্লিশের দশকে তখন তামিল সিনেমায় রাজত্ব করছেন তিনি। খুব স্বাভাবিক ভাবেই জনপ্রিয় নায়ককে ঘিরে সিনেমহলে বাড়তি উদ্দীপনা ছিল।
সেই সময় মাদ্রাজে (বর্তমানে চেন্নাই) চলচ্চিত্র সাংবাদিক হিসাবে পথচলা শুরু করেন সিএন লক্ষ্মীকান্থন। ১৯৪৩ সালে তাঁর হাত ধরে শুরু হয় সাপ্তাহিক সিনে পত্রিকা ‘সিনেমা থুটু’র যাত্রা।
ওই সময় ওই পত্রিকার খুব রমরমা ছিল। তামিল ছবির দুনিয়ায় সেই সময় প্রথম সারির নায়ক-নায়িকাদের ব্যক্তিজীবনের নানা কথা তুলে ধরা হত পত্রিকায়। এমনকি, নায়ক-নায়িকাদের নিয়ে নানা ধরনের মুচমুচে কাহিনিও প্রকাশ করা হত। ওই পত্রিকা তামিল ছবির দুনিয়ায় ঝড় তুলেছিল।
এমকেটিকে নিয়েও নানা ‘গসিপ’ লেখা হত পত্রিকায়। যা মোটেই ভাল চোখে দেখেননি তিনি। শুধু এমকেটি নন, সেই সময় বিখ্যাত কৌতুকাভিনেতা এন এস কৃষাণ-সহ আরও বেশ কয়েক জন অভিনেতার নানা কিস্সা প্রকাশ করা হত পত্রিকায়।
লক্ষ্মীকান্থনের পত্রিকার বিরুদ্ধে শেষে পদক্ষেপ করতে মরিয়া হয়ে ওঠেন এমকেটি-সহ বাকি অভিনেতারা। সেই সময় তৎকালীন মাদ্রাজের রাজ্যপালের কাছে তাঁরা স্মারকলিপি জমা দেন। লক্ষ্মীকান্থনের ম্যাগাজ়িনের লাইসেন্স বাতিল করার আর্জি জানান তাঁরা।
তাঁদের আর্জি মেনে লক্ষ্মীকান্থনের পত্রিকার লাইসেন্স বাতিল করা হয়। লাইসেন্স বাতিলের পরও ওই পত্রিকা চালানোর চেষ্টা করেছিলেন তিনি। কিন্তু পরে বাধ্য হয়ে তা প্রকাশ করা বন্ধ করেন।
তবে এ ভাবে লক্ষ্মীকান্থনকে রোখা যায়নি। এর পর আরও একটি পত্রিকা প্রকাশ করেন তিনি। যার নাম ‘হিন্দ নেশন’। ওই পত্রিকাতেও এমকেটি-সহ তামিল ছবির অভিনেতাদের কিস্সা প্রকাশ করতে থাকেন লক্ষ্মীকান্থন।
ফলে ফিল্মি দুনিয়ার সঙ্গে লক্ষ্মীকান্থনের অম্ল-মধুর সম্পর্ক তৈরি হয়। ১৯৪৪ সালের ৮ নভেম্বর। সেই দিনই ঘটে হামলা।
আইনজীবী বন্ধু জে নারগুনামের সঙ্গে দেখা করতে ভেপারিতে গিয়েছিলেন লক্ষ্মীকান্থন। সেখান থেকে রিকশায় বাড়ি ফেরার পথে আচমকা তাঁর উপর হামলা চালানোর অভিযোগ ওঠে।
এক দল অজ্ঞাতপরিচয় আততায়ী ঘিরে ধরে লক্ষ্মীকান্থনকে। তার পর ছুরি দিয়ে তাঁকে কোপানো হয়। হামলায় তাঁর পেটের বাঁ দিকে ক্ষত তৈরি হয়। রক্তে ভেসে যায় চারদিক।
সেই অবস্থাতেই ওই আইনজীবীর বাড়িতে গিয়ে ঘটনাটি জানান তিনি। সঙ্গে সঙ্গে লক্ষ্মীকান্থনকে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়।
হাসপাতালে যাওয়ার পথে হামলার বিবরণ তুলে ধরেন তিনি। পাশাপাশি রিকশাচালককে অনুরোধ করেন, যাতে ভেপারি থানায় অভিযোগ জানানো হয়।
পরের দিন হাসপাতালে মৃত্যু হয় লক্ষ্মীকান্থনের। সেই সময় তাঁর বয়স ছিল ৫০ বছর।
হামলার দিনই এক যুবককে গ্রেফতার করেছিল পুলিশ। পরে আরও ৬ সন্দেহভাজনকে গ্রেফতার করা হয়। যাঁদের মধ্যে অন্যতম এমকেটি, কৃষাণ এবং পরিচালক এসএম শ্রীরামুলু নাইডু।
সেই সময় তামিল ছবির জনপ্রিয় তারকা এমকেটির গ্রেফতারির ঘটনায় শোরগোল পড়ে গিয়েছিল। পরে বেকসুর খালাস পান নাইডু।
কিন্তু এমকেটি এবং কৃষাণ দোষী সাব্যস্ত হন। তাঁরা ১৯৪৭ সাল পর্যন্ত জেলবন্দি ছিলেন। পরে তাঁদের ছেড়ে দেওয়া হয়।
গ্রেফতারির জেরে বিপর্যস্ত হয়ে পড়েন এমকেটি। ১৯৫৯ সালে তাঁর মৃত্যু হয়। মুক্তি পেয়ে ঘুরে দাঁড়ানোর চেষ্টা করেন কৃষাণ। তাঁর অভিনীত কিছু ছবি সফলও হয়।
তবে লক্ষ্মীকান্থনকে খুনের রহস্যভেদ এখনও হয়নি। কারা আসলে তাঁকে খুন করলেন আর কেনই বা হামলা চালানো হল, তার এখনও কিনারা হয়নি। আসল দোষীদের চিহ্নিতই করা যায়নি।